ভারভারা রাও যেন এক দীর্ঘ প্রাচীন তরু, যাঁর ডালপালা বহু দশক ধরে দেশের আকাশের সীমা ছাড়িয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে কারাবন্দি মানুষের জীবন ও বহু শহিদের মৃত্যুর বেদনার সঙ্গে নিজেকে অন্বিত করছে। তাঁর অসংখ্য কবিতার মধ্যে থেকে আটচল্লিশটি কবিতা নির্বাচন করে সম্পাদনা করেছেন এন. ভেনুগোপাল ও মীনা কন্দস্বামী। বইটির নাম– ‘ভারভারা রাও, আ লাইফ ইন পোয়েট্রি’। এই প্রথম সর্বভারতীয় পাঠকের কাছে পৌঁছল।
‘যদি তুমি আমার পকেট সার্চ করো,
তছনছ করো আমার টেবিলের বই আর কাগজ পত্র,
শেলফের ধাপগুলো,
আমার ফুলের মত পাঁজরকে ছিঁড়ে উন্মুক্ত করো,
কবিতা ছাড়া গোপনীয় কিছু পাবেনা।
আমার বিপজ্জনক স্বভাব,
যা তুমি বুঝতে পারোনা,
কবিতা তার গোপন কথা।’
কবিতা। ৩০ ডিসেম্বর, ১৯৮৭।
অনুবাদ: এন ভেনুগোপাল, বঙ্গানুবাদ: অনিতা অগ্নিহোত্রী
জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় যিনি কারার অন্তরালে কাটিয়েছেন, সেই ভারভারা রাওয়ের কবিতা বুঝতে গেলে তাঁর কারাবাসের ডায়েরি পড়া খুব জরুরি। দিনলিপির লেখাগুলি কবিতা ও গদ্যের সন্ধিস্থলে দাঁড়িয়ে। কবির নিজের মতে, তেলুগু ‘চম্পু’ ধারার অনুসরণে লেখা। কারাবাসের কালে লেখা আত্মজীবনীমূলক লেখার উদাহরণও কম নয়। তেলুগু-তে লেখা উন্নাভা লক্ষ্মীনারায়ণের উপন্যাস ‘মালাপালি’ থেকে জুলিয়াস ফুচিক, জর্জ জ্যাকসন, কোরিয়ান বিপ্লবী কিম চিন হা-র রচনা সবই কারাগারের অন্তরালে, বিরাট প্রতিকূলতার মধ্যে লেখা।
কেনিয়ার জেলে বসে টয়লেট পেপারে তাঁর উপন্যাস ‘ডেভিল অন দ্য ক্রস’ লিখেছিলেন যিনি, সেই গুগি ওয়া থিওংও (Ngugi wa Thiong’O) ভারভারা রাওয়ের লেখা ‘ক্যাপটিভ ইমাজিনেশন’ নামের কারাবাস ডায়েরির ভূমিকায় লিখেছেন, কল্পনাশক্তি ছাড়া শিল্প সৃষ্টি সম্ভব নয়। লেখক, গায়ক, ভাস্কর, শিল্পী মাত্রেই কল্পনার প্রতীক। আপাত-অসম্ভব পরিস্থিতির মধ্যেও সম্ভাবনার খোঁজে তাঁরা কল্পনার শক্তিকে আবাহন করেন। সেইজন্য, রাষ্ট্রশক্তি বারবার শিল্পীকে কারাগারে নিক্ষেপ করে, তার কল্পনাকে নিগড়ে বাঁধার জন্য। কিন্তু সাময়িক ও স্থানগত বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করার ক্ষমতা কল্পনার আছে। শৃঙ্খল ছিন্ন কল্পনা সময়ের মধ্যে ও স্থানিকতার বাইরে বিচরণ করতে সক্ষম। দীর্ঘ জীবনে বারবার কারাদণ্ড হয়েছে ভারভারা রাওয়ের। তিন বছর জেলে কাটানোর পর সংবাদপত্রে তাঁর জেল থেকে লেখা ডায়েরি প্রকাশিত হতে থাকে। তারপর কেটে গেছে আরও দুই দশক। তাঁর সংসার জীবন এগিয়ে চলেছে। ২০০৫-’০৬-এর কারাবাস কালে পৌত্র-পৌত্রীরা আসছে কবির সঙ্গে জেলে দেখা করতে। এর মধ্য দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের কল্পনাতেও কারার বাস্তব ও মুক্তির অভিলাষ জড়িয়ে যায়।
রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধের অভিযোগ তাঁর উপর বারবার আনা হলেও তাঁর কবিতায় কোনও ক্রোধ, তীব্র দাহ বা হিংসাত্মক মনোভাবের স্পর্শ নেই। রাষ্ট্রশক্তিকে আঘাত করার চেয়েও গভীরতর তাঁর মুক্তির চেতনা, যা রাষ্ট্রের উপস্থিতিকে অগ্রাহ্য করেই পল্লবিত হতে চায়। আছে এক মৃদু ও লঘু কথনভঙ্গি, সমবেদনা, প্রকৃতির প্রতি, প্রান্তিক মানুষের জন্য নিবিড় ভালোবাসা। ভারভারা রাও যেন এক দীর্ঘ প্রাচীন তরু, যাঁর ডালপালা বহু দশক ধরে দেশের আকাশের সীমা ছাড়িয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে কারাবন্দি মানুষের জীবন ও বহু শহিদের মৃত্যুর বেদনার সঙ্গে নিজেকে অন্বিত করছে। তাঁর অসংখ্য কবিতার মধ্যে থেকে আটচল্লিশটি কবিতা নির্বাচন করে সম্পাদনা করেছেন এন. ভেনুগোপাল ও মীনা কন্দস্বামী। বইটির নাম– ‘ভারভারা রাও, আ লাইফ ইন পোয়েট্রি’। এন. ভেনুগোপাল ছাড়াও রোহিথ, ডি. ভেঙ্কটরাও, কে. দামোদর রাও প্রমুখের অনুবাদে কবিতাগুলি এই প্রথম সর্বভারতীয় পাঠকের কাছে পৌঁছল।
অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে লেখা অসংখ্য কবিতার মধ্যে থেকে বেছে নেওয়া কবিতাগুলিতে লক্ষ করা যায় এক অবিচল আস্থা, সত্য ও মুক্তির আকিঞ্চনের প্রতি। যত সময় গেছে, বাস্তবে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক ঘটনাবলি ছায়া ফেলেছে কবিতায়, কিন্তু মানুষের চারণ কবি ভারভারা রাওয়ের কণ্ঠস্বরের মূল আবেগটি বদলায়নি। ১৯৭৪-এ লেখা ‘সব ঠিক হ্যায়’ কবিতায় তাঁর অনুকম্পা জেলের সেই রাতপ্রহরীর জন্য, যাকে নিদ্রাহীন, আশ্রয়হীন, জেলের চৌহদ্দিতে হেঁকে যেতে হয়, ‘সব ঠিক হ্যায়’। অথচ কোথায় সব ঠিক? দেশের লক্ষ মানুষের হৃদয়ে ভবিষ্যতের আশা মেঘের ভিতর বিদ্যুতের মতো জ্বলে, আর বন্দি-কবির শৃঙ্খলে বাজে তার স্বর। রাতের বাতাস বয়, কাঁটাতারে আটকা পড়ে থাকে চাঁদ, জেলের প্রাচীরের ওপারে। আর, বন্দিরা গান করে, কথা বলে, বিপ্লবের স্বপ্নে হারিয়ে ফেলে নিজেদের। মানুষের সংঘবদ্ধতার উপর কবির গভীর বিশ্বাস। মানুষ কখনও একা নয়। সমাজের ধাঁধার সে একটি টুকরো। সূর্যের কিরণে গড়া সে, সমুদ্রের ও মাটির আর্দ্রতা দিয়ে। তাই মানুষের মৃত্যু মাত্রেই বিচলিত করে কবিকে। মানুষের মৃত্যু হলে মানবতার কণ্ঠ রোধ হয়।
সাম্প্রতিক জেলবন্দি জীবনে মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের বিরাট অবনতির পর পরিবারের আবেদনে জামিন পেয়েছেন ভারভারা রাও। কিন্তু কোর্টের নির্দেশে, নিম্ন আদালতের এলাকার মধ্যেই থাকতে হচ্ছে কবিকে। মুম্বই শহরে তিনি ও তাঁর স্ত্রী নিজের ভাষায় কথা বলার সঙ্গী পান না, অচেনা পরিবেশ, নিস্পৃহ উদাসীন মহানগর। এ যেন আর এক কারাবাস। এন. ভেনুগোপাল বলছিলেন, মুম্বইয়ে তাঁর বইয়ের উন্মোচন অনুষ্ঠানে কোনও কথা বলেননি কবি, কেবল কয়েকটি কপিতে সই দিয়েছিলেন, তাতেও তদন্তকারী সংস্থা আপত্তি জানায়। আশি বছর বয়সেও ভগ্নস্বাস্থ্য মানুষটিকে এতটাই বিপজ্জনক মনে করা হয়, কারণ তাঁর স্বপ্ন ও কল্পনা এখনও অটুট। ভারভারা রাও কথা বলতে অনুমতি প্রাপ্ত হোন বা নাই হোন, তাঁর কবিতা-জীবনেও মানুষের জয়গাথা ধ্বনিত হতে থাকবে।
‘মাটিকে ভয়’ (অনুবাদ: এন ভেনুগোপাল) কবিতাটি আরম্ভ হয় এইভাবে–
‘হুমকির উপর হুমকি জড়ো করে,
ভয়ের পর ভয় ছড়িয়ে,
সে নিজেই ভয় পেয়ে গেল।’
১৯৮৫ সাল। তেলেঙ্গানাতে পুলিশ দিয়ে শহিদ বেদিগুলি ধ্বংস করানো হচ্ছিল। তার প্রতিক্রিয়ায় লেখা এই কবিতা শেষ হয় এখানে, এক নিষ্পাপ প্রশ্নে–
‘যেখানে কালই মানুষ হেঁটে চলে বেড়াচ্ছিল,
শহীদরা নিহত হল,
জেগে উঠল স্মৃতি স্তম্ভগুলি,
ভয় পেয়ে সে জমি করে দিল সমান সপাট,
কবরস্থান বানিয়ে দিল, আর, সশস্ত্র প্রহরা বসাল,
কিন্তু মাটি তো ওখানেই আছে, তাই না?
সেই মাটি কি বলবে?’