‘যাঁরা প্রাণবাজি রেখে দেশের জন্ম সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করছে, সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে আরও বেশি উদ্বুদ্ধ করতে তাঁদের জন্য গান করার সুযোগ হয় আমাদের। সেই সময়ে আমরা কোনও ধর্মের ছিলাম না। কোনও জাতের ছিলাম না। সকলেই ছিলাম বাঙালি। সকল বাঙালি ছিলাম একত্রিত। আমাদের বিজয় আসে আমাদের এই একতা থেকেই। কলকাতার বাহিরেও আমরা গান গাইতে যাই।’ জানাচ্ছেন স্বপন চৌধুরী। সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় পর্ব।
তারপর সাংস্কৃতিকভাবে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করলেন।
পরের দিন ধর্মতলায় ১৪৪ লেলিন সরণির একটি দোতলা বাড়ির ‘পরিচয়’ পত্রিকার অফিসে পৌঁছে গেলাম। ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনের নেতৃত্বে গঠিত সংগঠন ‘মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’ গানের মহড়া হত এই বাড়িতে। ধীরে ধীরে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন পেশার মানুষের আগমন ঘটতে থাকল। মাহমুদুর রহমান বেণু, শাহিন সামাদ, ডালিয়া নওশিন, নায়লা খান, লুবনা মরিয়ম, মোশাদ আলী, বিপুল ভট্টাচার্য, লতা চৌধুরী, তপন বৈদ্য, মিলিয়া গণি, তারেক আলী, আজাদ হাফিজ, দেবব্রত ভট্টাচার্য-সহ আরও অনেকেই ছিলেন আমাদের দলে। দলে সদস্যসংখ্যা বাড়তে থাকল। প্রথম দিনের রিহার্সাল শুরু হইল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দেশে দেশে ভ্রমি তব দুঃখ গান গাহি’ গান দিয়ে।
গানের দল তো পেয়ে গেলেন। চিত্রশিল্পীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ কীভাবে ঘটল?
রিহার্সাল শেষে নতুন গান লিখবার জন্য আমাদের হাতে সাদা কাগজ কলম দেওয়া হল। অনেকদিন পর হাতে সাদা কাগজ পেয়ে মন আনন্দে নেচে উঠল। গান লেখার পরিবর্তে ছবি আঁকতে শুরু করলাম। ইতিমধ্যে কাঁধে ঝোলা ব্যাগ নিয়ে ঘরে ঢুকলেন পরিচয় পত্রিকার সম্পাদক লেখক দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলার এক পর্যায়ে জানালেন, ঢাকার চিত্রশিল্পীদের কথা। যাঁদের নাম বললেন, সকলকেই চিনতে পারলাম। জানালেন এখানে চিত্রশিল্পীদের ছবি আঁকার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং বাংলাদেশের শিল্পীদের আঁকা ছবি নিয়ে বিশেষ একটি প্রদর্শনীর আয়োজন চলছে। প্রথমে দেখা হল চিত্রশিল্পী বীরেন সোমের সঙ্গে। এরপর বিজয় সেন, নাসির বিশ্বাস, প্রাণেশ মণ্ডল, অঞ্জন, বণিক, শেখর-সহ আরও অনেকের সঙ্গে। আমাদের অনেক ছবি আঁকার জায়গা হিসেবে জুটল কলকাতা আর্ট কলেজের বারান্দা। সেখানে অনেকেই সন্ধ্যার পর ছবি আঁকি। কলেজের উপরতলায় থাকতেন বিখ্যাত ভাস্কর চিন্তামণি কর।
গানের পাশাপাশি আপনি তখন খুব ছবি আঁকছেন। চিত্রশিল্পীদের সঙ্গেও সমানতালে যোগাযোগ রাখছেন।
সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে বাংলাদেশের চিত্রশিল্পীদের আঁকা ছবি নিয়ে বিড়লা অ্যাকাডেমি গ্যালারিতে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। তখন তো আমি দিনে গানের দলের সঙ্গে গান করছি। আর রাতে যখন যেখানে থাকার জায়গা পাচ্ছি, থেকে যাচ্ছি। আর যা আঁকতাম সেটাও বিভিন্ন জায়গায় রেখে দিতাম। প্রদর্শনীর খবর শোনার পর বিভিন্ন জায়গায় রাখা ছবিগুলো সংগ্রহ করে শিল্পী কামরুল হাসান, চিন্তামণি কর, আরও দু’জন শিল্পী নাম ভুলে গেছি এবং একজন বিদেশি মহিলার উপস্থিতিতে ছবিগুলো দেখালাম। সেখান থেকে আমার ন’খানা ছবি প্রদর্শনীর জন্য নির্বাচিত করা হল। এই প্রদর্শনী উপলক্ষে আমার দু’খানা ড্রয়িং ১৫০ টাকা মূল্য বিক্রি হল।
আরেকটি প্রদর্শনী কথা বলতে পারি। কলকাতার বড় বড় চিত্রশিল্পীরা মুক্তিযুদ্ধের সহায়তার জন্য এসপ্লানেডের মোড়ে ফুটপাথের রেলিঙে তাঁদের ছবি দিয়ে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। সেখানে কুড়ি থেকে একশত টাকায় ছবি বিক্রি করা হয়। শিল্পী বিকাশ ভট্টাচার্য, সুনীল দাশ, শ্যামল রায় চৌধুরী, অমিতাভ সরকার, মাধবী পারেক, এবং প্রকাশ কর্মকার-সহ আরও অনেকের ছবি ছিল সেখানে।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
পড়ুন সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব: বাহিরে গুলির শব্দ হচ্ছে আর আপনি গান গেয়ে যাচ্ছেন
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
যুদ্ধের প্রকৃত পরিস্থিতি দেশের মানুষকে জানানো এবং বহির্বিশ্বকে অবহিত করতে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষক-শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি’। এদের সঙ্গেও নিশ্চয়ই আপনার পরিচয় ঘটল?
অনেক অনেক লেখক-শিল্পী-সমাজকর্মী আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন। মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস জুড়ে থাকলেন বাংলাদেশের সঙ্গে। এদের অনেকেরই পূর্বপুরুষের ভিটেবাড়ি ছিল পূর্ববঙ্গে। এইটা একটা বড় বিষয় হিসেবে কাজ করেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়। বিশেষ করে যাঁদের সঙ্গে, যাঁদের সহযোগিতায় আমার যুদ্ধকালীন সময় কেঁটেছে, তাঁদের কথা বলতে চাই। অধ্যাপক আবু সয়ীদ আইয়ুব, গৌরী আইয়ুব, মৈত্রেয়ী দেবী, কবি বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বিমল মিত্র, পান্নালাল দাশগুপ্ত, শুভ গুহঠাকুরতা এবং সাগরময় ঘোষ। এঁদের কাছে বাংলাদেশ যেমন ঋণী, আমিও তেমন ঋণী হয়ে আছি। ৫ নং পার্ল রোডের গৌরী আইয়ুবের এই বাড়ি ছিল সেই সময়ে বাংলাদেশ থেকে আসা সকলের প্রধান ঠিকানা। একদিন শিল্পী আবুল বারল আলভী এসে উপস্থিত হল এই বাড়িতে। একটি কাগজের প্যাকেট তুলে দিলেন গৌরীদি-র হাতে। বলেন, কবি শামসুর রাহমান এই প্যাকেট আপনার কাছে পৌঁছে দিতে বলেছেন। সেই প্যাকেটে ছিল একটি কবিতার বইয়ের পাণ্ডুলিপি। নিরাপত্তার কারণে ছদ্মনামে ছাপা হয় কবিতার বই ‘বন্দী শিবির থেকে’।
আপনাদের গানের দলের কথায় ফিরে আসতে চাই। ‘মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’-র আয়োজনে রবীন্দ্র সদনে ‘রূপান্তরের গান’ নামে দুইদিন ব্যাপী একটি গীতি-আলেখ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছিল।
আমাদের গানের দলের শিল্পীদের কণ্ঠে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচারের জন্য অনেকগুলো গান রেকর্ডিং করা হয়। দুইদিন ব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন হয় রবীন্দ্র সদনে। গানের শুরুতে বাংলাদেশের পক্ষে আলেখ্য পাঠ করেন বাংলায় হাসান ইমাম এবং ইংরেজিতে আলী যাকের। এই অনুষ্ঠানে প্রচুর লোক সমাগম হয়েছিল। বাংলাদেশের সমর্থনে পশ্চিমবঙ্গে ঢল নেমেছিল এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে– এমন মনে হয়েছিল সেদিন। এই অনুষ্ঠানের পরপরই ঠিক করা হয়– আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে। মাঠে-ঘাটে শরণার্থী ক্যাম্পে ঘুরে ঘুরে গান গাইতে হবে। মানুষের সমর্থন এবং শরণার্থীদের মনোবল বাড়াতে হবে।
আপনারা একটি ট্রাকে করে বেড়িয়ে পড়লেন। আপনাদের গানের দলের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে আসা চারজনের একটি চলচ্চিত্রের টিম ছিলো। যারা সেই সময়ে আপনাদের মাঠে-ঘাটে গান গাওয়ার দৃশ্য ধারণ করেন। টিম প্রধান ছিলেন চিত্রগ্রাহক ও পরিচালক লিয়ার লেভিন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের ওপরে ‘জয় বাংলা’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। কিন্তু সিনেমাটা কখনও আলোর মুখ দেখেনি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তারেক মাসুদ ও আরেক মার্কিন নাগরিক ক্যাথরিন মাসুদ লিয়ার লেভিনের অপ্রকাশিত ‘জয় বাংলা’-র কিছু ফুটেজ নিয়ে ‘মুক্তির গান’ নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেন। আমি আপনাকে প্রথম দেখি এই মুক্তির গান চলচ্চিত্রের মাধ্যমে এবং আপনাকে চিনতে পারি এই সিনেমা বিষয়ক একটি দৈনিক পত্রিকার ছোট্ট সাক্ষাৎকার থেকে। আপনাকে চেনা-জানার প্রায় বিশ বছর পর আপনার সাক্ষাৎকার নিতে বসে আছি আপনার এই লালমাটিয়ার বাসার ঘরে। আপনাদের সেই জার্নির একটা ছবি আমাকে খুব শক্তি দেয়, ‘আপনারা দল বেঁধে হাঁটছেন, শিবনারায়ণ দাসের নকশায় করা সবুজের মাঝে লাল বৃত্তের বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা বাতাসে উড়ছে, নীল আকাশ, সামনে নদী। নদী পাড় হলেই মুক্তাঞ্চল। মুক্তাঞ্চলে বাঙালার শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প।
নভেম্বরের শেষ দিকে আমরা মুক্তাঞ্চলে, এই প্রথম গান গাইতে যাই। যাঁরা প্রাণবাজি রেখে দেশের জন্ম সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করছে, সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে আরও বেশি উদ্বুদ্ধ করতে তাঁদের জন্য গান করার সুযোগ হয় আমাদের। সেই সময়ে আমরা কোনও ধর্মের ছিলাম না। কোনও জাতের ছিলাম না। সকলেই ছিলাম বাঙালি। সকল বাঙালি ছিলাম একত্রিত। আমাদের বিজয় আসে আমাদের এই একতা থেকেই। কলকাতার বাহিরেও আমরা গান গাইতে যাই। অক্টোবর মাসের শুরুদিকে দিল্লিতে বাংলাদেশের স্বপক্ষে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গান করতে যাই। সেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ। এই অনুষ্ঠানে গানের শুরু আর মাঝে ইংরেজিতে লেখা বাংলাদেশ বিষয়ক রূপান্তরের গানের আলেখ্য পাঠ করেন আলমগীর কবির। এই অনুষ্ঠানে গান করা বাদে আমি মঞ্চসজ্জার কাজে সহকারী হিসেবে কাজ করি শিল্পী মুস্তফা মানোয়ারের সঙ্গে। দিল্লিতে বসবাসরত পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা আমাদের গানের দলকে আমন্ত্রণ জানান। তখন আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয় জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেমা বিষয়ক একটি সেমিনারকে কেন্দ্র করে ঋত্বিক কুমার ঘটক উপস্থিত ছিলেন। আমাদের কথা শুনে আমাদের গানের দলের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। আমরা যারা আগ্রহী, সবাই ছুটলাম ঋত্বিক ঘটকের কাছে। তাঁর সঙ্গে দেখা হবে, সেমিনারেও অংশগ্রহণ করা হবে। তিনি আমাদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বললেন। বাংলাদেশের জন্য তাঁর ব্যাকুলতা আমরা অনুভব করতে পারলাম। দিল্লি থাকাকালীন একটি অনুষ্ঠানে চট্টগ্রামের বিদ্রোহী সেনানী কল্পনা দত্ত (যোশী)-র সঙ্গে পরিচয় হল। চট্টগ্রামের অধিবাসী হিসেবে আমি খুব উজ্জীবিত হলাম কল্পনা দত্তর সান্নিধ্য পেয়ে। তিনিও আমাদের একদিন তাঁর বাসায় দুপুরের খাবারের জন্য নিমন্ত্রণ করলেন। আমরা সবাই সেই নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে চলে গেলাম তাঁর বাসায়। এর মধ্যে হঠাৎ একদিন সকালে গান্ধী মেমোরিয়ালের হোস্টেলে এলেন বিখ্যাত গণসংগীত শিল্পী জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র। আমাদের জন্য নতুন একটা গান লিখে দিলেন এবং সুর করে শিখিয়ে দিলেন। গানটা হচ্ছে—
‘যশোর, খুলনা, বগুড়া, পাবনা
ঢাকা, বরিশাল, নোয়াখালী
তারা হিন্দু নয়, মুসলিম নয়
তারা শুধু বাঙালি।…’
মুক্তিযুদ্ধের ৫২ বছর পার হয়ে এল, এখনও কি সেই তরঙ্গ রক্তে অনুভব করেন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান কানে ভেসে এলে?
যে চেতনা থেকে যুদ্ধ করেছি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলেছি এই গত ৫০ বছরে। কিন্তু এখনও স্বপ্ন দেখি। দিনের বেশিরভাগ সময় ছবি আঁকছি। তাই হয়তো রক্তে এখনও সেই তরঙ্গ অনুভব করি ‘জয় বাংলা’ স্লোগান শুনলে।
বসন্তপঞ্চমীর প্রথম পর্ব ছিল বসন্ত চৌধুরীর পোশাকআশাক নিয়ে। দ্বিতীয় পর্বে, তাঁর বাড়ির পোষ্য জীবজন্তু। কখনও পপি নামের আহ্লাদী কুকুর, কখনও-বা রোজি নামের কচ্ছপ। দুম করে অন্দরমহলে ঢুকে পড়া বিদেশি একটি বিড়াল, অথচ যার ততটা বিড়ালপ্রেম নেই– এহেন বসন্ত চৌধুরীরও একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল।
পশ্চিমবঙ্গের একশ্রেণির মানুষ বলতেন, ওঁরা তো ভোটে না জিতে নেতা হয়েছেন। হ্যাঁ, সীতারাম ইয়েচুরি কখনও ভোটে জিতে মন্ত্রী বিধায়ক হননি। তারপরও দলমত নির্বিশেষে যে গ্রহণযোগ্যতা ও মর্যাদা তিনি দেশের সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অর্জন করেছিলেন, সেটা ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত।