স্বামীদের নাক ডাকা নিয়ে মেয়েদের নালিশ করতে শুনেছি, কিন্তু কোনও ছেলেকে আজ অবধি বউয়ের নাক ডাকা নিয়ে নালিশ করতে শুনিনি! মেয়েরা আমাকে ‘জেন্ডার বায়াসনেস’ নিয়ে একটা লম্বা লেকচার দিয়ে দিল এই শুনে। মরিয়া হয়ে আমি যখন মেয়েদের বললাম, ‘তোর মা যে নাক ডাকে, কোনওদিন তোদের বলেছি?’ গিন্নি উত্তর দিল– ‘আত্মরক্ষার তাগিদে ডাকি– ভেবে দেখেছো?
অলংকরণ: অর্ঘ্য চৌধুরী
আদিকাল
আমাদের ছোটবেলায় অনুষ্ঠান বাড়িগুলো অন্যরকম ছিল। তিন রকমের আত্মীয়দের দেখা যেত সেখানে। যাদের বাড়ির অনুষ্ঠান, তারা একদিন বা দু’দিন আগে ভাড়া করা বাড়িতে চলে এসে কর্মযজ্ঞ শুরু করে দিত। মফসসল থেকে যে আত্মীয়রা আসতেন, তাঁদের জন্যে দুটো ঘর বরাদ্দ থাকত– একটা মহিলাদের আর একটা পুরুষদের। মহিলারা ঝাঁকের কইয়ের মধ্যে মিশে যেতেন, তাই তাঁদের নিয়ে চাপ ছিল না। কিন্তু পুরুষদের ঘরটা ছিল খুব সেনসিটিভ– বেশ কিছু জামাই, কুটুম, আর গোলমেলে আত্মীয়রা ওই পুরুষদের ঘরে জুটতেন। তাই পরিবারের কোনও সদস্যের সেই ঘরে, বাইরে থেকে আসা মানুষজনের সঙ্গে থাকা ছিল আতিথেয়তার অঙ্গ।
ছোটদির বিয়েতেও তার অন্যথা হল না– কিন্তু আগত কিছু আত্মীয়ের নাম শুনে কাকু বলল, ওই ঘরে শুতে বললে সারারাত রাস্তার রোয়াকে বসে থাকবে, তাই উপায়ান্তর না দেখে সদ্য স্কুলের গণ্ডি উত্তীর্ণ আমাকে বলা হল সেই ঘরে থাকতে। আমার বেশ স্ফূর্তি হয়েছিল ওই ঘরে ঢুকে– কোনও কাজ দিলেই এড়িয়ে যাওয়ার অজুহাত সবসময়ের জন্য তৈরি এই ঘরে, সবসময়েই এই ঘরের মানুষদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারব। সকালবেলাতেই সেঁধিয়ে গেলাম সেখানে। হাতে একটা সুটকেস নিয়ে একের পর এক আত্মীয় এসে হাজির হয়– নিরীহ অমায়িক হাসিখুশি মানুষজন। আমাকে নিয়ে খানিক আদিখ্যেতা করলেন কয়েকজন– ‘আরেব্বাবা কত বড় হয়ে গিয়েছে’ গোছের। ফুচিক-চে-মাওদের নাম ততদিনে জেনে ফেলেছি, দাস ক্যাপিটাল আর ক্যাপিটাল ইলেক্ট্রনিক্স যে আলাদা, তা নিয়ে সম্যক ধারণা তৈরি হয়েছে– এই মফসসল থেকে আসা ভালোমানুষদের সঙ্গে কাকুর এই ঘরে না থাকার সিদ্ধান্তকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না! সারাদিন বিভিন্ন কাজের মধ্যে থেকে ক্লান্ত হয়ে রাতে শুয়ে ভাবছি– গ্রাম দিয়ে যেদিন শহর ঘেরা হবে, সেদিন বাবা-কাকুর মতো প্রতিক্রিয়াশীল মানুষরা জব্দ হবে, তখনই শুরু হল গর্জন!
সেই ভালোমানুষের দল ঘুমের জগতে ঢুকে একেক মস্তান– ঘর পুরো জঙ্গল হয়ে উঠল। আঁতকে আঁতকে উঠছিলাম– কিন্তু কোথায় কী! আরেক জায়গায় শুরু হল, কিন্তু অন্য সুরে। খানিক বাদে দেখি ঘরে যে, খান-বিশেক মানুষ শুয়ে আছে, তার মধ্যে কারও-র নাক দিয়ে সিংহের ডাক, কারও-র নাক দিয়ে বিচিত্র এক ‘ফুরররর’ শব্দ, কারও-র আবার নাক দিয়ে বাঁশির মতো ‘কুউউউউ’ আওয়াজ শুরু হল। কিছু মানুষ ‘উফ!’ বলে পাশ ফিরে শুলেন, কিছু মানুষ বালিশে কান চাপা দিলেন– কিন্তু কেউই জেগে উঠলেন না। সারারাত ধরে তাণ্ডব চলতে লাগল। নিজেকে ঘুম পারাতে মনকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে, এটা ‘ওসিবিসা-র ড্রাম’, এটা ‘বিসমিল্লার সানাই’; মন আমাকে মুখঝামটা দিয়ে বলল ওসিবিসা আর বিসমিল্লা এক মঞ্চে নিতে পারবে না। সারারাত চোখের পাতা এক করতে পারিনি, মাঝেমাঝেই চমকে চমকে উঠি!
ভোরবেলা ঘরের বাইরে বেরিয়ে কাকুর সঙ্গে দেখা। কাকু কাঁধে হাত দিয়ে নিয়ে গিয়ে বাবার পাশে শুইয়ে দিয়ে যখন বলল খানিক ঘুমিয়ে নিতে, তখন বুঝেছিলাম কাকুর রোয়াকে বসে থাকার সিদ্ধান্তটা প্রতিক্রিয়াশীলের ছিল না, এই ঘরে আগে রাত কাটানো অভিজ্ঞতালব্ধ মানুষের ছিল। বাবা বা কাকু– দু’জনেই নেশার জগতের ফোর্থ ডিভিশনের খেলোয়াড়। তাই কেউই নাক ডাকতেন না, তাই ছোটবেলায় আমার ব্যাপ্টিজম হয়নি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ট্রেনে যদিও বা ঘুমের সাহস দেখাতাম, মাঝেমাঝে ‘ট্রেনে উঠে কে এত নাক ডাকে– এটা কি বাড়ি নাকি!’ বলে হাঁকডাক করতাম, প্লেনে উঠে প্রাণপণ চেষ্টায় চোখ খোলা রাখতাম। তাও সবসময় সম্ভব হত না। একবার বুকে সজোরে কনুইয়ের গুঁতো খেয়েছিলাম বসের কাছে। আরেকবার ব্যাঙ্গালোর (বেঙ্গালুরু) থেকে ফিরছি, ফ্লাইটে দেশের সেরা মডেলরা কলকাতায় আসছে এক ফ্যাশন শো’তে। আমার পাশে এক নামী মহিলা মডেল বসেছে দেখে ‘নাক ডেকে’ হেনস্থা হওয়ার ভয়ে আমি বিমানসেবিকাকে অনুরোধ করি, আমাকে কোনও পুরুষ মডেলের পাশে সিট দিতে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
মধ্যকাল
বিপ্লব করা হল না।
কবিতা লেখার চেষ্টা করতে গিয়ে, কৃত্তিবাসীদের লেখার পথ অনুসরণ করতে গিয়ে, নেশার পথ অনুসরণ করলাম। বাবা-কাকুর মতো ফোর্থ ডিভিশনের প্লেয়ার না হয়ে একেবারে ফার্স্ট ডিভিশনের প্লেয়ার হয়ে উঠলাম সেই জগতে। ‘নবাবের সাথে আরাম ফ্রি’র মতো কবে নাক ডাকাটা ফ্রিতে রপ্ত করে ফেলেছি জানি না। একা ঘরে শুই, কিছু জানিই না এই বিষয়ে। চিরু বিদেশ থেকে ফিরলেই আমাদের হল্লাবাজি নতুন উদ্যমে শুরু হয়ে যেত। সেইরকম এক রাতে প্রবীরের হোস্টেলে মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে দেখি, বিলু আর প্রবীর, চিরু আর আমার দিকে চেয়ে বসে আছে; বলেছিল আমরা ঘুমলে ওদের ঘুমনো সম্ভব নয়। মাতালের প্রলাপ বলে পাত্তা দিইনি। কিন্তু অচিরেই ভুল ভাঙল! বিয়ের পরের দিন সকালে একটা ঘরে ঝিমোচ্ছি– পাশে চিরু। সারারাত বাসর জেগে দু’জনই ক্লান্ত। বউ পাশের ঘরে গিয়ে কান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, জানি না। বিয়ের পরের দিন সকালে ঘুমের রীতি আছে কি না জানি না, তাই খানিক বাদেই ধড়মড় করে উঠে পড়ে দেখি চিরু নাক ডাকছে। ওকে ধাক্কা দিয়ে বললাম, ‘তোর নাক ডাকছে!’ চিরু পাশ ফিরে শুতে শুতে বলল, ‘তুই কি ভাবছিস তোর নাক ডাকছিল না!’
ট্রেনে যদিও বা ঘুমের সাহস দেখাতাম, মাঝেমাঝে ‘ট্রেনে উঠে কে এত নাক ডাকে– এটা কি বাড়ি নাকি!’ বলে হাঁকডাক করতাম, কিন্তু প্লেনে উঠে প্রাণপণ চেষ্টায় চোখ খোলা রাখতাম। তাও সবসময় সম্ভব হত না। একবার বুকে সজোরে কনুইয়ের গুঁতো খেয়েছিলাম বসের কাছে। আরেকবার বেঙ্গালুরু থেকে ফিরছি, ফ্লাইটে দেশের সেরা মডেলরা কলকাতায় আসছে এক ফ্যাশন শো’তে। আমার পাশে এক নামী মহিলা মডেল বসেছে দেখে ‘নাক ডেকে’ হেনস্তা হওয়ার ভয়ে আমি বিমানসেবিকাকে অনুরোধ করি, আমাকে কোনও পুরুষ মডেলের পাশে সিট দিতে। বিমানসেবিকা কী মানে করল আমার কথার, আমি জানি না– চোখ দিয়ে আমাকে অপাঙ্গ মেপে গম্ভীর মুখে আমাকে এমন একটা সিটে বসিয়েছিল, যে রো-তে আমি একা।
বৃত্ত সম্পূর্ণ হল সেদিন, যেদিন আমার শ্বশুরমশাই এক অনুষ্ঠান বাড়িতে আমার পাশে শুয়ে পরের দিন আমার গিন্নিকে অনুরোধ করেন, তাঁকে আমার পাশে শুতে না দেওয়ার জন্য।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: প্রেমে ফেল করলে পাশ করায় পাশবালিশ
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আজকাল
ভিলাইতে এক বন্ধুর বউকে পানমশলা মুখে নিয়ে শুয়ে কাশির দমকের মতো নাক ডাকতে শুনেছিলাম। সারা রাত্তির কেশেছে মনে করে যখন বন্ধুর কাছে শরীর নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করি, আমার বন্ধু আমাকে আশ্বস্ত করে ওটা ‘নাক ডাকা’ বলে। তার কাছে শুনি তার বউ পাশ ফিরে শুলে আর নাক ডাকে না– তাই বেশি বাড়াবাড়ি হলে সে বউকে পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে দেয়। সারারাতের কাশির দমকের মতো নাক ডাকা যদি বাড়াবাড়ি না হয়, বাড়াবাড়ির সংজ্ঞা কী, সেই নিয়ে আর কৌতূহল প্রকাশ করিনি। মেয়েকে দিল্লির ইউনিভার্সিটির হোস্টেলে রাখতে যাচ্ছি– তিতলির এক বন্ধু আর তার মা চলেছেন সঙ্গে। ট্রেনে রাত কাটানো এক চিত্তির– বদ্ধ জায়গায় নাক ডাকা নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা খুব খারাপ। পরের দিন সকালে অনেক হিংস্র দৃষ্টি এড়িয়ে টয়লেট যেতে হয়।
একবার এক অচেনা লোক মাঝরাতে এসে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে তুলে বাছাই কয়েকটা গালাগাল দিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়েছিল হিন্দিতে– ‘তুই কি ভেবেছিস তুই একাই ঘুমাবি!’ এবার আরও বড় বিপদ– মেয়ের প্রাণের বন্ধুর মা চলেছেন। একবার ঘুমিয়ে পড়লে আর আমার নাসিকা-গর্জনে বিব্রত হবে না, তাই রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ করে আমি বললাম, ‘দিদি, আপনি শুয়ে পড়ুন।’ উনি শুয়ে পড়লেন আর তারপর শুরু হল, সেই কৈশোর বয়সে শোনা ‘ধুয়াঁধার বল্লেবাজি’! ভদ্রমহিলার নাক ডাকার ধাক্কায় ঘুমের দফারফা। দেখলাম ট্রেনের কামরায় বেশ কিছু আলো জ্বলে উঠল। এক মহিলার এই বিক্রম দেখে আবার অনেকে আলো নিভিয়েও ফেলল। আর আমি সামনে বসে বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে খেয়াল করলাম, উনি পাশ ফিরে শুয়েও একই রকম নাক ডাকেন।
ছুটকিকে যখন এটা নিয়ে বলতে গেলাম, সে উল্টে আমায় জিজ্ঞেস করল– কোন শাস্ত্রে লেখা আছে যে মেয়েরা নাক ডাকতে পারবে না! আমি ওকে বললাম যে, স্বামীদের নাক ডাকা নিয়ে মেয়েদের নালিশ করতে শুনেছি, কিন্তু কোনও ছেলেকে আজ অবধি বউয়ের নাক ডাকা নিয়ে নালিশ করতে শুনিনি! মেয়েরা আমাকে ‘জেন্ডার বায়াসনেস’ নিয়ে একটা লম্বা লেকচার দিয়ে দিল এই শুনে। মরিয়া হয়ে আমি যখন মেয়েদের বললাম, ‘তোর মা যে নাক ডাকে, কোনওদিন তোদের বলেছি?’ গিন্নি উত্তর দিল– ‘আত্মরক্ষার তাগিদে ডাকি– ভেবে দেখেছো? নাক ডাকা তবু মেনে নিয়েছিলাম– কিন্তু এই সি-প্যাপের সাইরেন প্রতিরক্ষা না করলে না ঘুমিয়ে মরে যাব যে!’