১৯৮৫ সালে সোনারপুর কৃষ্টি সংসদের ‘কৃষ্টি’ পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকার তিনি বলেন, ‘আমি এই মুহূর্তে একটি বিষয়কেই অধিকার দিয়ে লিখতে চাই, সেটা হলো, দীন মানুষ, অবহেলিত এবং পর্যুদস্ত মানুষ তার হীনতা, তার দুর্বলতা, তার ভয়, দ্বিধা, সংশয় কাটিয়ে মানুষের মতো উঠে দাঁড়াচ্ছে। এদেশের যে কোনও ঘটনার মধ্যেই আমি এই মানুষকে খুঁজি, মানুষের এই সংগ্রামকেই ধরতে চাই।’
‘মনোজ’ লিখছি, কারণ বন্ধুর প্রথম নামটাই অন্তরঙ্গতার স্মারক হয়ে থাকে। মনোজ মিত্র (২২ ডিসেম্বর, ১৯৩৮-১২ নভেম্বর, ২০২৪), বাঙালি ও ভারতীয় নাট্যদর্শকের কাছে এক বহুদর্শী, বিচিত্রকর্মা কীর্তিমান নাট্যকার, অভিনেতা, নাট্যনির্দেশক বটেই, কিন্তু আমার কাছে প্রায় ৫০ বছরের ব্যক্তিগত বন্ধু, সাত বছরের সহকর্মী। কাজেই এ লেখায় তাঁর ‘পাবলিক’ কাজগুলির সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিগত কথাও জায়গা করে নিতে চাইবে, পাঠকদের কাছে সেই বিনীত সতর্কীকরণ জারি রইল।
আমার সঙ্গে যখন মনোজের প্রথম আলাপ হয়, সহপাঠী হিসেবে, সে সেই ১৯৫৬ সালে, স্কটিশ চার্চ কলেজে। তাঁর দর্শনে অনার্স, আমার ইকনমিক্সে। আর এক নাট্যযোদ্ধা রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত ইংরেজিতে। কেয়া চক্রবর্তী ওই বছরই ভর্তি হবে ফার্স্ট ইয়ারে, ইংরেজিতেই। যতদূর মনে হয়, পরের বছরই মনোজ প্রয়াত চিত্রপরিচালক পার্থপ্রতিম চৌধুরীর (ওই কলেজের বাংলা অনার্স) সঙ্গে মিলে প্রথমে ‘ঋতায়ন’ ও পরে ‘সুন্দরম্’ নাট্যসংস্থা গঠন করে। ১৯৫৯ নাগাদ মনোজের ‘মৃত্যুর চোখে জল’ মিনার্ভাতে তার দল অভিনয় করে। আমি স্কটিশ ছেড়ে অন্য কলেজে চলে যাওয়ার পরে দীর্ঘদিন আর ব্যক্তিগত যোগাযোগ থাকে না। মনোজ দর্শনে এমএ করে পরে রানিগঞ্জের একটি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন, এবং তার পরে তাঁর সৃষ্টিক্ষেত্র নাটকের অধ্যাপনাই তাঁর জীবিকা হয়ে ওঠে, যখন তিনি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই বিষয়ে পড়ানোর ডাক পান। বাকি অধ্যাপনা জীবন ওখানেই কাটে, আর ওখানে আমি আবার তাঁকে পাই সাত বছর, ১৯৯০ থেকে ১৯৯৭– সহকর্মী হিসেবে। পুরোনো বন্ধুত্ব প্রগাঢ় হয়, কারণ মানুষটি ছিলেন বন্ধুস্বভাবের। আন্তরিক, নিষ্ঠাবান, অসূয়াহীন। বাড়িতে যাতায়াত চলতে থাকে। মনোজের বাড়িতে অল্পসময়ের জন্য গেলেও অবধারিতভাবে লুচি-তরকারির প্লেট সামনে এসে যেত, ভূরিভোজ অনিয়মিত ছিল না, আর আমার বাড়িতে নেমন্তন্নে এলে তিনি ল্যাজ আর মাথা প্লেট ছাপিয়ে যায় এইরকম পাবদা মাছের বায়না দিয়ে রাখতেন। তাঁর কন্যা আমার কাছে যাদবপুরে ডক্টরেট করেছে।
বাংলা আধুনিক গানের মতো কলকাতার বাংলা গ্রুপ থিয়েটারের ‘সুবর্ণ যুগ’ বলে যদি কিছু থাকে, সেটা হবে ১৯৫৪ (‘রক্তকরবী’) থেকে ১৯৮৬-৭ পর্যন্ত কমবেশি ৩০ বছর সময়, যে সময়ে পশ্চিম বাংলায় আমরা চারজন বিখ্যাত বাঙালি নাট্যকারকে পাই– উৎপল দত্ত (১৯২৯-১৯৯৩), বাদল সরকার (১৯২৪-২০১১) গ্রুপ থিয়েটারে বেশিদিন থাকেননি), মনোজ মিত্র আর মোহিত চট্টোপাধ্যায় (১৯৩৪-২০১২)। মোহিত মূলত নাট্যকার, কিন্তু বাকি তিনজন নাট্যকার, নাট্যনির্মাতা এবং অভিনেতা, সেই সঙ্গের নাট্যদলের প্রধান।
তবু মনোজের প্রথম যে নাটক বাঙালির কাছে তাঁর শক্তিশালী নাট্যকারের পরিচয় তুলে ধরে তা অন্য দলের করা, থিয়েটার ওয়ার্কশপের ‘চাক ভাঙা মধু’, বিভাস চক্রবর্তীর পরিচালনায়, মঞ্চে আসে ১৯৭২ সালে। ওই নাটক থেকেই বোঝা যায় বাংলায় এক নতুন অসম্ভব ক্ষমতাবান নাট্যকারের আগমন ঘটেছে। বহুরূপীতে কুমার রায়ের নির্দেশনায় তাঁর দু’টি নাটক, ‘রাজদর্শন’ আর ‘কিনু কাহারের থ্যাটার’ অত্যন্ত সফল প্রযোজনা। আর ক্রমে তাঁর নিজের দলের নাটকগুলিও আখ্যান ও রসের বৈচিত্র, অভিনয়ের, বিশেষত তাঁর নিজের অভিনয়ের আকর্ষণে, ক্রমশ দর্শকদের প্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, গ্রামীণ চাষি (মনোজ দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাষা চমৎকার ব্যবহার করতেন এসব নাটকে), পৌরাণিক আখ্যানের কাব্যিক রূপ, ফ্যান্টাসি, যাতে পশুচরিত্রও আছে, বর্ণাঢ্য ঐতিহাসিক, কষ্টের নাটক, তুমুল হাসির নাটক, কাব্যময় উপলব্ধির নাটক– কোন্ দিকে হাত বাড়াননি মনোজ ? এবং সমস্তদিকেই তিনি অভ্যর্থনাযোগ্য সাফল্য পেয়েছেন। তাঁর ‘সাজানো বাগান’, যা থেকে তপন সিংহ ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ নামে অসামান্য জনপ্রিয় চলচ্চিত্র করেছিলেন, তা মনোজকে চলচ্চিত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চরিত্রাভিনেতা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, এবং সত্যজিৎ রায়, হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, বাসু ভট্টাচার্য প্রভৃতি বহু পরিচালক তাঁকে সাদরে তাঁদের ছবিতে অভিনয় করতে আহ্বান করেন। থিয়েটার ও সিনেমায় তিনি সমান সমাদৃত অভিনেতা হয়ে ওঠেন। আমার মনে হয়, হিন্দিতে অভিনয় করতে পারলে মনোজ ভারতের এক শ্রেষ্ঠ চরিত্রাভিনেতা হিসেবে সম্মান পেতেন। তাঁর একটা বৈশিষ্ট্য ছিল যে, যাকে ‘সোজা’ বা স্ট্রেইট রোল বলা হয়, তাতে তিনি যেমন নিজেকে সংযত রেখে চরিত্রটিকে অনায়াসে ফুটিয়ে তুলতেন, তেমনই ‘টাইপ’ চরিত্রে নানা উৎকেন্দ্রিকতাও তাঁর অভিনয়ে চমৎকার চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠত। দু’-ধরনের ভূমিকায় এত সহজ যাতায়াত সকলের পক্ষে সম্ভব হয় না।
এখানে আমি আমার আগের একটি লেখা থেকে তাঁর বিষয়ে কয়েকটি ছত্র তুলে দিই– “…নাটকের বিষয় ও বৈচিত্র। নিশ্চিতভাবেই সমসাময়িক সকল নাট্যকারের চেয়ে বেশি। তেমনই বৈচিত্র তাঁর বিভিন্ন নাটকে আভাসিত ‘মুডের’। কখনও তিনি হাসির আড়ালে, বা নিছক বেদনাবদ্ধ (‘মৃত্যুর চোখে জল’ ১৯৫৯, ‘নীলকণ্ঠের বিষ’, ১৯৬১), কখনও ক্রুদ্ধ– (‘চাকভাঙা মধু’, ১৯৬৯, ‘নৈশভোজ’, ১৯৮৫), কখনও কাব্যময় ও জিজ্ঞাসাসংকুল (‘তক্ষক’, ১৯৬২, ‘অশ্বত্থামা’, ১৮৬৩), কখনও রহস্যে-রোমাঞ্চে সমর্পিত (‘ব্ল্যাকপ্রিন্স’, ১৯৬৪, ‘অবসন্ন প্রজাপতি’ , ১৯৬৪, ‘বেকার বিদ্যালংকার’, ১৮৬৪ , ‘আরক্ত গোলাপ’, ১৯৬৫, ‘পাহড়ি বিছে’, ১৯৭৬-৭৭)।” এই তালিকা থেকে মনোজের নাট্যসৃষ্টির ক্লান্তিহীন ধারাবাহিকতা যেমন বোঝা যায়, তেমনই পরিচ্ছন্ন পর্যায়ভাগ করা না গেলেও তাঁর নিজের শিল্প ও জীবন সম্বন্ধে তাঁর নানামুখী জিজ্ঞাসা ও কৌতূহল আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়।
নাটকের বহুমাত্রিক, নানা উপভাষার সংলাপে মনোজের মতো সিদ্ধহস্ত নাট্যকার খুব বেশি ছিলেন না। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত গদ্যও ছিল স্বাদু ও চমৎকার, পাঠককে তা নিবিষ্ট করে রাখত। তাঁর ‘অলীক কুনাট্যরঙ্গে’ এবং আত্মজীবনীমূলক ‘মনোজাগতিক’ বই দু’টি পড়লে বোঝা যায়, তাঁর গদ্যেও তিনি সরস ইন্দ্রজাল তৈরি করতে পারতেন।
……………………………………………..
মনোজ মিত্র-কে নিয়ে লিখছেন দেবশঙ্কর হালদার: অভিনেতাকে সব কিছু মনে রাখতে হয়, আমাকে বলেছিলেন মনোজ মিত্র
……………………………………………..
কিন্তু নিছক বিনোদনমুখী নাট্যসৃষ্টিতে তিনি বেশি দিন থাকেননি। ক্রমেই তাঁর নাটকে সমাজমুখী বক্তব্য প্রাধান্য পেতে থাকে, এবং তাঁর সমস্ত প্রধান নাটক– ‘সাজানো বাগান’, ‘নৈশভোজ’, ‘অলকানন্দার পুত্রকন্যা’, ‘রাজদর্শন’, ‘কিনু কাহারের থ্যাটার’, ‘পরবাস’, এমনকী, ‘কেনারাম বেচারাম’ পর্যন্ত, একদিকে বঞ্চিত মানুষের বঞ্চনাকে, অন্যদিকে মধ্যবিত্তের ব্যক্তিসম্পর্কের নানা জটিলতাকে তুলে ধরতে থাকে। তাঁর বয়ানও বিচিত্র– ব্যঙ্গ, কৌতুক, বিষাদ, ক্রোধ সব কিছুকেই তিনি অস্ত্র হিসেবে অনায়াসে চালনা করেন। তিনি প্রকাশ্যভাবে কখনও গণনাট্যের অন্তর্ভুক্ত হননি, কিন্তু তাঁর বেশ কিছু নাটকে গণনাট্যের আদর্শই প্রকট হয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু কোথাও কোনও উচ্চকিত প্রচার বা পরামর্শ নেই, স্লোগান তিনি সযত্নে এড়িয়ে যান। ১৯৮৫ সালে সোনারপুর কৃষ্টি সংসদের ‘কৃষ্টি’ পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকার তিনি বলেন, ‘আমি এই মুহূর্তে একটি বিষয়কেই অধিকার দিয়ে লিখতে চাই, সেটা হলো, দীন মানুষ, অবহেলিত এবং পর্যুদস্ত মানুষ তার হীনতা, তার দুর্বলতা, তার ভয়, দ্বিধা, সংশয় কাটিয়ে মানুষের মতো উঠে দাঁড়াচ্ছে। এদেশের যে কোনও ঘটনার মধ্যেই আমি এই মানুষকে খুঁজি, মানুষের এই সংগ্রামকেই ধরতে চাই।’ কিন্তু তিনি ‘বক্তব্যকৈবল্যবাদী’ হতে চান না, তাঁর নাটকে বিনোদনের মধ্য দিয়ে বক্তব্যকে পরিবেশন করার একটা শিল্প তৈরি হয়, কারণ তিনি জানেন, যাদের নিয়ে নাটক, আর যারা এই নাটকের দর্শক, তারা এক শ্রেণির বা এক গোষ্ঠীর লোক নয়।
………………………………………….
মনোজ মিত্র-কে নিয়ে লিখছেন অশোক মুখোপাধ্যায়: কল্পনা আর বাস্তবের অবিশ্বাস্য বন্ধুত্বই আসলে মনোজ মিত্র
………………………………………….
এখন সবই তো অলীক। মানুষটি শেষদিকে সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলেন না, তাঁর স্মৃতি কিছুটা স্ববশে ছিল না। অক্টোবরে একবার নার্সিংহোমে যেতে হয়েছিল, ফিরে এসে আর চলৎশক্তি ফিরে পাননি। ঘরে শয্যাগতা প্রায় নিশ্চেতন সহধর্মিণী হয়তো তাঁকে খুঁজবেন, একমাত্র কন্যাসন্তান তাঁর নাটকের উত্তরাধিকার বহন করবে। আমরা বন্ধু ও এককালের সহকর্মীরা তাঁর মধুর সাহচর্যের স্মৃতি বহন করব। আমার মনে আছে তাঁর সঙ্গে কলকাতা আকাশবাণীতে রবীন্দ্রনাথের ‘রোগীর বন্ধু’ অভিনয় করার কথা, মঞ্চে ‘সিরাজদ্দৌলা’ অভিনয়ের আনন্দময় অভিজ্ঞতা। রবীন্দ্র ভারতীতে সাত বছর নানা সহযোগিতা আর উদ্যোগের কথা।
তবে মনোজ মিত্রের শতাধিক পূর্ণাঙ্গ ও একাঙ্ক নাটক তাঁকে দীর্ঘদিন বাঙালি, হয়তো দক্ষিণ এশীয়, নাট্যকর্মীদের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখবে। এখন ‘দেহপট সনে নট সকলি হারায়’-এর সময় পার হয়ে গেছে। বহু চলচ্চিত্রে তাঁর বিচিত্র শৈলীর সমর্থ অভিনয়ও ধরা রইল। উত্তরসূরিদের কাছে হারিয়ে যাওয়ার মতো নাম মনোজ মিত্র নয়।
…………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………………