১৮২৩ সালে তৈরি হয়েছিল শ্যামপুকুর স্ট্রিটের শ্যামপুকুর বাটি। পরবর্তীকালে, তা নানা ভাবে রূপান্তরিক হয়। এই বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবান্দোলন। শ্রীরামকৃষ্ণদেব তখন কর্কট রোগে আক্রান্ত। চিকিৎসার জন্য ১৮৮৫ সালের এই ২ অক্টোবর তারিখে তাঁকে আনা হয় শ্যামপুকুরের এক ভাড়াবাড়িতে। সেখানে ছিলেন ৭০ দিন। ২০০ বছর পার করে আসা এই বাড়ির আয়ু ও ২ অক্টোবরের পুণ্যলগ্নে, সেই বাড়ি নিয়েই কিছু কথা।
মাস কয়েক ধরেই বোঝা যাচ্ছিল, শ্রীরামকৃষ্ণের গলার এই অসুখ বড় মারাত্মক। জুন, ১৮৮৫ নাগাদ এটি ধরা পড়েছে। তারপর থেকে ক্রমশ তা জটিলতর হচ্ছে। তাঁকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে তাই বড় ডাক্তারবাবুদের, বিশেষত ডা. মহেন্দ্রলাল সরকারের নিয়মিত তত্ত্বাবধানে রাখা জরুরি। প্রথমে বাগবাজারে দুর্গাচরণ মুখার্জি স্ট্রিটে এক ছোট বাড়ি ভাড়া করে ভক্তরা তাঁকে সেখানে নিয়ে আসেন। কিন্তু দক্ষিণেশ্বরের খোলা পরিবেশে অভ্যস্ত রামকৃষ্ণদেব এই বাড়িতে পা দিয়েই অস্বস্তি বোধ করেন। পায়ে হেঁটে সটান চলে যান তাঁর প্রিয় বলরাম বসুর বাড়ি। সেখানে সপ্তাহ খানেক থাকার মাঝেই ভক্তেরা ৫৫, শ্যামপুকুর স্ট্রিটে গোকুল ভট্টাচার্যের দোতলা বৈঠকখানা বাড়িটি ভাড়া নেন। ২ অক্টোবর, ১৮৮৫ শ্রীরামকৃষ্ণ এখানে এসে থাকতে শুরু করলেন।
৭০ দিনের বসবাস
‘হিম লাগা’ নিয়ে কিঞ্চিৎ খুঁতখুতুনি ছাড়া এই বাড়ি তাঁর বেশ পছন্দই হল। প্রথমত এটি বেশ খোলামেলা। তাছাড়া শ্যামপুকুর তাঁর চেনা জায়গা। এখানে তিনি আগে বেশ কয়েকবার এসেছেন নেপালের রাজপ্রতিনিধি কাপ্তেন বিশ্বনাথ উপাধ্যায়, প্রাণকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় এবং কালীপদ ঘোষ (দানাকালী)-এর বাড়ি। তাঁর ঘনিষ্ঠ আরও কিছু ভক্ত থাকেন এই তল্লাটে।
নতুন বাসায় থিতু হওয়ার পর এবার চিন্তা হল, পথ্য রান্না, এবং সর্বদা সতর্ক দেখাশোনার জন্য নির্ভরযোগ্য মানুষ দরকার।
পথ্য প্রস্তুতির জন্য সারদা-মা যোগ্যতম। কিন্তু এই বাড়িতে মহিলাদের থাকার যে কোনও অন্দরমহল নেই। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের অপ্রশস্ত নহবত ঘরে যিনি সবার চোখের আড়ালে এত বছর কাটালেন তিনি কি এখানে থাকতে পারবেন? কিন্তু ‘যখন যেমন তখন তেমন’ নমনীয়তার মূর্ত বিগ্রহ সারদামণি পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে কয়েক দিনের মধ্যে নির্দ্বিধায় চলে এলেন দক্ষিণেশ্বর থেকে। ভক্তরা নিশ্চিন্ত হলেন, রামকৃষ্ণদেবের পক্ষে রুচিকর ও স্বাস্থ্যকর, সহজে গলাধঃকরণ করার মতো নরম পথ্য তৈরির সমস্যা মিটল। অনেকে জানতেও পারলেন না এই খোলামেলা বাড়িতে সারদা-মা কেমন করে নিজের আব্রু রক্ষা করছেন। লোক সমাগম কেটে গেলে দোতলার এক কোণে এক ছোট ঘরে তিনি মাথা গোঁজার সুযোগ পেতেন রাত্রি এগারোটা নাগাদ; ভোর তিনটে নাগাদ তাঁকে স্নানাদি সেরে ফেলতে হত কারণ এই বাড়িতে তাঁর জন্য কোনও আলাদা শৌচাগার নেই; তার পর থেকে দিনরাতের বাকি দীর্ঘ সময় তাঁকে থাকতে হত তিনতলার ছাদে যাওয়ার সিঁড়ির মুখে অপ্রশস্ত চাতালে– সেখানেই পথ্য রান্না, নিজের মধ্যাহ্নের বিশ্রাম ইত্যাদি সবকিছু।
শ্রীরামকৃষ্ণের দৈনন্দিন দেখাশোনা ও সেবা করার দায়িত্ব নিলেন নরেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে কালী, শশী, ছোট-গোপাল প্রমুখ ত্যাগী যুবক। ক্রমশ এই দল সংখ্যায় বাড়তে থাকল। আর তাঁদের তদারকি করতেন রোজ একজন করে বয়স্ক গৃহীভক্ত, যেমন, গিরিশচন্দ্র, রামচন্দ্র দত্ত, বলরাম বসু, সুরেন্দ্রনাথ, নবগোপাল। বাড়ির ভাড়া বহন করতেন সুরেন্দ্রনাথ; বাকিরা রামকৃষ্ণ, সারদা দেবী ও অন্যান্য সেবকের দৈনন্দিন খরচ চালাতেন।
কিন্তু এত সুষ্ঠু আয়োজন সত্ত্বেও রামকৃষ্ণদেবের জাগতিক শরীর আশানুরূপ সাড়া দিচ্ছিল না চিকিৎসায়। ডা. মহেন্দ্রলাল সরকার খেয়াল করছিলেন, তাঁর ওষুধের কার্যকারিতা যেন গত দু’মাসে ক্রমশই অধোগতির পথে। ক্যানসারের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে প্রায় অন্ধকারে থাকা সেই সময়ের চিকিৎসাশাস্ত্র হাতড়ে তাঁর মনে হল শহুরে দূষণ হয়তো এর জন্য দায়ী। তাঁর পরামর্শ মেনে তৎপর ভক্তরা শহরের উপকণ্ঠ কাশীপুরে এক বড় বাগানবাড়ি মাসিক ৮০/- টাকায় ভাড়া নিলেন। ১১ ডিসেম্বর, ১৮৮৫ রামকৃষ্ণদেবকে নিয়ে যাওয়া হলেন সেখানে। শ্যামপুকুর বাটিতে তাঁর ৭০ দিনের বাস শেষ হল।
বাটির ইতিবৃত্ত
না তখন নয়, তার অনেককাল পর রামকৃষ্ণ ভাবানুরাগীদের কাছে এই ৫৫ শ্যামপুকুর স্ট্রিটের বাড়ি ‘শ্যামপুকুর বাটি’ নামে পূজিত হতে শুরু হয়। ১৯১৫ সালে বাড়িটি কিনে কিরণচন্দ্র বসু ১৯৩৮-’৩৯ সাল নাগাদ এটিকে ‘৫৫এ’ ও ‘৫৫বি’ এই দু’ভাগে ভাগ করেন। শেষ পর্যন্ত এটি ৫৫এ-বি-সি-ডি চারভাগে বিভক্ত হয়। রামকৃষ্ণদেব থাকতেন যে-হলঘরে সেটি ৫৫এ, আর সারদা-মা কষ্টে দিনযাপন করতেন যে চাতালে সেটি ৫৫বি ভাগে পড়ে। কিন্তু শরিকদের অবহেলা আর অসচেতনতায় এই স্মৃতিপূত স্থান জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে।
৫৫এ অংশের বাসিন্দা লক্ষ্মী গোস্বামীর চেষ্টায় ২৭ আগস্ট, ১৯৭৮ এখানে ‘শ্যামপুকুরবাটী শ্রীরামকৃষ্ণ সংঘ’ স্থাপিত হয়। তারাই রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করে। পরে রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে যৌথভাবে এই সংঘ ১৯৮৮ সালে ৫৫এ অংশ এবং ১৯৯৫ সালে ৫৫বি অংশ কিনে নেয়। মধ্যস্থতায় বিশেষ ভূমিকা নেন সঙ্ঘের সম্পাদক, কথামৃতকার শ্রীম-র অন্যতম প্রপৌত্র গৌতম গুপ্ত। ক্রমশ রামকৃষ্ণ ভাবান্দোলনে এই বাড়ি হয়ে ওঠে এক পুণ্যতীর্থ।
কিন্তু কেন? শুধুই কি রামকৃষ্ণদেবের ৭০ দিনের সান্নিধ্য, নাকি এই বাটিকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার পিছনে আরও গূঢ় ঐতিহাসিক কোনও কারণ রয়েছে? সংক্ষেপে সেটি চিহ্নিত করার চেষ্টা করি।
কেন পুণ্যতীর্থ
প্রথমত, শ্যামপুকুরেই রামকৃষ্ণদেবের ভক্তদের মধ্যে এক সংঘভাব দানা বাধে। বাহ্যত তাঁর চিকিৎসাকে কেন্দ্র করেই এই একজোট। কিন্তু ক্রমে বোঝা যায়, ভক্তদের মধ্যে এক সুদূরপ্রসারী বোঝাপড়া জন্ম নিচ্ছে, যা সংঘের ভিত। সংসারী ও সংসার-উদাসীন ভক্তদের যে যৌথ নেতৃত্ব রামকৃষ্ণ মিশনের বৈশিষ্ট্য তার রূপরেখাও অজান্তে তৈরি হয়ে যায় এই শ্যামপুকুরেই। এক সন্ধ্যায় শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রণাম করে যান নটী বিনোদিনী। গোঁড়া সেবকদের চোখে ধুলো দিয়ে তিনি এসেছিলেন হ্যাট-কোট পরা সাহেবের ছদ্মবেশে। তাঁর কাছে গিয়ে আত্মপরিচয় দিতে রামকৃষ্ণদেবের সহাস্য অভ্যর্থনা এই ভাবান্দোলনকে বরাবরের জন্য মুক্তমনা রাখল।
দ্বিতীয়ত, সেই ভাবানুরাগী সঙ্ঘের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য রামকৃষ্ণদেব নরেন্দ্রনাথকে নির্দিষ্ট করে গেলেন। গুরুর মহিমা সম্পর্কে তিনি আগেই নিঃসন্দিগ্ধ হয়েছেন। কিন্তু মা-ভাইয়ের একটা বিলি-বন্দোবস্ত না করে সংসার ত্যাগে তাঁর দ্বিধা হচ্ছিল। রামকৃষ্ণদেব ২৭ অক্টোবর, ১৮৮৫ সকালবেলা নরেন্দ্রনাথের দিকে একবার সস্নেহে চেয়ে নিয়ে কথা প্রসঙ্গে বললেন, ‘‘গোঁসাই [?বিজয়কৃষ্ণ] লেকচার দিয়েছিল, ‘দশ হাজার টাকা হলে ঐ থেকে খাওয়া দাওয়া এই সব হয়– তখন নিশ্চিন্ত হয়ে ঈশ্বরকে বেশ ডাকা যায়।’ কেশব সেনও ঐরকম বলেছিল…
আমি বললাম, তীব্র বৈরাগ্য হলে সংসার পাতকুয়া, আত্মীয় কালসাপের মতো বোধহয়। তখন টাকা জমাবো, বিষয় ঠিকঠাক করবো, এসব হিসেব আসে না।’’
রামকৃষ্ণদেবের এই কথা ঠিকই লক্ষ্যভেদ করেছিল, কারণ অন্য সকল শ্রোতারা হেসে উঠলেও, কথামৃতকারের মনে হয়েছিল, নরেন্দ্রনাথ যেন ‘বাণবিদ্ধের ন্যায়’।
সঙ্ঘবোধ দানা বাঁধা, নেতৃত্বকে প্রস্তুত, তারপর জনসংযোগ– সে কাজটিও কার্যকরভাবে শুরু হয়েছিল এই শ্যামপুকুর পর্বেই। রামকৃষ্ণদেব তাঁর রোগযাতনা ভুলে অক্লান্ত কথা বলতেন আরও আরও মানুষের সঙ্গে। এই সময়েই গিরিশচন্দ্র এবং রামচন্দ্র দত্ত শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রকাশ্যে অবতার হিসেবে প্রচার করতে শুরু করেন। ২৫ অক্টোবর ঢাকা থেকে এসে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী শোনান রামকৃষ্ণ সম্পর্কে তাঁর অলৌকিক অনুভূতির কথা। মানুষের বুঝতে ভুল হয় না, এসব কথা তাঁরা বলছেন প্রগাঢ় বিশ্বাস থেকেই। তা আরও স্পষ্ট হল ৬ নভেম্বর, ১৮৮৫ কালীপুজোর রাতে।
তাঁহারে আরতি করি
আগের দিন থেকেই তিনি কিছু ভক্তকে বলছিলেন, ‘পূজার উপকরণসকল সংগ্রহ করে রাখিস– কাল কালীপূজা করতে হবে।’ সেদিন সকালে মাস্টারমশায়কে বলেছিলেন, ‘আজ কালীপূজা, কিছু পূজার আয়োজন করা ভাল।…পাঁকাটি এনেছে কিনা জিজ্ঞাসা কর দেখি।’ সেদিন সন্ধ্যা সাতটায় দোতলার বৈঠকখানা ঘরে তিনি, শ্রীরামকৃষ্ণদেব বিছানায় উপবিষ্ট। রামচন্দ্র দত্ত স্মৃতিচারণ করেছেন, ‘তাঁহার দুই দিকে দুইটি বৃহৎ মোমের বাতি জ্বালিয়া দেওয়া হইয়াছিল। দুই দিকে দুইটি সুবৃহৎ ধূপ হইতে সুগন্ধ ধূম উত্থিত হইতেছিল, সে-সময়ে তিনি কি অপূর্বভাবে শোভা পাইতেছিলেন, তাহা প্রকাশ করিতে বাক্য পরাজয় হইয়া যায়।’ মেঝেতে পূজার উপকরণ: বেলপাতা, গঙ্গাজল, ফুলের মধ্যে মূলত রক্তকমল, রক্তজবা; নৈবেদ্যের মধ্যে লুচি, সুজির পায়েস, নলেন গুড়ের সন্দেশের সঙ্গে কে জানে কে, কী মনে করে খানিকটা বার্লিও রেখেছে।
ঘর ভক্তে ঠাসা। রামকৃষ্ণদেব তাঁদের বললেন, ‘একটু সবাই ধ্যান করো।’ পিছনে বসে রামচন্দ্র নিচু স্বরে গিরিশচন্দ্রকে বললেন, ‘পরমহংসদেবের উদ্দেশ্য কী? পূজার আয়োজন করে এভাবে বসে আছেন কেন?’ চকিতে গিরিশের মনে পড়ল, দিন দশেক আগে ডা. মহেন্দ্রলালকে তিনি বলেছিলেন, ‘তাঁর কালী মানে আলাদা। বেদ যাঁকে পরমব্রহ্ম বলেন, তিনি তাঁকেই কালী বলেন। মুসলমান যাঁকে আল্লা বলে, খ্রীস্টান যাঁকে গড বলে, তিনি তাঁকেই কালী বলেন।’ গিরিশ উঠে দাঁড়ালেন।
ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে হঠাৎ দু’হাতে ফুল নিয়ে ‘জয় মা’ ডাক ছেড়ে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের পায়ে বারবার পুষ্পাঞ্জলি দিতে থাকলেন। পরমহংসদেবের সারা শরীরে একটা শিহরণ দেখা দিল। তারপরই তিনি গভীর সমাধিতে। ভক্তেরা সোচ্ছ্বাসে পুষ্পাঞ্জলি দিতে লাগলেন। তাঁর মুখমণ্ডল জ্যোতির্ময়, দিব্যহাস্যে বিকশিত, হস্তদ্বয়ে বরাভয়-মুদ্রা।
শাস্ত্রমতে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের পূজা শুরু হয়ে গেল জীবৎকালেই। এই শ্যামপুকুরে।
ঋণ: