শিব লিঙ্গ আসলে ‘ফার্টিলিটি কাল্ট’ বা ‘উর্বরতাবাদ’-এর প্রতীক। শিব-সমাজ জীবনে প্রবেশ করে যাচ্ছে ‘ইকোলজিকাল সিম্বোলিক’ বা ‘পরিবেশগত প্রতীকী’ হিসেবেও। পুরুলিয়াতে পুকুর তৈরির পর পুকুরের একদম মাঝখানে গভীর গর্ত করে একটা শাল গাছের খুঁটি পুঁতে দেওয়ার রীতি রয়েছে। সেই শাল গাছের খুঁটির গায়ে তৈরি করা হয় একটা সাপ ও একটা ব্যাঙের ছবি। এই খুঁটিটাকে বলে ‘শিবখুটা’ বা ‘শিবখুঁটি’। সাপ ও ব্যাঙ বাস্তুতন্ত্রে খাদ্য শৃঙ্খলকে নির্দেশ করে। আর পুকুরের মতো এক পূর্ণাঙ্গ বাস্তুতন্ত্রের মধ্যমণি হয়ে বসে থাকেন শিব। মূলত বাস্তুতন্ত্রের রক্ষার প্রতীকী হিসেবে।
পার্বতীনাথ শিব। হরগৌরী নাথও তিনি। মাথায় জটা। গলায় সাপ। আর জটার মাঝে ধরে রেখেছেন গৌরীর সতীন গঙ্গাকে। কাজেই নদীর সঙ্গে শিবের সম্পর্ক রয়েছে, মোটামুটিভাবে তা প্রতিষ্ঠা হয়ে যায়। ভাগ্যিস এটা মহামান্য আদালত-এর সামনে প্রমাণ করতে হচ্ছে না। তাহলে তো ‘প্রাইমারি এভিডেন্স’, ‘সেকেন্ডারি এভিডেন্স’, ‘শ্যাল প্রিজিউম’, ‘মে প্রিজিউম’– কত কিছুর গল্প থাকত।
হ্যাঁ, সত্যি করে একটু ভেবে বলুন তো নদী বা পুকুরের সঙ্গে শিবের কি কোনও সম্পর্ক নেই? বিষয়টি একটু ভাবতে আমি আপনাদের সাহায্য করছি। কুমারী নদী নর্মদার গর্ভে আমাদের নদীমাতৃক দেশে জন্ম হয় নর্মদেশ্বর শিবলিঙ্গের। শিব ভক্তদের বিশ্বাস ভগবান শিবের বীর্য পারদ। গৃহীদের পারদ শিবলিঙ্গের পুজোতে অনেক বাধা নিষেধ রয়েছে। কিন্তু নর্মদেশ্বর শিবলিঙ্গের গৃহীদের পুজো করা বিহীত। কথা প্রসঙ্গে একটু জানিয়ে রাখা প্রয়োজন কেন কুমারী নদী নর্মদা। অমরকণ্টকে গেলে সে বিষয়ে পাওয়া যায় এক উপকথা।
কুমারী নর্মদার বিয়ে ঠিক হয়েছিল রাজকুমার শোনভদ্রের সঙ্গে। বিয়ের দিনক্ষণও ঠিক। নর্মদা শোনভদ্রকে কখনও দেখেনি। বিয়ের আগে শোনভদ্রকে দেখার জন্য নর্মদার মন ছটফট করে ওঠে। নর্মদার সেবিকা ছিল জোহিলা। নর্মদা তার সেবিকা জোহিলাকে অনুরোধ করে, যেন সে তার বস্ত্র-অলংকার পরিধান করে শোনভদ্রের কাছে যায়, আর শোনভদ্রকে তার প্রেরিত বার্তা দিয়ে আসে। নর্মদার কথামতো জোহিলা যায় শোনভদ্রের সঙ্গে দেখা করতে। নর্মদার বস্ত্র ও গহনা পরিহিত জোহিলাকে দেখে রাজকুমার শোনভদ্র চিনতে পারে না। সে জোহিলাকে ভেবে নেয় নর্মদা। জোহিলাও দেখে শোনভদ্র এক অপরূপ সুদর্শন পুরুষ। বলিষ্ঠ তার বাহুযুগল। সুঠাম দেহকাণ্ড। প্রশস্ত বক্ষ। সুন্দর মুখশ্রী। শোনের প্রেমে পড়ে যায় জোহিলা।
জোহিলার ফিরে আসতে অনেক দেরি হচ্ছিল। অপেক্ষা করতে করতে অধীরা নর্মদা নিজেই খোঁজ করতে গেল জোহিলার। সেখানে গিয়ে নর্মদা জোহিলার সঙ্গে শোনভদ্রকে খুব ঘনিষ্ঠ অবস্থায় আবিষ্কার করে। পলকে সমস্ত ঘটনাটা নর্মদার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। নর্মদা জোহিলাকে অপবিত্র জলের নদী হওয়ার অভিশাপ দেয়। আর প্রতিজ্ঞা করে, নিজে সারা জীবন কুমারী অবস্থায় থাকবে। এর পর জোহিলার বিপরীত দিকে নদীর রূপ ধরে নর্মদা বয়ে যায় আরব সাগরের দিকে। আর শোনভদ্র শোন নদের রূপ ধরে নর্মদার বিপরীত দিকে প্রবাহিত হয়। তার পর থেকে নর্মদা দেবাদিদেব শিবের তপস্যাতে মগ্ন হয়, বহু যুগ ধরে। নর্মদার এই ভক্তিতে শিব সন্তুষ্ট হন। নর্মদাকে আশীর্বাদ করে শিব বলেন ‘নর্মদার গর্ভে চির কাল বিরাজ করবেন তিনি। আর নর্মদার জল অভিষেক দিয়ে যে শিবকে আরাধনা করবে,তার ইহলোকের সমস্ত পাপ ক্ষয় হবে।’ এই আশীর্বাদের পর থেকেই শিব লিঙ্গ পাওয়া শুরু হয় নর্মদার বুকে।
শিব লিঙ্গ আসলে ‘ফার্টিলিটি কাল্ট’ বা ‘উর্বরতাবাদ’-এর প্রতীক। একথা বলে গিয়েছেন অতুল সুর-এর মতো নৃতাত্ত্বিকরা। তবে শিব-সমাজ জীবনে প্রবেশ করে যাচ্ছে ‘ইকোলজিকাল সিম্বোলিক’ বা ‘পরিবেশগত প্রতীকী’ হিসেবেও। পুরুলিয়াতে পুকুর তৈরির পর পুকুরের একদম মাঝখানে গভীর গর্ত করে একটা শাল গাছের খুঁটি পুঁতে দেওয়ার রীতি রয়েছে। সেই শাল গাছের খুঁটির গায়ে তৈরি করা হয় একটা সাপ ও একটা ব্যাঙের ছবি। এই খুঁটিটাকে বলে ‘শিবখুটা’ বা ‘শিবখুঁটি’। সাপ ও ব্যাঙ বাস্তুতন্ত্রে খাদ্যশৃঙ্খলকে নির্দেশ করে। আর পুকুরের মতো এক পূর্ণাঙ্গ বাস্তুতন্ত্রের মধ্যমণি হয়ে বসে থাকেন শিব। মূলত বাস্তুতন্ত্রের রক্ষার প্রতীকী হিসেবে। বাংলা তথা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে আমরা দেখব প্রায় প্রতিটি পুকুর বা জলাশয়ের পাশে রয়েছে একটি করে শিব মন্দির বা শিবের থান।
শ্রাবণ মাস শিবের জন্ম মাস। এই মাসে জল ঢালা হয় শিবের মাথায়। লক্ষ করলে দেখা যাবে, কোনও এক নদী থেকে জল নিয়ে ঢালতে হয় বেশ কিছুটা দূরে অবস্থিত শিব মন্দিরের শিব লিঙ্গের ওপরে। সেই প্রতিষ্ঠিত শিব মন্দিরের পাশে থাকে একটি পুকুর। শিবের মাথায় ঢালা জল নালি পথ বেয়ে জমা হয় ওই পুকুরে। ঈশ্বরের ভক্তির এই পথের মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয় নদীর জল এক স্থান থেকে অন্য এক ধর্মীয় পুকুরে। শিবের নামে উৎসর্গ করা সেই পুকুরে বেশিরভাগ সময় দেখা যায় প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। সেই মাছগুলোকে স্থানীয় মানুষেরা মারেও না, খায়ও না। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে নদীতে মাছ তার ডিম ছাড়ে। ভক্তিরা যখন সেই জল কলসি করে নিয়ে আসেন নদী থেকে, তার মধ্যে অজান্তেই চলে আসে মাছের ডিম ও প্ল্যাংটন (বা অনুজীব)। যা সংরক্ষণ হয় শরীর নামে সমর্পিত ‘ধর্মীয় পুকুর’ বা ‘সেক্রেট পন্ড’-এ।
প্রকৃতি ও শিবের এই মেল বন্ধন অপূর্ব। তবে আর কী লেখার জো আছে। আমাকে বাজার থেকে এনে দিতে হবে আকন্দফুল, ধুতুরা ফুল আর শিবের জটা ফুল। বেলপাতা আনতে ভুললে রক্ষে থাকবে না! আজ এখানেই থামলাম। পরে আবার লিখব।