Robbar

বাঙালির হিন্দি বাজে? উত্তর একটাই: তং মত করো!

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 2, 2024 5:47 pm
  • Updated:December 2, 2024 8:32 pm  

একদিন বাজার গিয়ে মাছওয়ালাকে জামাইবাবুর নির্দেশ শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম, ‘মুড়ো মে থোরা মছলি রাখনা, অউর গাদা-পেটি আলাগ করকে কাটনা,পুরা মাছ কা পেটি মত বানা দেনা।’ আমি জামাইবাবুর দিকে তাকাতে উনি জানালেন যে, রাজস্থানিরা রুই মাছও ফিলে করে কেটে খায় কাঁটার জন্য, তাই এটা বলে দিতে হয়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটা কি হিন্দি বললেন? আপনি তো চল্লিশ বছর ধরে এই দেশে!’ জামাইবাবু নির্বিকার ভাবে বললেন, ‘ধুর! ও বুঝে গেলেই হল!’ সন্তোষ দত্তর জন্মশতবর্ষে বাঙালির ভুল হিন্দি বলা নিয়ে বিশেষ লেখা।

পিনাকী ভট্টাচার্য

এক মনীষী বলেছিলেন, ২০ মাইল অন্তর কথ্য বাংলা ভাষা বদলে যায়। এই ২০ মাইল অন্তর স্পিড-ব্রেকারে হোঁচট খেয়ে বাঙালির অন্য যে কোনও ভাষার প্রতি অনীহা আগে থেকেই তৈরি ছিল। কলকাতা দেশের রাজধানী হতে সেই অনীহাতে মলম পড়ল, কারণ বাইরের প্রদেশের লোকেরা কলকাতায় আসে পেটের তাগিদে, বাঙালি পারতপক্ষে বাইরে যায় না! যদি নিতান্তই পেশাগত কারণে যেতে হয়, ডাকযোগে ‘প্রবাসী’, ‘ভারতবর্ষ’ যদি না আসে, তাহলে সে বাঙালি থাকে না– বদলে গিয়েছে!

Santosh Dutta: মেলেনি যোগ্য সম্মান, বুকে চাপা হতাশা নিয়েই চলে গিয়েছিলেন 'জটায়ু' - legendary actor Santosh Dutta never got his due respect and acknowledgement in his lifetime rjk - Aaj Tak Bangla

‘মহাস্থবির জাতক’-এর স্থবির যখন শোয়া শো বছর আগে বেনারস থেকে পালিয়ে গিয়ে উত্তরপ্রদেশের এক প্রত্যন্ত শহরে এক প্রবাসী বাঙালির বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছিল, আশ্রয়দাত্রী দিদিমণিকে দেখত রোজ দুপুরবেলায় পুরনো ‘ভারতবর্ষ’ দেরাজ থেকে বের করে পড়তে। বাঙালি চিরকালই বেড়াতে ভালোবাসে, ট্রেন চালু হতে হল পোয়াবারো– দলে দলে বাঙালি বেরিয়ে পড়ল বেড়াতে; কিন্তু কখনওই একা বা শুধু পরিবার নিয়ে নয়– তার মূল কারণ এই ভাষা বিভ্রাট। কে সেই বিদেশ-বিভূঁইতে সেখানকার ভাষায় কথা বলবে সেই ভয়ে দল বেঁধে যাওয়া– সবাই মিলে চেষ্টা করলে বার্তা ঠিক পৌঁছে যাবে অপর পক্ষের কাছে। হজমের গোলমাল সারাতে বাঙালি পশ্চিমে ‘চেঞ্জে’ যেতে শুরু করল, কিন্তু নিজেদের দৌড় সীমাবদ্ধ রাখল নিজের রাজ্যের সীমারেখার ১০০ মাইলের মধ্যে। চেঞ্জারদের ভিড় দেখে মধুপুর, শিমূলতলা, ঘাটশিলার স্থানীয় মানুষ দুটো বাড়তি পয়সা রোজগার করার তাগিদে বাংলা শিখে নিল, তাতে বাঙালির হল পোয়াবারো!

কদাচিৎ যদি বাজার-দোকানের বাইরে বাঙালির হিন্দি বলার প্রয়োজন পড়ে, তাহলেই চিত্তির! পূজ্যপাদ তারাপদ রায় এমন একটা ঘটনার কথা লিখেছিলেন একবার। চেঞ্জে গিয়ে একজনকে বোলতা কামড়েছে, তাই ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হয়েছে নিতান্ত বাধ্য হয়ে, কিন্তু ডাক্তার বাংলা জানেন না আর রোগী বোলতার হিন্দি জানে না। শেষে মরিয়া হয়ে রোগী ডাক্তারকে প্রশ্ন করেছিল, ‘হাম বোলতা কো বোলতা বোলতা, তুম বোলতা কো কেয়া বোলতা?’

অলংকরণ: দীপঙ্কর ভৌমিক

ইতিমধ্যে রাজধানী স্থানান্তরিত হয়েছে, কিন্তু ততদিনে অন্য ভাষার প্রতি অনীহা আত্মশ্লাঘায় পরিণত হয়েছে। ওড়িয়া-ভাষী হয়ে গেছে ‘উড়ে’, হিন্দিভাষী হয়ে গেছে ‘খোট্টা’। পুরীতে গিয়ে বাঙালি জগন্নাথ আর সমুদ্র-দর্শনের সঙ্গে আরেকটা আমোদ পেল একটা শব্দে ‘ধাঁইকিরিকিরি’। দ্রুতবেগে যাওয়ার এই ওড়িয়া শব্দ যেখানে সেখানে ব্যবহার করে মজা পেতে গিয়ে অনেকবার গোলমালে পড়েও বাঙালি নির্বিকার। ইতিমধ্যে পূর্ববাংলা থেকে মানুষজন চলে এসে বাসা বাঁধল। সেই ২০ মাইল অন্তর বাংলা ভাষা বদলের নিয়মে বিভিন্ন রকম বাংলা ভাষা চারপাশে ঘুরে বেড়াতে লাগল– পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি তাদের চিরকালের কথ্য ভাষার বাইরে বাংলা শুনলেই ‘বাঙাল’ তকমা দিয়ে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করল। আসল গোলমাল লাগল ভারতের মানচিত্রে বাংলার গুরুত্ব কমে যেতে আর জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যেতে যখন ভাতে টান পড়ল। পেটের তাগিদে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দৌড় শুরু হল।

…………………………………

দিপু মেসোমশাই পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন রিনা মাসির সঙ্গে বিয়ের রজতজয়ন্তী উপলক্ষে। একটা নামী লজের দোতলায় ঘর নিয়েছিলেন। ডিসেম্বরের শীতে জবুথবু হয়ে ঘরে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ খেয়াল করেন ঘরে ফায়ার-প্লেস রয়েছে। উল্লসিত হয়ে তিনি বারান্দায় বেরিয়ে নিচের কর্মচারীকে হুকুম করেন, ‘কামরা মে কুছ লরকি ভেজ দো!’ কর্মচারী মালিককে গিয়ে জানালে মালিক ঘরে এসে গম্ভীরভাবে জানান এইসব করতে হলে অন্য হোটেলে গিয়ে থাকুন। রিনা মাসি কোনওমতে বিপদ সামাল দেয়। 

…………………………………

দৌড় তো শুরু হল, কিন্তু বাঙালি হিন্দি শিখল কি? কর্মক্ষেত্রে ইংরেজি জানলে কাজ চলে যায়, তাই ইংরেজিটা আরও ভালো করে পালিশ করা শুরু হল। হিন্দি শেখার বিষয়ে অনীহা রয়েই গেল, কাজ চলে গেলেই হবে! আমার বড় পিসিমার বড় জামাই ১৯৬৪-তে রাজস্থানের আজমীঢ়ে চলে যান চাকরি নিয়ে, পরিবারও সঙ্গে যায়। জন্ম-ইস্তক দেখেছি, দিদি-জামাইবাবু প্রত্যেক বছর একমাসের ছুটি নিয়ে কলকাতায় আসতেন আর সমস্ত আত্মীয়র সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করতেন। আমার জন্মের আগে বাবা-মা’রা যখন রাজস্থানে বেড়াতে যান, সেখানে জামাইবাবুর বাড়িতে থেকেছেন আর রাজস্থানে দিদি-জামাইবাবুর জনপ্রিয়তার গল্প শুনে বড় হয়েছি। পরবর্তীকালে এঁরা উদয়পুরে চলে আসেন আর বাড়ি কেনেন। চাকরি সূত্রে এই শতকের শুরুর দিকে যখন রাজস্থানের উদয়পুরে গিয়ে পৌঁছলাম, স্বাভাবিকভাবেই আমি এই দিদির বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। ওখানে পৌঁছে দেখি, দিদির জীবনযাপন পুরো রাজস্থানি মতে– সকাল এগারোটাতে দুটো মোটা পরোটা খায় ভুজিয়া দিয়ে আর তারপর এক গ্লাস দুধ-চা। ঠেট হিন্দি বলে। শুনলাম, বাজার-দোকান দিদি করে থাকে, লোকজনের সঙ্গে মিশে জীবনযাত্রা এইরকম হয়ে গিয়েছে। জামাইবাবু সপ্তাহের শেষে মাছ-মাংস কিনে আনেন, সেটা দিদি পারে না বলে। একদিন বাজার গিয়ে মাছওয়ালাকে জামাইবাবুর নির্দেশ শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম, ‘মুড়ো মে থোরা মছলি রাখনা, অউর গাদা-পেটি আলাগ করকে কাটনা, পুরা মাছ কা পেটি মত বানা দেনা।’ আমি জামাইবাবুর দিকে তাকাতে উনি জানালেন যে, রাজস্থানিরা রুই মাছও ফিলে করে কেটে খায় কাঁটার জন্য, তাই এটা বলে দিতে হয়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটা কি হিন্দি বললেন? আপনি তো চল্লিশ বছর ধরে এই দেশে!’ জামাইবাবু নির্বিকার ভাবে বললেন, ‘ধুর! ও বুঝে গেলেই হল!’

যা খুশি হিন্দি বললেই হল, অপরপক্ষ বুঝতে পারলে চিন্তা নেই, এটাই আমাদের বাঙালিদের ধারণা। আমার এক আত্মীয়া বেনারসে গঙ্গাস্নান করে ফেরার সময় এক ভিখারি একটা জামা ভিক্ষে চেয়েছিল এক শীতের দিনে। স্বাভাবিকভাবেই সেই সময় আমার আত্মীয়ার কাছে বাড়তি জামা ছিল না– তাই নিয়ে ভিখারিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘মেরা পোঁদ মে পোঁদ মে আও।’ সেই ভিখারিটা বুঝে গিয়ে আমার আত্মীয়ার পিছু নিয়েছিল। কিন্তু সবাই বুঝে নিতে পারে না– এটা বাঙালি বুঝতে চায় না। দিপু মেসোমশাই পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন রিনা মাসির সঙ্গে বিয়ের রজতজয়ন্তী উপলক্ষে। একটা নামী লজের দোতলায় ঘর নিয়েছিলেন। ডিসেম্বরের শীতে জবুথবু হয়ে ঘরে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ খেয়াল করেন ঘরে ফায়ার-প্লেস রয়েছে। উল্লসিত হয়ে তিনি বারান্দায় বেরিয়ে নিচের কর্মচারীকে হুকুম করেন, ‘কামরা মে কুছ লরকি ভেজ দো!’ কর্মচারী মালিককে গিয়ে জানালে মালিক ঘরে এসে গম্ভীরভাবে জানান এইসব করতে হলে অন্য হোটেলে গিয়ে থাকুন। রিনা মাসি কোনওমতে বিপদ সামাল দেয়।

Jatayu Intro Scene | Sonar Kella | Feluda | Satyajit Ray
তং মত্ করো: সোনার কেল্লায় জটায়ুরূপী সন্তোষ দত্ত

বাঙালির এই হিন্দি বলা, বা বলতে পারলেও গোল-গোল হিন্দি বলা নিয়ে অনুযোগ করলে এখনও একটাই উত্তর আসে, ‘তং মত করো!’

………………………………………………..

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

………………………………………………..