সোশাল মিডিয়ার হিংস্র জগতের বাইরেও একখানা নির্মল পৃথিবী আছে। যেখানে নীরজ চোপড়ার সহজ-সরল মা সরোজ দেবী থাকেন। যেখানে ইংল্যান্ড-নিবাসী অজ্ঞাতপরিচয় ট্যাক্সি চালক থাকেন। যেখানে আমি, আপনি, কিংবা আমাদের মতো অনেকে থাকে। ওয়াঘা বলে কিছু নেই সে প্রদেশে, নেই কোনও লাইন অফ কন্ট্রোল। বেয়নেটের ঠোঁট সে দেশে সযত্নে বেঁকিয়ে দেয় শান্তির সাদা পায়রারা। সে দেশে লাহোর যা, দিল্লিও তা। করাচি যা, মুম্বইও তা। যে নামে ইচ্ছে, ডাকতে পারেন সে দেশকে। ভাষা আপনার, প্রয়োগও আপনার।
‘২০১২ মে মুম্বই মে ম্যাচ হোনে সে আচ্ছা হোতা!’
‘কিঁউ? কলকাত্তা কে লোগ তো আপলোগো সে ইতনা প্যয়ার করতে হ্যায়। ফির মুম্বই কিঁউ?’
‘ইয়েস, ক্যালকাটা ইজ ডিফারেন্ট। ফির ভি।’
‘ক্যয়া আপকা কোই দোস্ত রহতা হ্যায় মুম্বই মে?’
‘মেরি নানি রহতি হ্যায় ওঁহা! কভি উনসে মিলা নহি!’
প্রায় বছর ছয়েক আগে, দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে দুধসাদা শার্ট আর নীল জিন্সের যে সৌম্যকান্তি ভদ্রলোকের সঙ্গে মুখবন্ধ-বর্ণিত কথোপকথন হয়েছিল, তাঁর একখানা পেশাগত নাম আছে। মিস্টার পাকিস্তান ক্রিকেট! পিতৃদত্ত নাম শাহিদ হাসমি। এশিয়া কাপ কভার করতে আরব আমিরশাহি গিয়েছি। বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি কিংবা এশিয়া কাপে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশ সম্মুখসমরে নামলে, ভারত-পাকিস্তানের সাংবাদিককুলে এক অলিখিত ‘ওয়াঘা চুক্তি’ হয়ে যায়! দু’দেশের কাগজে চিরশত্রু দেশের সাংবাদিককে দিয়ে লেখানো-টেখানো চলে। টিভি শোয়ে ডাক পড়ে। শাহিদও ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সময় কিছু লেখাপত্তর দিয়েছিলেন ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এ। যার ‘পেমেন্ট’ দিতে হত। সে প্রসঙ্গে এ কথা, সে কথা এবং সব শেষে তাঁর দুঃখ-শোকের মৌন-মিছিল!
সে দিন শাহিদ সাহেবের হাহাকার-প্যাপিরাস পড়ে মনে হয়েছিল, ২০১২ সালে ভদ্রলোক গেলেন না কেন মুম্বই? শুনলাম, ’৪৭-এর দেশভাগের পর শাহিদরা চলে যান পাকিস্তান। কিন্তু তাঁর ‘নানি’ থেকে যান মুম্বইয়ে। পরে আচম্বিতে মনে হয়েছিল, চাইলেও বা মুম্বই যেতেন কী করে শাহিদ? আন্তর্জাতিক ইভেন্ট কভার করতে এলে পাকিস্তানি সাংবাদিকদের ভিসা শহর-ভিত্তিক হয়। অর্থাৎ, যে শহরে তোমার দেশের খেলা, সে শহরে তোমার গতিবিধি সীমাবদ্ধ। এবং সেটাও অবাধ নয়। নিত্যদিনের থানায় হাজিরা সাপেক্ষ। শুনেছি, ওয়াঘার ও পারেও তাই। হিন্দুস্তানের সাংবাদিকদের জন্য একই নিয়ম, একই ভাবে থানায় প্রতিদিনের হাজিরার যন্ত্রণার কাহিনি।
এই তো ক’মাস আগে। ওয়ান ডে বিশ্বকাপ খেলতে বাবর আজমের পাকিস্তান কলকাতা এসেছিল যখন, প্রখ্যাত ফুটবলার বলাই দে’র বাড়ির খোঁজ করছিলেন জিও টিভির সাংবাদিক ফৈজান লাখানি। সাক্ষাৎকার নেবেন বলে। কারণ, বলাই ভারত ও পাকিস্তান (যা আজ বাংলাদেশ) দু’দেশের জার্সিতেই ফুটবল খেলেছিলেন! তা, নাম-ধাম, ফোন নম্বর, ঠিকানা-পত্তর নেওয়ার পরেও আর এগোননি তিনি। কারণ, বলাইবাবুর বাড়ি লিলুয়া। হাওড়া জেলা অন্তর্গত। পাকিস্তানি সাংবাদিকের সেখানে যাওয়ার অনুমতি নেই। তাঁর বিচরণভূমি কলকাতা এবং শুধুমাত্র কলকাতা!
নীরজ চোপড়ার মায়ের মন্তব্য সে প্রেক্ষিতে এক দমকা হাওয়া বটে। কিন্তু পাল্টা হাওয়া কি না, জানি না। ওই যে, অলিম্পিক জ্যাভলিনে পাকিস্তানের আর্শাদ নাদিমের রাক্ষুসে থ্রো-র কাছে ছেলে নীরজের পরাজয়ের পর যা বলেছিলেন তিনি। সরোজ দেবী বলেছিলেন যে, ‘সোনা যে পেয়েছে, সে-ও আমার ছেলে। নীরজ সোনা পায়নি বলে আমার কোনও দুঃখ নেই!’ যা নিয়ে প্যারিসে ‘সংবাদ প্রতিদিন’ প্রতিনিধি অরিঞ্জয় বোস নীরজকে প্রশ্ন করলে সহাস্যে তিনি বলে দেন, ‘আমার মা বড় সহজ-সরল গ্রামের মানুষ। সোশাল মিডিয়া জানেন না। তার বাইরের পৃথিবীর প্রতিভূ উনি।’ যে ঘটনার পর আবেগাপ্লুত শোয়েব আখতারকে লিখতে দেখেছি, ‘একজন মা-ই পারেন এ কথা বলতে। অ্যামেজিং!’ স্বয়ং আর্শাদকে বলতে শুনেছি, ‘নীরজের মা, আমারও মা!’
ভারত ও পাকিস্তান– দু’দেশের স্বাধীনতা দিবস লগ্নে বড় মিঠে এ বাচন-সারি। পাকিস্তানেরটা গতকাল গেল। ভারতের আজ। দুই প্রতিবেশীর ক্ষয়াটে সম্পর্ক জোড়া দিতে সম্প্রীতির নতুন ‘রানার’ পেলে মন্দ লাগার কারণও নেই। হিংসা, রক্তপাত, ধর্ষণ, খুন, সাম্প্রদায়িক হানাহানির সংখ্যাগরিষ্ঠ পৃথিবীতে এ সম্মান, এ স্বাভাবিক মনুষ্য আদানপ্রদান আজও যে সাময়িক শান্তির নীড়। এক পশলা মুক্তি আন্দোলন। কিন্তু আদতে লাভ কি হবে? বিম্বিষার কাঁটাতার উপড়ে উড়বে চিরশান্তির শ্বেত-পায়রা?
…………………………………………………………………………
নীরজ চোপড়ার মায়ের মন্তব্য সে প্রেক্ষিতে এক দমকা হাওয়া বটে। কিন্তু পাল্টা হাওয়া কি না, জানি না। ওই যে, অলিম্পিক জ্যাভলিনে পাকিস্তানের আর্শাদ নাদিমের রাক্ষুসে থ্রো-র কাছে ছেলে নীরজের পরাজয়ের পর যা বলেছিলেন তিনি। সরোজ দেবী বলেছিলেন যে, ‘সোনা যে পেয়েছে, সে-ও আমার ছেলে। নীরজ সোনা পায়নি বলে আমার কোনও দুঃখ নেই!’
…………………………………………………………………………
মহাকাল জানে! মানুষ হিসেবে অক্ষম আশাই করা যেতে পারে মাত্র। করার নেই যে কিছু। আমরা যারা নয়ের দশকের জাতক, প্রথমে টলমল পায়ে হাঁটতে শিখেছি। সাইকেল চড়েছি। তারপর সোজা সানি দেওল দেখেছি! দেখেছি, কেমন অবলীলায় সানি ‘পাজি’ দেদার পেটাচ্ছেন পাকিস্তানকে! কখনও টিউবওয়েল উঁচিয়ে, কখনও ‘ল্যান্ডমাইন’ বগলে চেপে! ‘বর্ডার’, ‘গদর এক প্রেম কথা’, ‘হিন্দুস্তান কী কসম’–কী এক-একখানা জাতিরসে পরিপূর্ণ ঠাসা দেশাত্মবোধক সিনেমা, বাপ রে বাপ! খোঁজ না নিয়েও লিখে দিতে পারি, এ সমস্ত সিনেমা ওয়াঘার ও পারেও হয়। ‘স্যারিডন’-এর ব্যবসা যা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলে। মুশকিল হল, এ বোধ জন্মাতে বড় সময় নেয়। কখনও বা জন্মায়ই না। এক্ষেত্রেও কিছু করার নেই।
দু’দেশের মানুষকেই শৈশব থেকে ঘাড় ধরে শেখানো হয়, ‘এলওসি’ পারের ‘আওয়াম’ মহা খতরনাক! তারা রক্ত ছাড়া কিছু বোঝে না, জানে না। অবশ্যই পাকিস্তানের উগ্র মৌলবাদ সময়-সময় রক্তাক্ত করেছে ভারতকে। তার যোগ্য জবাবও দিতে হয়েছে। লড়তে হয়েছে, যুদ্ধ করতে হয়েছে। কিন্তু তার নেপথ্যে সর্বক্ষণ ছায়ার মতো থেকেছে সীমান্ত-উত্তেজনার রাজনৈতিক মুদ্রা। যে মুদ্রা বিনা দু’দেশের রাজনীতি অচল! অধিকাংশ কখনও ভাবতেই যায়নি কিংবা চায়নি যে, ভারত বা পাকিস্তান, দু’দেশের গরিষ্ঠ মানুষ মোটেও ‘খতরনাক’ নয়। তারা কেউ রক্তের ব্যবসা করে না। বরং তারা বড় সাধারণ, অতীব সাধারণ। সিন্ধু সভ্যতার দু’প্রান্তে থেকে যারা দু’প্রান্তকে ছুঁয়ে দেখতে চায়। বারবার। যারা ‘নিমন্ত্রণ’ বা ‘দাওয়াত’-এর কথা বলে। ‘মেহমান নওয়াজি’ বা ‘আতিথেয়তা’-র গল্প শোনায়। বললে বিশ্বাস করবেন না, ইংল্যান্ডে গত বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল কভার করতে গিয়ে এক পাকিস্তানি ট্যাক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, যাঁর ভিসার আবেদন বারবার খারিজ করে দিয়েছে ভারতীয় দূতাবাস। ভদ্রলোক পাঞ্জাবি মিত্র-র সঙ্গে দেখা করবেন বলে একবার অমৃতসর যেতে চেয়েছিলেন। পারেননি। কিন্তু ভিসা জোটেনি বলে তিনি ভারতের প্রতি বিদ্বেষও দেখাননি। উল্টে ওভালে গিয়ে বিরাট কোহলি-রোহিত শর্মাদের উদাত্ত সমর্থন করে এসেছিলেন! ভারতীয় দূতাবাসের প্রতিও কোনও রাগ-ক্ষোভ দেখিনি তাঁর মধ্যে। বরং এক স্বপ্নের কাহিনি শুনিয়েছিলেন সে অজ্ঞাতপরিচয়। বলেছিলেন, একদিন আসবে, যে দিন হিন্দুস্তানিদের পাকিস্তান, আর পাকিস্তানিদের হিন্দুস্তান যেতে কোনও বাধা থাকবে না! কোনও ভিসা লাগবে না! ভদ্রলোক বলেছিলেন যে, অপেক্ষায় থাকবেন তিনি। একদিন না একদিন, তিনি ঠিক যাবেন ইন্ডিয়া। যাবেন অমৃতসর। দেখা করবেন, ভারতীয় বন্ধুর সঙ্গে। যাবেনই!
………………………………………………….
আরও পড়ুন অর্পণ গুপ্তর লেখা: হ্যান্ডশেক না করার স্বাধীনতা
………………………………………………….
আর তাই, ঠিকই বলেছেন নীরজ চোপড়া। সোশাল মিডিয়ার হিংস্র জগতের বাইরেও একখানা নির্মল পৃথিবী আছে। যেখানে তাঁর সহজ-সরল মা সরোজ দেবী থাকেন। যেখানে ইংল্যান্ড-নিবাসী অজ্ঞাতপরিচয় ট্যাক্সি চালক থাকেন। যেখানে আমি, আপনি, কিংবা আমাদের মতো অনেকে থাকে। ওয়াঘা বলে কিছু নেই সে প্রদেশে, নেই কোনও লাইন অফ কন্ট্রোল। বেয়নেটের ঠোঁট সে দেশে সযত্নে বেঁকিয়ে দেয় শান্তির সাদা পায়রারা। সে দেশে লাহোর যা, দিল্লিও তা। করাচি যা, মুম্বইও তা। যে নামে ইচ্ছে, ডাকতে পারেন সে দেশকে। ভাষা আপনার, প্রয়োগও আপনার।
বাংলায়, মানবতা। হিন্দিতে, ইনসানিয়ত। ইংরেজিতে হিউম্যানিটি!
………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………..
পাশাপাশি এ-ও বলতে হবে, রবীন্দ্রনাথের আঁকা নারীমুখে যেমন অনেকে নতুন বউঠানের মিল খুঁজে পান, তেমনই কারও চোখে সেখানে উদ্ভাসিত ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর আদল। এই দ্বিতীয় মতে, চিত্রী রবি ঠাকুরের চোখে ওকাম্পোর ছায়া নিঃসন্দেহে আরও প্রবলতর, কারণ নতুন বউঠান সেখানে দূর গ্রহান্তরের বাসিন্দা।