স্বাধীন ইচ্ছা বা Free Will যে একমাত্র পরমা শক্তিরই আছে, তাঁর ইচ্ছা-ব্যতীত গাছের পাতাটিও যে নড়ে না– কথামৃতে শ্রীরামকৃষ্ণের মুখে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। বিবেকানন্দের ‘আর কোন সঙ্কল্প রাখি না’-ও তারই জোরালো প্রতিধ্বনি। মাতৃশক্তির এই স্বাধীন ইচ্ছার কথা ভাবতে গেলে, আরও এক জায়গায় মিলে যায় পরমহংসদেব ও স্বামীজীর ভাবনা। কিছু সময় আগে কবিতার আলোচনায় প্রকৃতি ও অন্ধকারের সঙ্গমে কালীর প্রসূত হওয়ার যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলাম, তার সমীকরণ আর ততটা সহজ থাকে না।
শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, ‘কালীই ব্রহ্ম, ব্রহ্মই কালী’। দীর্ঘ সহস্রাব্দব্যাপী ব্রহ্ম ও শক্তির ভেদাভেদ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক এক লহমায় শান্ত হয়ে যায় সে কথায়। শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শনে ভেদবুদ্ধি ছিল না, তাই সহজ ভাষায় ব্রহ্ম ও শক্তিকে অভেদ বলে বোঝাতে পেরেছিলেন তিনি– ‘একই বস্তু, যখন তিনি নিষ্ক্রিয়– সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় কোন কাজ করছেন না– এই কথা যখন ভাবি, তখন তাঁকে ব্রহ্ম বলে কই। যখন তিনি এই সব কার্য করেন, তখন তাঁকে কালী বলি, শক্তি বলি। একই ব্যক্তি নাম-রূপভেদ।’ তাঁর কথায়, যেমন অগ্নি ও তার দাহিকাশক্তি, যেমন দুধ ও দুধের ধবলত্ব, বা সাপ ও সাপের তির্যকগতি– তেমনই ব্রহ্ম আর শক্তি। একটি ব্যতীত অন্যটিকে ভাবা অসম্ভব।
কিন্তু তাঁর প্রিয় শিষ্য নরেন্দ্রনাথের পথটি ছিল আলাদা। দক্ষিণেশ্বরে প্রথম প্রথম যখন যাওয়া-আসা করছেন, তখন ব্রাহ্মমনস্ক, নিরাকার ব্রহ্মে বিশ্বাসী নরেনের কাছে দক্ষিণেশ্বরের শ্রীশ্রী ভবতারিণী নিছক এক প্রাণহীন মূর্তি ব্যতীত আর কিছু ছিলেন না। এমনকী, শ্রীরামকৃষ্ণের ‘মায়ের কথা কথা বলা’-কে গুরুত্ব দেওয়া তো দূরস্থান, শ্লেষভরা বাক্যবাণে বিঁধেছিলেন নরেন্দ্রনাথ!
কীভাবে ক্রমে তাঁর বিশ্বাস এল, কীভাবে প্রচণ্ড দারিদ্রর মুখেও ভবতারিণীর কাছে নরেন বিবেক-বৈরাগ্য প্রার্থনা করলেন, বা ‘নরেন কালী মেনেছে’ বলে শ্রীরামকৃষ্ণের সেই আনন্দ– আজ বহুশ্রুত, বহুচর্চিত। হ্যাঁ, কালী মেনেছিলেন নরেন্দ্রনাথ। শুধু মানেনইনি, পরবর্তী জীবনে স্বামী বিবেকানন্দের মুখে কালী-বিষয়ক একাধিক বিস্ময়কর উপলব্ধি বর্ণিত হয়েছে, শক্তিস্বরূপা সাকার মাতৃ-আরাধনা অনুষ্ঠিত হয়েছে তাঁর নিজহাতে। জীবনের শেষদিনেও প্রাণভরে শ্যামাসংগীত গেয়েছেন বিবেকানন্দ– ইতিহাস জানায়; আর কালীর উদ্দেশ্যে তিনি রচনা করেছেন দু’টি রুদ্ধশ্বাস কবিতা– ‘Kali the Mother’ (সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের বঙ্গানুবাদ ‘মৃত্যুরূপা মাতা’) ও ‘নাচুক তাহাতে শ্যামা’।
‘Kali the Mother’ কবিতাটি তার স্রষ্টার মতোই, ক্ষণজন্মা। মঙ্গলময়ী, অভয়দাত্রী মায়ের যে রূপটি বারবার উঠে আসে শ্রীরামকৃষ্ণের কথায় বা গানে, স্বামী বিবেকানন্দ সেই একই মাতৃশক্তিকে অনুভব করেছিলেন ভিন্নভাবে– প্রলয়ের সাজে। উইলিয়াম ব্লেকের ‘The Tyger’ কবিতায় যেমন বনের ভয়াল অন্ধকারের মধ্যে তার চেয়েও বেশি ভয়াল বাঘের দু’টি চোখ উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে, বা উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসের ‘The Second Coming’ কবিতায় আত্মহননকারী সভ্যতার পরিত্রাতা হয়ে করুণাঘন যিশু নন, বিকটরূপী এক নরপশু আসে– ধ্বংসের মধ্য দিয়ে নষ্টের অবসান ঘটাবে বলে, বিবেকানন্দের চোখেও অপার্থিব সেই মাতৃশক্তি নিজেকে প্রকাশ করেন পার্থিব সমস্ত কলুষ বা অন্ধকারের চেয়েও তীব্রতর অন্ধকার হয়ে উঠে, মৃত্যুরূপা হয়ে। অন্ধকার অন্ধকারকে খণ্ডন করে যেন জন্ম দেয় শাশ্বত আলোকের।
কবিতার প্রথমভাগে উত্তাল, অস্থির প্রকৃতি নিশ্ছিদ্র অন্ধকার রাত্রির সঙ্গে সঙ্গমে উন্মত্ত–
“The stars are blotted out,
The clouds are covering clouds.
…
The sea has joined the fray,
And swirled up mountain-waves,
To reach the pitchy sky.”
রচনাটির প্রথমার্ধ পেরিয়ে, প্রকৃতি ও আঁধারের সেই সঙ্গমের শেষে গভীর প্রসবযন্ত্রণা থেকে উদ্ভূত হচ্ছেন কালী। প্রসবযন্ত্রণাটি নিশ্চিতভাবে কার, বলা কঠিন। কালী প্রকৃতিস্বরূপা, আঁধারস্বরূপাও বটে। কবিতায় প্রথমবার বিবেকানন্দ আহ্বান করছেন ‘মা’-কে–
“Dancing mad with joy,
Come, Mother, come!”
সেই কালীর বর্ণনাও ভয়াল–
“For terror is Thy name,
Death is in thy breath,
And every shaking step
Destroys a world for e’er.”
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের বঙ্গানুবাদও অনুরণন জাগায়–
‘করালি! করাল তোর নাম, মৃত্যু তোর নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে
তোর ভীম চরণ-নিক্ষেপ প্রতিপদে ব্রহ্মান্ড বিনাশে!’
………………………………………………
মঙ্গলময়ী, অভয়দাত্রী মায়ের যে রূপটি বারবার উঠে আসে শ্রীরামকৃষ্ণের কথায় বা গানে, স্বামী বিবেকানন্দ সেই একই মাতৃশক্তিকে অনুভব করেছিলেন ভিন্নভাবে– প্রলয়ের সাজে। উইলিয়াম ব্লেকের ‘The Tyger’ কবিতায় যেমন বনের ভয়াল অন্ধকারের মধ্যে তার চেয়েও বেশি ভয়াল বাঘের দু’টি চোখ উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে, বা উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসের ‘The Second Coming’ কবিতায় আত্মহননকারী সভ্যতার পরিত্রাতা হয়ে করুণাঘন যিশু নন, বিকটরূপী এক নরপশু আসে– ধ্বংসের মধ্য দিয়ে নষ্টের অবসান ঘটাবে বলে, বিবেকানন্দের চোখেও অপার্থিব সেই মাতৃশক্তি নিজেকে প্রকাশ করেন পার্থিব সমস্ত কলুষ বা অন্ধকারের চেয়েও তীব্রতর অন্ধকার হয়ে উঠে, মৃত্যুরূপা হয়ে।
………………………………………………
বিবেকানন্দের এই প্রলয়রূপিণী কালীকে কে লাভ করবে? শ্রীরামকৃষ্ণ মাতৃকৃপালাভের সহজ পথ দেখিয়েছিলেন– ব্যাকুলতা। যাঁকে জানতে চাও, পেতে চাও, তাঁর জন্য কাঁদো। বিবেকানন্দের ‘করালি’-কে লাভ করার পথটি দুর্গম। কবিতাটি তিনি শেষ করছেন সে কথা বলেই–
“Who dares misery love,
And hug the form of death,
Dance in Destruction’s dance,
To him the Mother comes.”
(‘সাহসে যে দুঃখ দৈন্য চায়, মৃত্যুরে যে বাঁধে বাহুপাশে,
কালনৃত্য করে উপভোগ, মাতৃরূপা তারি কাছে আসে।’)
১৮৯৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কাশ্মীরে ক্ষীরভবানী দর্শনের পর এই কবিতাটি লিখেছিলেন বিবেকানন্দ। কবিতাটি যা জানায়, তার সঙ্গে আরও কিছুটা জানা যায় ‘স্বামী শিষ্য সংবাদ’-এর পূর্ব কাণ্ডের ষোড়শ বল্লীতে। ওই বছরই তীর্থ সেরে মঠে ফেরার পর নভেম্বর মাসে শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী গেছেন স্বামীজির কাছে। শিষ্যকে স্বামীজি বলছেন– একদিন ক্ষীরভবানীর পূজা করতে করতে তাঁর মনে হচ্ছে, ‘মা ভবানী এখানে সত্যসত্যই কতকাল ধরিয়া প্রকাশিত রহিয়াছেন। যবনেরা আসিয়া তাঁহার মন্দির ধ্বংস পুরাকালে করিয়া যাইল, অথচ এখানকার লোকগুলো কিছু করিল না। হায়, আমি যদি তখন থাকিতাম, তবে কখনো উহা চুপ করিয়া দেখিতে পারিতাম না।’ ভাবমাত্র, হঠাৎই যেন স্পষ্ট শুনছেন মাতৃকণ্ঠ– ‘আমার ইচ্ছাতেই যবনেরা মন্দির ধ্বংস করিয়াছে, আমার ইচ্ছা আমি জীর্ণ মন্দিরে অবস্থান করিব। ইচ্ছা করিলে আমি কি এখনি এখানে সপ্ততল সোনার মন্দির তুলিতে পারি না? তুই কি করিতে পারিস? তোকে আমি রক্ষা করিব, না তুই আমাকে রক্ষা করিবি?’
একথা বলে বিবেকানন্দ যোগ করছেন, ‘ঐ দৈববাণী শোনা অবধি আমি আর কোন সঙ্কল্প রাখি না। মঠ-ফঠ করবার সঙ্কল্প ত্যাগ করেছি; মায়ের যা ইচ্ছা তাই হবে।’
এই কথায় এসে, হাজার ভিন্নতা সত্ত্বেও শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের কালী-দর্শন মিলেমিশে যায়। স্বাধীন ইচ্ছা বা Free Will যে একমাত্র পরমা শক্তিরই আছে, তাঁর ইচ্ছা-ব্যতীত গাছের পাতাটিও যে নড়ে না– কথামৃতে শ্রীরামকৃষ্ণের মুখে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। বিবেকানন্দের ‘আর কোন সঙ্কল্প রাখি না’-ও তারই জোরালো প্রতিধ্বনি।
মাতৃশক্তির এই স্বাধীন ইচ্ছার কথা ভাবতে গেলে, আরও এক জায়গায় মিলে যায় পরমহংসদেব ও স্বামীজীর ভাবনা। কিছু সময় আগে কবিতার আলোচনায় প্রকৃতি ও অন্ধকারের সঙ্গমে কালীর প্রসূত হওয়ার যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলাম, তার সমীকরণ আর ততটা সহজ থাকে না। শাশ্বত ইচ্ছাশক্তি যদি একমাত্র ‘মা’-এরই হয়, তবে কালীর কি আদৌ প্রসূত হওয়া সম্ভব? না তিনি প্রসূতি? না কি, তিনি দুই-ই? আঁধার ও প্রকৃতিকে গর্ভে ধারণ করছেন তিনি, আবার তাদের মিলনে নিজেই প্রকট হচ্ছেন? অবাক হয়ে কথামৃতে দেখি, সেই ‘পাগলা বামুন’ বলছেন– ‘‘আদ্যাশক্তি… জগৎপ্রসব করেন, আবার জগতের মধ্যে থাকেন। বেদে আছে ‘ঊর্ণনাভির’ কথা; মাকড়সা আর তার জাল। মাকড়সা ভিতর থেকে জাল বার করে, আবার নিজে সেই জালের উপর থাকে।”
……………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………..