২০১৩-এ নয়ডার হাউসিং কমপ্লেক্সের এই দুই মধ্যবয়সি অবিবাহিতা বোনের, নিজেদের সেল্ফ আইসোলেট করার ঘটনায় হঠাৎ মনে হল– এই তো আমাদের সময়, এই তো আমাদের গল্প– পোস্ট গ্লোবালাইজেশনের একাকিত্ব, কোটর থেকে আরও ছোট কোটরে সেঁধিয়ে যাওয়া আর তার পরেও কোনও এক অজানা কারণে বেঁচে থাকার ইচ্ছে। কী খেয়ে প্রায় বছর খানেক কাটিয়েছিল ওরা– সেইসব ভাবনার থেকেও বেশি করে মাথায় ঘুরত কী ধরনের কথা বলত ওরা? সেসব কি এমন কথা, যা শুধু দীর্ঘদিন একটি ঘরে দু’জন দু’জনের সঙ্গে কাটালেই বেরিয়ে আসে– মনের বহু আস্তরণের অন্ধকার পেরিয়ে।
মেয়ে দু’টি যে ঠিক কী কারণে নিজেদের ফ্ল্যাটে নিজেদের বন্ধ করে রাখল– তা কেউ জানে না। প্রায় বছর খানেক পর তাদের দরজা ভেঙে যখন পুলিশ ঢুকল, সেই ফ্ল্যাটে তখনও তারা বেঁচে। কথা বলার অবস্থায় না থাকলেও তখনও তাদের শ্বাস পড়ছে। খবরের কাগজে তাদের ছবি দেখে, তাদের কথা পড়ে কেমন ঘোরের মতো তাদের নিয়েই বুঁদ হয়ে থাকি। অনেক গল্প নিয়ে কাটাছেঁড়া করে, অনেক চিত্রনাট্য লিখে আর ফেলে দিয়ে সেই সময় আমি অপেক্ষা করছিলাম আমার প্রথম ছবির সঠিক বিষয়টির জন্য। এমন কিছু একটা, যা আমাকে নতুন ছবি, নতুন শব্দ খুঁজে বের করার দিকে নিয়ে যাবে।
২০১৩-এ নয়ডার হাউসিং কমপ্লেক্সের এই দুই মধ্যবয়সি অবিবাহিতা বোনের, নিজেদের সেল্ফ আইসোলেট করার ঘটনায় হঠাৎ মনে হল– এই তো আমাদের সময়, এই তো আমাদের গল্প– পোস্ট গ্লোবালাইজেশনের একাকিত্ব, কোটর থেকে আরও ছোট কোটরে সেঁধিয়ে যাওয়া আর তার পরেও কোনও এক অজানা কারণে বেঁচে থাকার ইচ্ছে। কী খেয়ে প্রায় বছর খানেক কাটিয়েছিল ওরা– সেইসব ভাবনার থেকেও বেশি করে মাথায় ঘুরত কী ধরনের কথা বলত ওরা? সেসব কি এমন কথা, যা শুধু দীর্ঘদিন একটি ঘরে দু’জন দু’জনের সঙ্গে কাটালেই বেরিয়ে আসে– মনের বহু আস্তরণের অন্ধকার পেরিয়ে। কী করত তারা ওই একরত্তি ফ্ল্যাটে– তারা কি মাঝেমধ্যে ঝগড়া করত, হয়তো তারা খেলা করত ছোটবেলার মতো, কেমন তাদের স্বপ্ন বা ভয়গুলি? আস্তে আস্তে জমাট বাঁধতে শুরু করল আমার প্রথম ছবি, ‘ছোটি-মোটি বাতেঁ’র চিত্রনাট্য। তৈরি হল দু’টি চরিত্র– দুই বোন– রীতা (অনন্যা চট্টপাধ্যায়) আর ছোটি (তন্নিষ্ঠা চট্টপাধ্যায়)। তাদের বয়স তিরিশ পেরিয়েছে, তারা প্রেম করেনি, বিয়েও না। মা-মরা মেয়ে দু’টি বাবাকে ঘিরেই বড় হয়েছে, বাবাকে ঘিরেই তাদের জগৎ। বাবা যখন মারা গেল তখন হঠাৎ তারা দেখল বাইরের পৃথিবীটার সঙ্গে কিছুতেই সামঝোতায় আসতে পারছে না তারা। তারা যে চারপাশের নিয়ম-মাফিক সংসারে নিতান্তই দু’জন সোশ্যাল-মিসফিট, তা তারা বোঝেনি সেভাবে। শুধু বারবার আঘাতে, অনেকটা অভিমানে তারা গুঁটিয়ে নিতে থাকে তাদের পরিসর। একটা সময়, বাইরের পৃথিবী, যা অনেক বেশি আকর্ষণীয়, আর ভালো লাগে না ওদের। বরং নিজেদের দু’-কামরার বাড়িটিই তাদের মনের বিচরণভূমি হয়ে ওঠে– ‘ঘর জুড়ে মনের উঠোন/ তাই ঘর, ঘর নয়/ সর্বসময়’। সেখানেই, সেই আস্তে আস্তে অলীক হয়ে ওঠা সময় ও স্থানে ফুটে ওঠে তাদের শীতঘুমে চলে যাওয়া ইচ্ছেগুলো, চাওয়াগুলো– দুই মধ্য তিরিশের, আপাত সাধারণ, শ্যামলা মেয়ের সেসব চাওয়ার খোঁজ রাখে না বনবন করে ঘুরে চলা এই পৃথিবী।
ছেলেটা ইচ্ছে করে বল মেরে ভেঙে দেয় ওদের জানলা। জানলার ভাঙা কাচ ছড়িয়ে থাকে ঘরে, কাচের আলো ঠিকরে পড়ে ঘরের দেওয়ালে, তিরতির করে কাঁপতে থাকে। রীতা কাচগুলো ঝাড়ু দিয়ে জড়ো করতে গিয়ে হঠাৎ দেখে একটি ডেঁও পিপড়ে ভারি ব্যাস্ত হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে কাচগুলোর ওপর দিয়ে।
রীতা মন দিয়ে দেখতে থাকে ওকে, বলে– এত হুড়মুড় করে যাচ্ছে কোথায় বলো তো? বউয়ের কাছে বোধহয়।
……………………………..
রীতা অবাক হয়ে তাকায় ছোটির দিকে, এসব কথা আগে কখনও বলেনি ছোটি। আস্তে আস্তে ভেবে ভেবে বলে– আমি বিয়ে করলে তোদের দেখাশোনা কে করত? বাবা তো কিছুই পারত না নিজে। মা যখন চলে যায় তুই কত ছোট, আমি সংসারের হাল না ধরলে তোদের কী হত… তাছাড়া আমার…
ছোটি– তোর ভালোবাসতে ইচ্ছে করে না? মানে… তোর ‘ইচ্ছে’ হয় না? সেক্সের?
……………………………..
ছোটি ফট করে বলে ওঠে– বোধহয় গার্লফ্রেন্ডের কাছে।
রীতা ঘুরে তাকায় ছোটির দিকে, ছোটিও তাকিয়ে থাকে দিদির চোখে চোখ রেখে, সে জানে মৃত বাবার বান্ধবীকে আজও সহ্য করতে পারে না রীতা। বাবার সঙ্গে মা ছাড়া আর কোনও নারীর সঙ্গ রীতার কাছে অসহ্য।
রীতা চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে– হয়তো বাড়িতে ওর ছোট ছোট বাচ্চারা রয়েছে তাই এত তাড়া…
ছোটি সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে– হয়তো ওর বাড়িতে কেউ নেই, হয়তো ওর বাড়িই নেই কোনও… ও একটা এক পিপড়ে এমনি এমনি ঘুরে বেড়াচ্ছে।
রীতা আবার থমকে যায়, তারপর একটু ভেবে বলে– হয়তো ও পিপড়ে নয়, পিপড়ি। ওর বাড়িতে একটা পাগলি বোন রয়েছে, তার কাছে ফিরছে তাড়াহুড়ো করে…
এবার ছোটি থমকায়। রীতা হেসে ওর গাল টিপতে যায়, ছোটি চট করে সরে গিয়ে সোফাটায় বসে ধপাস করে। শুয়ে পড়ে, ঠ্যাং তুলে দেয় সোফার পিঠে, পা নাড়াতে নাড়াতে সে আলটপকা বলে ওঠে– তুই বিয়ে-টিয়ে করলি নে কেন রে দিদি? প্রেমও তো করলি না… কেন বল তো? এইভাবে একা একা…
রীতা অবাক হয়ে তাকায় ছোটির দিকে, এসব কথা আগে কখনও বলেনি ছোটি। আস্তে আস্তে ভেবে ভেবে বলে– আমি বিয়ে করলে তোদের দেখাশোনা কে করত? বাবা তো কিছুই পারত না নিজে। মা যখন চলে যায় তুই কত ছোট, আমি সংসারের হাল না ধরলে তোদের কী হত… তাছাড়া আমার…
ছোটি– তোর ভালোবাসতে ইচ্ছে করে না? মানে… তোর ‘ইচ্ছে’ হয় না? সেক্সের?
রীতা আস্তে আস্তে বলে– না… আমি তোদের নিয়ে ভালো ছিলাম। তোর, বাবার দেখাশোনা করা…
ছোটি দিদিকে নকল করে বলতে থাকে– সংসার সামলানো… বাড়িঘর সামলানো… দিদির দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে ছোটি।
রীতা এইবার বিরক্ত হয়ে বলে– তা তুই করলি না কেন বিয়ে এত যদি শখ ছিল? আমরা তো বেশ কয়েকটা ছেলে দেখেছিলাম তোর জন্য… সব বাতিল করে দিলি…
ছোটি– ধুর, ফালতু সবক’টা… ওইভাবে হয় না কি, যার-তার সঙ্গে! আমি কি ডেস্পো না কি!
সোফা ছেড়ে উঠে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ায় ছোটি, যেন অনেক দূরে হারিয়ে গেছে সে… দীর্ঘদিনের বন্ধ ঘরের দেওয়ালে ড্যাম্প পড়ে তৈরি হয়েছে নানারকম অবয়ব। মনে হয় দেওয়ালের তলায় চাপা পড়া অনেকগুলো মুখের মধ্যে, মানুষের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে ছোটি। সে বলে– আমি তো ভালোবাসতে চেয়েছিলাম। ভালোবাসা পেতে চেয়েছিলাম… জানিস আমি একজনের স্বপ্ন দেখি…
রীতা অবাক হয়ে ছোটিকে দেখে, অস্ফুটে বলে– কার?
ছোটির চোখ বন্ধ হয়ে যায়, একটু যেন রাঙা হয়ে ওঠে মুখ– সে আছে একজন… খুব ভালোবাসে আমায়… সে আমাকে পাগলের মতো আদর করে, চুমু খায়…
রীতা অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকে বোনের দিকে… গা শিরশির করতে থাকে তার।
ছোটি বলে চলে– তারপর হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়… আমি বুঝতে পারি সে আমাকে দেখছে, আমার সারা শরীরে তার ছোঁয়া, তার গন্ধ… আমি (লজ্জা পেয়ে হেসে ফেলে ছোটি) পুরো ভিজে যাই, জানিস…
রীতা ফিসফিস করে বলে– কে সে?
ছোটির মুখটা করুণ হয়ে যায়, চোখ খুলে তাকায় রীতার দিকে, একটু যেন ছলছল করে ওঠে তার চোখ, বলে– জানি না কে, খুব চেনা লাগে কিন্তু চিনতে পারি না… মনে হয় কত কত দিনের চেনা… কত জন্মের…
রীতার মনে হয় ছোটির কথাগুলো দেওয়ালের তলা থেকে উঠে আসছে, দেওয়ালের ওপর ফুটে ওঠা মানুষগুলোও একই কথা বলছে যেন ফিসফিস করে সবাই মিলে।
ঘুমের মধ্যে ঘেমে ওঠে ছোটির হাতের তালু, শক্ত হয়ে ওঠে তার স্তনবৃন্ত। একটি ভারি সুন্দর মুখ, সুঠাম দু’টি কাঁধ নেমে আসে তার দিকে…
ছোটি বলে– তুমি এমন সবার থেকে আলাদা কীভাবে? কে তুমি? কোথা থেকে এলে?
লোকটি আরও কাছে এগিয়ে আসে, বলে– আমাকে চিনতে পারছ না? সেই হারিয়ে যাওয়া সময় পেরিয়ে তোমার কাছে এলাম…
ছোটি– কী চাও তুমি?
ছোটি– ঘুমের বাইরে তোমাকে আমি দেখতে পাই না কেন?
ছোটির মুখে হাসি ফুটে ওঠে, বলে– পারি…
ঘুমের মধ্যে দু’হাত দিয়ে তার মাথা নিজের বুকে টেনে নেয় ছোটি… সারা ঘর ভরে ওঠে জংলি সাদা ফুলের গন্ধে… মাতোয়ারা করে দেয় ছোটিকে।
পাশের ঘরে কুঁকড়ে শুয়ে ঘুমোতে ঘুমোতে হঠাৎ রীতা দেখে তার কত বছর আগের মরে যাওয়া ঠাকুমার আচারের কাচের বয়াম নিয়ে পাশের রকিং চেয়ারে এসে বসেছে। ঠাকুমাই তো ছিল রীতার একটিমাত্র আবদারের জায়গা। ছোট থেকেই বড় হয়ে যাওয়া মেয়েটা শুধু ঠাকুমার কাছেই ছোট্টটি হয়ে যেত। অবাক হয়ে উঠে বসে রীতা। আস্তে আস্তে ঠাকুমার সমানে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে, বলে– তুমি তো মরে গেছ!
ঠাকুমা তার গাল টিপে দিয়ে বলে– আবার উল্টোপাল্টা কথা… তোকে নিয়ে যে কী করি… নে হাত পাত দিকি…
আঁচলের খুঁট থেকে পয়সা বের করে রীতার হাতে দেয় ঠাকুমা– এই নে, লজেন্স খাবি… চুলে তো একটু তেল দিতে হয় না কি!
রীতা আস্তে আস্তে ঠাকুমার কোলে মাথা রাখে। ঠাকুমা তার মাথার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বলে– আমার বে-র বেনারসিটা আমি তোকে দোবো, বুঝলি। ওইটে পরে বে করবি তুই…
রীতা বলে– ধ্যাৎ! তুমি তো কবেই মরে গেছ!
ঠাকুমা হেসে ওঠে, বলে– পাগলি একটা… নে ঘুমো দিকি এবার… গপ্প শুনবি… সাদা ঘোড়ায় চেপে, হাতে তরবারি নে, দিগন্ত পেরিয়ে সে আসবে…
মনে মনে হাসতে হাসতে ঘুমের মধ্যে ডুবে যায় রীতা– হ্যাহ্ আমাকে বোকা পেয়েছ, তুমি মরে ভূত হয়ে গেছ কবে… ঘুমের অতলে ডুবে যেতে যেতে তার ঘুম ঘিরে ছুটে আসে ধুলো ওড়ানো ঘোড়ার ক্ষুরের টগবগ।
ঘুমিয়ে পড়ে রীতা, ঘুমিয়ে পড়ে ছোটি। দেওয়ালের ভিতর ঘুমিয়ে থাকে আরও কত রীতা আর ছোটিরা। একটি গোটা বছর নয়ডার বোন দু’টির কাছে যায়নি কেউ– কেউ জানে না তাদের ইচ্ছেগুলোর হদিশ। পৃথিবী বনবন করে ঘুরে চলে, আর স্বপ্নের মধ্যে আদরে সোহাগে কেঁপে ওঠে কোন এক মেয়ে, ভিজে যায় তার শরীর। ঘুমের মধ্যে শক্ত মুঠির মধ্যে ধরা থাকে রীতার লজেন্স খাওয়ার আধুলি। জীবন চলতে থাকে দুদ্দাড় করে, নিয়ম মাফিক… কেউ জানে না, কেউ বুঝতে পারে না, চার দেওয়ালের নিভৃতে জংলি সাদা ফুলের গাছে ভরে যায় ঘর মাতাল করা সে গন্ধ ভেসে বেড়ায় বাতাসে আর ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে থরথর করে কেঁপে ওঠে মাটি।