শিবরামকে নিয়ে একটা ধারণা সেই সময় বিরাজমান ছিল, তিনি নাকি শুধুমাত্র চুটকি লেখার চটকের সাহায্যে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। দিকপাল সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় অখিল ভারত লেখক সম্মেলনের মাদ্রাজি ভাষণে দুঃখ করেছিলেন যে পাঠক চুটকি লেখাই চায়, চুটকি পড়তেই ভালবাসে। কিন্তু এইসব ক্ষণিকের চিত্তবিনোদক লেখা কি নিত্যকালের?
বিশ শতকের প্রথম দশক। মালদহের চাঁচলের ভগ্ন রাজপ্রাসাদের একটি ঘরে এক কিশোরকে তাঁর মা ব্যাকরণ শেখাচ্ছেন:
“প্রতি পদে মা–কে ডাকবি রে। মা–ই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সর্বপ্রথম। আদ্যাশক্তি। মা–কে সম্বোধন করেই সব কিছুর শুরু। সেই জন্যেই সম্বোধনে প্রথমা। তিনিই কর্ত্রী।
কর্ত্রীর ইচ্ছায় কর্ম। তার পরেই না কর্মের সূত্রপাত কর্মেনি দ্বিতীয়া।
করণে তৃতীয়া– প্রকরণে তৃতীয়া। করবার হেতুই যত করণকারণ।…
কার জন্যে করা? সেটা তাঁর জন্যেই– আর পরের জন্যেই। যে পর কিনা তাঁরই প্রতিমা। আর তাই হচ্ছে আমাদের প্রতিমা পূজা। সেই তাঁর কাছেই নিজেকে উজাড় করে দেবার জন্যেই– সম্প্রদানে চতুর্থী। তাকে আত্মসম্প্রদান ‚ আত্মবলি – যাই কেন বল না। তার ফল শ্রী–সমৃদ্ধি–সৌভাগ্য– সব কিছু।
পঞ্চমীতেই শ্রীলাভ‚ শ্রীপ্রকাশ– শ্রী পঞ্চমী। আমাদের বাক বা ঐশ্বর্য সঙ্গীত কলা যত কিছু– লক্ষ্মীশ্রী– আর বাগেশ্রী– এই পঞ্চমেই।
তারপর সম্বোধনে যিনি প্রথমা‚ তাঁর সঙ্গে সম্বন্ধসূত্রেই ষষ্ঠী। সম্বন্ধে ষষ্ঠী। সম্বোধনেই বোধন। সঙ্গে সঙ্গে বোধোদয়। বোধিলাভ। আবার ষষ্ঠীতেই মার বোধন।
সপ্তমীতে অধিকরণ‚ তাঁর কর্তৃক অধিকৃত হওয়া– তাঁর পদ অধিকার করা।
অষ্টমীতেই সেই সন্ধিক্ষণ। আর সেই সন্ধিসূত্র ধরেই না নবত্বলাভ‚ তাঁর সঙ্গে নিরঞ্জিত হয়ে নিজের নবীকরণ।’’
আরও পড়ুন: বাঙালি পাঠক সাবালকত্ব হারাবে যদি তার সন্দীপন অপঠিত থাকে
মা শিবরাণী নিজে তন্ত্র-সাধনা করতেন, বাবা শিবপ্রসাদ একসময় ছিলেন সংসার-ত্যাগী সন্ন্যাসী। এমন এক পরিবারে জন্ম নেন শিবরাম চক্রবর্তী যাঁর আত্মজীবনী ‘ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা’ এবং ‘ভালবাসা পৃথিবী ঈশ্বর’-এ ঈশ্বর এক বিরাট জায়গা জুড়ে প্রচ্ছন্নভাবে থেকে গেছেন। শিবরাম লিখেছেন, ‘ঈশ্বর থেকে পৃথিবীতে এলাম, এসে ভালবাসাকে জানলাম, ভালবাসার মধ্যে ঈশ্বরকে পেলাম। ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা– বৃত্ত পূর্ণ হল।’
এই জীবন সাধনার মধ্যে দিয়ে শিবরাম হয়ে উঠেছিলেন এক প্রকৃত মুক্তপুরুষ। চাঁচলের রাজবাড়ি ছেড়ে কলকাতার রাস্তার ফুটপাথে থাকা, কাগজ ফেরি করতে করতে সেই কাগজে লেখা, কিশোরকালে নিজের প্রেমিকাকে হারানো, তারপর আজীবন অকৃতদার অবস্থায় মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটের মেসবাড়িতে কাটিয়ে দেওয়া– সংসারে থেকে দূরে দাঁড়িয়ে জীবনের আনন্দ নিংড়ে উপভোগ করার টেকনিক তিনি শিখেছিলেন এ সবের মধ্যে দিয়ে।
শিবরাম সারাজীবন পালিয়ে বেরিয়েছেন সাংসারিক বন্ধন থেকে, আবার এই বন্ধনকেই তিনি দূর থেকে দাঁড়িয়ে উপভোগ করেছেন। শিবরামের ভাষায়:
“জলের মধ্যে দুধ যেমন মিশে যায়– মিলেমিশে একাকার– সেই ভাবে জীবনের সঙ্গে মিশতে পারেন না লেখক‚ তেলে জলে যেমন মিশ খায় না সেই রকম অনেকটা। তেলের মতই জলের ওপর ভাসতে থাকেন সব সময়।… জীবনের সাথে মিশে যাওয়া সহজ নয়‚ বিশেষ করে কোনো লেখকের পক্ষে। তাঁদের স্বাতন্ত্র্যবোধ‚ তাঁদের ব্যক্তিসত্তাও তাঁদের মিশতে দেয় না– ওপর ওপর ভাসিয়ে রাখে… জীবন থেকে অদূরে দাঁড়িয়ে তাঁরা জীবনকে দেখেন লেখেন।’’
আরও পড়ুন: সাদা-কালো ছবির যুগের আদ্যন্ত রঙিন বলতে বুঝি তুলসী চক্রবর্তীকেই
এই দূরে দাঁড়িয়ে জীবনকে দেখার মজা থেকেই হয়তো শিবরাম নানা বোন, ভাগনে, ভাগনি পাতিয়ে বেড়াতেন, আর সুযোগ খুঁজতেন সেসব ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দিয়ে সংসারে বেঁধে ফেলার। মা শিবরাণী শিবরামকে বলেছিলেন, ‘তোকে কোনও বোন দিতে পারিনি তার জন্য দুঃখ করিস না। দুনিয়া জোড়া তোর বোনরা ছড়িয়ে আছে, নিজে খুঁজে নিস।’ শিবরাম তাই করেছেন। মানুষকে ভালবেসে একসঙ্গে থাকতে দেখার আনন্দ যে রাবড়ির নেশার মতোই অমৃতময়। সেই কারণেই হয়তো শিবরামের নানা গল্পে এমন সব বোন, ভাগনে-ভাগনির সৃষ্টি হতে আমরা দেখেছি।
অধ্যাত্মবাদ শিবরামের ভিত্তি হলেও শিবরাম তাঁর জীবনজাপনের মধ্যে দিয়ে পদে পদে সমাজে গড়ে ওঠা ধর্মীয় উন্মাদনাকে চ্যালেঞ্জ করতেও ছাড়েননি। সদ্য যৌবনে পা দিয়ে তিনি অস্ত্রধারণ করলেন পণ্ডিচেরীর আশ্রমের বিরুদ্ধে। সমসাময়িক সংবাদপত্রে তিনি কয়েকটি প্রবন্ধ লিখলেন যা পরে ‘মস্কো বনাম পণ্ডিচেরী’ নামে প্রকাশিত হয়েছিল। শিবরাম ভাষায়:
“এই লেখাগুলি যখনকার, তখন কমিউনিজমের নামগন্ধও এদেশে ছিল না।… এই নামমাত্র কমিউনিজম সম্বল করে, ওই তন্ত্রে ওয়াকিবহাল না হয়েও যে আমি কলম ধরতে পেরেছিলাম তার কারণ সাম্যবাদ আসলে এ দেশেরই চারা– বিদেশের কলম নয়।… সাম্যের মূল ভারতীয় ঐতিহ্যেরই অন্তর্গত, তার অন্তর-গতি আমাদের মনের ফল্গুধারায়। সমস্ত মানুষের সমত্ব আর মানুষের প্রতি মমত্ব– এই বোধের দৃষ্টি এখানে এতই সহজ যে, এর জন্য মার্কসীয় অপেক্ষা রাখে না। উপনিষদে উপ্ত, আর বুদ্ধদেবে অঙ্কুরিত হয়ে গান্ধীজিতে এসে তা শাখা-প্রশাখায় প্রসারিত হয়েছে।… ভারতীয় আত্মিক-সাম্যের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের আর্থিক সাম্যনীতির আত্মীয়তা ঘটলেই বিশ্বজনীন সাম্যবাদের সাফল্য ঘটতে পারে। আর, ঘটবেও তাই।’’
শিবরাম আরও লিখলেন:
‘বৈজ্ঞানিক ল্যাবরেটরিতে ভগবান যেদিন আবিষ্কৃত হবেন সেই দিনই এই গ্রহে ভগবানের সত্যিকারের মুক্তি ঘটবে। ভাগবত শক্তি বলে সত্যিই যদি কোন শক্তি থেকে থাকে একদিন না একদিন তাকে বৈজ্ঞানিকের পর্যবেক্ষণে পড়তেই হবে– কোন মহাপুরুষের ভাবদর্শনে নয়।’
যৌবন বয়সে শিবরামের সিরিয়াস সামাজিক লেখার মধ্যে ‘ছেলেবেলায়’ উপন্যাসে সমকামিতার মতো স্পর্শকাতর বিষয় উঠে এসেছিল, বিশেষ করে সেই সময়ে যখন এমন বিষয় সাধারণের গ্রহণযোগ্যতার একেবারেই বাইরে ছিল। ‘যখন তারা কথা বলবে’ নাটকে শিবরাম এক অদ্ভুত সমাজের কল্পনা করেছিলেন:
‘আর সবই থাকবে, কেবল থাকবে না বড়লোক আর পুলিশ। সকলকে চাষবাস করে খেতে হবে, কেউ টাকা জমিয়ে বা মুনাফা লুটে আর সব ভাইকে ফাঁকি দিয়ে ঠকিয়ে বড়লোক হতে পারবে না। প্রত্যেক গাঁয়ে দুটো করে চোর থাকবে। তারা দেখবে কেউ যাতে টাকা না জমায়। কেউ যদি লুকিয়ে টাকা করে, চোর তার পুঁজি হাল্কা করে দেবে। আর একটা চোর অন্য চোরের ওপর নজর রাখবে চুরি করে বড়লোক হবার ফিকিরে আছে কিনা। চোর ছাড়া কি চোরকে কেউ ধরতে পারে ?’
আরও পড়ুন: সমরেশ বসুর শিল্পীসত্তার প্রয়োগ ঘটেছিল অস্ত্র কারখানায়
পাঠকমহলে প্রশ্ন ওঠে, শিবরাম কি আস্তিক নাকি নাস্তিক। বিশেষ করে যে শিবরাম ‘দেবতার জন্ম’ গল্প লেখেন যেখানে রাস্তায় পড়ে থাকা একটা পাথর ভগবান রূপে পুজো পেতে থাকে। ঠনঠনিয়া কালীবাড়িতে শিবরাম প্রায়ই যেতেন। একবার একজন প্রশ্ন করলেন, এই কালীমূর্তি তো জড়পূজা, আপনি এসবে বিশ্বাস করেন? শিবরামের উত্তর:
‘এই জড় জগতের নিছক জড়তার উৎস থেকেই তো প্রাণ আর চৈতন্যের উৎসার। কিন্তু কোথায় যে সেই জড়তার শেষ আর চৈতন্যের সঞ্চার আধুনিক বিজ্ঞান কি তার ধারেকাছেও পৌছতে পেরেছে? চেতনাই নাকি সর্বশক্তির মূলে আর তার ভিত্তি নাকি অবচেতনায় – আধুনিক মনবিজ্ঞানীরা কেউ কেউ এ কথা বলেছেন বটে। কেউ কেউ নির্জ্ঞানের কথাও বলেছেন। আরও এগিয়ে যান– একেবারে অজ্ঞানে ‚ অচেতনতায়, জড়তায় ‚ জড়পিণ্ডতায়– মানে আমাদের সম্মুখীন এই পুতুলে‚ প্রতিমায়‚ প্রতিকে। জড়োপাসনা– অর্থাৎ নিজের মনকে জড় করা। সর্ষের মতন যে মন বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের নানান বিষয়ে ছড়িয়ে রয়েছে তাকে পাকড়ে এক জায়গায় জড় করে আনা। এই জড় পুত্তলিকায় মন দিয়ে সহজেই সেটা হয়ত সম্ভব হয়। আর তখনই হয়ত সেই পুতুল প্রতিমা হয়ে ওঠে। জড়ের আড়ালে অনন্ত শক্তি বিশ্বচৈতন্যের সাক্ষাত মিলে যায় কারও কারও।’’
এই শিবরাম আস্তিক নাকি নাস্তিক? এতই সহজ এই মেরুকরণ?
শিবরামকে নিয়ে একটা ধারণা সেই সময় বিরাজমান ছিল, তিনি নাকি শুধুমাত্র চুটকি লেখার চটকের সাহায্যে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। দিকপাল সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় অখিল ভারত লেখক সম্মেলনের মাদ্রাজি ভাষণে দুঃখ করেছিলেন যে পাঠক চুটকি লেখাই চায়, চুটকি পড়তেই ভালবাসে। কিন্তু এইসব ক্ষণিকের চিত্তবিনোদক লেখা কি নিত্যকালের?
আরও পড়ুন: রোকেয়া স্বপ্ন দেখেছিলেন যখন হু হু করে বিক্রি হচ্ছিল ‘পাসকরা মাগ’
শিবরামের জবাব:
“কালজয়ী কী হবে? এই প্রশ্ন বিধাতারও ছিল। এর সদুত্তর পাবার জন্য আদি স্রষ্টা একদিন যেমন তাঁর এপিক সৃষ্টি সব করেছিলেন– সেই অতিকায় সরীসৃপ, ম্যামথ ইত্যাদির সঙ্গে ক্ষণিকের খুশিতে কী খেয়ালে কে জানে কতকগুলি চড়াইও তিনি ছাড়লেন। তারপর কালক্রমে দেখা গেল তার ঐরাবতরা সব পিছিয়ে পড়ে রইল; আস্তে আস্তে অবশেষে নিখোঁজ হয়ে গেল একদিন, কিন্তু তার চুটকি রচনার সেই চটকপক্ষী–কতকালের চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজকের কালেও এসে ঠেকেছে। ফুরফুর করে উড়ছে আজও। চুটকির এমনিই চটক!
‘বিশ্বামিত্র তিনটি ছত্রে রচিলা গায়ত্রী
চুটকি বলিয়া পেল নাকো ঋষি ফলারের পত্রী।’
কিন্তু তাঁর সেই তিন ছত্রের মধ্যেই স্বর্গ মর্ত রসাতল বাঁধা পড়ল। ভর্গোদেব ধরা দিলেন একাক্ষরে।
ক্রমেই সে–সব চুটকি এক লোক থেকে আরেক লোকে, কালে কালে, লোকোত্তর স্ত্রীলোকোত্তর হতে হতে কালের পারাবার পার হয়ে যাবে। চড়াই পাখীর মতোই অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে যাবে নিজের চটকে। লোকের মুখে মুখেই ফিরবে সে–সব কথা।’’
শিবরাম বলেছেন, “মুক্তি আমি চাইনে‚ মারা গেলেও নয়। পাছে কোনও কারণে আমায় স্বর্গে যেতে হয় এই ভয় আমার দারুণ। সাবধান থাকি‚ প্রাণ থাকতে ধর্মকর্ম কিছু করিনে। স্বর্গে নয়‚ পৃথিবীর এই রসাতলেই ফিরে আসতে চাই ফের– একবার নয়‚ আবার আবার বারংবার। পাপী মানুষ‚ কিন্তু তাপী নয়‚ পাপের উপর ধর্মের সন্তাপ বাড়িয়ে উত্তপ্ত হবার বাসনা নেই আমার।’’
একজন প্রকৃত মুক্তপুরুষ ছাড়া একথা আর কে বলবে? শিবরামের সিদ্ধিলাভের সাধনা সংসার থেকে পালিয়ে নির্জন গুহায় ধ্যানরত অবস্থায় নয়, এই সংসারের জ্বালা যন্ত্রণা সহ্য করাতেই। ওঁর সাহিত্যিক বন্ধু অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ভাষায়:
‘বদলালো না কোনদিন জীবনের বাসা
একটি ঠিকানা তার নাম ভালোবাসা।
দুই হরি এক শাখে করেছে যে ভর
শিবেতে মঙ্গল সে, যে রামেতে সুন্দর।।’