সুন্দরবনের গোসাবা, কুলতলী, বাসন্তী, হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকগুলিতে বাঘের আক্রমণে নিহত ব্যক্তিদের বিধবাদের খুঁজে পেতে খুব বেশি গবেষণার প্রয়োজন হয় না। প্রায় সব জঙ্গলঘেঁষা গ্রামেই বেশ কয়েকজন করে এমন মানুষের সন্ধান মেলে। অনেকেই এঁদের মর্মান্তিক জীবন নিয়ে জানতে আগ্রহী। তবে পর্যটকদের গ্রাম দেখানোর নাম করে বেশ কিছু সংস্থা ইদানীং ‘বাঘ-বিধবা’ দেখানোর বিজ্ঞাপনী ফাঁদ পাতছেন, লোক দেখানো সামান্য কিছু ত্রাণ সামগ্রী তাঁদের হাতে তুলে দিয়ে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে ‘সমাজসেবী’ হয়ে ওঠার সুযোগ করে দিচ্ছেন।
পলাশির যুদ্ধে জয়লাভের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা শাসনের দায়িত্ব পেল। শাসনভার পেয়ে তারা প্রথমেই অঞ্চলটির একটি মানচিত্র তৈরি করার পরিকল্পনা নিল। ডাক পড়ল এক তরুণ সাহেবের, নাম জেমস রেনেল। তিনি কখনও পায়ে হেঁটে, কখনও নৌকায়, কখনও ঘোড়ায় চড়ে বহু পরিশ্রমে তৈরি করলেন ১০টি বিস্তারিত মানচিত্র। লন্ডনে ছাপা হওয়া সেই মানচিত্রই ‘বেঙ্গল অ্যাটলাস’ যেখানে প্রথমবার সুন্দরবন অঞ্চলের প্রামাণ্য মানচিত্র পাওয়া গেল। এখনও যদি আমরা ১৭৮০ সালে প্রকাশিত সেই মানচিত্র দেখি তাহলে দেখব সেখানে বঙ্গোপসাগর উপকূল থেকে কলকাতা পর্যন্ত অংশে ম্যানগ্রোভ গাছের চিহ্ন আঁকা আছে।
এই মানচিত্র হাতে পেয়ে ইংরেজরা বুঝল বাংলার সমুদ্র উপকূলবর্তী বিস্তৃর্ণ এলাকা জঙ্গলে ঢাকা রয়েছে এবং এখান থেকে রাজস্বলাভের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে, যদি না এখানে চাষাবাদের ব্যবস্থা করা যায়। ব-দ্বীপ অঞ্চলের এই বনভূমি অর্থাৎ সুন্দরবনে চাষাবাদ শুরু করার মূল অসুবিধা ছিল দু’টি– দিনে দু’বার লবণাক্ত জলের স্রোত এবং হিংস্র জন্তু, বিশেষত বাঘের উপস্থিতি।
লবণাক্ত জলের স্রোত আটকানোর জন্য তৈরি হতে লাগল বাঁধ এবং বাঘের প্রাদুর্ভাব কমানোর জন্য শুরু হল বাঘের সঙ্গে লড়াই। জঙ্গল পরিষ্কার করে জোয়ার-ভাটায় নিত্য জলের নিচে থাকা অঞ্চলকে উদ্ধারের জন্য আনা হল আদিবাসীদের, এলেন অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষও, বিশেষত যাঁদের আর্থিক অবস্থা স্থিতিশীল নয় তাঁরা বেঁচে থাকার জন্য খড়কুটো আশ্রয় করার মতো বেছে নিলেন এক অনিশ্চিত জীবন।
এখন ইংরেজ রাজত্ব নেই, বাঘ মারতে মারতে সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে সংখ্যাটা নেমে এসেছে শ’খানেকে, মাটির বাঁধ নানা পরিকল্পনার হাত ধরে তার রূপ বদল করেছে বহুবার তবু সুন্দরবন ঘেঁষা কয়েক লক্ষ মানুষের জীবনে ‘অনিশ্চয়তা’ শব্দটি রয়ে গিয়েছে একইভাবে।
সুন্দরবন ঘেঁষা গ্রামগুলিতে বসবাসকারী মানুষের সঙ্গে বাঘের সংঘাত এখনও অতি স্বাভাবিক ঘটনা। বাঘ-মানুষ সংঘাতের ঘটনাগুলিকে আজকের দিনের প্রেক্ষিতে আমরা দু’টি ভাগে ভাগ করতে পারি। প্রথমত, বাঘের লোকালয়ে প্রবেশ এবং দ্বিতীয়ত, মানুষের জঙ্গলে প্রবেশের পর বাঘের মুখোমুখি হওয়া।
………………………………………………………………
ব্যাঘ্র প্রকল্পে একদিকে যেমন বাঘের সুরক্ষার দিকে নজর দেওয়া হল তেমনই জঙ্গল-সংলগ্ন গ্রামগুলিতে ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে গড়ে তোলা গেল বাঘ সম্বন্ধে সচেতনতা। বাঘের গ্রামে ঢোকা বন্ধ করার জন্য নেওয়া হল নানা ব্যবস্থা। যার শেষতম নিদর্শন জাল দিয়ে গ্রামের উল্টোদিকের জঙ্গল ঘিরে রাখা। নানা ব্যবস্থা গ্রহণে সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়ে বাঘের অনুপ্রবেশ আগের তুলনায় কমলেও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। তবে বাঘ গ্রামে ঢুকলে তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা এখন আর ঘটে না। বনদপ্তরের কর্মীরাও যেমন তৎপর হয়েছেন তেমনই সচেতন হয়েছেন গ্রামবাসীরাও।
………………………………………………………………
ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ব্যাঘ্র প্রকল্প চালু হওয়ার আগে পর্যন্ত গ্রামের ভিতরে বাঘের প্রবেশ এবং তারপরের ঘটনাক্রম ছিল এরকম– গ্রামবাসীরা বাঘটিকে জঙ্গলের দিকে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করতেন, সেক্ষেত্রে বাঘের শারীরিক ক্ষতি, এমনকী, মৃত্যু পর্যন্ত হত প্রায়ই। পক্ষান্তরে গ্রামবাসীরাও অনেকেই বাঘের আক্রমণে আহত বা নিহত হতেন।
ব্যাঘ্র প্রকল্পে একদিকে যেমন বাঘের সুরক্ষার দিকে নজর দেওয়া হল তেমনই জঙ্গল-সংলগ্ন গ্রামগুলিতে ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে গড়ে তোলা গেল বাঘ সম্বন্ধে সচেতনতা। বাঘের গ্রামে ঢোকা বন্ধ করার জন্য নেওয়া হল নানা ব্যবস্থা। যার শেষতম নিদর্শন জাল দিয়ে গ্রামের উল্টোদিকের জঙ্গল ঘিরে রাখা। নানা ব্যবস্থা গ্রহণে সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়ে বাঘের অনুপ্রবেশ আগের তুলনায় কমলেও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। তবে বাঘ গ্রামে ঢুকলে তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা এখন আর ঘটে না। বনদপ্তরের কর্মীরাও যেমন তৎপর হয়েছেন তেমনই সচেতন হয়েছেন গ্রামবাসীরাও। আর শেষবার গ্রামে ঢুকে সুন্দরবনের বাঘের মানুষ মারার ঘটনা ঘটেছিল সামশেরনগর গ্রামে। দাওয়ায় বসে পড়াশোনা করছিল কিশোরী রূপালী বাউরি, অতর্কিতে বাঘ এসে তাকে তুলে নিয়ে যায়। সে প্রায় চার দশক আগের ঘটনা। তারপর থেকে সুন্দরবনের লোকালয়ে ঢুকে বাঘের মানুষ মারার ঘটনা ভারতীয় সুন্দরবনে ঘটেনি।
কিন্তু বাঘের জঙ্গলে ঢুকে বাঘের আক্রমণে মৃত্যুর ঘটনা এখনও নিয়মিতভাবে ঘটে চলেছে। কোভিড-পরবর্তী লকডাউনের দু’বছরে এভাবে মৃত্যুর পরিসংখ্যান একলাফে অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। এখনও সুন্দরবনের মানুষকে বাঘের জঙ্গলে জীবন বাজি রেখে ঢুকতে হচ্ছে কেন, সে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। গত এক দশকে যতজন সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন তাদের ৯০ শতাংশ মাছ-কাঁকড়া ধরতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। এঁদের অধিকাংশের কাছেই বৈধ অনুমতিপত্র ছিল না এবং এঁরা জঙ্গলের যে অংশে ঢোকা বনবিভাগের নির্দেশ অনুসারে নিষিদ্ধ সেখানে ঢুকে প্রাণ হারিয়েছেন। দুর্ঘটনাগুলির বিবরণ শুনলে বোঝা যায়, এইসব দলের সদস্য সংখ্যা তিন-চার জনের বেশি নয়। কোনও সময় এক পরিবারের বাবা-মা-ছেলেকেও নৌকো নিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়তে দেখা যায়। এইসব দল অনেকসময়ই বনবিভাগের জঙ্গল-ঘিরে রাখা জাল সরিয়ে বা কেটে গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করেন অল্প সময়ে বেশি মাছ-কাঁকড়া সংগ্রহের আশায়। ভাটার সময় কাদা মাটিতে নেমে কাঁকড়ার গর্ত থেকে শিক ( লোহার দণ্ড ) দিয়ে কাঁকড়া টেনে বের করার অসতর্ক মুহূর্তে সুন্দরবনের ক্ষিপ্র গতির বাঘের সামনে অসহায় আত্মসমর্পণ করতে হয়। হাইকোর্টের সাম্প্রতিক রায়ে বলা হয়েছে, জঙ্গলের যেকোনও অংশে বাঘের আক্রমণে মৃত ব্যক্তি পাঁচ লক্ষ টাকা আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাবেন। কিন্তু টাকা কখনই জীবনের বিকল্প হতে পারে না।
তাই জঙ্গলজীবী মানুষের বিকল্প জীবিকার কথা অবশ্যই ভাবতে হবে। জঙ্গলে মধু সংগ্রহে না গিয়ে গ্রামের মানুষদের বাক্সের মধু চাষে প্রশিক্ষিত ও উৎসাহিত করা যায় সহজেই। সে চেষ্টা শুরুও হয়েছে। এ সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু যে অঞ্চলগুলিতে সবচেয়ে প্রকট (সাতজেলিয়া, বালি, কুলতলি, দেউলবাড়ি, ঝড়খালি) সেইসব অঞ্চলে পর্যটনকে কেন্দ্র করে ব্যাপক বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করার সম্ভাবনা আছে। পর্যটনের সংজ্ঞা বদলেছে পৃথিবী জুড়ে। বহু মানুষ জঙ্গলঘেঁষা গ্রাম সুন্দরবনে গ্রামীণ পরিবেশে দু’রাত্রি কাটাতে আগ্রহী। জানতে আগ্রহী গ্রাম জীবন সম্পর্কে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাধারণ মানুষ ঘরে ঘরে ‘হোম স্টে’ খুলে দিব্যি সংসার চালাচ্ছেন। সুন্দরবনের দ্বীপে তা জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না কেন? আসলে সুন্দরবন ভ্রমণকে একচেটিয়াভাবে দখল করে রেখেছেন মুষ্টিমেয় কয়েকজন লঞ্চ মালিক। জল-জঙ্গল থাকায় বাইরে থেকে আসা মানুষ ভয় পেয়ে লঞ্চে চেপে বসেন এবং এক বাঁধাধরা গতে দু’রাত তিনদিন কাটিয়ে ঘরে ফেরেন। সামান্য কিছু টাকা আর সময় থাকলে যে গ্রাম সুন্দরবনের মধ্যে নিজে নিজেই ঘুরে বেড়ানো যায় গণপরিবহণে সেকথা এখনও অনেকেই জানেন না। সাতজেলিয়া বা বালিতে সাধারণ গৃহস্থ বাড়িতে একটি-দু’টি ঘরের ‘হোম স্টে’ চালু করলে পর্যটকের অভাব হবে না।
১৯৭০-এর দশকে সুন্দরবন ভ্রমণ শেষে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর জাদু গদ্যে অন্য অনেক কথার মধ্যে শুনিয়েছিলেন ‘বিধবা গ্রাম’-এর কথা। এখনও এই শব্দবন্ধটি ভেসে বেড়ায় সুন্দরবনের আনাচে-কানাচে। সুন্দরবনের গোসাবা, কুলতলী, বাসন্তী, হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকগুলিতে বাঘের আক্রমণে নিহত ব্যক্তিদের বিধবাদের খুঁজে পেতে খুব বেশি গবেষণার প্রয়োজন হয় না। প্রায় সব জঙ্গলঘেঁষা গ্রামেই বেশ কয়েকজন করে এমন মানুষের সন্ধান মেলে। অনেকেই এঁদের মর্মান্তিক জীবন নিয়ে জানতে আগ্রহী। তবে পর্যটকদের গ্রাম দেখানোর নাম করে বেশ কিছু সংস্থা ইদানীং ‘বাঘ-বিধবা’ দেখানোর বিজ্ঞাপনী ফাঁদ পাতছেন, লোক দেখানো সামান্য কিছু ত্রাণ-সামগ্রী তাঁদের হাতে তুলে দিয়ে, ছবি তুলে সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করে ‘সমাজসেবী’ হয়ে ওঠার সুযোগ করে দিচ্ছেন। সেটাও ঠিক নয়, যাঁরা অসহায় তাঁদের প্রতি সহমর্মী হওয়া আর তাঁদের বিপন্নতাকে পণ্য করে তোলা এক কথা নয়।
…………………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………………………
বিকল্প জীবিকাই এই মৃত্যু মিছিল পুরোপুরি আটকাতে পারবে এমন নয়। যেসব গ্রামে এই ধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে সেখানে ব্যাপক সতর্কতামূলক প্রচার এবং জঙ্গলে অবৈধভাবে প্রবেশ করলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা থাকা দরকার। একথা মাথায় রাখতে হবে সুন্দরবনকে ঘিরে বসবাসকারী কয়েক লক্ষ মানুষের যেমন সুস্থভাবে বাঁচার ব্যবস্থা করতে হবে তেমনই বাঁচিয়ে রাখতে হবে সুন্দরবনকে এবং সুন্দরবনের অতন্দ্র প্রহরী রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে।
………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন ডোরাকাটা-র অন্যান্য পর্ব
শুভঙ্কর দাস-এর লেখা: বাংলায় বিলুপ্তির পথে বাঘ-পুতুলের শিল্পধারা
তন্ময় ভট্টাচার্য-এর লেখা: বাংলা কবিতায় বাঘ ইতিমধ্যেই চিরস্থায়ী