চাঁদ রাতের মোড়কে জড়িয়ে থাকা এমন এক বহু যুগের প্রতীক যা আসলে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে দেখে যায়। কিছু গ্রামবাংলার লোকাচারে জড়িয়ে আছে চাঁদের আলোয় নিজের ছায়া দেখে ফেলার অনুষঙ্গ; চাঁদের আলোয় বাড়ি ফেরার সময় পিছন থেকে কেউ ডাকলে ফিরে না-তাকানোর নিদান; কিংবা চাঁদের আলোয় বিশেষ বিশেষ গাছের নীচ দিয়ে না-যাওয়ার পরামর্শ। চাঁদনি রাতের সঙ্গে ভারতের অন্যান্য প্রদেশে চুড়েলের আবির্ভাবের কথা বলা হয়। কখনও খুঁজে দেখলে প্রচলিত এই সব গল্পই আসলে এক অর্থে ‘রিটার্ন অফ দ্য রিপ্রেসড’।
‘সেই সময় চাঁদের আলো বেরোলো মেঘ ফুটে। দাদাশ্বশুরের ঘড়ি দেখালে গোলাকার মুখটার ডৌল। চাঁদমুখটি যেন তার খিটখিটে বৌ-র। গুলবাহারি শাড়ির ঘোমটা– দুটো কালো চোখ পুট-পুটে।’
অবন ঠাকুরের ‘দাদাশ্বশুরের ঘড়ি’ গল্পের শেষে চাঁদের আলো একটা ঘড়ির ওপরে রাখা নতুন শাড়ির ওপর এসে পড়ায়, সামগ্রিকভাবে মনের গহীন জটিল বিন্যাসেরই আলোছায়ার খেলা হয়েছে। জমাট বেঁধে থাকা একটা অন্ধকার সময় যেন মৃদু চাঁদের আলোয় বাইরে আসতে চেয়েও পুরোটা প্রকাশ হতে পারে না। নতুনভাবে জীবন শুরু করার কথা ভাবলেও ঘড়ির ওপর রাখা নতুন শাড়ি অচিরেই যেন মৃতা স্ত্রীকে নববধূর বেশে দেখায়।
সাহিত্যকর্ম বা চলচ্চিত্রে অতিপ্রাকৃত অস্তিত্বের সঙ্গে চাঁদের সম্পর্ক বারেবারেই দেখানো হয়। তন্ত্রসাধনার ক্ষেত্রেও চাঁদের অবস্থানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ওয়ারউল্ফের মতো প্রাণঘাতী অশুভ শক্তির কর্মক্ষমতার সঙ্গে যোগ রয়েছে চাঁদের। বাংলা তথা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সর্বত্রই চাঁদ হয়ে উঠেছে রাতের প্রতিনিধি। যেন রাতের সকল অশুভ কাজের, সমস্ত গতিবিধি আর ষড়যন্ত্রের নীরব দর্শক সে। বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘The Others’- এ (২০০১) আমরা দেখতে পাই আনে আর নিকোলাস নামের দুই বাচ্চাকে– যারা আলোর প্রতি বড় বেশি স্পর্শকাতর। আর পূর্ণিমার রাত কোথাও নিয়ে আসে নতুন কোনও উপস্থিতির সঙ্কেত।
আলো আর অন্ধকার পরস্পর ভাগ করে নেয় বিভিন্ন ভয় পাওয়া-না-পাওয়ার দৃশ্যকল্প। চোখের সামনে যে অন্ধকার ভয় হয়ে দেখা দেয় তাকেই জয় করে নেওয়ার রূপক হয়ে ওঠে আলো। অন্ধকার তাও একরকম। কিন্তু আলোর অনেক প্রকারভেদ– কোথাও উচ্চকিত আবার কোথাও বা মৃদু উদ্ভাস। কোথাও বিদ্যুৎ বয়ে আনা আলো আবার কোথাও বা শহুরে আকাশে চাঁদ খুঁজে না-পাওয়ার আক্ষেপ। যুগে যুগে কালে কালে আলো আর আঁধার হয়ে ওঠে মনের জটিল বিন্যাসের প্রতিচ্ছবি। রাতের সঙ্গে যেমন অন্ধকারের সম্পর্ক, তেমন অন্ধকারের সঙ্গে ভয়ের সম্পর্ক ছিল। ক্রমে বিদ্যুতের প্রভাবে প্রায় দূর হয়ে যাওয়া অন্ধকার– আলোর মধ্যেই ভয়ের বাতাবরণকে আরও প্রতিষ্ঠিত করেছে।
অন্ধকার প্ল্যাটফর্মের মতোই ভূতের গল্পের প্লট নিওন আলো-ঘেরা বাইপাস বা ঝলমলে শপিং মলেও হতে পারে। আর সেই সূত্র ধরেই কেবল অমাবস্যা নয়, ভয়ের আবহ তৈরি করতে পূর্ণিমাও পারদর্শী। লোকবিশ্বাস অনুসারে চাঁদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে বিভিন্ন অতিপ্রাকৃতিক ধারণা। ‘নব চন্দ্র’, ‘বৃদ্ধি চন্দ্র’, ‘পূর্ণিমা’, ‘হ্রাসমান চন্দ্র’, ‘অমাবস্যা’ প্রভৃতি বিভিন্ন আকার আকৃতি ও অবস্থান অনুসারে চাঁদের নামকরণ হয় এখানকার সংস্কৃতিতে। এছাড়াও পাশ্চাত্যের ‘ব্লাড মুন’ এখানে ‘লোহিত চন্দ্র’ নামে পরিচিত। পৃথক পৃথক চাঁদের অবস্থান ও আকৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা লোকবিশ্বাস অনুসারে ‘নব চন্দ্র’ সাধারণত তার ছায়ায় লুকিয়ে রাখে অলৌকিক অস্তিত্বদের। বিভিন্ন সংস্কৃতিতে ‘পূর্ণিমা’ বা চন্দ্রের পূর্ণ পর্যায়কে নিয়ে এমন বিশ্বাস রয়েছে যে, ভূত এবং প্রেতাত্মারা এই দিনে সবথেকে বেশি সক্রিয় থাকে। পাশ্চাত্যে কিছু প্রাচীন মিথের দাবি– পূর্ণিমার সঙ্গে সঙ্গে পোলটারজাইস্ট তার কার্যক্রম শুরু করে। অবর্ণনীয় শব্দ শুনতে পাওয়া বা কোনও বস্তু স্থানান্তরিত হওয়া– এরকম বিভিন্ন ঘটনা পোলটারজাইস্টরা ঘটিয়ে থাকে।
বিপরীতে চন্দ্রালোকের অনুপস্থিতি বা ‘অমাবস্যা’ আমাদের এখানকার সংস্কৃতিতে বিভিন্ন অপশক্তির উত্থান নিয়ে বললেও, পাশ্চাত্যে তা অধিকাংশ সময়েই অলৌকিক কাজকর্ম হ্রাস পাওয়ার কথা বলে। কারণ চাঁদের আলোর সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক জড়িয়ে থাকে এদের। এর পাশাপাশি থাকে যথারীতি ভয়-ভাবনার বিস্তার অর্থাৎ মনের কেন্দ্রবিন্দুতে কিছু সমীকরণের চাপান-উতোর।
‘চন্দ্রাহত’ বা ‘লুনাটিক’ ইত্যাদি শব্দবন্ধের সঙ্গে আমরা পরিচিত। চাঁদের আলোয় হ্যালুশিনেসন হওয়ার কথাও জানা যায়। বিভিন্ন মনোবিকলন এভাবেই নানান মানুষের মধ্যে দেখা দিলে তা-ই প্রতিভাত হয়ে ওঠে অতিপ্রাকৃতিকতার মোড়কে। চাঁদ রাতের মোড়কে জড়িয়ে থাকা এমন এক বহু যুগের প্রতীক যা আসলে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে দেখে যায়। কিছু গ্রামবাংলার লোকাচারে জড়িয়ে আছে চাঁদের আলোয় নিজের ছায়া দেখে ফেলার অনুষঙ্গ; চাঁদের আলোয় বাড়ি ফেরার সময় পিছন থেকে কেউ ডাকলে ফিরে না-তাকানোর নিদান; কিংবা চাঁদের আলোয় বিশেষ বিশেষ গাছের নীচ দিয়ে না-যাওয়ার পরামর্শ। চাঁদনি রাতের সঙ্গে ভারতের অন্যান্য প্রদেশে চুড়েলের আবির্ভাবের কথা বলা হয়। কখনও খুঁজে দেখলে প্রচলিত এই সব গল্পই আসলে এক অর্থে ‘রিটার্ন অফ দ্য রিপ্রেসড’।
এখনকার মতো গ্লো-সাইন বোর্ডে যখন ঢেকে যায়নি মফস্সল– তখন লোডশেডিং মানে ছিল চাঁদের আলোর একক মঞ্চ। ঝলমলে জ্যোৎস্না হলে তো কথাই নেই, না-হলেও একফালি চাঁদ শোভা পেত আরও অনেকটা আলো নিয়ে। আড্ডা আর প্রতিদিনের কাজের মাঝে সেদিন আচমকাই শোরগোল। আকাশ জুড়ে যেন গলে গলে ঝরে পড়ছে চাঁদের আলো। সারা পাড়া জড়ো হয়েছিল রিমলিদিদের বাড়ি। অনেকক্ষণ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে সেই রাতে গলায় ওড়নার ফাঁস দিয়েছিল রিমলিদি।
দরজা ভাঙার পর যারা ভিতরে যায় দেখতে পেয়েছিল– বদলে যাওয়া রিমলিদির মুখে চাঁদের আলো ছিটকে ছিটকে যাচ্ছে। শরীরটা দোলার জন্য একবার করে চাঁদ ছুঁয়ে যাচ্ছিল, আর একবার অন্ধকার। যারা দেখেছিল তাদের চোখে অনেকদিন থেকে গেছিল সেই দৃশ্য। জানলার এক চিলতে ফাঁক দিয়ে আসা চাঁদের আলো তখন সাক্ষাৎ মৃত্যুকে ছুঁয়ে আছে।
অনেকদিন বা বলা ভালো চিরদিনই ওই বাড়ির ছোট ছেলেটার কাছে চাঁদের আলো তাই একরকম ভয়ের স্মৃতি যেন ফিরিয়ে ফিরিয়ে দেয়। চাঁদের আলোর গন্ধ পায় ও, রিমলিদির পারফিউমের মতন।