Robbar

ডানহাতিদের উপত্যকায় বাঁহাতির সফল দাদাগিরি

Published by: Robbar Digital
  • Posted:July 8, 2024 6:48 pm
  • Updated:July 8, 2024 7:05 pm  

যে বিশ্বে ৯০ শতাংশ ডানহাতি, যে দেশে মাত্র ৭% বাঁহাতির বসবাস, এবং শুধু এই দেশ বলে নয়, বিশ্বজুড়ে বাঁহাতি ব্যাটারের গ্লাভস সহজে মেলে না– এমন এক বাস্তবতায়, সেসব পরিসংখ্যানের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আছে– সবচেয়ে বেশি পশ্চিমবঙ্গেই বাঁহাতি ব্যাটারের গ্লাভস বিক্রি হয়। এই তথ্যটুকুই কি বিবর্তনের এই ৬-৭ হাজার বছর পুরনো বিজ্ঞানের বিপরীতে, কালক্ষয়, সময়মলমের মুখের ওপর প্যাশনের, আবেগের, সৃজনের, সৃষ্টিশীলতার ব্যাপক চ্যালেঞ্জ নয়? সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিনে বিশেষ লেখা।

সুপ্রিয় মিত্র

গণতন্ত্রের ফান্ডা নাকি— of the people, by the people, for the people। জনগণের অংশগ্রহণ, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য।

ধর্মচর্মমর্মকর্ম ওসব বাদ দিন, আমি বলছি, গণতন্ত্র একটা কাওতাল! ওটা হবে of the right handed, by the right handed, for the right handed. কেন? ছোট থেকে শোনেননি? বাঁহাতে খাবে না, বাঁহাতে পেন ধরবে না, বাঁহাতে টাটা করবে না, বাঁহাতে ফুল ছোঁবে না, বাঁহাতে ছুড়বে না, বাঁহাতে টাকা দেবে না, বাঁহাতে টাকা নেবে না, কারণ বড়রা বলেছে, বাঁহাত অশুভ। বাঁহাতের একটাই স্পেশালাইজেশন, প্রাতঃকৃত্য সেরে অনবরত পৃষ্ঠপ্রক্ষালন। আর অন্যান্য সময়ে সে ডানহাতের সাপোর্ট স্টাফ। আশপাশের দুনিয়াটা একটু চোখ চারান। জানি, বাঁদিকেই আগে তাকাবেন। কারণ, বাস্তব ও স্মৃতির মিশেল যখন চোখের ওপারে তৈরি হয়, মানুষের দৃষ্টি কাত হয়ে যায় বাঁদিকে। আর যখন সে গল্প বানায়, বাস্তবকে বিকৃত করে, স্মৃতিতে উত্তর সত্যের প্রলেপ দেয়, তার নজর সরে থাকে ডানদিকে, কারণ মস্তিষ্কের বাম হেমিস্ফেয়ারে সে দায়িত্ব আরোপ করে, ঘটনা সাজানোর, কল্পনালতা বুননের।

যা হোক, কী দেখতে পাচ্ছেন? পেনের অ্যাঙ্গুলার ডিফ্লেকশন, চায়ের কাপের হাতল, আপনার চুলের সিঁথি, ব্যাগের চেন, মাউস, কি-বোর্ড, ক্লাসরুম থেকে অফিসের ডেস্ক (কারণ ড্রয়্যারটা ডানদিকে), কাঁচি, গাড়ির গিয়ার, আলুর পিলার, এটিএম মেশিন, কার্ড সোয়াইপ, ফোনের টাচ– কোনওটাই কিন্তু ‘বাঁয়ে হাত কা খেল’ নয়। প্রখরভাবে ডান হাতিয়ার চর্চা। লেখার খাতা, বই কিংবা এই স্ক্রিনও। যা যা ভাষা বাঁদিক থেকে শুরু হয়ে ডানদিকে শেষ, তা কি একতরফা চিন্তাপ্রসূত নয়? সর্বত্র ডানহাতির রমরমা। এমনকী, বাড়ির দরজাটাও।

Sourav Ganguly's top 3 innings in CWC

…………………………………………………………………

লিখতে গিয়েও যখন বাঁহাতে ধরে ফেললাম খড়ি, ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছিল বাবার। মাস্টারমশাই বলেই হয়তো বুঝেছিল, বাঁহাতে লেখার জ্বালা। বাবার অকালে চলে যাওয়ার অনেক পরে যদিও জানতে পারব ঠাকুরমার থেকে, বাবা নিজেও লেখা শুরু করেছিল বাঁহাতেই। কিন্তু তাকেও বাধ্যত ডানহাতে আসতে হয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রকোপে। ফুটবল খেলতে গিয়ে দেখা গেল, আমার লাথের যাবতীয় নিয়ন্ত্রণ আর জোর বাঁপায়ে। মারাদোনা তখন বাঙালির মনে ‘চরণ ধরিতে দিয়েগো আমারে’, ঘটনাচক্রে বাড়ির লোকজন এমনকী, বাবা-মাও আর্জেন্টিনার ফ্যান। ফলে বেঁচে গেলাম।

…………………………………………………………………

বলা হয়, ভারতীয় দরজার একটা দর্শন আছে। সহজেই সেই দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করা যায়, কিন্তু টেনে বেরনো তুলনামূলক কসরতের। ‘অতিথি দেব ভব’-র ফুলেল বাই-প্রোডাক্ট। আদপে, একচোখামি। ডানহাতি হলেই সেই দরজা ঠেলা সহজ, টানা কসরতের। কিন্তু, বাঁহাতির ক্ষেত্রে? ঘর থেকে বেরনো সহজ। ঢোকা কঠিন। দরজাটা ডানহাতিদের ভেবে গড়া বলেই কি, বাঁহাতিদের কামব্যাকের জন্য লড়তে হয়?

ভাবলে কাব্যললাটকল্পের গালিচা পাতা যায় বেশ, তবে ঝোলটা হালের বা একাল-সেকালেরও নয়, প্রায় ৬ হাজার বছরের পুরনো ক্যাঁচাল; যে— পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই ডানহাতি হয়ে জন্মায়। নিশ্চিত করে বলা যায় না, তবে, গবেষণার সিদ্ধান্ত ও উপসিদ্ধান্তের প্রবণতা বলে, মানুষের পূর্বজ কিংবা তারও পূর্বতর জিনকুল, খাদ্যের জোগানে শিকার করার বেলা ডানচোখের দৃষ্টিই বেশি প্রখর হয়ে ওঠে। সেই থেকেই নাকি বিবর্তনের কলকাঠি, মস্তিষ্কের কোষাগারকে এভাবে একতরফা ঠেলে আনল।

আর ডানহাত হয়ে উঠল সামগ্রিক ইতিবাচকতা, শুভ, শুচি, পারদর্শিতার প্রতীক। ক্লাসে ‘প্রেজেন্ট স্যর’ বা ‘উপস্থিত’ বললেই হবে না, তুলতে হবে ডানহাত। বাঁহাত তুললেই চকের রকেট, স্কেলের সপাৎ। উপমহাদেশীয় আখ্যানে চাঁদ সদাগরের মনসাকে ফুল ছুড়ে পুজো হোক কিংবা ইউরোপীয় আখ্যানে জোন অফ আর্কের মরণ– বাঁহাতের কুখ্যাতি জগৎজোড়া। ইংরেজিতে পাপ অর্থাৎ ‘sinister’ শব্দটির উৎসও বাঁহাত। মধ্যযুগীয় লাতিন ভাষায় ‘sinistral’ অর্থ বাম।

Sourav Ganguly turns 51: A complete look at career, accomplishments of legendary Indian batter - The Hindu

ফলে, এহেন পরিসরে মানুষের বাচ্চা যেই না বোধ ইস্তক বাঁহাত ছুড়তে শুরু করছে বেশি, তাকে বিবিধ উপায়ে বাগে আনার, পথে আনার, সভ্য করার চেষ্টায় বাপ-মায়েরা কমতি রাখে না। এই যেমন আমি। খাবার দেখলেও বাঁহাত, নোংরা ঘাঁটতেও বাঁহাত। অতঃপর, বড়দের হালকাফুলকা চাঁটি, হাতের তালুতে। তাহলে শিক্ষা হবে, ডানহাতকে ব্যবহারের, এমনটাই তারা ভেবেছিল। তাই লিখতে গিয়েও যখন বাঁহাতে ধরে ফেললাম খড়ি, ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছিল বাবার। মাস্টারমশাই বলেই হয়তো বুঝেছিল, বাঁহাতে লেখার জ্বালা। বাবার অকালে চলে যাওয়ার অনেক পরে যদিও জানতে পারব ঠাকুরমার থেকে, বাবা নিজেও লেখা শুরু করেছিল বাঁহাতেই। কিন্তু তাকেও বাধ্যত ডানহাতে আসতে হয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রকোপে। ফুটবল খেলতে গিয়ে দেখা গেল, আমার লাথের যাবতীয় নিয়ন্ত্রণ আর জোর বাঁপায়ে। মারাদোনা তখন বাঙালির মনে ‘চরণ ধরিতে দিয়েগো আমারে’, ঘটনাচক্রে বাড়ির লোকজন এমনকী, বাবা-মাও আর্জেন্টিনার ফ্যান। ফলে বেঁচে গেলাম। কিন্তু ক্রিকেট তো আরও বেশি পারিবারিক সংস্কৃতি। এ-কথাও জানলাম বাবার চির-অনুপস্থিতির পর, বাবার ডিগ্রিপত্রের ফাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে। কিশোরকালে, কলেজ বেলায়, ক্লাবে ক্লাবে, এমনকী, কলেজের হয়ে টুর্নামেন্টে বল-ব্যাটে অলরাউন্ডার, আমার ঘনঘোর পড়াকু, পড়াশোনা ছাড়া কিচ্ছু না বোঝা মাস্টারমশাই কৃষ্ণেন্দু মিত্র কি না স্নাতক ডিগ্রির তলায় লুকিয়ে রেখেছে একগুচ্ছ ম্যান অফ দ্য ম্যাচ, প্লেয়ার অফ দ্য টুর্নামেন্টের শংসাপত্র। অবাক লাগছিল। এই মানুষটাই সেই মানুষ, না কি অন্য কেউ, অন্য কোনও অভিমানের ফসল, ক্ষোভের উন্মাদ পাঠ্যক্রম, না-পাওয়ার রং, ‘থাক বরং’?

এহেন বাপের ব্যাটা, যখন ব্যাটও বাঁহাতে তুলে নিয়েছিল, ধর্মযুদ্ধ লেগে গিয়েছিল প্রায়। গাভাসকরের কট্টর ফ্যান, বাবার কাছে খেলার বিকেলে মনে পড়ে, একঝাঁক তাচ্ছিল্য খেয়েছিলাম ডানহাতে ব্যাট করতে পারি না বলে। বিকেলে স্কুল-ফেরত চকের ধুলোয় উলোঝুলো মাস্টার বাপ আমার, বাচ্চাদের দলে ভিড়ে গিয়ে খেলতেও চাইবে, আবার বল-ব্যাটে খামতি হলে রগড়ানিও দেবে! এ কেমন টক্সিসিটি? অথচ, এখন ভাবলে খুঁজে পাই তার কোচপনা, তার ভেতরকার খেলোয়াড়, যার কাছে খেলা মানে কেবলই দুটো বল পেটানো, তিনটে বল ঘোরানো, ঘাম ঝরিয়ে বিকেলটা কাটিয়ে দেওয়া ছিল না।

জেঠুর ছেলে, আমার বড়দাকে বাবা তৈরি করেছিল শচীনের মতো। তখন বাবার প্রিয়তম প্লেয়ার, যা আস্তে আস্তে রাহুল দ্রাবিড়ের দিকে ঝুঁকে যাবে একসময়। ছোট থেকেই বড়দার স্ট্রোকের পাওয়ার, শ্যাডো, ফ্রন্ট ফুট ছিল মাপা, পেশাদারি। অথচ, আমরা ওই ওয়ান ড্রপ ক্যাচ-অলা ম্যাচই খেলতাম বেশি গলির ভেতর। বড়দাকে আউট করতে পারা ছিল ভীষ্মর স্বেচ্ছামৃত্যুসম। তার একটা বলও মাটিতে ড্রপ খেয়ে লাফাবে না, একমাত্র যদি না সে ইচ্ছা করে। বাবা বড়দার খেলা চোখ ভরে দেখত, দূরে বারান্দা থেকে উৎসাহ জোগাত, ‘এই তো হচ্ছে গুড্ডু, চালিয়ে যা। সূর্য ডুবিয়ে দিলে নতুন কসকো বল আসবে!’

আর আমার ব্যাটিং ছিল মারব চাবুক, চলবে ঘোড়া। ওয়ান ড্রপে মারব, হয় চার হবে, ছয় মারব ফিল্ডারের গা তাক করে, নয়তো আউট। পিচ কি আমার দরজা যে সারাক্ষণ ঠক ঠক করব? বড়দার বিপরীতে অন্য এক আবহ তৈরির মেজাজে, বাবার ভালোবাসা-তারিফ পাওয়ার আশায় আমি যে এমন হয়ে উঠছিলাম, তা এখন বুঝতে পারি। বড়দার প্রশংসায় আমার কোনও খারাপ লাগা ছিল না। কিন্তু, তা কেন আমারও হবে না। আমার ধরন আলাদা। খারাপ তো নয়। অভিমানে, অবহেলায়, আমি হয়ে উঠেছিলাম আমারই বাপের মনসা, আর আমার বাপ কৃষ্ণেন্দু, হয়ে উঠেছিল আমার কালাচাঁদ সদাগর।

অনেক পীড়াপীড়ির পর, পড়াশোনায় কোনও খামতি হবে না, আঁকার ক্লাসে কামাই হবে না দিব্যি কেটে যখন ক্রিকেটের কোচিং নেওয়া শুরু হল, সেখানে সুগ্রীব দোসর হয়েছিলেন সেই ধোবিঘাটের কোচ, নাম বলছি না। বাঁহাতি ব্যাটসম্যান (তৎকালীন) কিংবা বাঁহাতি বোলার এগারোর মধ্যে কিঞ্চিৎ শোভাবর্ধক, অল্টারনেট লাইন-আপে ব্যাটিংয়ে নামালে ফিল্ডিং সাজাতে বিপক্ষের কালঘাম– এইমাত্র বিশ্বাস করতেন তিনি। পিচের আকার ও উইকেটের পজিশনের খাতিরে আর কোথাও হোক বা না-হোক, ক্রিকেটে অন্তত বাঁহাতি পেসারদের যে সুযোগ বেশি, তা বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে না হলেও, আমাদের সেই কোচস্যর এই সত্যকে নস্যাৎ করতে ডানহাতি পেসারে মনোনিবেশ করেছিলেন। সে তো ভালো কথা। জেদ ভালো। কিন্তু, সেই জেদে উঠতি শিক্ষার্থীর কেরিয়ার গিলে কোনও লাভ হবে? শুধু এখানেই থামেননি, আমাদের টিমে বব নামের এক বাঁহাতি পেসার ছিল, তাকে সবার সামনে খুব খোরাকের ভঙ্গিতে বলেছিলেন, এই তুই ক্রিস্টান না! বাঁহাতি পেসার মানেই মাইনরিটি, মুসলিম। তুই ক্রিস্টান। দ্যাখ উপায় করতে পারিস কি না ন্যাশনাল টিমে, ভবিষ্যতে এই লাইনেও কোটা আসে যদি! এখনও কানে বাজে।

তা, তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টায়, দাপটে, দোর্দণ্ডে আমি লেফট আর্ম পেসার থেকে পর্যবসিত হয়েছিলাম রাইট আর্ম অফ স্পিনারে। কিন্তু, এমন এক আবহে, আমাকে ও আমার মতো বাঁহাতিদের হয়ে শুচিবাইগ্রস্ত বাঙালির ডানপিটেমোর মাথায় বাড়ি মারতে, আমাদের অনাহুত মনসামঙ্গল অবস্থানে প্রশ্রয় দিতে উদিত হলেন এক চণ্ডীমঙ্গল! সৌরভ চণ্ডীদাস গঙ্গোপাধ্যায়। ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রথম সফল বাঁহাতি ব্যাটার তো বটেই, সর্বোপরি সেই ক্যাপ্টেন, যিনি বিদেশের মাটিতে ভারতকে জেতার সাহস জোগালেন। কেরিয়ারের তাবৎ চড়াই-উতরাইয়ে তিনি হয়ে উঠলেন প্রত্যাবর্তনের মসিহা। এবং, অজস্র শচীন ভগবানের দেশে বাঁহাতি উপাসকদের থেকে ব্যাট নামানো গেল না। এবং আমারও। এমনকী, দু’দল মিলিয়ে সংখ্যা যখন বিজোড়, তখন বাঁহাতি হিসেবে দু’দলের হয়েই খেলার সুযোগও কিছু পাইনি কম।

Watch Sourav Ganguly Play Gully Cricket On Streets Of Kolkata, That Too Right-Handed!

যদিও গ্লাভস তথৈবচ। ভারত তখনও ১৯৮৩-র বিশ্বকাপকে পুঁজি করেই লড়ছে। ২০০৩-এর বিশ্বকাপের ফাইনাল থেকে মুখ থুবড়ে ফিরে আসা নিয়ে ভুগছে, ফাটছে, তৈরি হচ্ছে ভেতর ভেতর। আমাদের মফস্‌সলে তখনও স্পোর্টসের দোকান বলতে একটাই, মধ্যবিত্তর ‘দত্ত স্পোর্টস’ আর কিঞ্চিৎ উচ্চবিত্তদের নিমিত্তে ‘ধর স্পোর্টস’। কিন্তু কোনওখানেই বাঁহাতি গ্লাভস স্টকে থাকে না, অর্ডার দিতে হয়। দিলে পরেও পাওয়া যায় না ‘এসএস’-এর সস্তা গ্লাভস। নিতে হবে ন্যূনতম লারসন্স। খেলার শুরুতে বহুদিন যাবৎ ডানহাতিদের গ্লাভস নিয়েই খেলতে হয়েছিল খড়গপুরের বাঁহাতিদের। কতিপয়, তবু, ক্রমশ এই সংখ্যা বাড়ছিল।

রেলের চাকরি পাওয়ার অন্যতম উপায় ছিল স্পোর্টস কোটা। সেই মর্মেই খড়গপুরে খেলা নিয়ে একটা সাংস্কৃতিক ও কেরিয়ারসুলভ মন তৈরি হয়ে গিয়েছিল বহুদিনই। আর এমন এক প্রাঙ্গণে, বাঁহাতি ব্যাটার ও বোলার হয়ে কিঞ্চিৎ ব্যতিক্রমী হওয়ার লড়াইয়ে, আমাদের থেকে একটু বড়, সিএবি-তে সবে খেলা শুরু করেছে, তামিল ছেলে, ভিগনেশদা, ডানহাত ছেড়ে বাঁহাতে ব্যাটিং প্র‍্যাকটিসের ঝুঁকি অবধি নিয়েছিল। আর এ সমস্তর নেপথ্যে দুঃসাহস জুগিয়ে চলেছিল সৌরভে মাতোয়ারা ভারতীয় ক্রিকেট সমকাল।

হাবে ফুটবলার, ভাবে প্যাশনেট বণিক, তায় ব্রাহ্মণ, বাঙালির যা কিছু সুপ্ত বাসনা, সুষুপ্ত অহং– সেসবে তুরীয় মৌতাত মাখিয়ে আচমকা ক্রিকেট ময়দানে আবির্ভূত হলেন এই বঙ্গসন্তান। উস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ বাঁহাতি ছিলেন। বেহালা বাজাতেন ডানকাঁধে শুইয়ে, আর বেহালাকে নাম দিয়েছিলেন বাহুলীন। আর, এই বেহালা-বালকের বাম বাহুতে লীন হল ব্যাট।

ভারতীয় ক্রিকেট, তার ইতিহাস, তার ভবিষ্যৎ, তার বর্তমান– এসব নিয়ে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ভূমিকা নিয়ে তর্কবিতর্ক, পরিসংখ্যানের হুটোপাটি, এসব চলতে থাকবে। কিন্তু, যেদেশে ক্রিকেট ধর্ম, সেই ক্ষেত্রে শুধুমাত্র একজন বাঁহাতি ও বাঙালি প্লেয়ার হয়ে সৌরভ গাঙ্গুলির আবির্ভাব ঘটেছিল বলে কত শুচিবাই, কত ট্যাবু, কত অসূয়া, কত সংস্কার ও তার জগঝম্পের ইতি না ঘটলেও তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল, তা নিয়ে গবেষণা করলে ক্রিকেটের এক অন্যতর সামাজিক বীক্ষণ কি উঠে আসবে না? এবং, শুধু এটুকু দেখলেও সৌরভ একাকী দাদাগিরি চালিয়ে এই ডানহাতিদের উপত্যকায় কিংবদন্তি হয়ে থাকবেন।

যে বিশ্বে ৯০ শতাংশ ডানহাতি, যে দেশে মাত্র ৭% বাঁহাতির বসবাস, এবং শুধু এই দেশ বলে নয়, বিশ্বজুড়ে বাঁহাতি ব্যাটারের গ্লাভস সহজে মেলে না– এমন এক বাস্তবতায়, সেসব পরিসংখ্যানের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আছে– সবচেয়ে বেশি পশ্চিমবঙ্গেই বাঁহাতি ব্যাটারের গ্লাভস বিক্রি হয়। এই তথ্যটুকুই কি বিবর্তনের এই ৬-৭ হাজার বছর পুরনো বিজ্ঞানের বিপরীতে, কালক্ষয়, সময়মলমের মুখের ওপর প্যাশনের, আবেগের, সৃজনের, সৃষ্টিশীলতার ব্যাপক চ্যালেঞ্জ নয়?