জেঠিমা আমাদের উত্তর কলকাতার বাড়ির বাড়িওয়ালি ছিলেন, আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। সময়ের সঙ্গে তাঁর অট্টহাসি শুনে অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল, আমাকেও উনি বলতেন জোরে হাসতে– সেটা নাকি ফুসফুসের জন্য ভালো। শুনে মুচকি হাসতাম, কিন্তু সাহস করে অট্টহাসির অভ্যেস করিনি– কারণ অন্তর্নির্মিত প্রক্রিয়ায় শিখে গিয়েছিলাম শোষিত শ্রেণির মানুষ দাঁত দেখিয়ে হাসে, হা-হা করে হাসে না। এর কিছুদিন বাদে কিশোরবেলায় দেখা সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে উৎপল দত্ত’র হাসি শুনে ধারণা আরও দৃঢ় হল– ভিলেন আর অট্টহাসির মধ্যে গভীর সম্পর্ক আছে।
এ এক আজব কেলো! চুপচাপ বসে থাকার উপায় নেই– বসলেই হা-হা-হা-হা করতে করতে পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে। ‘আজব গাঁয়ের আজব কথা’-তে ভূতের চাঁটা মারার গপ্পো আছে, কিন্তু বাস্তব জীবনে যে এইরকম হতে পারে, বাপের জন্মে ভাবিনি।
সকাল
বাবার কথাই যখন উঠল, তাঁকে দিয়েই শুরু করা যাক। শুনেছি, আমার জন্মের পর আমার কোষ্ঠী বানানো হয়েছিল। সেই কোষ্ঠী আমি জন্ম-ইস্তক দেখিনি, কারণ বাবা সেটা লুকিয়ে ফেলেছিলেন আমার বড়বেলা নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী দেখে (আর তারপর ভুলে গিয়েছিলেন, ঠিক কোথায় সেই কোষ্ঠী লুকিয়েছিলেন)। তাই হয়তো ছোটবেলায় শেখানো হয়েছিল– আওয়াজ করে হাসতে নেই– সেটাই স্বাভাবিক, কারণ শোষিত শ্রেণির মানুষদের জোরে হাসতে নেই। জোরে হাসা বা অট্টহাসির অধিকার শুধু মালিক শ্রেণির, তাই ছোটদির কাছে যখন শুনেছিলাম যে প্রথমবার ওপরতলার জেঠিমা’র অট্টহাসি শুনে চমকে উঠে কেঁদে ফেলেছিলাম, অবাক হইনি।
জেঠিমা আমাদের উত্তর কলকাতার বাড়ির বাড়িওয়ালি ছিলেন, আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। সময়ের সঙ্গে তাঁর অট্টহাসি শুনে অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল, আমাকেও উনি বলতেন জোরে হাসতে– সেটা নাকি ফুসফুসের জন্য ভালো। শুনে মুচকি হাসতাম, কিন্তু সাহস করে অট্টহাসির অভ্যেস করিনি– কারণ অন্তর্নির্মিত প্রক্রিয়ায় শিখে গিয়েছিলাম শোষিত শ্রেণির মানুষ দাঁত দেখিয়ে হাসে, হা-হা করে হাসে না। এর কিছুদিন বাদে কিশোরবেলায় দেখা সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে উৎপল দত্ত’র হাসি শুনে ধারণা আরও দৃঢ় হল– ভিলেন আর অট্টহাসির মধ্যে গভীর সম্পর্ক আছে। ভেবে দেখলাম জেঠিমাও কোনও কোনও অর্থে ভিলেন– মাঝে মাঝেই জলের পাম্প কম সময়ের জন্যে চালিয়ে বা ছাদের দরজায় তালা দিয়ে আমার মা’কে হয়রান করে জানান দেওয়া তিনি বাড়ির মালিক– তাঁর অন্যতম প্রিয় কাজ ছিল। মফসসল শহরে বেড়ে ওঠা মা মধ্যবয়সে কলকাতায় এসেছিলেন শহরের ইশকুলে পড়াতে– মফসসলে অনেক কিছু না থাকলেও কাপড় কাচার জল আর সেই কাপড় শুকোনোর জন্য খোলা আকাশের অভাব ছিল না– তাই জেঠিমার এই অদ্ভুত প্যাঁচে মা’র ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স বিদ্রোহ ঘোষণা করল, আর গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়াল এই কর্মগুলো করে জেঠিমার অট্টহাসি।
সেই যুগে বাড়িতে টিভি ছিল না, রেডিওই ছিল সম্বল– সপ্তাহে একদিন যাত্রাপালা শোনা যেত। সেখানেই প্রথম শুনি ‘চেঙ্গিজ খাঁ যখন হাসে, দুনিয়া তখন কাঁদে’ আর তারপর এক পিলে চমকানো অট্টহাসি। ইতিহাস বই থেকে জানতে পারলাম চেঙ্গিজ খাঁ ইতিহাসের এক খলনায়কের নাম– এদেশে এসে অনেক খুনখারাপি করে বিস্তর ধনসম্পদ নিয়ে দেশে ফেরত গিয়েছিল। শোষিত আর শোষকের মধ্যে ফারাক যে অট্টহাসি, কৈশোরেই বুঝে গিয়েছিলাম।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সময়ের সঙ্গে শিক্ষা আর বাকি ধারণাগুলো বদলাতে লাগল। দেখলাম যে উৎপল দত্তকে অট্টহাসি হাসতে দেখে ভিলেন ভেবেছিলাম, দেখলাম তিনি প্রয়োজন অনুযায়ী হাসি বদলাতে পারেন, নিজেকেও বদলাতে পারেন। জানলাম যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত শুধু লর্ড কর্নওয়ালিসের আনা আইনেই পাওয়া যায়, ইতিহাসের পাতায় চিরস্থায়ী কোনও বন্দোবস্ত হয় না।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
দুপুর
ইশকুলে মাস্টারমশাই ডঃ চৌধুরী ক্লাসে অঙ্ক দিতেন আর ক্লাসে করতে দেওয়া অঙ্ক কেউ বাজে ভুল করলে অট্টহাসি হাসতেন। তাঁর ওই হাসি দেখে আমিও একদিন হেসে ফেলেছিলাম। উনি হাসি থামিয়ে আমায় বলেন ‘দাঁত না কেলিয়ে পড়ায় মন দাও’। সেদিন বুঝেছিলাম শোষিত শ্রেণির দাঁত বের করে হাসির অধিকার নেই।
সময়ের সঙ্গে শিক্ষা আর বাকি ধারণাগুলো বদলাতে লাগল। দেখলাম যে উৎপল দত্তকে অট্টহাসি হাসতে দেখে ভিলেন ভেবেছিলাম, দেখলাম তিনি প্রয়োজন অনুযায়ী হাসি বদলাতে পারেন, নিজেকেও বদলাতে পারেন। জানলাম যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত শুধু লর্ড কর্নওয়ালিসের আনা আইনেই পাওয়া যায়, ইতিহাসের পাতায় চিরস্থায়ী কোনও বন্দোবস্ত হয় না। যাদের দাপট আছে, তারা লাঠি ঘোরায় আর শাসন করে। যারা এই লাঠির সামনে আসে, তাদের মাথা ফাটে– আর নিজেদের শোষিত ঘোষণা করে আর্তনাদ করে। এই ‘শোষিত’দের বালখিল্য ভেবে দাপুটে শাসক অট্টহাসি হেসে এদের ছেড়ে অন্যদিকে মন দেয়, যেখানে তার জন্যে উজ্জ্বলতর ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করে। শোষিতরা পরবর্তীকালে ইতিহাস লেখার সময় যতই এই শাসকদের খলনায়ক হিসেবে আঁকে, এই শাসকরা নিজের জায়গায় বীরত্বের জন্যে শ্রদ্ধা আর সম্মান দুটোই আদায় করে নেয়। যেমন চেঙ্গিজ খাঁ-কে যতই আমরা খলনায়ক বলি, নিজের দেশ মঙ্গোলিয়ায় তিনি নায়ক– সেখানে শহরের মাঝে এক প্রকাণ্ড স্ট্যাচু হয়ে ঘোড়ায় বসে অট্টহাসি হাসছেন নিজের দেশের মানুষের তাঁর প্রতি ভক্তিতে খুশি হয়ে। বুঝলাম অট্টহাসির সঙ্গে প্রতিপত্তি আর দাপটের সঙ্গে একটা সুস্থ স্বাভাবিক সম্পর্ক রয়েছে, আর যারা অট্টহাসি হাসে, তারা বাইরের লোকের কাছে যতই আগ্রাসী হোক, নিজের সাম্রাজ্যের মানুষজনকে বুক দিয়ে আগলে রাখে।
হোটেলে যখন চাকরি করতে ঢুকলাম, উত্তর কলকাতার পরিবেশে বড় হয়ে উঠে মেপে হাসা, মেপে কথা, মেপে খাওয়া ঝাঁ-চকচকে পরিবেশে খাবি খেতে শুরু করলাম। বিজয় দিওয়ান তখন সবে হোটেলের দায়িত্ব নিয়ে ‘সন্দেহে শুঁকে বুড়ো মুখে নাহি তোলে’ মোডে– কথা খুব কম বলেন কিন্তু তাঁর চোখ চারদিকে ঘুরে বেড়ায়। নিজেকে জাতে তুলতে মরিয়া হয়ে একবার বার্ষিক ছুটির পর হোটেলে জয়েন করলাম লম্বা ঝুলফি নিয়ে। অনেকের বিস্ময় ভরা দৃষ্টি পেরিয়ে সবে নিজের ডিপার্টমেন্টে পৌঁছে থিতু হয়েছি, অট্টহাসি কানে এল। স্বভাব-গম্ভীর স্বল্পভাষী দিওয়ান সাহেব হাসিতে ফেটে পড়েছেন আমাকে দেখে। সেই অট্টহাসির আওয়াজ আমাকে অপমানের চেয়ে আশ্বস্ত বেশি করেছিল, তাই তাঁর ‘এল্ভিস অর পেল্ভিস?’ প্রশ্ন গায়ে মাখিনি। পরবর্তী কালে ব্যাঙ্কে ঢুকে প্রথম বস হিসেবে যখন অশোক বসুকে পেলাম, তাঁর আদবকায়দা দেখে বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম– কিন্তু আশ্বস্ত করেছিল তাঁর অট্টহাসি। দুই ক্ষেত্রেই অঙ্ক মিলে গিয়েছিল, নিজেদের সাম্রাজ্যে তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নাতীত।
সন্ধ্যা
অট্টহাসির সঙ্গে প্রতিপত্তি, দাপট আর চেহারার কো-রিলেশন থাকলেও মূর্তিমান ব্যতিক্রম অমিতাভদা। অমিতাভদা পেশায় নৃত্য-শিক্ষক, জীবিকানির্বাহের জন্যে বিমার দালালিও করে। ছাতি খুব বেশি হলে ৩০ ইঞ্চি। প্রতিদিন জীবনের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে চলেছে। কিছু বললে হাসে। সাধারণ হাসি না, অট্টহাসি। সময় আরও শিখিয়েছে আমায়– যে জীবনকে ভয় পায় না, এক চিমটে নুন মিশিয়ে জীবনকে দেখে, সেই অট্টহাসি হাসতে পারে। যেমন অমিতাভদা।
রাত্রি
আবার হা-হা করে অট্টহাসি হেসে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে! নিয়তি ব্যাটা বড্ড বাড় বেড়েছে। নিজের শর্তে বাঁচব বলে যেদিন স্থায়ী আরামের চাকরি ছেড়ে দিলাম, নিয়তি মুচকি হেসেছিল। যত সময় গিয়েছে, ওর হাসি বেড়েছে; ইদানীং সুযোগ পেলেই কানের কাছে এসে অট্টহাসি হাসে। স্থান-কাল-পাত্র মানে না। মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে এই হাসির আওয়াজে ঘুমের দফা রফা হয়ে যায়। এবার লেখা শেষ করে মুখোমুখি চোখে চোখ রেখে কথা বলা দরকার। অমিতাভদার মতো।
যে উন্মত্ত জনতার ঢেউ রবীন্দ্রনাথকে প্রয়াণের পর ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, সেই ঢেউ হয়ে ওঠা জনতার অন্তর্গত মানুষগুলি কি জানতেন, তাঁদের এই মানুষটির প্রতি বিশ্বের মানুষের গভীর শ্রদ্ধার কথা! কয়েক মাস পড়ে, এই সংখ্যাটি কি হাতে নিয়ে দেখেছিলেন ভিড়ের মানুষেরা?