কবিসম্মেলনে তাঁকে দেখা যেত না। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী হয়েও তিনি কোনওদিন চাকরি করেননি। যখন লিখতে এলেন, লোকে তাঁর বিধ্বংসী রূপ দেখে ভয় পেয়েছিল। যখন তিনি মধ্যগগনে, তখন দেখেছি ট্রামে করে বাপের বাড়ি যেতেন চারু মার্কেটে, আবার ট্রামে করে ফিরে আসতেন হিন্দুস্থান পার্কের এক কামরার ফ্ল্যাটে, যেটাকে মনে হত, কান্দাহার পর্বতের গুহা। প্রচ্ছদের ছবি: সুপ্রিয় মিত্র
দেবারতি মিত্রের কবিতা, স্নানের মতো সুন্দর। তিনি কবিতা লিখতেন, পাহাড় থেকে নেমে আসা কিন্নরীর মতো, যিনি গড়িয়াহাটার মোড়ে দিশাহারা দাঁড়িয়ে পড়েছেন। আধুনিক পৃথিবীর কেউ ছিলেন না তিনি, কিন্তু তাঁর কবিতা ছিল আধুনিকতায় গনগনে, উদ্দাম, ঈশ্বরীয়, যাকে তিনি রতি-লবণ দিয়ে জাগিয়ে রাখতেন। কোথাও যেতেন না। কবিসম্মেলনে তাঁকে দেখা যেত না। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী হয়েও তিনি কোনওদিন চাকরি করেননি। যখন লিখতে এলেন, লোকে তাঁর বিধ্বংসী রূপ দেখে ভয় পেয়েছিল। যখন তিনি মধ্যগগনে, তখন দেখেছি ট্রামে করে বাপের বাড়ি যেতেন চারু মার্কেটে, আবার ট্রামে করে ফিরে আসতেন হিন্দুস্থান পার্কের এক কামরার ফ্ল্যাটে, যেটাকে আমার মনে হত, কান্দাহার পর্বতের গুহা। আজীবন বড় পত্রিকায় লিখেছেন, সবচেয়ে বড় পত্রিকায় লিখেছেন। সবচেয়ে বড় প্রকাশকের ঘর থেকে প্রকাশিত হত তাঁর বই। আর যে বাড়িতে তিনি থাকতেন, সেই বাড়িতেই ছিল লিটল ম্যাগাজিনের নিঃসঙ্গ সম্রাট। এরকম নিষ্পাপ ‘বাইপোলারিটি’ বাংলা সাহিত্যে আর দেখা যায়নি।
লিখতেন কম। শেষের দিকে আরও কমে এসেছিল তাঁর লেখা। বছরে দুটো কি তিনটে কবিতা ছাপতে দিতেন। এই সংযম সোজা কথা নয়। কেউ কেউ এক চামচ সংযম দেখিয়ে ঢোল পিটিয়ে থাকেন, দেখো আমি কত সংযত। দেবারতি মিত্র কোথাও যেতেন না– চলাফেরায় নিয়ন্ত্রিত ছিলেন বলে নয়, তিনি জানতেন, কোথাও গিয়ে কিছু হয় না। মাইকে কবিতা পড়ে, কিছু হয় না। দেশ-বিদেশে গিয়ে বকবক করেও কিছু পাওয়া যায় না। তিনি অপেক্ষা করতেন, একটা কবিতার জন্য, যে কবিতা তিনি আগে লেখেননি। তিনতলার ফ্ল্যাটে তিনি একজন সুফি কবির মতো দিন কাটাতেন, মাস কাটাতেন, বছর কাটাতেন। তাঁর কোন ধর্ম ছিল না, চালে যেন কাঁকড় না থাকে, শাকান্ন প্রস্তুত হল কি না, দু’-টুকরো মাছ ঠিকমতো পক্ক হল কি না, তাঁর স্বামী কবি মণীন্দ্র গুপ্তকে ঘিরে তাঁর মহাজগৎ আবর্তিত হত। সেই মহাজগৎ একটা চালের মতো, একটা তণ্ডুলের মতো। একটা স্টোভের মতো। একটা হাঁড়ির মতো।
ভোর পৌনে পাঁচটায় ট্রেন যেন ডোডোর কঙ্কাল,
সকাল নটায় পাখি, ঘন ধানক্ষেত।
সাড়ে এগারোটা বাজলে
নরম বালির গর্তে জমা বৃষ্টিজল।
বিকেল পৌনে তিনটে–
সারাদিন সঙ্গহীন তিন চারটে মথ।
সন্ধে ছটা তেতাল্লিশে
রোস্টেড মুরগির উষ্ণ সুগন্ধ ও স্বাদ,
নটা চৌত্রিশে প্রায় নিষ্ঠুরতা:
প্রীতিময় মৌমাছির কামড়।
রাত একটা পঞ্চান্নয়
কালীর গর্ভের মতো অন্ধকার, একা।
ছয়ের দশকে যখন দেবারতি মিত্র কবিতা লিখতে এলেন, তখন কবিতা লেখা খুব কঠিন হয়ে গেল। একটু সময় নিয়ে ঠান্ডা মাথায় লক্ষ করলে দেখা যাবে, তখন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বীরেন চট্টোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীরা তাঁদের সাংঘাতিক কবিতাগুলো লিখছেন, শক্তি-সুনীলের দাপট, শঙ্খ, অলোকরঞ্জন হয়ে উঠছেন ঐতিহ্যের বিস্তার, হাংরি আন্দোলনের দাবানল– সব মিলিয়ে বাংলা কবিতা তখন ভলক্যানোর ওপর দাঁড়িয়ে। তখন লিখতে এলেন তুষার রায়, এসেই কলেজ স্ট্রিটের মুকুটহীন রাজা বলে ঘোষিত হলেন। ভাস্কর চক্রবর্তী, বিষাদের দেবদূত হয়ে হাঁটতে লাগলেন বরানগর থেকে বালিগঞ্জের দিকে। সম্পূর্ণভাবে পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত বাংলা কবিতায় কবিতা সিংহ-র পরে একটি নাম উঠে এল– দেবারতি মিত্র।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
তিনতলার ফ্ল্যাটে তিনি একজন সুফি কবির মতো দিন কাটাতেন, মাস কাটাতেন ,বছর কাটাতেন। তাঁর কোন ধর্ম ছিল না, চালে যেন কাঁকড় না থাকে, শাকান্ন প্রস্তুত হল কি না, দু’টুকরো মাছ ঠিকমতো পক্ক হল কি না, তাঁর স্বামী কবি মণীন্দ্র গুপ্তকে ঘিরে তাঁর মহাজগৎ আবর্তিত হত। সেই মহাজগৎ একটা চালের মতো, একটা তন্ডুলের মতো। একটা স্টোভের মতো। একটা হাঁড়ির মতো।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
‘অন্ধ স্কুলে ঘণ্টা বাজে’ একটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ, যাঁর ঘণ্টাধ্বনি বাংলা কবিতায় কান পাতলেই শোনা যায়। তাঁর আর একটি কাব্যগ্রন্থ আমার মাথার কাছে থাকত, ‘যুবকের স্নান’। এত ‘এলিমেন্টাল’ কবিতার বই বাংলা ভাষায় আর লেখা হয়েছে কি না, আমার জানা নেই। এই বই ইতিহাসে থেকে গেল।
একটি কবিতার কথা বলব, যেটা না বললে অন্যায় হবে। কবিতাটার নাম, ‘পৃথিবীর সৌন্দর্য, একাকী তারা দুজন’:
প্রিয়তম পুরুষটি এক পা একটুখানি উঁচু করে
বিছানায় ভেসে আছে দেবদূত
…
হঠাৎ সচল হয়ে ডাকে তরুণীকে
দুহাতে জড়ানো নারী
তার উর্ধ্বশরীরের ক্ষীর সৌকর্ষ ফেলে রেখে
গা শিরশিরে লোভে
দু পায়ের ফাঁকে এসে মুখ গুঁজে দেয়।
আমরা যখন লিখতে এসে এই কবিতার মুখোমুখি হলাম, তখন অবাক হয়ে ভাবলাম, এই কবিতা একজন নারী লিখছেন! ছয়ের দশকের লজ্জা, ছয়ের দশকের ভিক্টোরিয়ান ঢাকাঢাকি, ছয়ের দশকের ঢাকনা পড়ানো ট্যাবুজ, এসবকে কেয়ার না করে একজন নারী, এরকম কবিতা লিখতে পারেন?
মেয়েটির উচ্ছ্বল তৃপ্ত ওষ্ঠাধর, দাঁত, দু’চোখের পাতা
চটচটে ঘন লাক্ষারস মাখামাখি
সজীব রঙিন শান্ত সুস্থ জানুসন্ধির মধ্যিখানে
আস্তে আস্তে তার মুখমণ্ডল অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ে
পৃথিবীর সৌন্দর্য একাকী।
আমি এই নশ্বর মানব জীবনে, সঙ্গম নিয়ে যে ক’টা কবিতা পড়েছি, এটিই মহত্তম।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: নারীবাদী সত্তায় নিজেকে উচ্চকিতভাবে চিহ্নিত করতে চাননি দেবারতি মিত্র
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
গত ২০ বছরের কবিতায়, তিনি গার্হস্থ ও মহাজগতকে উনুনের কাছে জড়ো করে রেখেছিলেন।
‘কিচেন অ্যান্ড ক্যাওস’ তাঁর কবিতার ব্যাটারিকে জীবন এনে দিত।
‘আমার বোনের মেয়ে বারুদঠাসা শ্বশুরবাড়ি থেকে/ একটুকরো পোড়া কাঠের মতো ছিটকে পড়ল পৃথিবীতে।’– এই কবিতাও লিখে গেছেন দেবারতি মিত্র।
দেবারতি, না সিলভিয়া প্লাথ, না অ্যানি সেক্সটন। তিনি দেবারতি মিত্র। তাঁর হাহাকার ও হারমনি তাঁর নিজের। সেখানে কোনও ইউরোপ এসে হাত ধরেনি।
অক্ষর চেনায়নি কেউ কোনদিন
আমি ঘুরে ঘুরে একা
লেখাপড়া করি এই বিজন কবরে।
এরকম উচ্চারণ বাংলা কবিতা আগে শোনেনি।পরেও শোনেনি। তিনি এতটাই নিজস্ব। এতটাই একা। শুধু কবিতাটাই লিখতে চেয়েছেন। কৃত্তিবাস, আনন্দ, রবীন্দ্র– কবিতার পক্ষে তিনটি শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়েও তিনি ছিলেন, কোলাহল থেকে শত মাইল দূরে। শেষপর্যন্ত লেখাটাই থাকে, আর সব ছাই।
বাংলা কবিতায় এখন ছাই বেশি, দেবারতি কম।