শূন্যতার বুকে স্বপ্ন হয়ে বেঁচে থাকতে চেয়েছিল রোহিত ভেমুলা। তাই ও কার্ল সেগান হতে চেয়েছিল। নইলে ভেবে দেখুন না, ওই সুইসাইড নোটে রোহিত লিখছে– ও বিশ্বাস করে না কোনও ‘after-death stories’-এ, বিশ্বাস করে না ভূত-প্রেতে, কিংবা আত্মার অস্তিত্বে। তবু, ও বিশ্বাস করে– ‘believe’ শব্দটাই লিখেছে স্পষ্ট করে যে, ও একদিন তারাদের দেশে পৌঁছে যাবে! এই যে ‘বিশ্বাস’, এর জন্ম হয় ওর বেপরোয়া যথেচ্ছ কল্পনাপ্রবণ মন থেকে।
রোহিত ভেমুলা লেখক হতে চেয়েছিল। কার্ল সেগানের মতো লেখক। অবশেষে এক-জীবনের চেষ্টায় মনের মতো একটা লেখাই লিখে উঠতে পেরেছিল। সুইসাইড নোট!
কিন্তু, ‘কার্ল সেগানের মতো লেখক’ মানে কী? খেয়াল করার বিষয়, ও ফাইনম্যানের মতো খ্যাত বিজ্ঞানী হতে চায়নি। এমনকী, রিচার্ড ডকিন্সের মতো বৈজ্ঞানিক সত্যের হাতিয়ারকে সামনে রেখে আমাদের মনের-ভিতরে-জমে-থাকা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সারাজীবন লড়াই করার কথাও ও বলেনি। বলেছে শুধু, কার্ল সেগানের মতো হতে চেয়েছিলাম। সে ঠিক কেমন চাওয়া?
প্রথমত, যথেচ্ছ বেপরোয়া স্বপ্ন দেখার সাহস। মনে আছে তো, ১৯৭৭ সালে ‘ভয়েজার ১’ যখন পাড়ি দিল অনন্তের উদ্দেশ্যে, কার্ল সেগান কার্যত তাঁর একার উদ্যোগে সেখানে ভরে দিলেন এক গোল্ডেন ডিস্ক? সেই ডিস্কে থাকল এই পৃথিবীর যা-কিছু ‘সুন্দর’– তার শব্দ, ছবি, গান। প্রেমের, উচ্ছলতার, বেদনার, বাৎসল্যের। আর রইল পৃথিবীর ৫৫টি ভাষায় উচ্চারিত এক লাইনের এক বার্তা: ‘নমস্কার। বিশ্বের শান্তি হোক।’ এই বার্তা কি আদৌ কোথাও পৌঁছবে? কার্ল সেগানও জানতেন, কার্যত অসম্ভব। কয়েকশো কোটি বছরেও ভয়েজারের পক্ষে অন্য কোনও প্রাণময় দূরবর্তী গ্রহে পৌঁছনো সম্ভব নয়। কিন্তু তাতে কী? রইল তা অনন্ত শূন্যের বুকে মানুষের চির অভিজ্ঞান হয়ে। শূন্যতার বুকে রইল আমাদের এই সম্মিলিত স্বপ্ন, আমরা শান্তি চেয়েছিলাম!
শূন্যতার বুকে স্বপ্ন হয়ে বেঁচে থাকতে চেয়েছিল রোহিত ভেমুলা। তাই ও কার্ল সেগান হতে চেয়েছিল। নইলে ভেবে দেখুন না, ওই সুইসাইড নোটে রোহিত লিখছে– ও বিশ্বাস করে না কোনও ‘after-death stories’-এ, বিশ্বাস করে না ভূত-প্রেতে, কিংবা আত্মার অস্তিত্বে। তবু, ও বিশ্বাস করে– ‘believe’ শব্দটাই লিখেছে স্পষ্ট করে যে, ও একদিন তারাদের দেশে পৌঁছে যাবে! এই যে ‘বিশ্বাস’, এর জন্ম হয় ওর বেপরোয়া যথেচ্ছ কল্পনাপ্রবণ মন থেকে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এক অন্যরকমের ‘আমি’র সন্ধান দিতে থাকে সেগান, সেকথা আমরা বলেছি। সেকথা রোহিতও জানত। কিন্তু আত্মপরিচয় শুধু সেই ‘অন্যরকম আমি’ দিয়ে তৈরি নয়। আত্মপরিচয় তৈরি হতে থাকে নানা সামাজিক প্রকল্প দিয়ে। ধর্ম, রাজনীতি আর পুঁজি নিয়ন্ত্রিত সেইসব প্রকল্প। আমি হতে চাই কেবল মৃত তারার সন্তান। আমি থাকতে চাই কেবল সূর্যের কাছে ঋণী। কিন্তু প্রকৃতির থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে ওঠাই এই অসুস্থ ‘আধুনিকতা’র নিয়তি।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
কিন্তু তারাদের দেশে কী আছে? কেন ও পৌঁছতে চায় সেখানে? চায়, কেননা কার্ল সেগানই শিখিয়ে গেছেন, ওই তারাদের দেশের আছে আমার যে আত্মপরিচয়, তার এক অন্যরকমের সন্ধান। এই ধরুন না, এই যে আমার শরীর, সে কী দিয়ে তৈরি? সকলেই আমরা জানি, এর স্থির উত্তর হচ্ছে, মূলত অক্সিজেন, কার্বন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, ক্যালসিয়াম আর ফসফরাস। কিন্তু এর ঠিক পরের কথাটাই হচ্ছে সবচেয়ে রহস্যময়। এই যে ‘আমি’ তৈরির উপাদান, এসব মহাবিশ্বে তৈরি হয়েছিল কখন? কোথায়? কার্ল সেগানই আমাদের সহজ করে সে-উত্তর শিখিয়ে দিয়ে গেছেন। এইসব উপাদান, আমার শরীরের প্রতিটা পরমাণুর জন্ম হয়েছে কোনও-না-কোনও তারা-শরীরের ভিতরে। বহুকাল আগে কোনও-না-কোনও নক্ষত্র তার জীবৎকাল জুড়ে এবং একেবারে তার মৃত্যুমুহূর্তেই মহাবিশ্বকে ‘দান’ করে গেছিল সেইসব পরমাণু, যা দিয়ে আজ আমি তৈরি। আমরা সবাই কোনও-না-কোনও মৃত তারার সন্তান!
আমি তাহলে ভুঁইফোড় নই, ক্ষুদ্র নই, অকিঞ্চিৎকর নই। বড় যে মহাবিশ্ব আর অনন্ত যে সময় প্রবাহ, আমি তারই অংশ। মনে আছে তো, সুইসাইড নোটে এক ভেঙে-পড়া ছোটবেলার কথা লিখেছিল রোহিত ভেমুলা? লিখেছিল ‘My birth is my fatal accident. I can never recover from my childhood loneliness. The unappreciated child from my past’? সমস্ত শৈশব-জুড়ে যারা নিজেকে অকিঞ্চিৎকর ভাবতে শিখেছে, unappreciated, কার্ল সেগান তাদের খানিক মুক্তি দেন।
তা যদি দেন, রোহিত তাহলে ওই ‘fatal accident’-এর বোধ থেকে মুক্তি পেল না কেন একেবারে? সে উত্তরও ওর শেষ চিঠির মধ্যেই আছে আসলে।
এক অন্যরকমের ‘আমি’র সন্ধান দিতে থাকে সেগান, সেকথা আমরা বলেছি। সেকথা রোহিতও জানত। কিন্তু আত্মপরিচয় শুধু সেই ‘অন্যরকম আমি’ দিয়ে তৈরি নয়। আত্মপরিচয় তৈরি হতে থাকে নানা সামাজিক প্রকল্প দিয়ে। ধর্ম, রাজনীতি আর পুঁজি-নিয়ন্ত্রিত সেইসব প্রকল্প। আমি হতে চাই কেবল মৃত তারার সন্তান। আমি থাকতে চাই কেবল সূর্যের কাছে ঋণী। কিন্তু প্রকৃতির থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে ওঠাই এই অসুস্থ ‘আধুনিকতা’র নিয়তি। ‘I loved people without knowing that people have long since divorced from nature’. ভালোবাসাও উপকরণ-বহুল বাঁচার অংশ। রাতে ঘুমনোর আগে, ভালোবাসার আগে, প্রশ্ন করো তুমি কোন দল! কার কাছে যাব তাহলে এখন? ‘It has become truly difficult to love without getting hurt.’
কিন্তু স্বপ্ন দেখত বলেই ছেলেটা লড়াইয়ে ছিল। স্বপ্ন না থাকলে লড়াইও থাকে না কোথাও। আমার সামাজিক আত্মপরিচয় নির্ধারিত হয়ে আছে আমার পদবিতে। আমার ধর্ম-পরিচয়ে। গলা তুলে চিৎকার করে এই পরিচয়কে অস্বীকার করতে চাওয়া মাত্র আমি হয়ে যাই দেশদ্রোহী কিংবা শত্রুপক্ষ। হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা কেড়ে নেয় রাষ্ট্র। স্কলারশিপের টাকা বন্ধ হয়ে যায়। স্বপ্ন দেখার আস্পর্ধা রাষ্ট্র সহ্য করে না। ‘Never was a man treated as a mind. As a glorious thing made up of star dust.’
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: সফদর মারা গেছে, কিন্তু ধমনীতে সে বেঁচে
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
একটি ছেলের কথা বলেছিলেন শঙ্খ ঘোষ তাঁর ‘আত্মঘাত’ কবিতায়। শান্তিনিকেতনে পড়তে এসেছে সে, দূরের গ্রাম থেকে। সেখানকার জীবনে দমবন্ধ লাগে তার। কিন্তু ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। সে একদিন আত্মঘাতী হয়। কিন্তু এক বিশেষ দিনে। বাইশে শ্রাবণ! শঙ্খ ঘোষের মনে হয়, এর পিছনে রয়েছে তার এক গভীর বিশ্বাস। ‘আমার বিশ্বাস আজও কিছু বেঁচে আছে তাই হব/ পঁচিশে বৈশাখ কিংবা বাইশে শ্রাবণে আত্মঘাতী’। সমস্ত স্বেচ্ছামৃত্যু যেহেতু এক একটা অনিবার্য ‘স্টেটমেন্ট’, তাই এই স্টেটমেন্টও এখানে রইল যে, আমি সবার মতো মেনে নিইনি সবকিছু।
রোহিতও মানেনি। মানেনি রাষ্ট্রের দাগিয়ে দেওয়া ‘আমি’র চিহ্নগুলোকে। তাদের সজোরে অস্বীকার করতে করতে ও ভেসে পড়েছে তারাদের দেশে। ও জানত চিৎকার উঠবে এই মৃত্যু থেকে। ‘let my funeral be silent and smooth’, লিখেছিল রোহিত। কিন্তু চিতা যতই নিঃশব্দে জ্বলুক, চিতা নিভে যাওয়ার পরের চিৎকার ফাটিয়ে দিয়েছিল সমস্ত বধিরতাকে। সমস্ত দেশ আর্তনাদ করে উঠেছিল সেদিন। যারা ছিল আর্তনাদ ঢেকে দেওয়ার দলে, তাদেরও প্রতি-চিৎকার, মূল চিৎকারকেও জাগরিত করে তুলছিল বারবার। রোহিত তারাদের দেশে পৌঁছেছে কি না, জানা নেই। কিন্তু ও তারা হয়ে গেছে আজ। এমন এক তারা, যে পথ দেখায়। যে বলে স্বপ্ন দেখতে ভয় পেও না। কার্ল সেগান যেমনটি বলতেন আর কী। কার্ল সেগানের মতো লেখক হওয়া ওর হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ওর জীবনটা যদি একটা ‘রচনা’ হয়, সেই রচনা অনেকটা কার্ল সেগানের লেখার মতোই মায়াবী, তাতে কি কোনও সন্দেহ আছে?