পাতে ভাত বেঁচে থাকলে লোকে ‘অপচয়’ বলে, ন্যায্যর থেকে এক্সট্রা দাম চাইলে ‘কালোবাজারি’ বলে, সিনেমার টিকিট চড়া দামে বেচলে ‘ব্ল্যাক’ বলে! এরকম অজস্র ‘এক্সট্রা’– যেগুলোকে ‘কালো এক্সট্রা’ হিসেবে নিন্দে করি সবাই। আবার অধিকাংশ জিনিসই সাদা ‘এক্সট্রা’-র জন্য মরিয়া হয়ে লড়ে যাই। হয়তো ভুলে যাই এই সাদা-কালোর মাসে দম আটকে থাকা মূল্যবোধের কথাটা। কেন এমনটা হয়?
ছোটবেলায় ‘এক্সট্রা’ শব্দের বাংলা অর্থ হয়তো একটাই শব্দ বলতাম। আজ শব্দটা হিরের মতো হয়ে গেছে। এত দিক, এত তল, গুণে শেষই করতে পারব না। প্রতিদিন ঘুম ভেঙে জেগে ওঠাটাই যখন বাড়তি পাওনা, তখন জীবনের হাজার খুঁটিনাটিতে অগুনতি ‘এক্সট্রা’র লোভ মানুষ ছেড়েও ছাড়তে পারছে না। একদিকে ‘এক্সট্রা’ যেমন ‘বেশি’, তেমনই অন্যদিকে সে আবার ‘অপচয়’ও বটে। একটা শব্দ এতভাবে ফেঁসে গিয়েছে সভ্যতা এগনোর সঙ্গে সঙ্গে যে, বলে বোঝানো যাবে না।
সিনেমায় এই ‘এক্সট্রা’ শব্দটা আজ ব্রাত্য। ভিড়ের বা অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ অভিনেতাদের ডাকনাম ছিল ‘এক্সট্রা’! এই ফাউ-ফাউ ভাবটা কারওই ভালো লাগতে পারে না, তাই সংবেদনশীল প্রতিবাদ উঠল। ‘এক্সট্রা’ ডাকটা বদলে হয়ে গেল ‘জুনিয়ার আর্টিস্ট’! তাঁদের প্রতি আচরণটা বদলাল না, কেবল নেমপ্লেটটা পাল্টাল। ‘এক্সট্রা’ লেখা বা কথা কেউই প্রশংসার যোগ্য মনে করে না। এমনকী, পরিচিত গানে কেরামতি করে ‘এক্সট্রা’ সুর বা কাজ করলে গান-জানা মানুষরা বেশ বিরক্ত হয় দেখেছি! পাঞ্জাবির হাতাটুকু গিলা বা গিলে করাটাই যথাযথ স্টাইল; পুরো পাঞ্জাবিটা গিলে করলে সে পোশাক হাসির খোরাক হয়ে যাবে। ঠিক যতটুকু, ততটুকুই যদি মানুষ মেপে চলতে পারত, তাহলে সভ্যতা থেকে এই ‘এক্সট্রা’র হ্যাংলামিটাই চলে যেত। তা কখনও হয় নাকি! ছোট্টবেলায় ফুচকার ফাউ বা ‘এক্সট্রা’ পাওয়ার মধ্যে যে বাড়তি খুশির হাতেখড়ি, তার সুদ আজীবন গুনতে হবে। বাড়িতে লোক আসবে খাবার যাতে কম না হয়, দু’-চার প্লেট বেশি অর্ডার দিয়ে নিশ্চিন্ত হই। বাজারে ধনেপাতাটা হিসেবের বাইরে এক্সট্রা দিলে বা কাটা মাছ কিনে মুড়োটা ফ্রি দিলে তো কথাই নেই! আমরা বেশি, বাড়তিটা সবক্ষেত্রে চেয়েই চলেছি। থামতেই পারছি না! আর সেই ‘আরও একটু বেশি হলে ক্ষতি কী?’ গোছের দর্শনটা আমাদের প্রতি মুহূর্তে লোভী করে তুলেছে। মা-সন্তানের কাছে বাড়তি সময় চান, প্রেমিকা একটু বেশি বেশি আদর, অফিসের বস চাইছেন বাড়তি ঘণ্টা। শরীর চাইছে বাড়তি যত্ন।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………উল্টো করে যদি ভাবি, সত্যি যদি ওই ‘এক্সট্রা’কে আমরা ত্যাগ করে দিতাম! মাসমাইনের মতো নির্ধারিত পাওনা হিসেবে দেখতাম। ডিএ-র মতো বাড়তি কিছু থাকত না! আমরা কি বেশি ভালো থাকতাম? সত্যি জানি না! কাগজে লেখা সহজ, পালনে নয়। খালি মনে হয়, যাঁদের খুব কম আছে, যাঁরা কষ্টে বাঁচেন, তাঁদের তো প্রাপ্যটুকুও ‘এক্সট্রা পাওনা’ মনে হয়। তারা তো আমাদের ফাউ সভ্যতার আধার কার্ডই পেল না।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
অথচ বালতি, কৌটো, বাটি, চামচ বাড়তি চাইলেও ধরে রাখতে পারছে না। উপচে বুঝিয়ে দিচ্ছে তাদের সীমাবদ্ধতা। ওরা তো আমাদের মনের মতো বদলাতে পারে না যে, যত পাব ঠিক লাগুক, না-লাগুক আঁটিয়ে নেবই। কারণ আমাদের ‘এক্সট্রা’কে ট্রফির মতো সাজিয়ে রাখি! যেন একটা অ্যাচিভমেন্ট!
উল্টো করে যদি ভাবি, সত্যি যদি ওই ‘এক্সট্রা’কে আমরা ত্যাগ করে দিতাম! মাসমাইনের মতো নির্ধারিত পাওনা হিসেবে দেখতাম। ডিএ-র মতো বাড়তি কিছু থাকত না! আমরা কি বেশি ভালো থাকতাম? সত্যি জানি না! কাগজে লেখা সহজ, পালনে নয়। খালি মনে হয়, যাঁদের খুব কম আছে, যাঁরা কষ্টে বাঁচেন, তাঁদের তো প্রাপ্যটুকুও ‘এক্সট্রা পাওনা’ মনে হয়। তারা তো আমাদের ফাউ সভ্যতার আধার কার্ডই পেল না।
পাতে ভাত বেঁচে থাকলে লোকে ‘অপচয়’ বলে, ন্যায্যর থেকে এক্সট্রা দাম চাইলে ‘কালোবাজারি’ বলে, সিনেমার টিকিট চড়া দামে বেচলে ‘ব্ল্যাক’ বলে! এরকম অজস্র ‘এক্সট্রা’– যেগুলোকে ‘কালো এক্সট্রা’ হিসেবে নিন্দে করি সবাই। আবার অধিকাংশ জিনিসই সাদা ‘এক্সট্রা’-র জন্য মরিয়া হয়ে লড়ে যাই। হয়তো ভুলে যাই এই সাদা-কালোর মাসে দম আটকে থাকা মূল্যবোধের কথাটা। কেন এমনটা হয়?
মনে হয়, জীবন শব্দটাই আয়ুতে সীমাবদ্ধ, বাসস্থান মাপা স্কোয়ার ফুটে, শ্বাস মাপা ফুসফুসে, খরচ বাঁধা রোজগারে– এরকম নানাদিকে আমাদের ‘এক্সট্রা’ প্রবৃত্তির নানা এন্ট্রি থাকায়, ফাঁকফোকরে যখন যেখানে যেটুকু বাড়তি নিংড়ে নেওয়া যায়, সেটাই একটা সাফল্যের রূপ নেয় আমাদের রোজকার জীবনে।
অথচ, একটু এক্সট্রা সময় দিয়ে অন্যের উপকার করা, একটু এক্সট্রা পড়াশোনা, একটু এক্সট্রা সংযম, একটু এক্সট্রা সহনশীলতার চর্চাই করা হয় না অভ্যেস করে। বললাম না, এক্সট্রা আয় বলে কিস্সু নেই, হবেও না, তাই ‘কালো বাড়তি’ থেকে মনটা একটু ঘুরিয়ে ‘সাদা বাড়তি’তে যতটা বেশি কাটাতে পারি ভালোভাবে বাঁচার আয়ুটুকু অন্তত বাড়বে। প্রিয়জনকে আর একটু বেশি সময় দিন, সন্তানকে আরও একটু বাড়তি সময়, চুমুটা টিকে থাক আরও এক্সট্রা ২০ সেকেন্ড, ভাল গান শুনে দু’ফোঁটা ‘এক্সট্রা’ চোখের জল পড়ুক, একটু বেশি হাসি বন্ধুর দিকে চেয়ে– সেটাই হবে ‘এক্সট্রা’র আসল উদ্যাপন।