গান যে একটা ‘পারফরম্যান্স’, সেটা নাগরিকদের মধ্যে উনিই প্রথম সিরিয়াসলি দেখালেন। আমরা পারফরম্যান্স দেখেছি বাউলদের মধ্যে বা ওড়িষ্যার রঘুনাথ পানিগ্রাহী ও তাঁর বাবা নীলমণি পানিগ্রাহীর মধ্যে। দেখেছি কীর্তনীয়াদের মধ্যেও– যেমন পার্বতী বাউল। বাউল বা কীর্তনীয়ারা বাউলাঙ্গের বা কীর্তনাঙ্গেরই গান করেন। খোল, হারমোনিয়াম, বাঁশি আরও নানা যন্ত্রানুষঙ্গে। প্রতুল মুখোপাধ্যায় নিজের গানে নির্মাণ করছেন পারফরম্যান্সে।
প্রচ্ছদ শিল্পী: দীপঙ্কর ভৌমিক
কিছুক্ষণ আগেই খবর পেয়েছি, চলে গিয়েছেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়। অবশ্য, এ খবর শোনার একরকম প্রস্তুতি ছিলই। কিন্তু তা সত্ত্বেও, মন মানে না। আমার চেয়ে খুব যে বড় তিনি, তা নয়। আর যে দেখা হবে না, হাসাহাসি হবে না একসঙ্গে, একথা ভেবে বিষণ্ণ লাগছে বইকি।
আমি যদি এ জীবনে একজনও প্রকৃত নিরীক্ষামনস্ক নাগরিক মধ্যবিত্ত বাংলাভাষী সংগীতকার দেখে থাকি– তিনি প্রতুল মুখোপাধ্যায়। ওঁর চেয়ে নিরীক্ষামনস্ক কেউ কোনও দিনই আসেননি। ওঁর ধারে-কাছে আমি তো নেই, কেউ-ই নেই। কিন্তু আমরা ‘গান’ বলতে এখনও ওই হেমন্ত-মান্না-সন্ধ্যা-লতা– এইরকমটাই বুঝি। বড় বড় কথা বলি গান নিয়ে, কিন্তু এটুকুর বাইরের বাংলা গান নিয়ে আমাদের বোঝাপড়া তৈরি হয়নি। সংগীতশিক্ষা নেই, আলোচনা নেই, সংগীত-সাহিত্য নেই। ফলে কীভাবে সংগীত নিয়ে কথা বলা দরকার, চর্চার দরকার, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সেটা নেই। ফলে প্রতুল মুখোপাধ্যায়কে আমরা কতদূর বুঝতে পারব, সে নিয়ে সন্দেহ আছে।
প্রাথমিকভাবে আমাদের শোনা দরকার প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গান। অভিনিবেশ সহকারে শোনা। এবং ওই গান-পৃথিবীতে সবাই ঢুকতে পারবে না, কারণ প্রবেশযোগ্যতা লাগবে। প্রতুল মুখোপাধ্যায় যদিও জীবনের শেষ পর্যায়ে ‘আমি বাংলায় গান গাই’ গানটি রচনা ক’রে, পরিবেশন ক’রে, খুবই জনপ্রিয় হয়েছিলেন। কিন্তু আমার মনে হয় না, ওটা ওঁর ‘আসল’ গান-পরিচয়। গুরুত্বপূর্ণ এই গান– বাঙালিদের ভালো লাগবে, অবাঙালিদেরও খারাপ লাগার কথা না। কিন্তু ওঁর প্রধান কাজ যা গান হতে পারে না, এরকম কথায় সুর দেওয়া। সা-রে-গা-মা-পা-ধা-নি-সা– সুর, এইরকম না। উনি ধরতেন ‘টোন’। ধরা যাক, ‘একটি ছেলে বল খেলিতেছে।’ একটা কবিতা পঙক্তি এটা। সম্ভবত মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিদেশি এক কবিতার অনুবাদ। প্রতুল মুখোপাধ্যায়, একই সুরে, একই টোনে এই ‘একটি ছেলে বল খেলিতেছে’-কে নানারকম ভাবে পড়তে থাকলেন। সে এক আশ্চর্য মুগ্ধকর ব্যাপার! গায়কীর এ এক যুগান্তকারী দিক উন্মোচন। ওঁর সঙ্গে তুলনা হতে পারে, একমাত্র হিন্দুস্থানী রাগ সংগীতের সংগীতাচার্য কুমার গন্ধর্ব-র। তিনিও কিচ্ছু মানতেন না। প্রতুল মুখোপাধ্যায়ও তথাকথিত শিক্ষা-দীক্ষার ধার ধারতেন না, কিন্তু আসল শিক্ষাটা ওঁর চিন্তা থেকেই তৈরি হচ্ছে। যদি প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের সুরে, কবিতার ওই পঙক্তিটির নানারকম ভাবে ফিরে ফিরে আসা কেউ শোনেন এবং সেই শ্রোতা যদি সংবেদনশীল হন– আমি নিশ্চিত তিনি অসুবিধেয় পড়বেন। গল্পটা তো এই– একটি ছেলে বল খেলছে, খেলছে, খেলছে এবং ওই ছেলেটিকেই মাটিতে কবর দেওয়া হল। আমরা দেখছি সেই দৃশ্য। আমরা কী দেখছি, কোথায় আছি– এই প্রশ্নটা গানের মধ্য দিয়ে সঞ্চারিত হচ্ছে। হারমোনিয়াম-বাঁশি-বেহালা-পিয়ানো বাজিয়ে গান নয়, এ এক অন্য জাতের প্রতুলসংগীত।
প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে এক-দু’টি অনুষ্ঠানে আমি কি-বোর্ডস বাজিয়েছিলাম। আমাকে অনুরোধ করেছিলেন, আমি রেখেছিলাম সেই অনুরোধ। সে অনেক আগের কথা। আমার এক বন্ধু ওঁর গানের সঙ্গে হারমোনিয়ামও বাজাতেন এককালে। কিন্তু আমরা বুঝেছিলাম, এই পথটা ওঁর নয়, উনি খালি গলাতেই গাইবেন।
অরুণ মিত্রর লেখা কবিতা ‘নিসর্গের বুকে’র কথা মনে করুন। ‘আমি এত বয়সে গাছকে বলছি/ তোমরা ভাঙা ডালে সূর্য বসাও।’ এটা কিন্তু তিনি গান করে তুললেন। এ এক বিরাট ইতিহাস! গান যে একটা ‘পারফরম্যান্স’, সেটা নাগরিকদের মধ্যে উনিই প্রথম সিরিয়াসলি দেখালেন। আমরা পারফরম্যান্স দেখেছি বাউলদের মধ্যে বা ওড়িশার রঘুনাথ পানিগ্রাহী ও তাঁর বাবা নীলমণি পানিগ্রাহীর মধ্যে। দেখেছি কীর্তনীয়াদের মধ্যেও– যেমন পার্বতী বাউল। বাউল বা কীর্তনীয়ারা বাউলাঙ্গের বা কীর্তনাঙ্গেরই গান করেন। খোল, হারমোনিয়াম, বাঁশি আরও নানা যন্ত্রানুষঙ্গে। প্রতুল মুখোপাধ্যায় নিজের গানে নির্মাণ করছেন পারফরম্যান্সে। অরুণ মিত্রর কবিতা, ‘ভাঙা ডালে সূর্য বসাও’ বা ‘নদীকে বলছি তোমার মরা খাতে পরী নাচাও’– এর পর একটা ‘হাঃ হাঃ’ হাসি ছিল কবিতায়। পারফরম্যান্সে প্রতুল মুখোপাধ্যায় অদ্ভুত এক হাসি হাসতেন, প্রায় ভৌতিক একটা হাসি! পুরো জিনিসটাকেই একেবারে অন্য স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন।
অন্তত তিন-সাড়ে তিন হাজার আধুনিক বাংলা গান রচনা করেছি। সুর লিখেছি-গেয়েছি। দেড় হাজার বাংলা খেয়াল গান বা বন্দিশ বিভিন্ন রাগে, বিভিন্ন তালে আমি রচনা করেছি। কিন্তু প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের নিরীক্ষামনস্কতার ধারে কাছেও আমি নেই। ওঁর ‘স্লোগান দিতে গিয়ে’ অবিস্মরণীয় গান। কিন্তু আমরা হয়তো শুনব না। প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গলা, যাকে আমরা ‘গানের গলা’ বলি, সেরকম ছিল না। ফলে ওঁর গান শুনে রেকর্ডিংয়ে বা ফাংশনে লোকে যে মোহিত হতে পারে, দুলে উঠতে পারে, তা নয়– যেমনটা গিরীন চক্রবর্তী শুনলে লোকের হত। বা কলিম শরাফি বা দেবব্রত বিশ্বাস শুনলে। আমি আসলে কণ্ঠের ধ্বনিবৈশিষ্টের কথা বলছি। প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে কিন্তু সেই আলোড়ন-তোলা ধ্বনিবৈশিষ্ট ছিল না। কিন্তু তাতে কিছু আসে-যায় না। কণ্ঠ দিয়ে যে মানুষ গান গায় না, পৃথিবী দখল করে না, তার সবথেকে প্রমাণ শচীন দেব বর্মন। চেরা বাঁশের মতো গলা ছিল তাঁর। কিন্তু ওর’ম ‘অ্যাপিল’ পৃথিবীতে আর কার আছে! অনেকে আছেন, বিখ্যাতদের কণ্ঠ নকল করে গান করেন, বেশ করেন, কিন্তু দেখবেন সেই কণ্ঠীশিল্পীরা কখনও শচীন দেব বর্মনকে অনুসরণ করেননি। একজন এরকম কণ্ঠীশিল্পীকে অবশ্য চিনি, যিনি শচীন দেব বর্মনকে নকল করতে গিয়ে ভারি বিপদে পড়েছিলেন। তেমনই প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গান ‘রিমেক’ করা যাবে না।
আমি একাধিক সময় ওঁকে বলেছি, ‘তুমি একটু শেখাও না!’ প্রতুলদা বলেছেন, ‘ধোওত! এটা শিখবে নাকি, এটা শেখানো যাবে না। তোমার গান কেউ শিখবে? শিখতে পারবে কোনও দিন? বাপের জম্মে শুনেছে কবীর সুমন কী করেছে? শোনেনি। তোমার কাছে যাবে। ক্লাস করবে। পয়সা দেবে। তোমারও দরকার পয়সা। তুমিও নেবে, কিন্তু একজনকেও তৈরি করতে পারবে না। আমিও পারব না।’
ওঁর একটা গান ছিল ‘ছোকরা চাঁদ’। কী অপূর্ব গায়ে কাঁটা দেওয়া গান। ও ছোকরা চাঁদ, ও জোয়ান চাঁদ। ভাবা যায় না! এ গান যদি ছয়-সাত-আটের দশকের হিন্দি সিনেমায় ব্যবহার হত এবং কিশোর কুমার গাইতেন, তাহলে নিঃসন্দেহে ‘ন্যাশনাল হিট’ হয়ে থাকত চিরকালের জন্য। ‘বাবরের প্রার্থনা’ও কী ব্রিলিয়ান্ট গেয়েছিলেন! প্রতুল মুখোপাধ্যায়, আমার মতে, আমারই মতো কমিউনিস্ট ছিলেন। ওয়ানস আ কমিউনিস্ট, অলওয়েজ আ কমিউনিস্ট। প্রতুল মুখোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মঞ্চে আমার চেয়ে অনেক বেশিবার গান গেয়েছেন, কিন্তু তার মানে এই নয়, তিনি বিশেষ রাজনৈতিক দলটিরই সমর্থক। যদি কেউ বলে, কেন গাইতেন? বলব, বেশ করতেন। সুযোগ দিত, তাই গাইতেন। কে সুযোগ দেয়? আমিও তো একুশে জুলাইয়ের মঞ্চে গান গেয়েছি, গাইতে পারি, তাই গেয়েছি লাখ লাখ লোকের সামনে। প্রতুলদাও কিন্তু দেড়-দু’লাখ লোকের সামনে, মঞ্চে দাঁড়িয়ে গান গেয়েছিলেন, বুকের পাটা না থাকলে এভাবে গান গাওয়া যায় না। যন্ত্র নেই, কিচ্ছু নেই, খর্বকায় রোগাপটকা লোক–গান গাইলেন।
একটা জীবন চলে গেল। গান দিয়ে ম্যাজিক করে, দিব্যি চলে গেলেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়।
……………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………