কলকাতা বইমেলাকে অগ্নিকাণ্ড গ্রাস করে নেওয়ার পর, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং সুভাষ চক্রবর্তী যেভাবে মেলার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, খাণ্ডবদহনের ভেতর থেকে ফিনিক্স পাখির মতো জাগিয়ে তুলেছিলেন বইমেলাকে, তা আমাদের মনে থাকবে। আমাদের মনে থাকবে এ-ও, যে তিনি সার্বিকভাবে পশ্চিমবাংলার উন্নয়নের কথা ভেবেছিলেন। কোনও অন্ধ গলির ভেতর ঢুকে না পড়ে।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, ডাকনামে ‘বাচ্চু’, ছিলেন শ্যামবাজার শৈলেন্দ্র সরকার স্কুলের ছাত্র। চমৎকার ক্রিকেট খেলতেন, বক্তৃতা করতেন আরও ভালো। শুধু কবিতার অনুরাগী ছিলেন, এমন নয়, কবিতা লিখতেনও। কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর সঙ্গে এককালে হৃদ্যতা ছিল যথেষ্টই। অনুবাদ করেছেন মায়াকোভস্কি, মার্কেজ। সবসময় যে ভালো লেগেছে, তা নয়। কিন্তু নিরন্তর সেই কাজের মধ্যে তিনি ডুবেছিলেন। প্রচুর গল্প করতেন তিনি। আমি তাঁকে দেখেছি, কবিসম্মেলনে বসে প্রিয় কবিদের কবিতা পড়া শুনছেন। কমিউনিস্ট পার্টির যে আর্বান শৃঙ্খল, যে বিষয় রবীন্দ্রনাথ ‘রাশিয়ার চিঠি’তে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন– এই ব্যবস্থা টিকবে তো? বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কিন্তু সেই রবীন্দ্রনাথেরও অসম্ভব ভক্ত ছিলেন। রবীন্দ্র-অনুরাগী বলতে যা বোঝায়, রবীন্দ্র-পড়ুয়া বলতে যা বোঝায়, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ছিলেন তাই। এই পাঠ তাঁকে সমৃদ্ধ করেছে, এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে সামগ্রিক জীবনবোধে। এমনকী, যে-জীবননান্দ কমিউনিস্ট নন, কিংবা কমিউনিস্টদের থেকেও বড় কমিউনিস্ট– যখন জীবনানন্দর লেখা পড়ি ও ব্যবচ্ছেদ করি, দেখি– জীবনানন্দ দাশ বারবার শতজল ঝর্নার ধ্বনির কথা শুনতে চেয়েছেন। আমাদের বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কিন্তু জীবনানন্দ নিয়ে দীর্ঘ কাজ করেছেন। জীবনানন্দর লেখালিখি নিয়ে বই রয়েছে তাঁর। সে লেখায় নিজস্ব বিশ্লেষণ ও পঠনের ছাপ স্পষ্ট।
শুধু কবিতা নয়, ছবিও পেন্টিং ভালো বুঝতেন তিনি। আজ তাঁর প্রয়াণের পর, একটি চ্যানেলে দেখানো হচ্ছিল তাঁর ছবির সংগ্রহ। দেখলাম, পিকোসোর ‘গুয়ের্নিকা’ও রয়েছে সেখানে। আমরা জানি, গুয়ের্নিকার ইতিহাস, বিস্তারিত বলছি না সে নিয়ে। তিনি পছন্দ করতেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস। এবং হাসতে হাসতে আমার মনে আছে, তিনি তাঁর অতি-ঘনিষ্ঠদের বলেছিলেন, যাঁরা সিগারেট খেতেন না, তাঁরা হেরে গিয়েছেন। জোসেফ স্তালিন ধূমপান করতেন, অ্যাডলফ হিটলার করতেন না। স্তালিন জিতেছেন, হিটলার হেরেছেন। হয়তো তখন সিগারেট ছাড়ার কথাই হচ্ছে। এ নিজের সঙ্গেই খানিক মশকরা। ‘সিওপিডি’ ধরা পড়ার সময় বোধহয় এইটা নিজের কাছে এই মজার যুক্তি ছিল তাঁর। অসম্ভব জীবনরসিক মানুষ না হলে এরকম কেউ বলতে পারেন?
একজন মানুষ, যিনি সাদা-ধুতি পাঞ্জাবি পরে এসেছেন চিরকাল। ওপরে কখনও একটা মটকা রঙের জহরকোট। এটাই মূলত তাঁর পোশাক। বাইরে গেলে, প্যান্ট-শার্ট বা সাফারি পরতেন। বামফ্রন্ট জমানায় খুব কাছ থেকে দেখেছি ওঁকে। কখনও মনে হয়নি যে, তিনি খুব অ্যারোগেন্ট। অথচ তাঁর ঔদ্ধত্য নিয়ে অনেক বদনাম ছিল। কোন জায়গায় এই ঔদ্ধত্য দেখিয়েছেন? ওরা ৩৫, আমরা ২৩৫। কিন্তু এরকম সৎ মানুষ, পড়ুয়া মানুষ, বাংলার রাজনীতিতে কমই এসেছেন। বলা চলে– আসেননি।
বুদ্ধবাবু উদারমনস্ক ছিলেন। ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সমস্ত সিদ্ধান্ত যে তিনি মেনে নিতেন, তা নয়। তাঁর শিল্পায়ন প্রতিষ্ঠা, নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুরে কৃষকভাইদের জমি অধিগ্রহণ করে কারখানা গড়তে দেওয়াটা ব্যক্তিগতভাবে আমার ভালো লাগেনি। আন্তর্জাতিকভাবে কুখ্যাত দাও কেমিক্যালকে নন্দীগ্রামের জমি ছেড়ে দেওয়াটাও ওঁর সঙ্গে মানায় না। যখন তিনি বড় বৈদ্যুতিন চ্যানেলে শিল্পপতি টাটার জয়গান করেন, সিঙ্গুরের আগামী কারখানা নিয়ে, তখনও ভালো লাগেনি। কিন্তু তিনি বেকার সমস্যার সমাধান চেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ। তাঁর মন্ত্রিসভার স্লোগানই ছিল এটা। এই স্লোগানে রাস্তায় রাস্তায় হোর্ডিংও পড়েছিল। আমার সবসময়ই মনে হয়, কৃষকের ছেলে হয়তো কৃষক হতে চান না, কিন্তু জমির প্রতি ভারতীয়তার যে হৃদয়, সেই অনুসারে, জমির প্রতি একটা মায়া ছিল। কমলকুমার মজুমদারের লেখার মতো, তবু কিছু মায়া রহিয়া গেল। সেই কৃষকের ছেলে যদি ব্যাঙ্কে চাকরি করেন, স্কুল-শিক্ষকতা করেন, ওকালতি করেন, তবুও মাটির প্রতি তাঁর আগ্রহ থাকবে। আমার প্রশ্ন, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এটা বুঝতে পেরেছিলেন না পারেননি?
আজ তিনি প্রয়াত হয়েছেন, এসব কথা বলার সময় এটা নয়। বরং বলি, কলকাতা বইমেলাকে অগ্নিকাণ্ড গ্রাস করে নেওয়ার পরও, তিনি এবং সুভাষ চক্রবর্তী যেভাবে মেলার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, খাণ্ডবদহনের ভেতর থেকে ফিনিক্স পাখির মতো জাগিয়ে তুলেছিলেন বইমেলাকে, তা আমাদের মনে থাকবে। আমাদের মনে থাকবে এ-ও, যে তিনি সার্বিকভাবে পশ্চিমবাংলার উন্নয়নের কথা ভেবেছিলেন। কোনও অন্ধ গলির ভেতর ঢুকে না পড়ে।
………………..………..
পড়ুন মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায়ের লেখা: শক্তির ‘হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান’ কবিতাটা প্রথম তাঁর পত্রিকায় ছাপিয়েছিলেন বুদ্ধদেবই
………………………….
আজ শিল্পের সংজ্ঞাই বদলে গিয়েছে। ইউরোপের শিল্পবিল্পব, তারপর যে বুর্জোয়াদের উত্থান, পুঁজিবাদের উত্থান, সেই ধারণাটাই বদলে গিয়েছে এখন। তার ওপর উত্তর সোভিয়েত ইউনিয়নের অনেক নতুন নতুন সমস্যা, তবুও মার্কসবাদ ও ফলিত মার্কসবাদ তার মতো করে এগিয়েছে। সে পথ হারায়নি। যদিও চিনের পুঁজির আমন্ত্রণ, শি জিন পিংয়ের আগে যে রেজিম– প্রাইভেটাইজেশন, লগ্নি পুঁজিকে আমন্ত্রণ করা, বাজার খুলে দেওয়া– তাকে তিনি সমর্থন করেছেন। সিপিআইএমের একটা স্লোগান তৈরি হল তখন: আগে পুঁজিবাদ, পরে সমাজতন্ত্রবাদ। এটাও যে আমার পছন্দ হয়েছিল তা না। কিন্তু আমার পছন্দ হওয়ায় কী এসে যায়?
…………….……………………………..
পড়ুন রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা: মার্কস ও রবীন্দ্রনাথ– দুই ধারার মিশ্রণে পরিণত হয়েছেন বুদ্ধদেব
……………………………………………
ক্ল্যাসিকাল মার্কসিজমের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিপ্লবের ইতিহাস পড়তেন। সে বিষয়ে কথা বলতেন। সিনেমা দেখতেন খুবই। কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সিনেমা দেখতেন নিয়মিত। বিশেষ করে, যুদ্ধের সিনেমা এবং পৃথিবীবিখ্যাত চলচ্চিত্রকারদের সিনেমা। এমন একজন মানুষ, যিনি সবদিক থেকে খোলা মনের– অনুবাদক, শিল্পবোদ্ধা, সিনেমাবোদ্ধা, সংগীতবোদ্ধা, নিজের মৌলিক লেখাও যথেচ্ছ। এই ব্যাপারটা আমাকে বিস্মিত করে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শেষ পর্যায়তেও, যখন একেবারেই বিশৃঙ্খল অবস্থা, তখনও তিনি লেখা জারি রেখেছেন। এটা একটা বড় কাজ। সমস্ত রাজ্যের প্রশাসন সামলে নিজের লেখাকে চলমান রাখা, এটা শেখার মতো। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের লেখার মধ্যে ছিল সৃষ্টিশীল পরিক্রমা, যা শুরু হয়েছিল তাঁর প্রাথমিক জীবনের কবিতা লেখা দিয়ে।
শ্যামপুকুর কেন্দ্র থেকে তিনি দাঁড়িয়ে জিতেছিলেন, আবার হেরেও গিয়েছিলেন কংগ্রেস আই প্রার্থী প্রফুল্লকান্তি ঘোষের (শত ঘোষ) কাছে। এই জয়-পরাজয়ের পর দক্ষিণ কলকাতায় যাদবপুর কেন্দ্রে একবার ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তাঁর বিরুদ্ধে যিনি দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি নামকরা অভিনেত্রী, বারেবারেই ‘রক্ত রক্ত’ বলে চিৎকার করছিলেন। বুদ্ধবাবু পাল্টা কোনও উচ্চারণ করেননি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সেই অভিনেত্রীর বিরুদ্ধে। সেই শালীনতা বজায় রেখেছিলেন। অথচ পরে, দরকারে, দাঙ্গাবাজদের মাথা ভেঙে দেব– এই কথাটাও তিনি নিজের মতো করে উচ্চারণ করেছিলেন। যেমন, জ্যোতিবাবু বলেছিলেন যে, সরকার না চাইলে দাঙ্গা হয় না। মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুর পর সবচেয়ে কলঙ্কজনক ঘটনা ছিল বাবরি মসজিদ ভাঙা। আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতার কাঠামো হুড়মুড় করে ভেঙে পড়েছিল ফ্যাসিস্টদের আক্রমণে। আমরা রুখতে পারিনি। এই পরাজয় আমাদের। আমাদের সেই সেদিনের হেরে যাওয়ার দলে বুদ্ধবাবুও ছিলেন।
তাঁর প্রয়াণের পর আবারও, আরও বেশি করে মনে হচ্ছে পড়ায়-লেখায়, মানুষের সঙ্গে মেশায় যে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, তাঁকে কি আমরা অনুসরণ করিনি? যদিও অনুসরণ করা কতটা সম্ভব আজ, জানি না। আজকের মুক্ত-দুর্নীতির কাছে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর পাম অ্যাভিনিউয়ের দু’কামরার ফ্ল্যাট বাতিস্তম্ভ হয়ে থেকে যাবে। কেউ কেউ নিশ্চয়ই বলবেন, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বোকা ছিলেন। কিন্তু মাও সে তুং তো সেই কবেই বলেছিলেন, বোকা বুড়ো পাহাড় সরাতে নেমেছিল।