আমার খুব দুর্ভাগ্য যে, এইরকম তুলসী চক্রবর্তীর মতো একজন শিল্পীর সমসময়ে জন্মাইনি। যদি জন্মাতাম, তাহলে তাঁর সঙ্গে যদি এককলিও অভিনয় করতে পারতাম, নিজেকে ধন্য মনে করতাম। বলতে কোনও দ্বিধা নেই, তুলসী চক্রবর্তীকে আমি শিক্ষক, শিক্ষাগুরু হিসাবে মানি। তাঁর পথ ধরে অভিনয় করার চেষ্টা করে যাই। কিছুই করতে পারি না। নখাগ্রটুকুও আমি ছুঁতে পারিনি, কিন্তু তার কিয়দংশটুকুও যদি করে থাকি, যদি মানুষের মনে হয়ে থাকে খরাজ অন্তত একটা উত্তরসূরি হিসাবে কাজ করছেন, তাহলেই বুঝতে হবে যে, ওঁর আশীর্বাদ আমাদের মাথার ওপরে আছে।
আমাকে অনেকে বলেন, অমুক বিদেশি ছবিটা দেখুন। তমুকের অভিনয় দেখুন। আমি বলি, বাংলা ছবিতে যে সমস্ত বড় অভিনেতা অভিনয় করছেন, তাঁদের অভিনয় দেখেই এখনও শেষ করতে পারলাম না! এরপর তো আরও সমস্ত বড় বড় অভিনেতা-অভিনেত্রী যাঁরা আছেন বিদেশের, তাঁদেরকে দেখব। এই যে অভিনেতাদের কথা বলি, বাংলার অভিনেতা, তাঁদের মধ্যে তুলসী চক্রবর্তী অন্যতম। ওঁরা যখন অভিনয় করেছেন, যে সমস্ত চরিত্রে অভিনয় করছেন, তাঁরা যেরকম মগ্ন ছিলেন, সেই মগ্নতার স্বীকৃতি কি তাঁরা পেলেন কি? না। পাননি। কিছু বাঙালি দর্শকের কাছে তাঁরা স্বীকৃতি পেয়েছেন। আর্থিকভাবে কতখানি স্বাচ্ছন্দ্য তাঁরা পেয়েছিলেন? সেভাবে কিছুই না। মনে রাখতে হবে, বাংলা সিনেমায় প্রযুক্তিগত আধুনিকতার ঢের আগে এসে পড়েছিলেন তুলসী চক্রবর্তীরা। আজকের আধুনিক বাংলা সিনেমাতেও সেই মাপের কাউকে পাওয়া দুষ্কর হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
সত্যজিৎবাবুর সিনেমায় অভিনয়ের জন্য একটা রেমুনারেশন পাঠানো হয়েছিল তুলসী চক্রবর্তীর কাছে। তিনি যে রেমুনারেশন পেয়ে এসেছিলেন এতকাল, দেখলেন এইবারে রেমুনারেশনের টাকা অনেকটাই বেশি। তিনি বলেছিলেন, ‘এটা আমার খাম নয়, ফেরত দিয়ে দাও। উনি বোধহয় ভুল করে অন্য কারওর খাম আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন।’ সত্যজিৎবাবু একথা শোনার পর বলেছিলেন, “না, তুলসীবাবুকে ব’লো আজ থেকে আমি এটাই ওঁর মাইনে করে দিলাম।” একথা জানার পর গাছতলায় বসে গরমের মধ্যে শুটিংয়ের শেষে তুলসী চক্রবর্তী ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিলেন।
একজন শিল্পী সামান্য উপার্জনে অক্লেশে পরিশ্রম করে গিয়েছেন দিনের পর দিন। তাঁর চরিত্রগুলো সাধনার মতো। এমন নয় যে এক-দুটো। বহু– একের পর এক। অভিনয়ের প্রতি আত্মনিমগ্ন হয়ে। সেটা শুধুই প্রশংসাযোগ্য নয়, তা শিক্ষণীয়ও বটে। কিছুদিন আগে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলছিলেন যে, ‘একটাই মেকআপ রুমে শিল্পীরা একসঙ্গে বসতাম। সেখানে পাহাড়িদা, সেখানে ছবিদা, সেখানে তুলসীদা এবং আরও অনেকে ছিলেন। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হত। খেলাধুলো, সাহিত্য, রাজনীতি– নানানরকম। তোমাদের এখনকার যেমন পরচর্চা, পরনিন্দা, তার চেয়েও বেশি হত আমাদের সময়। যে ছবিতে আমরা অভিনয় করছি, তার সাহিত্য নিয়েও কথা হল। এবং অবশ্যই অভিনয় নিয়ে, অভিনয়চর্চা নিয়ে। আমরা এভাবেই আস্তে আস্তে বর্ধিত হতাম।’
এখন দেখুন। এখনকার যে বড় হওয়া, একজন বড় শিল্পীর প্রথম কন্ডিশন হল আলাদা একটা মেকআপ রুম দিতে হবে। এবং সেই মেকআপ রুমে সে একা থাকবে। সে যে নামকরা একজন শিল্পী– এছাড়া যেন প্রমাণ হবে না। আর সৌমিত্রদা বলতেন, ‘কোনও শিল্পীকে যদি একা করে দেওয়া হত, বোঝা যেত যে, ডিরেক্টর তাঁকে শাস্তি দিয়েছেন। কারণ এ বড্ড বেশি আড্ডা দিয়ে ফ্লোরে আসতে দেরি করে, সেজন্য! তোমাদের সঙ্গে আমাদের ডিফারেন্সই হল এটা।’
আমার খুব দুর্ভাগ্য যে, এইরকম একজন শিল্পীর সমসময়ে আমি জন্মাইনি। যদি জন্মাতাম, তাহলে তাঁর সঙ্গে যদি এককলিও অভিনয় করতে পারতাম, নিজেকে ধন্য মনে করতাম। বলতে কোনও দ্বিধা নেই, তুলসী চক্রবর্তীকে আমি শিক্ষক, শিক্ষাগুরু হিসাবে মানি। তাঁর পথ ধরে অভিনয় করার চেষ্টা করে যাই। কিছুই করতে পারি না। নখাগ্রটুকুও আমি ছুঁতে পারিনি, কিন্তু তার কিয়দংশটুকুও যদি করে থাকি, যদি মানুষের মনে হয়ে থাকে খরাজ অন্তত একটা উত্তরসূরি হিসাবে কাজ করছেন, তাহলেই বুঝতে হবে যে, ওঁর আশীর্বাদ আমাদের মাথার ওপরে আছে।
তুলসী চক্রবর্তীর মতো এক উজ্জ্বল নক্ষত্র বাংলা সিনেমাপাড়ায় ছিলেন। ছিলেন এবং থাকবেনও। কোনও দিন তাঁর ঔজ্জ্বল্য এবং উপস্থিতি ধূসর হবে না। সাদা-কালো ছবির যুগের মানুষ ছিলেন কিন্তু ছিলেন আদ্যন্ত রঙিন। এখন রঙিন ছবির সঙ্গে আমরা পরিচিত, কিন্তু আমরা তত রঙিন নই। মনে হয় না আগামী ১০০ বছরের মধ্যেও এরকম একজন শিল্পী আবার জন্ম নেবেন!
ওঁর অভিনীত ‘পরশপাথর’ আমার প্রিয়তম চরিত্র। অসামান্য চরিত্র– ওই বিস্ফারিত চোখদুটো! ওইরকম চরিত্র যদি আমি কোনও দিন করতে পারতাম, মনে করতাম, সত্যিই একটা ঠিকঠাক কাজ করেছি।