সুচিত্রা, এখন চৈত্রমাস! তোমাকে সত্য কথাটি জানানোর এই পরম লগ্ন। তুমি, তুমিই সুচিত্রা– সেই অমোঘ বিষ্ণুপ্রিয়া, যে ইচ্ছে করলে আটকে দিতে পারে সন্ন্যাসীর অন্বেষ, ডেকে আনতে পারে তার কৃচ্ছ ও আধ্যাত্মিকতার চরম সর্বনাশ! কারণ দিন শেষের আলোয় রাঙা এখন চৈত্রমাস!
যা-কিছু ব্যক্তিগত, তা-ই পবিত্র। ব্যক্তিগত-কে এই অমল অভিধাটি দিয়ে গিয়েছেন বুদ্ধদেব বসু কী অপ্রতিম অবলীলায়! সুচিত্রা সেন আমার একান্ত ব্যক্তিগত। সুচিত্রাকে রেখেছি আমার নিবিড় নিঃশব্দ আদর ও অনুভবের ইথার-স্পন্দনে। ওই চিরযৌবনা পরমা আমার সোনার কাঠি। ওকে ছুঁলে আমার ‘তিরাশি’ হয়ে ওঠে সুবর্ণরেখা। জোয়ারে ভেসে আসে স্মৃতি। প্রাচীন শিকড়ে জাগে নতুন প্রাণ। পুরনো ভালোবাসা ফিরে গিয়ে বসে বেদনার আসনে।
সুচিত্রা আমার ‘এসেছিলে তবু আস নাই জানায়ে গেলে!’ চিরকালই তা-ই। কত নারীই তো এল জীবনে। তারা সবাই স্বাগত-বিদায়ে রঙিন হয়ে আছে। কেউ এসেছে নিঃশব্দ চরণে। কেউ বিপুল সমারোহে। কেউ নদীর মতো আঁকাবাঁকা স্রোতে। কেউ চোখের চাওয়ার হাওয়ায়। কালো মেয়ের ছিপছিপেমি যেন ডিঙি নৌকো। ভাসিয়ে নিয়ে যায় আমাকে। বাদামি মেয়ে দুপুরবেলা নদীর ঘাটে গান ধরে, রবীন্দ্রনাথের গান, ‘আজ বুকের বসন ছিঁড়ে ফেলে।’ আর এক কিশোরী, লেকের ধারে জ্যোৎস্নায় ভাসিয়ে দিল নিতল কণ্ঠ, ‘বনফুলের গন্ধ বাঁশির তানে মিশে যায়।’ কিছুক্ষণ আগেই লেক ক্লাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক জ্যোতি ভট্টাচার্যের আকুল কণ্ঠে শুনেছি এই একই গান। এখন লেকের পাশ দিয়ে, রেল লাইনের ধার দিয়ে, বাড়ি ফিরছি। বন্ধুনি হঠাৎ গেল থেমে। থামলে কেন? বাকি গান শুনতে গেলে দাম দিতে হবে, বলল চাঁদের আলোয় ঝলমলে সুন্দরী। কী দাম? শুয়ে পড়ো ট্রেন লাইনে মাথা দিয়ে। শুলাম। সে-ও শুল পাশে। দখিনা বাতাস উড়িয়ে দিল আঁচল। মনে পড়ে, সেই ছবি রবীন্দ্রনাথের অব্যর্থ অক্ষরে-অক্ষরে: ‘যেখানে যা উঁচু নীচু প্রকৃতির বিধানে!’
সুচিত্রাই একমাত্র মেয়ে– যে আমার জীবনে এসেও আসেনি। আবার না এসেও এসেছে। তার কোনও স্বাগত-বিদায় নেই আমার স্মৃতিতে। সে আমার বিপাশার তীর, মনকেমনের ফ্রেমে বাঁধানো। সে আমার লতা-পাতা-ঘেরা জানলার মাঝে একটি মধুর মুখ। সে আমার ক্ষণকালের আনন্দ। চিরকালের মিসিং! সে আমার চিরকালের ‘কিছুই না পাইলাম, যাহা কিছু চাই!’ সে আমার আটপৌরে আড়ালের চুপিচুপি চুমু!
এই সুচিত্রা একদিন ডাকল আমাকে। তার স্বর্গের বারান্দায়। যে-স্বর্গ, যে-বারান্দার খোঁজ দান্তেও পায়নি, সেই বারান্দায় উত্তীর্ণ হয়েছি আমি। সে এগিয়ে আসছে আমার দিকে পদাবলি পদক্ষেপে। সারা অঙ্গে তার রাধারূপ দ্রব হচ্ছে। যেন মোমবাতির গায়ে গড়িয়ে নামছে মোম। যেন রতির আরতি হচ্ছে স্বর্গের বারান্দায়।
সেই নারী এসে দাঁড়াল আমার সামনে!
–তুমি রঞ্জন!
–হ্যাঁ।
–মুনমুনের বন্ধু?
–হ্যাঁ।
–বেশ লেখো। কত চিঠি! কত লিখেছ! কিন্তু কী ঠিক চাও, লেখোনি তো!
–মানে? লিখেছি তো!
–না তো, লেখোনি। ঠিক কী চাও!
–সাক্ষাৎকার!
–তা-ই! দেব না।
–কেন?
–তুমি দুষ্টু। তা-ই।
কী বলব আমি, বুঝতে পারি না।
–সাক্ষাৎকার নিয়ে কী হবে?
–‘জুনিয়ার স্টেটসম্যান’-এ ছাপা হবে। আমার এডিটর ডেসমন্ড ডয়েগ চায়, সুচিত্রা সেনকে আমি ইন্টারভিউ করি।
–কিন্তু আমি যে কাউকে ইন্টারভিউ দিই না। তোমাকে তো দেবই না।
–কেন? আমি এমন স্পেশাল কেন?
–ওই যে বললুম। তুমি দুষ্টু। এই তো কথা বললুম।
লিখে দিও কোনও দিন।
–আর একদিন আসতে পারি?
–নিশ্চয়ই পারো। কিন্তু আজকে আর নয়। আজ একটু পরেই আমাকে বেরতে হবে।
সুচিত্রা ফিরে যাওয়ার সময় বারান্দার দোলনাটা সামান্য দুলিয়ে দিল তার হাতের দোলায়। সেই দোলনা, সেই দোলন, আজও তো থামল না। আমি চোখ বুঝলে আজও দেখতে পাই, দীর্ঘ বারান্দা দিয়ে ফিরে যাচ্ছে সুচিত্রা। তার আসা-যাওয়ার পদাবলি অমৃত আখরে আজও দীপ্যমান মধুর মেদুরতায়! আজও হৃদয় মাঝারে দুলছে সেই দোলনা। সুচিত্রার আপন হাতের দোলে।
আমি কি কেবল সাক্ষাৎকারই চেয়েছিলুম? আর কিছুই কি চাইনি? বলতে পারিনি কেন? কেন বলতে পারিনি, কেন বেঁধে যায় কণ্ঠ? হারিয়ে যায় ভাষা? যা চাই, তা তোমাকে বলতে পারব না। তুমি সাহায্য করো বলতে– যদি এই কথাটুকুও বলতে পারতুম!
তখন যদি সুচিত্রা বলত, ‘কী করে সাহায্য করব বলো? কী করতে হবে আমাকে?’
আর আমি বলতে পারতুম সুচিত্রাকে, তোমার রূপের টানে সকল বাঁধন খোলাও! ভেঙে দাও আমার ভয়। শুষে নাও আমার লজ্জা। দহিত করো আমার ইনহিবিশন্স!
ভাগ্যিস বলিনি! আর ভাগ্যিস তুমি চোখের সামনে থেকে সরে গিয়েছিলে, সরে গিয়েছিলে নিরুদ্ধ নির্বাসনে!
টেনিসনের সেই কথাটা, আজ বুঝি, কী অপূর্ব সত্য:
‘আফটার মেনি আ সামার ডাইজ্ দ্য সোয়ান।’ অনেক বসন্ত পেরিয়ে মরে যায় স্বপ্নের রাজহংসী! তুমি সুচিত্রা, একমাত্র তুমিই সেই নারী, যে হারাল না যৌবন। আজও জেগে আছ, রয়েছ তোমার অমৃত মাত্রায়, তোমার মহুয়া-মাধুর্য্যে, তোমার সেই সব অব্যর্থ চাপা চাউনি আর রতি-বিভঙ্গের মাধবীকুঞ্জে! এখনও আমার স্বপ্নে, কল্পনায়, আমার আদ্দেক ঘুম আর আদ্দেক জাগার দুষ্টু খোয়াবে বিছিয়ে আছে আজও তোমার সমস্ত শরীরী বিন্যাসের বিদ্যাপতি, তোমার সমস্ত না-দেওয়া আশ্লেষের বিষ্ণুপ্রিয়া!
সুচিত্রা, এখন চৈত্রমাস! তোমাকে সত্য কথাটি জানানোর এই পরম লগ্ন। তুমি, তুমিই সুচিত্রা– সেই অমোঘ বিষ্ণুপ্রিয়া, যে ইচ্ছে করলে আটকে দিতে পারে সন্ন্যাসীর অন্বেষ, ডেকে আনতে পারে তার কৃচ্ছ ও আধ্যাত্মিকতার চরম সর্বনাশ!
আমি তো কোন ছার! আজও পুড়ছি অপারগ আগুনে! তুমি ফুরবে না আমার মিসিং-এ! আমার আর্তিতে। আমার তেষ্টায়।