শুধু আধুনিক কবিতাই নয়, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাংলা সাহিত্যে ফিরে-ফিরে এসেছে বাঘ। বাঙালির এই ব্যাঘ্র-উল্লেখের উৎস ভাবতে বসলে, উভয়ের সহাবস্থানই ফুটে ওঠে মূল কারণ হিসেবে। আজ ভৌগোলিকভাবে সুন্দরবনে সীমায়িত হলেও, এককালে অরণ্যসংকুল বঙ্গদেশে বাঘের অভাব ছিল না। শুধু সুন্দরবনই নয়, দেখা যেত অন্যত্রও। মানুষের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল ভয়ের ও শ্রদ্ধার। উপযুক্ত দূরত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি, বাঘের বিক্রমকেও অস্বীকার করতে পারেননি বাঙালি কবিরা। ফলে আশেপাশের বিভিন্ন জীবজন্তুর পাশাপাশি ফিরে-ফিরে এসেছে বাঘ, মূলত বীরত্বের প্রতীক হিসেবে– যা নিতান্ত স্বাভাবিক।
প্রচ্ছদ শিল্পী: অর্ঘ্য চৌধুরী
সর্বশেষ সমীক্ষা অনুযায়ী, সুন্দরবনের পশ্চিমবঙ্গীয় পরিসরে ১০১টি বাঘের বাস। এই সংখ্যা আনন্দের না বিষাদের, তা ব্যাঘ্রপ্রেমীরা বলতে পারবেন। তবে কবিতায় বাঘের উপস্থিতি তাঁদের স্বস্তি দিতে পারে। জাগতিক বাঘ জন্ম-মৃত্যু চক্রের অধীন, কিন্তু সাহিত্যে ‘বন্দি’ হয়ে গেলে সেই বাঘই অমরত্ব লাভ করে। কবিতার সূত্রে এমন বাঘের সংখ্যা অগুনতি। বাংলাভাষায় তো বটেই।
শুধু আধুনিক কবিতাই নয়, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাংলা সাহিত্যে ফিরে-ফিরে এসেছে বাঘ। বাঙালির এই ব্যাঘ্র-উল্লেখের উৎস ভাবতে বসলে, উভয়ের সহাবস্থানই ফুটে ওঠে মূল কারণ হিসেবে। আজ ভৌগোলিকভাবে সুন্দরবনে সীমায়িত হলেও, এককালে অরণ্যসংকুল বঙ্গদেশে বাঘের অভাব ছিল না। শুধু সুন্দরবনই নয়, দেখা যেত অন্যত্রও। মানুষের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল ভয়ের ও শ্রদ্ধার। উপযুক্ত দূরত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি, বাঘের বিক্রমকেও অস্বীকার করতে পারেননি বাঙালি কবিরা। ফলে আশেপাশের বিভিন্ন জীবজন্তুর পাশাপাশি ফিরে-ফিরে এসেছে বাঘ, মূলত বীরত্বের প্রতীক হিসেবে– যা নিতান্ত স্বাভাবিক।
তবে কোনও-কোনও ক্ষেত্রে দেবদেবী বা অবতারের মাহাত্ম্যবর্ণন-প্রসঙ্গেও উঁকি দিয়ে যায় চতুষ্পদ প্রাণীটি। অমন ভয়াল ও বিশাল এক প্রাণী কাব্যের আরাধ্যের বশবর্তী– এই ভাব ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমে আখেরে আরাধ্যেরই মহিমা কীর্তিত হয়। যেমন ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ কাব্যে কৃষ্ণদাস কবিরাজ লিখছেন– “একদিন পথে ব্যাঘ্র করিয়াছে শয়ন।// আবেশে তার গায়ে প্রভুর লাগিল চরণ।।/ প্রভু কহে—কহ ‘কৃষ্ণ’, ব্যাঘ্র উঠিল।/ ‘কৃষ্ণ’ ‘কৃষ্ণ’ কহি ব্যাঘ্র নাচিতে লাগিল।।” চৈতন্যের পদস্পর্শে বাঘের কৃষ্ণনাম উচ্চারণ ও নৃত্য যে অসম্ভব, তা বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন মানুষমাত্রেই স্বীকার করবেন। কিন্তু এই বর্ণনার মাধ্যমে চৈতন্যের ও সর্বোপরি কৃষ্ণের মাহাত্ম্য ফুটিয়ে তুললেন কবি।
আবার মুকুন্দ চক্রবর্তীর ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে দেখা যায়, কালকেতুর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে অন্যান্য পশুর সঙ্গে বাঘও শরণ নিয়েছে দেবী অভয়া ওরফে চণ্ডীর। অতঃপর, ‘বাঘেরে সদয় হয়্যা বলেন অভয়া।/ নিরাতঙ্ক অরণ্যে বসত কর গিয়া।।’ এই প্রেক্ষিতটি এক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা তুলে ধরে। তা হল, মনুষ্য-অত্যাচারে প্রাণীজগতের কোণঠাসা হওয়ার কাহিনি। বাঘের মতো সবল প্রাণীও যে মানুষের শিকার-প্রবণতার হাত থেকে রেহাই পায়নি, ষোড়শ শতকে লিখিত ‘চণ্ডীমঙ্গল’ সেই ইঙ্গিতই দেয় আমাদের; যা পরবর্তী কয়েক শতকে প্রাণীটিকে ঠেলে দেবে বিলুপ্তির দিকে।
কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর ‘রামায়ণ’-এ হনুমানের বিক্রমকে তুলনা করেছেন বাঘের সঙ্গে। রাবণ-পুত্র অক্ষয়কুমারের ‘মাথার উপর পলায় হনুমান কোপে/ লাফ দিয়া দুই পা ধরে বাঘ যেন ঝাপে।।’ অর্থাৎ বাঘের মতো লাফ দিয়ে অক্ষয়কুমারের দুই পা ধরলেন হনুমান। কৃষ্ণরাম দাসের ‘রায়মঙ্গল’ কাব্যে বাঘের উপস্থিতি ভরপুর। বস্তুত, দক্ষিণরায়ের প্রতি ভয় ও তজ্জনিত ভক্তি নিম্ন-দক্ষিণবঙ্গের অধিবাসীদের মধ্যে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিল, সেই সূত্রে জন্ম নিয়েছিল একাধিক কাব্য-পাঁচালি। উল্লেখ্য বনবিবিও, যিনি দক্ষিণরায়কে দমনের মাধ্যমে রক্ষা করেন মানুষকে।
উনিশ শতকে পৌঁছে, বাঘের উল্লেখ ‘কবিতা’ হয়ে উঠল মাইকেল মধুসূদন দত্তের কল্যাণে। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-তে অঙ্গগ্রহ (খিঁচুনি) নামক ‘যমচর’ অর্থাৎ অসুখের বর্ণনাপ্রসঙ্গে লিখছেন– ‘…যথা ব্যাঘ্র, নাশি জীব বনে,/ রহিয়া রহিয়া পড়ি কামড়ায় তারে/ কৌতুকে!’ অর্থাৎ, বাঘ যেভাবে জীবহত্যা করে তার শিকারকে ইচ্ছেমতো থেকে-থেকে কামড়ায়, অঙ্গগ্রহের ক্রিয়াও তেমনই। এখানে ‘কৌতুকে’ শব্দটির ব্যবহার অকল্পনীয়। বস্তুত, একটি অসুখের সঙ্গে বাঘের মর্জি ও কৌতুকের যে তুলনা টানলেন মাইকেল, সেই বিন্দু থেকেই যেন বাঘ-প্রসঙ্গে আধুনিকতার প্রবেশ ঘটল বাংলা কবিতায়।
‘বাঘ’-কে উদাহরণ হিসেবে নিয়ে, কাব্য ও কবিতার একটি মৌলিক ফারাক করতে পারি আমরা, যা পরবর্তী অংশে স্পষ্ট হবে আরও। কাব্যে বাঘের উল্লেখ মূলত চরিত্র হিসেবেই; বাচ্যার্থ পেরিয়ে অন্য-কোনও অর্থে উত্তীর্ণ হতে পারেনি তা। প্রাণীত্বেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে তার বিচরণ। অথচ কুড়ি ও একুশ শতকের বিভিন্ন কবিতায় আমরা বাচ্যার্থের পাশাপাশি রূপক হিসেবেও দেখতে পাব বাঘকে, যা প্রাণীটির পরিচয় ও নামোল্লেখের অভিঘাতকে সুদূরপ্রসারী করে তুলবে।
মাইকেল থেকে যে যাত্রা শুরু, তার জাগতিক অথচ অভিঘাতময় উত্তরণ দেখা গেল জীবনানন্দ দাশের কবিতায় (রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ‘বাঘ’ আক্ষরিক অর্থ নিয়েই উপস্থিত)। “…জল নিহত প্রাণীর রক্তে লাল/ হ’য়ে আছে ব’লে বাঘ হরিণের পিছু আজো ধায়”। শিকারী ও শিকারের আবর্তন, বাস্তুতন্ত্রের অনতিক্রম্য চক্র ও সর্বোপরি মৃত্যুর অমোঘ পরিণতিকে একসূত্রে বেঁধেছেন তিনি, প্রশ্ন তুলেছেন কার্য-কারণের সূত্রের দিকেও। এর ঠিক পরের বাক্যেই জীবনানন্দ লিখলেন– “মানুষ মেরেছি আমি– তার রক্তে আমার শরীর/ ভ’রে গেছে”। হরিণের পিছু-নেওয়া বাঘ ও মানুষের হত্যাকারী মানুষ যেন অবিচ্ছেদ্য হয়ে গেল এই বিন্দুতে। মানুষের এই অবস্থান প্রতিষ্ঠিত করতেই হিংস্র বাঘের প্রসঙ্গ এনেছিলেন তিনি, বোঝা যায়-তাও।
ধীরে ধীরে পরিচিত গণ্ডি ছেড়ে, শব্দপ্রয়োগ ও ব্যঞ্জনায় ভর দিতে শুরু করেছে বাঘ। এরপর আমরা দেখব, শুধু পরিচয়জনিত বিশালতা ও হিংস্রতাই নয়; ভালোবাসা, যৌনতা এমনকী প্রতিবাদের চিহ্ন হিসেবেও বাংলা কবিতায় থাবা রাখছে তারা। এই প্রসঙ্গে প্রথমেই মনে পড়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘বাঘ’ কবিতাটি। মেঘলা দিনে, দুপুরবেলা, মনে পড়ামাত্র বনে বেরোল ‘চিরকালীন ভালোবাসার বাঘ’। এই বাঘের কাছে যাওয়া যায়, মুখে বলাও যায়– ‘খা’। অথচ ‘আঁখির আঠায় জড়িয়েছে বাঘ, নড়ে বসছে না।’ বাঘ-রূপকের আড়ালে এ এক প্রেমের কবিতা। এদিকে ‘ছোট্ট হাতের আঁচড় খেলেই খোলে রূপের বাহার।’ বাঘকেই কেন নির্বাচিত করলেন কবি? ‘বাঘ’ শোনামাত্র আমাদের মস্তিষ্কে যে-ধারণা জন্ম নেয়, প্রেমের অবস্থান তার সম্পূর্ণ বিপরীতে। এমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও ভয়ংকর প্রাণীও প্রণয়ীর কাছে আদুরে ও অভিমানী হয়ে ওঠে– বৈপরীত্যের মধ্যে দিয়ে আসলে মানুষের প্রেম-স্বভাবের কথাই বুঝিয়ে দিলেন শক্তি।
জুয়েল মাজহার ‘হেমন্তের বাঘিনীকে’ কবিতায় লেখেন– ‘সোনার বাঘিনী, খোলো শয়নকুঠুরি। দাও সহজ প্রবেশ’। এখানে নির্দিষ্ট হচ্ছে বাঘের লিঙ্গ– সে নারী, বাঘিনী সে। প্রথম পঙক্তিতেই যৌনতার ইঙ্গিত লুকিয়ে রেখেছেন কবি। যা কবিতার অগ্রগতির সঙ্গে-সঙ্গে স্পষ্ট হয় আরও। বাঘিনীর ‘চির-অভিযোজক, আশ্রয়ণীয় যোনির স্বেদ/ ও শিশির থেকে’ কেউ যেন বঞ্চিত না-হয়, সে-অনুরোধও জানিয়েছেন জুয়েল। বাঘ তথা পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা এ-কবিতা কি শেষাবধি ‘বাঘিনী’-কে যৌন-উপকরণ হিসেবেই চিহ্নিত করল? ‘বাঘিনী’-র ব্যবহার যে-ব্যক্তিত্বময়ীকে ফুটিয়ে তোলে, শেষাবধি সেই ব্যক্তিত্বকেই যেন তরল করে দিলেন কবি।
অন্যদিকে অনির্বাণ করের ‘বাঘ’ কবিতাটি এক অসম্পূর্ণ যৌনতার কথা জানায় পাঠককে। ‘…পুরো খেয়ে যেতে পারেনি বলে/ অসহায় বসে আছে/ তোমাকে ছোঁবে না আর কেউ’– হঠাৎ-বিচ্ছিন্ন রমণের প্রসঙ্গে বাঘ এল কোথায়? শিরোনামে থাকলেও, কবিতার শরীরে ‘বাঘ’ শব্দটির ব্যবহার নেই। একেবারে শেষে– ‘শুধু তুমি জান/ কুলুঙ্গীর আলো নিভু নিভু হয়ে এলে/ ঘরময় হালুম-গন্ধ, লুকানো শীৎকার।’ এখানে পৌঁছে নামকরণের কারণ বোঝা যায়। ‘হালুম গন্ধ, লুকানো শীৎকার’-এর মধ্যে লুকিয়ে রমণস্মৃতি। বাঘ, যে পুরুষ, তার মিলনপটুত্বের আচ্ছন্নতা থেকে বেরোতে পারছে না নারী। সে-জন্যেই অতৃপ্তির পাশাপাশি গোপনে কোথাও জেগে থাকছে পুনর্মিলনের আকাঙ্ক্ষাও।
…………………………………………………………………..
‘বাঘ’-কে উদাহরণ হিসেবে নিয়ে, কাব্য ও কবিতার একটি মৌলিক ফারাক করতে পারি আমরা, যা পরবর্তী অংশে স্পষ্ট হবে আরও। কাব্যে বাঘের উল্লেখ মূলত চরিত্র হিসেবেই; বাচ্যার্থ পেরিয়ে অন্য-কোনও অর্থে উত্তীর্ণ হতে পারেনি তা। প্রাণীত্বেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে তার বিচরণ। অথচ কুড়ি ও একুশ শতকের বিভিন্ন কবিতায় আমরা বাচ্যার্থের পাশাপাশি রূপক হিসেবেও দেখতে পাব বাঘকে, যা প্রাণীটির পরিচয় ও নামোল্লেখের অভিঘাতকে সুদূরপ্রসারী করে তুলবে।
…………………………………………………………………..
রাকা দাশগুপ্তের ‘বাঘ’ কবিতার বাঘটি আসলে নখদন্তহীন, বৃদ্ধ, সংসারীও বটে। এককালে যে ‘হাঁক দিলে রাজ্যশুদ্ধ ঠান্ডা হয়ে যেত’, এখন তার ভিআরএস, ‘পেনশন প্রকল্পে বেঁচে থাকা।’ এই বর্ণনায় মনে পড়ে যায় আমাদেরই পরিচিত ঘরে-বাইরের অসংখ্য মুখ, বার্ধক্য যাঁদের প্রভাব-প্রতিপত্তিকে স্তিমিত করেছে। মাঝেমধ্যে রক্তের তেজ চাগাড় দিয়ে ওঠে, তবে তা স্থায়ী হয় না বেশিক্ষণ। ‘অতীত গৌরব নিয়ে এবছর রোমন্থনে বাঁচা’– স্মৃতির পাশাপাশি, অসহায়তা ও ক্লান্তি ছড়িয়ে কবিতার সর্বাঙ্গে। এ-বাঘও আসলে মানুষ বই অন্য-কেউ নয়।
এমনই আরেক বাঘের হদিশ দেন শ্যামলকান্তি দাশ, তাঁর ‘তথাস্তু’ কবিতায়। ‘বনের বাঘ, পথ ভুল করে লোকালয়ে ঢুকে পড়েছি/ একটু হালুম হুলুম না করলে চলে?’ তারপর বাঘ ঝাঁপাঝাঁপি করে, মানুষের মনযোগ পেতে চায়। কিন্তু কেউ ঘুরেও তাকায় না। এমনকি, অঞ্চলপ্রধানও এসে জিভ ছিঁড়ে ফেলার হুমকি দেন। বাঘের ‘ব্যাঘ্রত্ব’ থেকে এই স্খলন, নখদন্তহীনতা সর্বোপরি অসহায়তার হদিশ প্রথমেই দিয়ে রেখেছিলেন কবি– ‘একটু হালুম হুলুম না করলে চলে?’-র মধ্যে দিয়ে।
ওপরের দুটি উদাহরণে বাঘ যখন গৌরবময় অতীত হারিয়ে ‘হোমিওপ্যাথির মতো করুণানির্ভর’, অমিতাভ দাশগুপ্তের ‘বাঘের মুখে’ কবিতাটি সেখানে বিপরীত যাত্রার কথা বলে। মানুষ থেকে হিংস্র বাঘে বদলে যাওয়ার কাহিনি। ‘মানুষ এসে কড়া নাড়লো।/ দরজা খুলে বলে উঠলাম– হালুম।’ এই বিবর্তন একদিনে হয়নি, পরিপার্শ্বের বিভিন্ন ঘটনা, বঞ্চনা ও ক্রোধ তাকে ‘উত্তীর্ণ’ করেছে বাঘে। সে বুঝেছে, ভালোমানুষ হয়ে থেকে লাভ নেই, বরং ‘মানুষখেকো বাঘ’ হলেই অস্তিত্বরক্ষা সম্ভব।
অমিতাভ ‘বাঘ’ হয়ে ওঠার মাধ্যমে প্রতিবাদ তথা আত্মরক্ষার ইঙ্গিত দেন। ঠিক সেখান থেকেই হাত ধরে বিপুল চক্রবর্তীর ‘তোমার মারের পালা শেষ হলে’ কবিতাটি। ‘পা থেকে মাথা পর্যন্ত চাবুকের দাগ যেন থাকে/ এমনভাবে মারো’ থেকে শুরু হয়ে, কবিতাটির উত্তরণ ঘটে ‘তোমার মারের পালা শেষ হলে/ আমাকে দেখায় যেন ডোরাকাটা বাঘের মতন’-এ। মুখ বুজে মার খেতে খেতে, সহ্য করতে-করতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষের কথা লুকিয়ে এই কবিতায়, যার আর কিছুই হারানোর নেই। মারতে মারতে ক্লান্ত প্রতিপক্ষ যখন হাত তুলে নেবে, আক্রান্তের সারা শরীরে চাবুকের দাগ ‘ডোরাকাটা বাঘের মতন’, বাঘই যেন-বা। বিপুল যেখানে কবিতাটি সমাপ্ত করেছেন, ঠিক সেখান থেকেই শুরু নতুন অধ্যায়– প্রতি-আক্রমণের, শাসকের প্রতি শোষিতের বিদ্রোহের। বাঘ হয়ে লাফিয়ে পড়ার।
……………………………………………………………………..
আরও পড়ুন সম্বিত বসু-র লেখা: শীতের রোদে বাঘের থাবা
……………………………………………………………………..
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লেখেন, ‘হাজার শিশুর জন্মভূমি/ পুড়ে যায় ক্ষুধার চিৎকারে/ আর কান্নার গর্জনে// কোথা থেকে আসে এত বাঘ?’ ক্ষুধার্ত শিশুর চিৎকার আর কান্না বাঘের গর্জনের সঙ্গে তুলনীয়, যেন-বা একেকটি ক্ষুধার্ত বাঘই হয়ে উঠছে তারা। আসলে, শিশু হোক বা পরিপূর্ণ মানুষ, প্রত্যেকে ভেতরেই কোনো-না-কোনো ভাবে একেকটি বাঘ লুকিয়ে থাকে। সে-কথাই স্মরণ করিয়ে দিতে চান হিন্দোল ভট্টাচার্য– ‘আমাদের ভেতর যে বাঘ গুঁড়ি মেরে আছে,/ তার কথাও মনে রেখো।’ বিপুল চক্রবর্তী ডোরাকাটা বাঘের মধ্যে যে বিপ্লবের বীজ বুনেছিলেন, তেমনই কোনো এক ডোরাকাটা বাঘকে গতিশীল দেখে বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের মনে পড়ে নামাবলির কথা— ‘বাঘ লাফ দিলে মনে হয়,/ নামাবলী উড়ে যাচ্ছে ঝড়ে’।
শাহ মাইদুল ইসলাম বাঘ ও বনকে ঘনসন্নিবিষ্ট করে তোলেন– ‘এখানে গাছে ডোরাকাটা হয়, বাঘ হয়। বাঘবন ও বনগাছ মিলে ছত্রখান হয়।’ পঙ্কজ চক্রবর্তীর বাঘ তার শ্বাপদস্বভাব থেকে উত্তীর্ণ হচ্ছে মনুষ্যত্বে, ফিরে যাচ্ছে শিকার ছেড়ে– ‘মানুষকে ভালোবেসে বাঘ যদি ফিরে যায়’। সায়ন্তন গোস্বামীর কবিতায় একাত্ম হয়ে যায় বাঘ, বোন ও বনবিবি– ‘সবকটা বাঘই পোষ মেনে গেছে, হেরে গেছে চতুরতায়/ আমার বোনের কাছে, আমার বোন হল ঠাকুর, নিজেই বনবিবি’। নির্মল হালদার বাঘকে অপেক্ষা করতে বলেন, যাতে হৃদয় প্রশস্ত করে বসতে দেওয়া যায়। বাঘের বিশালত্বই বোধকরি এর কারণ। ভাস্কর চক্রবর্তীর বাঘ ‘পনের পয়সার’, সম্ভবত চিড়িয়াখানায় বন্দি। তুষার চৌধুরীর কবিতায় বিড়ালের সঙ্গে বেড়ে-ওঠা বাঘ চারপাশের মিউ মিউ-এর ভেতরে নিজের গর্জন শুনে আত্মপরিচয় সম্পর্কে সচেতন হয়। হুমায়ুন আজাদ বাঘিনীর মতো ওঁৎ পেতে থাকতে দেখেন চাঁদকে। রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরীর বাঘ স্বভাবচ্যুত, হয়তো-বা আপোসীও– ‘ভারত-ভ্রমণে যায় একসঙ্গে জ্যোতির্ময় বাঘ ও হরিণ’।
বাংলা কবিতার বিপুল ভাঁড়ারে উঁকি দিলে এমন অজস্র উদাহরণ পাওয়া যায়। বর্তমান প্রবন্ধে সামান্য কয়েকটি তুলে ধরা হল, মূলত প্রবণতা বোঝাতেই। আক্ষরিক ব্যবহারের তুলনায় ব্যঞ্জনার পরিসর ও ব্যাপ্তি যে সর্বদাই অধিক, তা বাঘ-কেন্দ্রিক উদাহরণগুলিতেও লক্ষণীয়। বস্তুত, একটি প্রাণীকে সামনে রেখে মানুষের বিভিন্ন প্রবৃত্তিকে ফুটিয়ে তোলার প্রবণতাই বিশিষ্ট করে তুলেছে কবিতাগুলিকে। বাঘ যে শুধুমাত্র বাঘ নয়, ক্ষেত্রবিশেষে মানুষও, কিংবা উল্টোটা– এই দর্শনের কাছেও পৌঁছে দেয় উদাহরণগুলি। এই যাত্রার কথাই লিখেছিলেন মণীন্দ্র গুপ্ত– ‘সেদিন সন্ধেবেলা চমকে উঠলাম— একটা বাঘ এসে/ ঢুকছে ঘরে। না, না, বাঘ নয়, তুমি। লাফিয়ে উঠতে গিয়ে/ তাকিয়ে দেখি– নাঃ তুমি না, পৃথিবীর ঠাণ্ডা/ সন্ধ্যাবেলাকার ছায়া ঢুকছে ঘরে।’ বাঘই হোক বা ‘তুমি’ বা ছায়া, বাংলা কবিতার রহস্যময়তা অক্ষুণ্ণ থাকুক…
……………………………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………………………………