Robbar

সময় হয়েছে মেয়েদের সমান অর্গাজমের দাবি করার

Published by: Robbar Digital
  • Posted:March 7, 2025 10:00 pm
  • Updated:March 8, 2025 6:17 pm  

২০১৯ সালের একটি কন্ড‌োমের বিজ্ঞাপনে বলা হয় যে, সত্তর শতাংশ ভারতীয় মহিলা প্রতিবার বিষমকামী শারীরিক মিলনের সময় অর্গাজমের আনন্দ পান না। এবার এই ‘অর্গাজম’ শব্দটির বাংলা খুঁজতে গিয়ে কোনও জুতসই কাছাকাছি শব্দও খুঁজে পাওয়া গেল না। এই যে শব্দ না-থাকা সেটাও একটি রাজনীতি। নারীর শারীরিক চাহিদাকে নামহীন, শব্দহীন অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার রাজনীতি। যৌনতার পাওয়ার-পলিটিক্স, যাতে পিতৃতন্ত্রের আধিপত্যবাদ চলে। যা নারীদের শুধু শেখায়– তুমি তো শুধুই এক বাচ্চা-থলি। বাচ্চা জন্ম দিয়েই তোমার পূর্ণতা, তোমার নিজের শারীরিক আনন্দের দাবি জানাতে নেই। আর পুরুষ তো মালিক, সে ভোগ করবে শুধু। তাই ‘জি স্পট’ জানার প্রয়োজন তার হয় না। সে নিজের সুখেই সুখী।

মৌমিতা আলম

প্রায় বছর পনেরো বা তারও আগের কথা। গ্রামের সালিশি সভা। সবার মুখে আলাপ, ‘মফিজারের মাইয়া ভাতারের ভাত খাবার না হয়, তাঁর জইন্যে বিচার!’

ভরা সালিশি সভায় মফিজারের বউকে জিজ্ঞেস করা হল কেন সে স্বামীর সঙ্গে সংসার করতে চায় না। ভদ্রমহিলা, যাঁর নাম জানা হয়ে ওঠেনি কোনও দিন, স্বামীর শারীরিক সমস্যার কথা বলতে গিয়ে খুব সুন্দর এক উপমা দিয়ে বুঝিয়েছিলেন, ধরুন আপনাদের বাড়িতে একটা কুয়ো আছে, সেই কুয়োর গভীরতা হল দশ হাত, কিন্তু আপনার কাছে জল তোলার যে বালতি আছে, তার দড়ির দৈর্ঘ্য হল ছয় হাত। তাহলে কি জল উঠবে?

ভরা সভায় সেই অজ পাড়াগাঁয়ের মহিলা নিজের শারীরিক চাহিদার অপূর্ণতা বোঝাতে এই প্রশ্ন করেছিলেন সভার সব পুরুষ-মানুষের চোখে চোখ রেখে। হ্যাঁ, সব পুরুষ-মানুষই ছিল। কারও মনে হয়নি সেই সভায় বাকি মহিলাদের ডাকা উচিত। আমরা শুনছিলাম পাটকাঠির বেড়া, বাঁশের বেড়া বা ঘরের দরজার ফুটোয় চোখ রেখে আর বেড়ায় কান পেতে। সেই সালিশি সভার পর ছিঃ ছিঃ পড়ে যায় গ্রামে। মফিজার আর তার বউয়ের তালাক হয়ে যায়। কত বড় নির্লজ্জ বেহায়া বউ যে সালিশি সভায় নিজের বরের লিঙ্গ নিয়ে কথা বলে– এই ছিল মূল বক্তব্য!

গ্রামের মহিলারা আজও সেই ঘটনার কথা বললে শাড়ির আঁচল মুখে টেনে নিয়ে মুখ টিপে হাসে, অবশ্যই আড়ালে। আজও সেই ঘটনা নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলে না কেউ। সেই ঘটনা একটি ট্যাবু হিসেবেই থেকে গেছে। এক মহিলা কেন তাঁর চাহিদার কথা বলবেন নিজের মুখে! বেড়ার ওপারের মহিলারা আজ অবধি কি পেরেছেন সেই ‘বেড়া’ সরিয়ে প্রকাশ্যে এসে নিজের শারীরিক চাহিদার দাবি জানাতে? উত্তরটি অবশ্যই না।

………………………………

MsChief-এর করা একটি সমীক্ষায় জানা গেছে, ৮১%-এর বেশি মহিলা তাঁদের সেক্স লাইফ নিয়ে সুখী নন। এঁদের মধ্যে ৭৩% শারীরিক মিলনের সময় কদাচিৎ ক্লাইম্যাক্সের স্বাদ পেয়েছেন। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে মাত্র ৩% পুরুষ জানেন যে তাঁদের মহিলা পার্টনার অর্গাজমের স্বাদ পাননি। অর্থাৎ, পুরুষ খোঁজ রাখেন না বা তাঁদের সেই জ্ঞানটুকু নেই। এই সমীক্ষা আরও জানায় যে, পুরুষের থেকে মহিলারা বেশি মিথ্যে শীৎকার করেন!

………………………………

সেই নাম না-জানা ভদ্রমহিলা নিজের মতো করে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন শারীরিক মিলন ও তার পিতৃতান্ত্রিক বোঝাপড়াকে। পিতৃতন্ত্র জন্মের পর থেকেই নারীকে শেখায় যে নারী শুধুই পুরুষকে আনন্দ দেওয়ার মাধ্যম, তার দাবি নেই কোনও। নারীর জন্ম থেকেই খুব সচেতনভাবেই জানানো হয় ‘সেক্স’ খারাপ, সেক্স অপবিত্র। নানা ধর্মীয় আচরণে ত্যাগ এবং তিতিক্ষায় মুড়ে ফেলা হয় নারীর শারীরিক চাহিদাকে। যেখানে মাসিক আজও ধরা হয় ট্যাবু হিসেবে, সেখানে একজন মহিলার শারীরিক চাহিদা ট্যাবু হবে, সেটাই পিতৃতন্ত্রের দস্তুর।

This may contain: a drawing of a woman's lips with the words, my kisses can bring you good luck so kiss me
ছবি সূত্র: ইন্টারনেট

২০১৯ সালের একটি কন্ড‌োমের বিজ্ঞাপনে বলা হয় যে, সত্তর শতাংশ ভারতীয় মহিলা প্রতিবার বিষমকামী শারীরিক মিলনের সময় অর্গাজমের আনন্দ পান না। এবার এই ‘অর্গাজম’ শব্দটির বাংলা খুঁজতে গিয়ে কোনও জুতসই কাছাকাছি শব্দও খুঁজে পাওয়া গেল না। এই যে শব্দ না-থাকা সেটাও একটি রাজনীতি। নারীর শারীরিক চাহিদাকে নামহীন, শব্দহীন অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার রাজনীতি। যৌনতার পাওয়ার-পলিটিক্স, যাতে পিতৃতন্ত্রের আধিপত্যবাদ চলে। যা নারীদের শুধু শেখায়– তুমি তো শুধুই এক বাচ্চা-থলি। বাচ্চা জন্ম দিয়েই তোমার পূর্ণতা, তোমার নিজের শারীরিক আনন্দের দাবি জানাতে নেই। আর পুরুষ তো মালিক, সে ভোগ করবে শুধু। তাই ‘জি স্পট’ জানার প্রয়োজন তার হয় না। সে নিজের সুখেই সুখী। MsChief-এর করা একটি সমীক্ষায় জানা গেছে, ৮১%-এর বেশি মহিলা তাঁদের সেক্স লাইফ নিয়ে সুখী নন। এঁদের মধ্যে ৭৩% শারীরিক মিলনের সময় কদাচিৎ ক্লাইম্যাক্সের স্বাদ পেয়েছেন। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে মাত্র ৩% পুরুষ জানেন যে তাঁদের মহিলা পার্টনার অর্গাজমের স্বাদ পাননি। অর্থাৎ, পুরুষ খোঁজ রাখেন না বা তাঁদের সেই জ্ঞানটুকু নেই। এই সমীক্ষা আরও জানায় যে, পুরুষের থেকে মহিলারা বেশি মিথ্যে শীৎকার করেন!

তাই প্রিয় পুরুষ, এর পরেরবার কোনও নারীকে তৃপ্ত করার দাবি করে টেবিল চাপড়ানোর আগে ‘জি স্পট’ জানুন। জি স্পট কিন্তু GPS নয়!

Le Rêve (The Dream), Pablo Picasso (1932)
‘দ্য ড্রিম’। শিল্পী: পাবলো পিকাসো

স্ত্রী যোনিকে উর্দু ভাষায় বলা হয়, শরমগাহ্ বা লজ্জাস্থল। ক্লিটোরিসকে বলা হয় ‘হারাম কি বোটি’ বা ‘সোর্স অফ সিন’। বোহরা সম্প্রদায়ের মানুষরা মনে করেন ক্লিটোরিস হল হারামের সূত্র, তাই মেয়ে বাচ্চাদের ছোটবেলাতেই কেটে দেওয়া হয় ক্লিটোরিস। এভাবে মেয়েদের পাপ থেকে দূরে রাখা হয়। গোটা বিশ্বে ১০ -১৪ কোটি নারী ফিমেল জেনিটাল মিউটিলিয়েশনের শিকার। যখন একটি অঙ্গকে ‘লজ্জাস্থান’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়, তখন সেই অঙ্গজুড়ে যে আনন্দের অনুভূতি, সেটা থেকে মহিলারা নিজেদের দূরে রাখবেন সেটা বলাই বাহুল্য।

মাসিক হলে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান থেকে আজও ব্রাত্য নারীরা। তাঁদের অচ্ছুত হিসেবে ধরা হয়। স্বামীর সঙ্গে রাতে শুলে সকালে স্নান না সারলে রান্নাঘরে প্রবেশ নিষেধ তাঁদের। নিজেদের শরীরকে চিনতে, নিজেদের প্লেজারকে জানার আগেই অবচেতন মনে পুঁতে দেওয়া হয় নিষেধাজ্ঞার বীজ। তাই Veere Di Wedding সিনেমায় মাস্টারবেশনের একটি দৃশ্য থাকার জন্য স্ল্যাট শেমিংয়ের শিকার হতে হয় অভিনেত্রী স্বরা ভাস্করকে। মাস্টারবেশন আর নারীরা! তওবা তওবা…

সেই একই কারণে প্রথমে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় ‘Lipstick Under My Burkha’ সিনেমাটিকেও। সিনেমাটির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে গিয়ে সেন্সর বোর্ড বলে যে সিনেমাটি ‘মহিলা কেন্দ্রিক’ (lady oriented)।

This may contain: a drawing of a woman laying on her stomach
শিল্পী: গুস্তাভ ক্লিম্ট

অর্থাৎ সিনেমা মহিলা-কেন্দ্রিক হবে কেন! মহিলারা নিজেদের শারীরিক ডিজায়র বা ইচ্ছের দাবি জানাবে কেন! পরে যদিও অনেক কাটছাঁট করে সিনেমাটি সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পায়। গত বছরই স্তন ক্যান্সার রোগ প্রতিরোধের সচেতনতার বিজ্ঞাপনে, অতি সংস্কারী মানসিকতার সৌজন্যে বিজ্ঞাপনে স্তনের জায়গায় ‘কমলালেবু’ ব্যবহার করা হয়। যা পরবর্তীতে প্রতিবাদের সম্মুখীন হওয়ায় বিজ্ঞাপনটি সরিয়ে দেওয়া হয়। স্তন এতটাই ট্যাবু যে তার ছবিও ব্যবহার করা যাবে না এই সংস্কারি দেশে!

অবাক করার মতো আবার অবাক হওয়ারও কিছু নেই যখন ইংরেজি শব্দ ‘অর্গাজম’-এর হিন্দি অর্থ কাম-উন্মাদ! সেই সালিশি সভার মহিলাটিকে যেমন দাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল ‘বাজে মেয়ে’ বলে, তেমনই অর্গাজমের দাবি জানালে বলা হয়– কাম-উন্মাদ! বা ডাইনি সন্দেহে পিটিয়েও মারা হতে পারে। আর একবার ‘খারাপ মহিলা’ বা ‘উন্মাদ’ বলে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে সম্পত্তি থেকে সমস্ত অধিকার বাদ দেওয়া অতীব সহজ কাজ। যেমনভাবে সম্পত্তির অধিকার থেকে ব্রাত্য থেকে যায় LGBTQ+ কমিউনিটির মানুষজন। বৃহত্তর সমাজে আজও ‘অপর’ প্রান্তিক লিঙ্গ সম্প্রদায়ের মানুষজন।

স্বীকার করার সময় এসেছে যে, জেন্ডার গ্যাপ, পে-গ্যাপ-এর মতো অর্গাজম-গ্যাপও হচ্ছে বাস্তবতা। সেক্স এডুকেশন, মহিলাদের নিজেদের শারীরিক চাহিদার উন্মুক্ত দাবির ক্ষেত্র না হলে গ্যাপ থাকবেই চিরকাল। বিদ্যা বালানের মতো বলতেই হবে নারীদের–

যেমন পুরুষরা চায়, তেমন মহিলাদেরও দরকার সেক্স–

Women like it, want it, need it as much as men do.’

ছবি সূত্র: ইন্টারনেট

যেমনটি সেই স্তন ক্যানসার প্রতিরোধের বিজ্ঞাপনে স্তনের বদলে কমলালেবু ব্যবহারের প্রতিবাদে এক কবি লিখেছেন–

আমার স্তন সাধারন একটি অঙ্গ

আমার পাগুলো যেমন

আমি হাঁটি কেবলই হাঁটতে থাকি সারাদিন ধরে

ক্লান্ত হয়ে বিছানায় না যাওয়া পর্যন্ত

 

আমার স্তন তোমাদের গোঁফ

অথবা তোমাদের ভুঁড়ির মতন

অথবা তোমাদের নিকোটিনের ছাপ পড়া

দাঁতের মতন।

আমি আমার স্তন নিয়ে লজ্জিত নই

যেমনটি তোমরা তোমাদের শরীর নিয়ে নও।

 

আমার স্তনকে স্তনই বলো

কমলালেবুর রূপকে তাকে মোড়ার

প্রয়োজন নেই।

আমি আমার ছোট স্তনবৃন্ত নিয়ে গর্বিত

সেটা সাদা, কালো, বাদামি যাই হোক না কেন

আমি আমার স্তন পরীক্ষা করতে পারি

(স্তন ক্যানসার পরীক্ষার জন্য)

যেমন তোমরা পারো

তোমাদের পেনিস বা টেস্টিকেল পরীক্ষা করতে।

 

আমার স্তন কোনও লজ্জাজনক অঙ্গ নয়

আমার স্তনকে তোমরা স্তন বলো

কমলালেবু নয়।