Robbar

উপত্যকার শৈশব বিস্ময় গোলকে প্রথম পা ছোঁয়াবে আর স্মরণ করবে সুনীল ছেত্রীকে

Published by: Robbar Digital
  • Posted:August 3, 2024 6:17 pm
  • Updated:August 3, 2024 6:24 pm  

মেসি রোনাল্ডোর সঙ্গে একই পোডিয়ামে আসা একমাত্র ভারতীয় কিংবদন্তি তিনি। কিন্তু ওই যে, বাহুল্যর পরোয়া করেননি কখনও। বরাবরই তিনি ঋষির মতো উদাসীন, আড়ম্বরহীন। হঠাৎই এক সাড়ে নয় মিনিটের ভিডিওবার্তা। গোটা দেশ জানল, শেষবার মাঠে নামতে চলেছে ১১ নম্বর নীল জার্সি। সেই জার্সির মালিক, যিনি কি না দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা কুস্তিগিরদের প্রতিবাদ নিয়ে মুখ খুলেছিলেন। রাষ্ট্রের কাছে চেয়েছিলেন দ্রুত সমাধান। রাষ্ট্র কর্ণপাত করেনি বিশেষ। তবুও সুনীল অবিচল, স্থিতধী। মাঠের মতো মাঠের বাইরেও।

স্বস্তিক চৌধুরি

তারিখটা ৬ জুন। লক্ষ্মীবারের সন্ধে পেরিয়ে রাত নেমেছে শহরে। দিনশেষে বাইপাসের জ্যামও খানিক পাতলা। ঝাঁ-চকচকে ফ্লাইওভারের নিচের ঝুপড়িতে ক্লান্ত যুবক পয়সা গুনে নিচ্ছে। ওর নাম পল্টু। কাদাপাড়ায় ব্ল্যাকার পল্টুকে একডাকে সবাই চেনে। আবার অফ সিজনে ভিক্ষাও করে ও। নিজে ফুটবল ভালোবাসত খুব, খেলতও দারুণ। পায়ে নাকি অদ্ভুত জাদু ছিল ওর। মলিন হয়ে যাওয়া রং-চটা সবুজ-মেরুন জার্সিটা এখনও সযত্নে রাখা আছে ট্রাঙ্কে। কিন্তু দুর্ভাগা এ দেশ! সদ্য শেষ হওয়া ভোটে ছাপ্পা দিতেও পল্টুরই ডাক পড়েছিল পার্টি অফিসে। বিনিময়ে ঝুপড়ি ভাঙবে না কথা দিয়েছে এলাকার দাদা। দপদপ করতে থাকে ব্রিজের নিচের নিওন আলো। নীল-সাদা ফ্লাইওভারে ধুলো উড়িয়ে বাড়তে থাকে কিছু বিলাসবহুল গাড়ির দীর্ঘশ্বাস।

চিংড়িহাটার সিগন্যালে দাঁড়িয়ে একটা ‘মানুষ’, গাড়ির কালো কাচে জ্বলজ্বল করে যার প্রতিবিম্ব। ব্যস্ত সন্ধেয় মাঝেমাঝে সাগিনা ভাবে এটুকুই কী তার পরিচয় হতে পারে না? সবাই খালি ছুড়ে দেয় কিছু নোংরা শব্দ। কেউ বলে ‘হিজড়ে’, কেউ বলে ‘ছক্কা’, কেউ মুখের ওপর তুলে দেয় জানলার কালো কাচ। যদিও জীবনটা এমন হবে, সে কখনও ভাবেনি। মাধ্যমিক অবধি পড়াশোনা করেছিল। কিন্তু আজ সে ঠিকানাহীন। পেটের দায় যে বড় নিষ্ঠুর। হঠাৎ আনমনা সাগিনার চমক ভাঙে। সামনের ঝাঁ-চকচকে গাড়ির কালো কাচ নেমে, ভেসে ওঠে এক শিশুর মুখাবয়ব। ছোট্ট শরীরে নীল ঢোলা জার্সি। হাত বাড়িয়ে একটা ছোট্ট তেরঙ্গা সাগিনার হাতে ধরায় সে। মুখ ফুটে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই সিগন্যাল খুলে যায়। হুস করে বেরিয়ে যায় গাড়িটা। তাড়াহুড়োয় একঝলক দেখা যায় জার্সিটার পিছন দিক, সংখ্যাটা ১১।

Sunil Chhetri Looks Back on 15 Years in International Football: 'I Am Very Fortunate' - News18
সুনীল ছেত্রী

মেট্রোর জন্য মুখ কালো করে ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষারত এক যুবক। ফরমাল শার্টের গলার বোতামটা খানিক আলগা করে অনিরুদ্ধ। এখনও শিকে ছেঁড়েনি ভাগ্যের। কেউ বলেছে ডেস্কে সিভি জমা দিতে, কেউ বা ধরিয়েছে এইচআরের মেইল আইডি। লিঙ্কড ইন চেক করতে করতেই কানে এল গমগমে যুবভারতীর গর্জন। আজ খেলাটা দেখতে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছা ছিল তার। কিন্তু টিকিট ব্ল্যাকে কেনার সাধ্যি নেই। দুটো পয়সা বাঁচলেও তার কাছে এই মুহূর্তে অনেক। অগত্যা পকেট থেকে ফোনটা বের করল সে। আজ সুনীল ছেত্রীর শেষ ম্যাচ।

কতগুলো বছর কেটে গেল। খোঁচা খোঁচা চুলের ছেলেটার নীল জার্সি গায়ে চাপানো থেকে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে পরিসমাপ্তির এক স্বর্ণোজ্জ্বল আখ্যান। ১৯ বছরের পথ চলা। সঙ্গে চলেছে আসমুদ্রহিমাচল একটুকরো ভূখণ্ড। মাঝে কতকিছু বদলেছে। টাইপ ফোন পুরোপুরি অতীত। স্মার্ট হয়েছে দুনিয়া। স্মার্ট হয়েছে দেশ। স্মার্ট দেশে ভোটের আগে অনুষ্ঠিত হয়েছে জি-২০ অধিবেশন। প্রবল পরাক্রমশালী রাষ্ট্রনেতারা বার্তা দিয়েছে দেশ উন্নতির। সেই দেশেই দলিত ‘অপরাধ’-এ পিটিয়ে মারাও চলছে সমান্তরালে। এহেন পল্টু, সাগিনা কিংবা অনিরুদ্ধর ভারত, যা কোনও দিনও ফুটবল খেলিয়ে দেশগুলির কাছে পরিচিত নাম নয়, সেই ক্ষুদ্র ভূখণ্ডেরই এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের নাম সুনীল ছেত্রী। এক বহমান ইতিহাস। ১৯ বছরের অধ্যবসায় সঙ্গে করে সবুজ গালিচাকে বিদায় জানালেন আধুনিক ভারতীয় ফুটবলের এক ঋষি। মনে পড়ে যায় শুরুর দিনগুলো।

Sunil Chhetri's Last Match – An Unprecedented Au Revoir for an Unparalleled Icon
সুনীল ছেত্রী: ভারতীয় ফুটবলের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক

যারা নয়ের দশকের শেষের দিকে বেড়ে উঠেছে, তাঁদের কাছে মনখারাপে একাকী ছাদ, চন্দ্রবিন্দু আর রাতজাগা এল ক্লাসিকো ছাড়াও আবেগের আরেক নাম ছিল কলকাতা ডার্বি। বাবার হাত ধরে প্রথম মাঠে যাওয়া। জিভ আঠা হয়ে যাওয়া তেলচিটে প্যাটিস। মাঠের বাইরে গালে আঙুল বুলিয়ে লাল-হলুদ দাগের এক অনাবিল আনন্দ। বাবা গল্প বলতেন, কৃশানু এই মাঠের এক লাগামহীন ঘোড়া। টগবগে। যেমনটা ছিলেন মজিদ বাসকার, তুলসীদাস বলরাম, পরিমল দে। আক্ষেপও ছিল গলায়। বাইচুং-বিজয়ন পরবর্তী যুগে আর সেই দেশীয় প্রতিভা কোথায়!

ঠিক সেখান থেকেই শুরুটা হয়েছিল, সবার অলক্ষ্যে, কালের নিয়মে নিতান্তই স্বাভাবিক গতিতে। ২০০২-তে মোহনবাগান তাঁবুতে শুরু পথচলা। কিন্তু কাগজের পিছন পাতার হেডলাইন বা বাংলার ফুটবলপ্রেমীদের মনে স্থান নিয়েছে আরও পরে। তখনও সুব্রত ভট্টাচাৰ্য, সুখবিন্দর সিং বা বব হাউটনের মতো প্রথিতযশা জহুরিরা হিরে কাটাইয়ে ব্যস্ত। যাঁর দ্যুতি ছড়াতে শুরু করেছে সদ্য। নেহরু কাপের সেই চোখধাঁধানো পারফরম্যান্স ঘোষণা করেছিল এই ছেলে ভারতীয় ফুটবলে বিপ্লব আনবে। সত্যি হয়েছিল সেই সম্ভাবনা। কিন্তু কোনও দিন কি মনের মণিকোঠায় জায়গা পেয়েছিল সে! চৈত্র-শেষের মেলায় কেউ একবারও খুঁজে দেখেছিল শচীন-মেসিদের বাদ দিয়ে সুনীলের পোস্টার? টেস্ট পেপারের মধ্যিখানে সযত্নে কী কখনও ঠাঁই পেয়েছিল পুরোনো কাগজের কাটিং? কোনও এক গ্রীষ্মের তপ্ত অপরাহ্নে পশ্চিম আকাশ কালো করে আসা কালবৈশাখীর আগে কেউ কি সবুজ মাঠে বল পায়ে ছেত্রী হতে চেয়েছিল?

………………………………………………………………

ক্রিকেটধর্মে দীক্ষিত এক দেশে সবার অলক্ষ্যেই ভারতীয় ফুটবল-তরীর নাবিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন সুনীল। টানতে থাকেন ধুঁকতে থাকা দলকে। ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে ক্রমাগত অবনমিত এক ঘুমন্ত দৈত্যকে তুলে আনেন প্রথম ১০০-র দোরগোড়ায়। যে ভারত কি না স্বপ্ন দেখে বিশ্বকাপ খেলার। তিনি এই অসম যুদ্ধে কতটা সফল, তা নিয়ে কাটাছেঁড়া চললেও সুনীলের প্রচেষ্টার উদযাপনে কসুর করেনি ভারতীয় ফুটবলপ্রেমীরা।

………………………………………………………………

সেই জায়গাতেই সুনীল আলাদা। আলাদা ভারতীয় ফুটবলে। ক্রিকেটধর্মে দীক্ষিত এক দেশে সবার অলক্ষ্যেই ভারতীয় ফুটবল-তরির নাবিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন সুনীল। টানতে থাকেন ধুঁকতে থাকা দলকে। ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে ক্রমাগত অবনমিত এক ঘুমন্ত দৈত্যকে তুলে আনেন প্রথম ১০০-র দোরগোড়ায়। যে ভারত কি না স্বপ্ন দেখে বিশ্বকাপ খেলার। তিনি এই অসম যুদ্ধে কতটা সফল, তা নিয়ে কাটাছেঁড়া চললেও সুনীলের প্রচেষ্টার উদযাপনে কসুর করেনি ভারতীয় ফুটবলপ্রেমীরা।

Watch: Sunil Chhetri breaks down as India teammates give him guard of honour after farewell game – Firstpost
যুবভারতীতে বিদায়ী ম্যাচে সুনীল

শুধু কি এইটুকু? মেসি রোনাল্ডোর সঙ্গে একই পোডিয়ামে আসা একমাত্র ভারতীয় কিংবদন্তি তিনি। কিন্তু ওই যে, বাহুল্যর পরোয়া করেননি কখনও। বরাবরই তিনি ঋষির মতো উদাসীন, আড়ম্বরহীন। হঠাৎই এক সাড়ে নয় মিনিটের ভিডিওবার্তা। গোটা দেশ জানল, শেষবার মাঠে নামতে চলেছে ১১ নম্বর নীল জার্সি। সেই জার্সির মালিক, যিনি কি না দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা কুস্তিগিরদের প্রতিবাদ নিয়ে মুখ খুলেছিলেন। রাষ্ট্রের কাছে চেয়েছিলেন দ্রুত সমাধান। রাষ্ট্র কর্ণপাত করেনি বিশেষ। তবুও সুনীল অবিচল, স্থিতধী। মাঠের মতো মাঠের বাইরেও। তাই তো অভিভাবকের মতো আগলে রাখেন সতীর্থ জিকসন সিং-কে, যিনি সাফ কাপ জিতে নিজের জন্মভূমি মণিপুরে শান্তি প্রার্থনা করলে প্রবল আক্রমণ ধেয়ে আসে সোশাল মিডিয়ায়। ট্রোলের বন্যা বয়ে যায় এই পোড়া দেশে।

সুনীল মিশে যান দলে, মিশে যান দেশে। যে দেশ হাজারও সমস্যায় জর্জরিত। সোনার ফসল ফলানো কৃষকরা দীর্ঘদিন বসে অসহায় দিন গুনেছে রাস্তায়। কখনও খেয়েছে লাঠির বাড়ি, কখনও বা জলকামান। কাউকে মারা হচ্ছে ধর্মের নামে। বুলডোজার চালিয়ে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে সন্তানসম্ভবা মায়ের ঝুপড়ি, বদলে তৈরি হচ্ছে ধর্মের আখড়া। অসহায় মায়ের বুকফাটা কান্নায় চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করেছে রাষ্ট্র।

………………………………………………………..

আরও পড়ুন সুনীল ছেত্রীকে নিয়ে লেখা: চুনী-পিকের মতো ভারতীয় ফুটবলকে সমৃদ্ধ করেছে সুনীল

………………………………………………………..

তবু তো তারা মুক্তি চায়। অশ্রুস্নাত চোখে স্বপ্ন দেখে। যেভাবে সুনীল স্বপ্ন দেখেছিলেন বিশ্বকাপ খেলার। যে স্বপ্ন পল্টু দেখে পায়ে ফুটবল পেলে। যেভাবে ঘুম থেকে উঠে আবার কাজে বেরোনোর ভরসা পায় সাগিনা। যেভাবে চাকরির আশায় আরেকবার ফরমাল শার্টটা কোমরে গোঁজে অনিরুদ্ধ। সব শট তেকাঠিতে ঢোকে না। কিছু জাল ছুঁয়ে বাইরে চলে যায়। যাতে স্বাক্ষর থাকে ঘাম আর রক্তের। ওরা সবাই সেদিন না থেকেও ষাট হাজারি যুবভারতীতে ছিল। তেকাঠির বাইরে ছিল। ছিল ওদের হার না মানা লড়াই। আর ছিল ঝাপসা হয়ে আসা কতিপয় চোখ। যে চোখ ম্যাচ শেষে সুনীলের, যে চোখ ১৪০ কোটির।

শুভ জন্মদিন কিংবদন্তি। অবসরের অবকাশে পায়ে পায়ে এখন ৪০। যদিও একেবারেই চালশে নয়। ধুঁকতে থাকা উপমহাদেশীয় ফুটবলকে মেসি-রোনাল্ডোর সমতুল্য মঞ্চে দাঁড় করানোর একক কান্ডারি। ক্রিকেট ধর্মে দীক্ষিত এক দেশে দ্য বিউটিফুল গেমের দু’দশকের পতাকাবাহক। একুশ শতকে ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম পোস্টার বয়। তেকাঠির বাইরে যখন কোনও বুলেটবিদ্ধ উপত্যকায় শৈশব, প্রথমবার বিস্ময় গোলকে পা ছোঁয়াবে কিংবা অগ্নিগর্ভ উত্তর-পূর্ব ভারতে কোনও যুবক ফুটবলকে নিজের পেশা হিসাবে বেছে নেওয়ার স্বপ্ন দেখবে, তারা একবার হলেও আপনাকে স্মরণ করবে। তেকাঠির বাইরে আপনি থেকে যাবেন জন-গণ-মন-র অধিনায়ক হয়ে।

………………………………………………………………

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

………………………………………………………………