২০১০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয়েছিল রোববার পত্রিকার কালকূট সংখ্যা। সেখানেই কালকূটের একটি অসমাপ্ত নিবন্ধর অংশ, যা প্রায় আত্মজীবনী, স্মৃতির টুকরো কোলাজ, প্রকাশিত হয়। সমরেশ বসুর শতবর্ষে সে লেখা পুনর্মুদ্রিত হল।
মেঘ যায় গলতে, ঝর ঝর ঝরতে। আমি যাই সুধার সন্ধানে। তীব্র বিষ নাম আমার– কালকূট। গরল আমার ধমনীতে। সেই কবিতার মতো বলতে ইচ্ছা করে, ‘চিরসুখী জন ভ্রমে কী কখন, ব্যথীত বেদন বুঝিতে পারে?/ কী যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে/ কভু আশীবিষে দংশেনি যারে।’ আমার দৌড়ঝাঁপ ছুটোছুটি যাই বলো, সেই কারণে। মরি যে! জ্বলি যে! তাই আমি ভ্রমি সুধার সন্ধানে। বাঁচতে কে না চায়? মানুষ তো বহুত দূর, ওটা জীবের ধর্ম। হতে পারি কালকূট। তা বলে অমৃতের সন্ধানে যাব না? এই আকণ্ঠ বিষ নিয়ে বাঁচব কেমন করে?
মনে করার চেষ্টা করি, ওকে কি আমি চিনি? দেখেছি কি কখনো? মানুষটার চোখের দিকে তাকাই। মুখের দিকে দেখি। দেখি পায়ের পাতা থেকে মাথা পর্যন্ত। না, এ বড় বেকায়দার ব্যাপার! ডানদিক দিয়ে দেখতে গেলে একরকম, আর বাঁয়ে গেলে আরেকরকম। একচোখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, চিনি চিনি। আর এক চোখের দিকে তাকিয়ে ধন্দ লেগে যায়। মনে হয়, উঁ হুঁ একে আমি চিনি না। অথচ দেখেশুনে মনে হচ্ছে, মানুষটাকে দেখেছি সেই যেন জন্ম থেকে। এখন যখন আমাকে পুছ করা হচ্ছে, দ্যাখ তো তোমার বিষকূট চোখে, কেমন লাগে? চেন কি না?
এমনটা না তো, ওকে জন্মকাল থেকে খুঁজে বেড়াচ্ছি বলেই, মনে হচ্ছে, দেখে এসেছি, আর সেই জন্যই চেনা চেনা লাগছে, আবার অচেনা লাগছেও? এক-একবার সেই পুরনো দিনের গানটা মনে পড়ে যায়, ‘বহুদিনের চেনা বলে মনে হতেছে/ তুমি কে পাগলিনী হে।’ তবে এক্ষেত্রে পাগলিনী না, পাগল। হ্যাঁ, এই একটা কথা খুঁজে পাওয়া গিয়েছে, ওকে তোমার কালকূট চোখে কেমন দ্যাখ? পাগল দেখি, তবে সেয়ানা পাগল কিনা, সেটা আবার এক ধন্দ!
এখন ওর বাড়ি ফিরে যাবার সময়। যে বন্ধুদের সঙ্গে ও পার্কে খেলা করেছে, তারা ঘরে ফিরে গিয়েছে। ওর পকেটে ছিল পঞ্চম জর্জের ছাপাওয়ালা ঝকঝকে একটা তামার পয়সা। পুরো একটি পয়সার বাদাম কম না। প্যান্টের পকেট বোঝাই করে, তাই চিবিয়ে চলেছে। ঘরে ফেরার গা নেই। ফিরতে দেরি হলে যে কী পেড়ার হবে, তাও যেমন মনে নেই। তারপরে ওর দৃষ্টি গেল সেই ছেলেগুলোর দিকে, যারা লোকের জল শুষে নেওয়া ডাবের খোলায় আঙুল ঢুকিয়ে, নেয়াপাতি খুঁটিয়ে খাচ্ছে। ব্যাপারীদের কাছে, হাত বাড়িয়ে কলা চাইছে। একটা কলা দ্যান। ওর চকচকিয়ে ওঠা দৃষ্টি তারপরে গেল ভিখিরি ছেলের দিকে, হাত বাড়িয়ে বলে, বাবু একটা পয়সা দ্যান। বাবু, একটা আধপয়সা দ্যান। ও বাদাম চিবোতে ভুলে গেল। কেন? এমন দৃশ্য ও কি জীবনে দেখেনি? রোজই তো দেখে থাকে। এমন দেখছে যেন, আর কখনও দেখেনি। ওর চোখদু’টি জ্বলজ্বলিয়ে উঠল। পায়ে পায়ে এগিয়ে এল রাস্তার ওপরে, পশ্চিমের সদরঘাটের মোড়ে, ভিড়ের মধ্যে দাঁড়াল। ওর মনের রাজ্যে একটা কোনও দুর্ঘটনা ঘটেছে নিশ্চয়। টেপা ঠোঁট, শক্ত মুখ আর জ্বলজ্বলে দৃষ্টি দেখে তা বোঝা যায়। সকলের মুখের দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছে, যেন সে কারোকে খুঁজছে। তার পরেই কী অবাক কাণ্ড দ্যাখো, এক মাঝবয়সী ভদ্রলোকের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, বাবু একটা পয়সা দ্যান।
ভদ্রলোক অন্যমনস্ক চোখ ফিরিয়ে তাকান, একটু যেন অবাক চোখেই, কয়েক মুহূর্ত ওকে দ্যাখেন। তার পরে জামার পকেট থেকে একটা পয়সা বের করে, ওর হাতে দিয়ে চলে যান। ও পয়সাটা দেখল। ভদ্রলোককে দেখল পেছন থেকে। মুখ ফিরিয়ে, আবার অন্য লোকের মুখের দিকে তাকাল। এখন ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছে, ও যেন একটা যুদ্ধে নেমে পড়েছে। এখন আর পিছনে যাবার প্রশ্ন নেই। নতুন ভিখিরি ছেলেটা এগিয়ে চলল। হাত বাড়িয়ে সকলকে এক কথা। বাবু একটা পয়সা দ্যান।
কেউ দেয়, কেউ দেয় না। তবে ভিক্ষাদাতাদের সকলের চোখেই পলকের জন্য একটু জিজ্ঞাসা জাগে, একটু বা বিস্ময়। ও নিজেও জানে না, হাতের মুঠোয় কত পয়সা জমে উঠেছে। এখন বিচারের বয়ান কী, বলো। এমন বালকের না সাবালকের, এই মনের গুণের বিধান কে দেবে? ওর জীবনের পটভূমি ঝটিতি একেবারে পাল্টে গেল? ও তো দেখল না, ওর দিকে তাকিয়ে থাকা সংসারের চোখ বিস্ময়ে ভরা। ও কি বাড়ির কথা ভুলে গিয়েছে? পরিবার মা বাবা দিদি দাদা, সর্বোপরি এই শহর, যে শহরের ছেলে ও, সব যেন ছিঁড়ে ফেলে, ছুড়ে দিয়ে একেবারে ভিন পথে ছুট দিয়েছে।
ওর নতুন পথের যাত্রা ওকে সদরঘাটের কোথায় টেনে নিয়ে গিয়েছে, খেয়াল নেই। মোতিমহল বায়োস্কোপের ঘর ছাড়িয়ে, ভিড়ের মধ্যে হাত পেতে ঘুরছে, বাবু একটু পয়সা দ্যান।
…
এই বয়সে এসে এখনো অবাক মানি, কেন ও সেই দশ বছর বয়সে এমন কাণ্ডটা করেছিল! জবাব একটা পাই, সেটা আবার মন-গড়া কি না, তাই বা কে জানে।
বন্ধুদের সঙ্গে খেলা শেষে, পকেটে বাদাম পুরে, বুড়ি গঙ্গার বুকে উদাস চোখে তাকিয়ে বাদাম চিবোচ্ছিল, তারপরে ওর নজর কেড়ে নিয়েছিল দুর্দশাগ্রস্ত হত-ভাগ্যের দল, যারা ওরই বয়সী। নজরের পরেই মন। তারপর কি উথলে উঠেছিল ওর মনে? এটা জানি, ওর পয়সার তখনই কোনো দরকার ছিল না। সে-কথা ওর মনেও আসেনি। তবে? রাগ? ঘৃণা? যন্ত্রণা? ওরা যদি ভিক্ষে করে, তবে চল, তুইও ভিক্ষে করবি। কে তুই ভদ্রলোকের ছেলে, চার বেলা পেট পুরে খাস, খেলে বেড়াস, হাত পাতলে মায়ের আঁচল থেকে পয়সা বেরোয়। যা ভিক্ষে কর।
এ-ই কি সত্যি? তবে, ও যে ত্রুদ্ধ, তা বুঝেছি। ওর বুকে দাহ, এ কথা মনে হচ্ছে। মন যে কেবল টাটায়, তা তো না, জটা খুললেই দক্ষ-যজ্ঞ। ও তো কালকূট না, বিষ নিয়ে, বিষে জরজর। রাগে আর ঘৃণায়, কখনো কখনো ও ক্ষ্যাপা। দশ বছর বয়সের ছেলেটার মধ্যে, সেই প্রতিক্রিয়াটাই যেন দেখছিলাম।…
ওকে আমি নির্ঘাত চিনি, সে কথা কখনো বলতে পারব না। চিনি বলাও ভুল, কথা হয়েছে দেখাব। আমার চোখে দেখা। তবে সেই যে দেখেছিলাম, দশ বছর বয়সে, রাগের ক্ষ্যাপা হাত পেতে ভিক্ষে করতে আরম্ভ করেছিল, সেই রাগটা ওকে ছেড়ে যায়নি কখনো। দেখি, এখনো রেগে যায়, আর রাগলে, এমন কাণ্ড করে, সে ভিক্ষে করার মতোই, চমকে দেওয়া অবাক কাণ্ডের মতো। তখন লাগে লাঠালাঠি। আগে ছিলেন বাবা, মা, দাদা, দিদি, এখন রয়েছেন সমাজের লোকজন। তাঁরা গণ্যিমান্যি লোক, তাঁদের কত দায়-দায়িত্ব। তুমি রেগে গিয়ে, যা খুশি তাই করবে, সে-অনাচার তাঁরা মানতে পারেন না। তখন তুমি নিজের মনে যা খুশি তাই করতে, লোকের কিছু আসত যেত না। ধাক্কা যা লাগবার তোমার পরিবারে গিয়ে লাগত। মাথা ব্যথা পরিবারের, বাপ-মায়ের। তাঁরা ঘরের মধ্যে শাসন করতেন। দশজনের কিছু আসত যেত না। তখন তাঁরা তোমাকে পই-পই করে বলেছেন। ‘যা ভাল করে পড়গা ইস্কুলে, নইলে দুঃখ পাবি শেষকালে।’
দেখছি, সেইটাই ওর ধারাতে বহে গিয়েছে। তাঁরা ওকে যে-ইস্কুলে যে-পাঠ নিতে বলেছিলেন, সে-ইস্কুলে সে-পাঠ ও নেয়নি। ওর মায়ের বিশ্বাস ছিল এরকম; তাই বলতেন, অষ্টম গর্ভের ছেলে স্বাভাবিক হয় না। তা ওর মায়ের কথার মধ্যে কিছু কিঞ্চিৎ সত্য আছে বলে মনে হয়। তা না হলে, দশের সঙ্গে থেকে, দশের সঙ্গে এক রা-য়ে কেন বাজে? দশে তো তাই চায়। আমরা এক চাকের মৌমাছি, আমরা ঐক্যবদ্ধ। কথায় বলে সব শিয়ালের এক রা। তুমি ভিন্ রা দিতে গেলে চলবে কেন?
তখনই গোলমাল লেগে যায়। হৈ-হল্লা রাগারাগি চিৎকার হবেই তো। আমার পুরো সায় আছে। তখন তুমি ছিলে অবাধ্য ইউরা ছাওয়াল। এখন তোমার পরিচয়, বাংলায় যারে কয়, লেখক। কথাটার পুরোপুরি মানেও আমি জানি না। যারা বই লেখে, তাদের লেখক বলে। তাই তো? ও বই লেখে। তার জন্যই ওর নাম সমরেশ। আমি যতদূর জানি, ওর বংশদত্ত নাম ওটা না। শুনেছিলাম ওর নাম সুরথনাথ। সমরেশ কবে থেকে হল, স্মরণে নেই। বোধহয় বই লেখার আগে থেকেই, নিজের এই নামটা ও প্রচার করেছিল। সম্ভবত যখন থেকে হাতে লিখে ম্যাগাজিন বার করত।
হ্যাঁ, পাকামি ছিল ষোল আনা। সে কথা বলতে গেলে একটি পাকায়ন লিখতে হয়। আমার দেখাটা সেইরকম। সেই কী পাকামি বলে, তাই। এমন পাকামি তোমরা কত দেখেছ। পাকামি করতে গিয়ে আর দশটা ছেলের মতো, কোনোদিন ইস্কুলে যায়নি। সেই ঢাকা শহরের লক্ষ্মী বাজারে, গিরিশ মাস্টারের পাঠশালা থেকে বেরিয়েছিল। আর কোনোদিন নিয়মমাফিক বিদ্যালয়ের সীমানায় পাঠানো যায়নি। ওর ভগ্নিপতি ছিলেন ঢাকার গ্র্যাজুয়েট, উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। সেখানে জোর করে কিছুদিন পাঠানো হয়েছিল। পাঠালে কী হবে, ইস্কুলে যাবার জন্য তো পাহারাদার পাঠানো যায় না। মা খাইয়ে-দাইয়ে, ছেলেকে পাঠাবেন ইস্কুলে। ছেলে বই বগলদাবা করে হাঁটা দিল কোন্দিকে? না, শ্মশানের দিকে।
মূল রচনার নির্বাচিত অংশের পুনর্মুদ্রণ, বানান অপরিবর্তিত