মেয়েরা মায়ের জাত, এই অতি প্রচলিত কৌশলী শব্দের আড়ালে লুকিয়ে আছে মেয়েদের প্রতি সমাজের প্রতারণা। সুকুমারী ভট্টাচার্য ‘মাতৃত্ব’ আরোপের ষড়যন্ত্রকে ব্যখ্যা করেছেন, ‘প্রাচীন ভারতে মাতৃত্ব’ প্রবন্ধে। ভারতে মাতৃত্বের উপর দেবত্বের আরোপ যে উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল তেমন উচ্চ পর্যায়ে আর কোথাও পৌঁছায়নি। দেবত্ব আরোপ করে, ‘দেবী’ নামে ভূষিত করে নারীর সামাজিক অবস্থানের বাস্তব চিত্র প্রতিফলিত হয় না। এটা মায়ের প্রতি শুধুমাত্র সমাজের নিস্পৃহতার ক্ষতিপূরণসূচক একটা শব্দমাত্র বলে মনে করেছেন। কারণ এই শব্দ প্রয়োগে তো বাস্তবের নারীর প্রতি ঘটে যাওয়া নির্যাতনের ক্ষতিপূরণ হয় না।
সুকুমারী ভট্টাচার্য ১০৩ বছর আগে ১২ জুলাই (১৯২১ সালে) জন্মগ্রহণ করেন। জন্মসূত্রে তিনি খ্রিস্টান। ১৯৪২ সালে সংস্কৃতে সাম্মানিক পাশ করলেন প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে। কিন্তু সংস্কৃতে এমএ পড়ার অনুমতি পেলেন না। কারণ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত পণ্ডিতরা খ্রিস্টান ছাত্রীকে সংস্কৃত পড়াতে রাজি হননি। সংস্কৃত ছেড়ে তখন ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে ১৯৪৪ সালে এমএ পাস করেন প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে। ১৯৫৪ সালে প্রাইভেটে সংস্কৃতে এমএ পরীক্ষা দিয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। অধ্যাপনা করেছেন লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ এবং পরে সংস্কৃত বিভাগে।
সংস্কৃত পণ্ডিতদের কাছে বাধা পেয়ে যে ছাত্রীকে আরও দশ বছর পর সংস্কৃত নিয়ে এমএ পাস করতে হল, তিনিই অনুবাদ করলেন ‘মৃচ্ছকটিক’, লিখলেন ‘প্রাচীন ভারত: সমাজ ও সাহিত্য’, ‘ইতিহাসের আলোকে বৈদিক সাহিত্য’, ‘ধ্রুপদী সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস’, ‘রামায়ণ ও মহাভারত: আনুপাতিক জনপ্রিয়তা’, ‘বেদের যুগে ক্ষুধা ও খাদ্য’, ‘বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য’, ‘প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ’, ‘গীতা কেন?’, ‘পুরাণ ও অন্যান্য’ প্রভৃতি প্রবন্ধ গ্রন্থ।
সুকুমারী ভট্টাচার্যের বিদগ্ধ মনন ও যুক্তিনিষ্ঠ বিশ্লেষণে প্রাচীন ভারতের নারীর যথাযথ অবস্থান চিত্রায়িত হয়েছে। নারী-পৃথিবী কাঁটায় মোড়া। বাধা-নিষেধ, নিয়ন্ত্রণ আর শোষণে জর্জরিত। এর উৎসগুলো সঠিকভাবে শুধু চিহ্নিত করেননি, বিরোধিতা করেছেন প্রবল যুক্তিতে। তীক্ষ্ণ সমালোচকের দৃষ্টিতে প্রাচীন ভারতের সাহিত্যকে মূল্যায়ন করেছেন। ‘প্রাচীন ভারত সমাজ ও সাহিত্য’ গ্রন্থের নিবেদন অংশে সুকুমারী ভট্টাচার্য বলেছেন, ভারতে নারীকে সম্মানের আসনে রেখেছিল– একথা প্রায়ই শোনা যায়। কিন্তু বহু অনুসন্ধানেও নারীকে সেকালের সমাজে তিনি সম্মানের আসনে দেখতে পাননি। শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, স্বাধীন অর্থকরী জীবিকা থেকে বঞ্চিত নারীরা কেবল রূপ- যৌবন আর শ্রমের বিনিময়ে সেখানে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এই জীবনকে সম্মানের জীবন বলে মনে করেননি গ্রন্থকর্ত্রী। প্রাচীন ভারতের সমাজে স্বাধীন নারী একমাত্র গণিকারা ছিলেন। নগণ্য সংখ্যক শিক্ষিত সন্ন্যাসিনী, পরিব্রাজিকা থাকার কথা বলেছেন। তবে তাঁরা সমাজের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাস করতেন। তাঁদের তেমন কোনও ভূমিকা ছিল না। তবে শিক্ষার অধিকার পুরোমাত্রায় গণিকাদের ছিল। তাঁরা রাষ্ট্রের টাকায় শিক্ষা গ্রহণ করত। নিজের উপার্জিত অর্থ ও নিজের শরীরের ওপর কিছু অধিকার ছিল। এখানেই কূলবধূদের শোচনীয় অবস্থানকে তুলনামূলকভাবে উল্লেখ করেছেন। কূলবধূদের শিক্ষা, উপার্জন বা নিজের দেহের ওপর ততটা অধিকার ছিল না।
‘বৈদিক সমাজে নারীর স্থান’ প্রবন্ধে সুকুমারী ভট্টাচার্য যাযাবর পশুচারী আর্যদের কথা বললেন। তারা ভারতে প্রবেশ করার পর ক্রমশ কৃষিজীবী হয়ে ওঠে। ‘‘ক্রমে ক্রমে ‘কুল’-এর প্রবর্তন হয়। প্রথমে একটা বাড়িতে তিন চার পুরুষ ধরে বৃহৎ পরিবারের বাস। তারপর শুরু হয় যৌথ পরিবার। তারপর হল একক পরিবার। একটি পুরুষের সংসার। এসবের সঙ্গেই উৎপাদন ব্যবস্থার ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল, কিন্তু একটি ব্যাপার ক্রমশ পরিণতির দিকে এগোচ্ছিল: সমাজে শূদ্র ও নারীর স্থানের অনিবার্য অবনমন, অর্থৎ ক্রমেই নারীর স্থান সমাজে ও পরিবারে নেমে যাচ্ছিল। উৎপাদন ব্যবস্থায় নারীর অংশ ক্রমেই কমে যাচ্ছিল, যদিও গৃহকর্মে তার পরিশ্রম ও দায়িত্ব যথেষ্টই ছিল তবু তাকে ‘ভার্যা’ অর্থাৎ অন্যের দ্বারা ভরণীয়া, স্বামীর অন্নে প্রতিপালিত এই সংজ্ঞা দেওয়া হল। মনে রাখতে হবে ‘ভৃত্য’ আর ‘ভার্যা’ শব্দ দুটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ একই: যাকে ভরণ করতে হয়।’’ (প্রাচীন ভারত: সমাজ ও সাহিত্য, সুকুমারী ভট্টাচার্য, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা)
নারীর গৃহশ্রমকে অদৃশ্য করে রাখার প্রবণতা সেই প্রাচীন সমাজ থেকে এখনও একইভাবে চলে আসছে। আজকে অনেক নারী বাইরের জগতের সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের সকলকে আর ‘ভরণ’ করতেও হয় না। শিক্ষা বা কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার বাধাও দূর করতে পেরেছেন। উৎপাদনশীল কাজে নারীর চাহিদা তৈরি হলেও গৃহের কাজ থেকে অব্যাহতি মিলছে না। গৃহশ্রমে মাইনে নির্ধারণ হোক– হয়তো এই দাবি তাঁর ছিল। নইলে কেন বলবেন, বৈদিক সাহিত্যে নারীদের অর্থনৈতিক অবস্থা জানা যায় না। অথচ তাঁরা পশম বুনতেন, পশুপালন করতেন, গৃহশ্রম তো ছিলই। ‘রান্নাঘর ও শিশুপালন তাদেরই আয়ত্তে ছিল, কিন্তু এখনও যেমন, তখনও তেমনি। সেই কাজগুলির অর্থনৈতিক দিক দিয়ে কোন হিসেব হতো না, ফলে কোন মাইনে দেওয়া হতো না।’ (‘প্রাচীন ভারতে নারীর অর্থনৈতিক অধিকার’- প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ)। পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোয় ‘স্বামী’ (প্রভু) ঘরের অধিকাংশ কাজকে (নিম্ন মানের মনে করা হয়) স্ত্রীর দায়িত্বে ফেলে রাখার ভেতর পৌরুষ অনুভব করেন। সমাজের কেন্দ্রে পুরুষের বাস। নারীরা প্রান্তিক। এই প্রান্তবাসীদের জীবন কেন্দ্রের ইচ্ছেতেই পরিচালিত হত। তিনি বলেছেন, ‘‘বিধবা বেঁচে থাকলেই সব সময়ে তার জীবন সুখের হত না, তাই প্রার্থনা শুনি, ‘যেন ইন্দ্রাণীর মত অবিধবা হই।’ [তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ৩/৭/৫/৫১] বলা বাহুল্য, সমস্ত ভারতীয় সাহিত্যে ‘যেন বিপত্নীক না হই’ এমন প্রার্থনা কোথাও নেই। বরং এখন এর উল্টো কথাই শোনা যায়, ‘ভাগ্যবানের বউ মরে, অভাগার গোরু।’ সম্পত্তি হিসেবেও স্ত্রীর স্থান গরুর নিচে, কারণ নতুন গরু কিনতে টাকা লাগে, আর নতুন বৌ আনলে টাকা পাওয়া যায়।’’ (বৈদিক সমাজে নারীর স্থান। প্রাচীন ভারত: সমাজ ও সাহিত্য) সমাজে নারীর অবস্থান নির্মাণ করেছে পিতৃতন্ত্র। সুকুমারী ভট্টাচার্যের মননশীল লেখায় প্রাচীন ভারত থেকে বর্তমান ভারত– লিঙ্গবৈষম্যের রাজনৈতিক ধারাবাহিকতার কথা রয়েছে।
‘মাতৃত্ব’ একটি শোষণমূলক শব্দ। নারীর গুণাবলী সম্পর্কে সমাজ কিছু ধারণা তৈরি করে রেখেছে। ভালো নারীর স্বীকৃতি পেতে চাইলে সহনশীল স্ত্রী হতে হবে, ধৈর্যশীল মা হতে হবে। পুত্রের জননী হলে চূড়ান্ত সম্মান। তাই প্রাচীন ভারতবর্ষে পুত্রের জন্মের পর শাঁখ বাজানো হত। কন্যা জন্মের পর শাঁখ বাজত না। ‘তনয়া’ প্রবন্ধে ঐতরেয় ব্রাহ্মণের উক্তি দিয়ে কন্যা সন্তানের মাতার অবস্থান বুঝিয়েছেন। পুত্রের জন্ম দিতে পারলে সেই নারী শ্রেষ্ঠ। কিন্তু কন্যার জন্ম দিলে সেই নারীকে বারো বছর পর ত্যাগ করা যায়। শাস্ত্রের মূলে, সমাজের গোড়ায় নারীকে অপর করে রেখে পুরুষের সুবিধা অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণের ছক নির্মাণ হয়েছে, সেকথা স্পষ্ট করে লিখেছেন প্রবন্ধগুলিতে। আসলে মাতৃত্বের শিরোপায় আছে বঞ্চনা, নির্যাতনের পথ-পরিক্রমা। মেয়েরা মায়ের জাত, এই অতি প্রচলিত কৌশলী শব্দের আড়ালে লুকিয়ে আছে মেয়েদের প্রতি সমাজের প্রতারণা। সুকুমারী ভট্টাচার্য ‘মাতৃত্ব’ আরোপের ষড়যন্ত্রকে ব্যখ্যা করেছেন, ‘প্রাচীন ভারতে মাতৃত্ব’ প্রবন্ধে। ভারতে মাতৃত্বের উপর দেবত্বের আরোপ যে উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল তেমন উচ্চ পর্যায়ে আর কোথাও পৌঁছায়নি। দেবত্ব আরোপ করে, ‘দেবী’ নামে ভূষিত করে নারীর সামাজিক অবস্থানের বাস্তব চিত্র প্রতিফলিত হয় না। এটা মায়ের প্রতি শুধুমাত্র সমাজের নিস্পৃহতার ক্ষতিপূরণসূচক একটা শব্দমাত্র বলে মনে করেছেন। কারণ এই শব্দ প্রয়োগে তো বাস্তবের নারীর প্রতি ঘটে যাওয়া নির্যাতনের ক্ষতিপূরণ হয় না।
……………………………………………………..
নারী যে কেবল ভোগ্যবস্তু তেমন উক্তি রামচন্দ্রের মুখেও শুনিয়েছেন। প্রজানুরঞ্জন রাম সীতাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন কারণ ‘‘পরহস্তগতা নারীকে তিনি ‘ভোগ’ করতে পারবেন না।’’ ‘‘যেদেশে ‘সতী’ বা ‘সাধ্বী’ শব্দের ঐ অর্থে কোনো পুংলিঙ্গ প্রতিশব্দই নেই, সেদেশের সমাজের অন্যরকম কিছু আশা করাও যায় না।’’ লিঙ্গ রাজনীতির সমাজ-ভাষাকে সরাসরি আক্রমণ করলে তবেই পাঠক সচেতন হওয়ার পরিবেশ পায়। আর ঠিক সেই কাজগুলোই লেখার মাধ্যমে করেছেন।
……………………………………………………..
বৈদিক পরবর্তী সাহিত্যে নারীকে ‘ভোগ্যবস্তু’ বলার প্রবণতা এসেছে বৈদিক সাহিত্য থেকেই, তা জোরের সঙ্গে প্রমাণ করেছেন ‘বৈদিক সমাজে নারীর স্থান প্রবন্ধে’। যৌন অপরাধে কেবল নারীরা অপরাধী হত। অথচ পুরুষের যৌন অপরাধকে সমাজ প্রশ্রয়ের চোখে দেখেছে। নারী যে কেবল ভোগ্যবস্তু তেমন উক্তি রামচন্দ্রের মুখেও শুনিয়েছেন। প্রজানুরঞ্জন রাম সীতাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন কারণ ‘‘পরহস্তগতা নারীকে তিনি ‘ভোগ’ করতে পারবেন না।’’ ‘‘যেদেশে ‘সতী’ বা ‘সাধ্বী’ শব্দের ঐ অর্থে কোনো পুংলিঙ্গ প্রতিশব্দই নেই, সেদেশের সমাজের অন্যরকম কিছু আশা করাও যায় না।’’ লিঙ্গ রাজনীতির সমাজ-ভাষাকে সরাসরি আক্রমণ করলে তবেই পাঠক সচেতন হওয়ার পরিবেশ পায়। আর ঠিক সেই কাজগুলোই লেখার মাধ্যমে করেছেন।
বর্তমান ভারতে রূপ কানোয়ারের সতী হওয়ার ঘটনায় নারীর বাস্তব জীবন নিয়ে আতঙ্কিত লেখক সুদূর প্রসারিত শিকড়ের সন্ধান করলেন ‘সতী’ প্রবন্ধে। শাস্ত্র পুড়িয়ে মারার প্রথাকে ‘সতী’ শব্দে ভূষিত করল। আর অতীত তাড়িত বর্তমান, পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো এবং কখনো নারীর মননেও ‘সতী’ শব্দের মোহ সৃষ্টি হল। কিন্তু সব নারী কী স্বেচ্ছায় স্বামীর সঙ্গে স্বর্গসুখ লাভের আশায় জ্বলন্ত চিতায় উঠেছেন? সমাজের বলপ্রয়োগের কাছে পরাস্ত নারী ‘সতী’র মিথ্যা তকমা নিয়ে পুড়ে মরেছেন তার নজির পেয়েছেন রূপ কানোয়ারের বেলাতেও। ‘আলোচ্য বিশেষ ঘটনার ক্ষেত্রে আমরা জানতে পারি যে রূপ কানোয়ারের স্বামী ছিল নির্বীর্য, তাই তার মৃত্যুর কিছুদিন আগেই সে স্বামীকে ত্যাগ করেছিল অপর এক পুরুষের জন্য। তাই সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন ওঠে অনন্তকালের জন্য সেই স্বামীর সঙ্গলাভের জন্য কি সে সত্যি ব্যাকুল ছিল?’ (সতী: প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ)।
সুকুমারী ভট্টাচার্য গভীরভাবে নারীর জীবনের অবস্থানকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন। শাস্ত্রের বাণীতে, সমাজকর্তাদের নির্দেশে নারী শৃঙ্খলিত হয়েছে প্রাচীনকাল থেকে। এই বাস্তবতার বিরুদ্ধপক্ষে অবস্থান নিয়ে, লিঙ্গবৈষম্য দূর করার যুক্তিপূর্ণ, জরুরি বার্তাগুলি আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।