‘ভয় পাস নে ছেলে’ বা ‘ডিঙ্গা ভাসাও সাগরে’র শিল্পীকে শুধুমাত্র ‘আমি বাংলায় গান গাই’-এ সীমাবদ্ধ করাটা যেমন অসমীচীন তেমনই উগ্র বাঙালিয়ানার চোখ দিয়ে ‘আমি বাংলায় গান গাই’কে দেখাটাও ভুল। এই গানে গঙ্গা পদ্মায় সাত নদী তেরো সমুদ্রকে খুঁজে পাওয়া যেমন আছে, তেমনই আছে বাংলাকে ভালোবেসে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে আসার কথাও।
প্রতুলদা চলে গেলেন। এই সময়ে বারবার মনে হচ্ছে একজন গেরিলা যোদ্ধা চলে গেলেন। অসংখ্য যন্ত্রের বৃন্দবাদনের জাঁকজমকে ভরা গানের প্রতিবেশে একটি মাত্র মাইক্রোফোনের সামনে যন্ত্রানুষঙ্গ রহিত একজন ছোটখাটো চেহারার একলা মানুষের সিংহ বিক্রম দাপটের অনুষ্ঠান দেখলে তো ভিয়েতনামের গেরিলা যোদ্ধাদের কথাই মনে পড়ত। নানাবিধ ‘নেই’কে একটিমাত্র ‘আছে’র জোরে নস্যাৎ করে দেওয়া এটাকে শুধুমাত্র পারফরমেন্সের মুনশিয়ানা বলে না। এটা একটা রাজনৈতিক যুদ্ধ, মতাদর্শের দীক্ষা ছাড়া যা লড়া যায় না। ভিয়েতনামের মানুষকে একটা অসম যুদ্ধ লড়তে হয়েছিল। বিশ্বের প্রবল পরাক্রমশালী রাষ্ট্র যার হাতে সব ধরনের অস্ত্র ও অফুরান অর্থের ভাণ্ডার আছে। অন্যদিকে সহায় সম্বলহীন ভিয়েতনামের জনগণ। অথচ যুদ্ধটা না লড়ে উপায় নেই। লড়তেই হবে। কী ছিল অস্ত্র তাঁদের?
রবীন্দ্রনাথের ভাষা ধার নিয়ে বলতে হয়, ‘কম কিছু মোর আছে হেথা পুরিয়ে নেবো প্রাণ দিয়ে তা’। যা কিছু কম পড়ছে সেটা প্রাণ দিয়ে পুষিয়ে নেওয়া। পুরিয়ে নেওয়া। ভিয়েতনামের গেরিলা যোদ্ধা আর প্রতুলদার মধ্যে মিল এখানেই। প্রাণশক্তি। যে রাজনীতির আঁচে প্রতুলদা নিজের গানকে সেঁকেছেন বা ভিয়েতনামের গেরিলা যোদ্ধারা নিজেদের চেতনাকে বহ্নিমান রেখেছেন সেই মতাদর্শে প্রাণশক্তিকে অন্য মূল অস্ত্রশক্তির পাশে বাড়তি উপাদান ভাবা হয়ে থাকে। কিন্তু সেটা যে কখনও মূলশক্তি হয়ে যেতেও পারে, এটা অজানিত ছিল। তাঁরা ভাবতেন বস্তুগত শক্তি একটা নির্দিষ্ট স্তরের না হলে শুধু আকাঙ্ক্ষা দিয়ে স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করা যায় না। কিন্তু আকাঙ্ক্ষা আর স্বপ্নের জোরও যে কখনও বস্তুগত শক্তির চেহারা নেয়, সেটা অভাবিত ছিল। কিন্তু কারও কারও তো নিশ্চয়ই এই বিষয়ে প্রত্যয় ছিল যে, এটা সম্ভব যার জন্য তাঁরা অসম্ভবকে সম্ভব করার স্বপ্ন দেখতে পারতেন। আজকাল ব্যবস্থাপনা বিদ্যায় একটা কথা বলা হয় যে, প্রতিকূলতা নতুন সম্ভাবনারও ধাত্রী। ভিয়েতনামের মুক্তিসংগ্রামে গেরিলা বাহিনী যে পাহাড় প্রমাণ প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছিল সেই প্রতিকূলতা থেকেই উদ্ভাবিত হয়েছে অভাবনীয় সমস্ত রণকৌশল, যা সমর বিজ্ঞানের জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধতর করেছিল। প্রতুলদা অন্তিম জীবনে রাজনীতির লড়াইয়ে ছিলেন না নিঃসন্দেহে। রাজনীতিগত যা সংস্রব ছিল তা তাঁর গানের রাজনীতির বিরুদ্ধ মেরুর রাজনীতি। কিন্তু আমৃত্যু যে গান গেয়েছেন, তার ভাষা বা প্রকরণটি জন্ম নিয়েছে রাজনৈতিক সংগ্রামের গর্ভে। যে রাজনীতির বার্তাবহন করতে প্রতুলদা গান গাইতে এসেছিলেন সে রাজনীতি মূলধারার রাজনীতি নয়। সরকার, রাষ্ট্র, বাজার, পুঁজি কারওই সহায়তা পাওয়ার প্রশ্ন নেই। কারণ সেটা তাদেরই বিরুদ্ধ পক্ষ। আবার বামপন্থার মধ্যেও যে ধারাটির অনুসারী হয়ে গানের লড়াইয়ে এসেছিলেন প্রতুলদা তাদেরও বস্তুগত সামর্থ্য ছিল খুবই অপ্রতুল।
এই সুবিপুল প্রতিকূলতা প্রতুলদার গানে সম্ভাবনার এক অজানিত সম্ভাবনার দরজা খুলে। ব্যবস্থাপনা বিদ্যার সূত্রের পথ ধরেই প্রতিবন্ধকতাকে শক্তিতে পরিবর্তিত করে নিলেন প্রতুলদা। উপকরণ থেকে সংগতি অবধি যাবতীয় না-থাকাকেই তাঁর থাকা বা পুঁজি করে নিলেন তিনি। এই না-থাকাই তৈরি করল প্রতুলদার গানের অনন্য ভাষা, যে গান-ভাষার প্রধান উপকরণ প্রাণশক্তি। এই অফুরান প্রাণশক্তির আধারে তৈরি গানে রাজনীতির ময়দানকে প্রাণিত করেছেন প্রতুলদা। তাঁর এক অনুজ সতীর্থ বলেছেন, তাঁর গান মুখে নিয়ে আমরা লড়েছি। কারাবন্দি আমাদের বন্ধুরা কারান্তরালে বসে তাঁর গান গেয়েছেন। নকশাল আন্দোলনের পথ ও মত নিয়ে সেই আন্দোলনের ভিতরের মানুষেরাই পরবর্তীতে আত্মসমালোচনা করেছেন। একটি ছোট্ট অংশ ব্যতিরেকে অধিকাংশই এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, সশস্ত্র সংগ্রামের ডাকটি ভুল ছিল। নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তটিও ঠিক ছিল না। কিন্তু নকশাল আন্দোলন বামপন্থী সংস্কৃতি আন্দোলনে একটা বাঁক এনেছিল ভাষায় ও প্রকরণে। অগ্নিগর্ভ ওই সময়ের গর্ভ থেকেই বাদল সরকারের এক বিকল্প নাট্যভাষার নির্মাণ। প্রতিবাদী গানের ধারাতেও নানা নতুন বৈশিষ্ট্য যোগ করেছিল। প্রতুলদার গানের ভাষা সেই ধারাগুলিরই অন্যতম। নয়ের দশকে বাংলা গানে নতুন জোয়ারের সময়ে গানের মূলধারায় চলে আসে প্রতুলদার গানও। দেখা গেল তাঁর নিরাভরণ গানের ভাষা মূলধারাতেও প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেল।
‘আমি বাংলায় গান গাই’-এর সূত্রে একটি বিশেষ রাজনৈতিক ধারার গণশিল্পী থেকে প্রতুলদা রূপান্তরিত হয়ে যান দু’পারের আপামর বাঙালির শিল্পীতে। একুশ ফেব্রুয়ারি, নববর্ষ বা উনিশে মে’র অনুষ্ঠান ‘আমি বাংলায় গান গাই’ ছাড়া অসম্পূর্ণ হয়ে যায়। ‘ভয় পাস নে ছেলে’ বা ‘ডিঙ্গা ভাসাও সাগরে’র শিল্পীকে শুধুমাত্র ‘আমি বাংলায় গান গাই’-এ সীমাবদ্ধ করাটা যেমন অসমীচীন তেমনই উগ্র বাঙালিয়ানার চোখ দিয়ে ‘আমি বাংলায় গান গাই’কে দেখাটাও ভুল। এই গানে গঙ্গা পদ্মায় সাত নদী তেরো সমুদ্রকে খুঁজে পাওয়া যেমন আছে, তেমনই আছে বাংলাকে ভালোবেসে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে আসার কথাও। এই মাতৃভাষা ও সংস্কৃতিপ্রেম কূপমণ্ডুকের বাঙালিয়ানা নয়।
প্রতুলদার প্রথম জীবনের রাজনীতির ধারার বামপন্থী থেকে বামফ্রন্টের ধারার বামপন্থীদের প্রতুলদার জীবনের শেষ পর্বের রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে। বামফ্রন্টের ধারার বামপন্থার সঙ্গে প্রতুলদার কখনওই সখ্য ছিল না। তিনি বরাবরই ছিলেন সিপিএম-এর রাজনীতির বিরোধী। ফলে সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম পর্বে তাঁর ভূমিকা প্রত্যাশিতই ছিল। প্রশ্ন উঠল বেশি করে ২০১১ উত্তর ভূমিকা নিয়ে। আসলে বিষয়টা নকশাল, সিপিএম, তৃণমূলেরও নয়। বিষয়টা প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা থেকে সরে আসার। প্রতুলদার নকশাল রাজনীতি, সিপিএম বিরোধিতা নিয়ে কারও সমালোচনা থাকতে পারে। এটা একটা স্বাভাবিক মতাদর্শগত মতপার্থক্য। কিন্তু ২০১১ সালের পর থেকে জীবনের শেষদিন অবধি তাঁর যে রাজনৈতিক অবস্থান সেটাকে কোনও যুক্তিতেই ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা’ বলার সুযোগ নেই। রাজ্য একের পর এক ঘটনায় তোলপাড় হয়ে গেছে, অথচ প্রতুলদার গান কথা বলে উঠছে না দ্রোহে। এটা প্রতুলদার গানের সঙ্গে যায় না।
প্রতুলদার রাজনৈতিক অনুরাগী এক অনুজ সামাজিক গণমাধ্যমে দুঃখ করে বলেছেন প্রতুলদার মরদেহকে আগলে রেখেছে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের লোকেরা। তিনি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে পারেননি। কেউ কেউ ক্ষোভে বলেছেন, শ্রদ্ধা জানাচ্ছি, লাল সালাম দিতে অপারগ।
মৃত্যুর পর এমন প্রতিক্রিয়া কাম্য নয়। মৃত্যু মানুষের শেষ জীবন নয়, গোটা জীবনকে সামনে নিয়ে আসে। দ্বিতীয়ত, আজকের শাসকরা তাঁর ‘আমি বাংলায় গান গাই’ ছাড়া অন্য কোনও গানের মুখোমুখি হতে চায় না। এমনকী, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে তাদের আন্দোলনের সঙ্গী হয়ে যে-গানগুলি তিনি তৈরি করেছেন, সেগুলোরও মুখোমুখি হতে চায় না তারা। ফলেই প্রতুলদাকে তারা বন্দি করতে চায় ‘আমি বাংলায় গান গাই’ দিয়ে। প্রতুলদা ও তাঁর গানকে যখন গোটা জীবনের নিরিখে ফেলব তখন বড় হয়ে প্রতিভাত হবে তাঁর প্রতিষ্ঠান বিরোধী মুখচ্ছবি ও গানই। এই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার লড়াইয়ে তিনি ছিলেন মরিয়া গেরিলাযোদ্ধার মতো। এই গেরিলাযোদ্ধার সহযাত্রী হয়েই ‘আমাদের যেতে হবে দূরে বহুদূরে’।