শ্যাম বেনেগালের উত্থান আসলে ‘মিডল সিনেমা’ থেকে। প্রথমাবস্থায় যুক্ত হয়েছিলেন বিজ্ঞাপন-ইন্ডাস্ট্রিতে। তাঁর তৈরি বিজ্ঞাপনের সংখ্যা প্রায় ৯০০। তারপরই চলচ্চিত্রের নেশা লাগে। ১৯৬২। সিনেমা-জগতে আত্মপ্রকাশ করলেন শ্যাম বেনেগাল। তাঁর প্রথম ছবি ‘ঘের বেথা গঙ্গা’ (আমার ঘরের ভেতর গঙ্গা)। বেনেগালের সুখ্যাতি হল ‘অঙ্কুর’ ছবিটি মুক্তির পরে, ১৯৭৪-এ। সে ছবিতেই, সিনেমা-পর্দায় প্রথমবারের মতো আলো পেয়েছিলেন শাবানা আজমি। ’৭৫ সালে, বেনেগালের ‘নিশান্ত’ ছবিতেও অভিনয় করবেন তিনি।
‘অঙ্কুর’ ছবির শেষ দৃশ্যটি মনে পড়ে? সেই যে ছেলেটি, বলেছিল কিস্থায়া চোর! ছেলেটি আসলে একটি মোটিফ। আচমকা মালিকের বিরুদ্ধে গিয়ে, জানলার কাচ ভেঙে দিয়েছিল সে। স্ক্রিন হয়ে ওঠে লাল। এবং শেষাবধি দেখতে পাই, বিদ্রোহের এক অঙ্কুরিত চারাগাছ। গ্রামবাসীদের সম্মিলিত প্রতিবাদ। সামাজিক হায়ারার্কির বিপক্ষে।
কাট: এ ঘটনার সময়কাল ১৯৭৪। সদ্য শেষ হয়েছে সিনিয়ার কেমব্রিজ সার্টিফিকেটের পরীক্ষা। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের গণজ্ঞাপন বিভাগের একটি কোর্সে ভর্তি হলাম আমি। তত্ত্বাবধায়ক, ফাদার গ্যাস্টন রবার্গ। ধাপে ধাপে, যেভাবে চলচ্চিত্র-ভাষার মাধ্যমে ফাদার রবার্গ ব্যাখ্য করেছিলেন ছবিটির নুয়্যান্স! সকলেই আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, ভারতীয় সিনেমার চেহারাটি আমূল বদলে দিতে চলেছে একটি ছবি: অঙ্কুর।
ভারতে চলচ্চিত্র সম্পর্কে যে ধারণা, শ্যাম বেনেগালের অফবিট ছবিসমূহ তা সম্পূর্ণ পালটে দিয়েছিল। বেনেগালের উত্থান আসলে ‘মিডল সিনেমা’ থেকে। প্রথমাবস্থায় যুক্ত হয়েছিলেন বিজ্ঞাপন-ইন্ডাস্ট্রিতে। তাঁর তৈরি বিজ্ঞাপনের সংখ্যা প্রায় ৯০০। তারপরই চলচ্চিত্রের নেশা লাগে।
১৯৬২। সিনেমা-জগতে আত্মপ্রকাশ করলেন শ্যাম বেনেগাল। তাঁর প্রথম ছবি ‘ঘের বেথা গঙ্গা’ (আমার ঘরের ভেতর গঙ্গা)। বেনেগালের সুখ্যাতি হল ‘অঙ্কুর’ ছবিটি মুক্তির পরে, ১৯৭৪-এ। সে ছবিতেই, সিনেমা-পর্দায় প্রথমবারের মতো আলো পেয়েছিলেন শাবানা আজমি। ’৭৫ সালে, বেনেগালের ‘নিশান্ত’ ছবিতেও অভিনয় করবেন তিনি।
জাম্প কাট: ১৯৮৪। দশটি গ্রীষ্ম পরের কথা। আমি তখন এক সংবাদপত্রের দপ্তরে চাকরি করছি। রবিবারের সেগমেন্টে। বম্বেতে এসেছি, সম্পাদক এম.জে.আকবর ফোন করলেন। বললেন, চলচ্চিত্র-পরিচালক শ্যাম বেনেগালের কিছু রিসার্চ পেপার সংগ্রহ করে কলকাতায় নিয়ে এসো। আকবর যে ‘কিছু কাগজপত্র’-এর কথা বলেছিল, বাস্তবে তা আকার নিল দু’খানা ট্রাঙ্কে। গবেষণার বিষয়, জওহরলাল নেহরু। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। যে বিপুল গবেষণার উপাদান সংগ্রহ করে এনেছিলাম কলকাতায়, সেটাই তৈরি করেছিল একটি বইয়ের পটভূমি। ‘নেহরু: দ্য মেকিং অফ ইন্ডিয়া’। লেখক? এম.জে.আকবর। প্রকাশক, পেঙ্গুইন হাউস।
……………………………………….
’৯০-র দশকে ভারতীয় মুসলিম নারীদের কেন্দ্র করে একটি ট্রিলজি তৈরি করেছিলেন শ্যাম বেনেগাল। শুরু হয়েছিল মাম্মো (১৯৯৫), সর্দারী বেগম (১৯৯৬) এবং জুবেইদা (২০০১)। জুবেইদা সেই ছবি, যার জন্যে প্রথমবারের মতো বলিউডের মূলধারার ছবির জগতে প্রবেশ করলেন তিনি। যেহেতু এ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন বলিউডের স্টার কারিশ্মা কাপুর এবং সঙ্গীত পরিচালনায় এ.আর.রহমান।
……………………………………….
১৯৭০ এবং ১৯৮০। এ-সময়কালে ভারতের ‘প্যারালাল সিনেমা’ অথবা ‘নিউ ইন্ডিয়ান সিনেমা’ যে সাফল্য উদযাপন করেছিল, তা মূলত শ্যাম বেনেগালকে কেন্দ্র করেই। অঙ্কুর (১৯৭৩), নিশান্ত (১৯৭৫), মন্থন (১৯৭৬) এবং ভূমিকা (১৯৭৭), যা শৈল্পিকভাবে উচ্চমার্গীয়, তবু বাণিজ্যিকভাবে সফল। এফটিআইআই এবং এনএসডি– বেনেগাল খুঁজে খুঁজে তুলে এনেছিলেন আশ্চর্য সব নতুন প্রতিভা: শাবানা আজমি, নাসিরুদ্দিন শাহ, ওম পুরী, স্মিতা পাতিল, কুলভূষণ খারবান্দা এবং অমরিশ পুরি।
‘নিশান্ত’ ছবিটির কথাই ধরা যাক! যেখানে অপহৃত একজন স্কুলশিক্ষকের স্ত্রী। এবং চারজন জমিদার গণধর্ষণ করেছে মেয়েটিকে। স্বামীটি বিচার চাইতে এলে, সিস্টেম বধির হয়ে বসে থাকে। চুপ করে। কিংবা মন্থন। ছবিটির প্রেক্ষাপট গুজরাটের দুগ্ধ শিল্প। এ ছবিতে কমার্শিয়াল ভাষার পরিবর্তে, দর্শকের সঙ্গে একটি কঠোর সিনেমাটিক ভাষায় কথা বলছিলেন বেনেগাল। কো-অপারেটিভ সিনেমা আন্দোলনের সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ, মন্থন। গুজরাটের ৫ লক্ষ কৃষক, প্রত্যেকে, সিনেমার জন্যে অবদান রেখেছিলেন– অমূল্য ২ টাকা। ট্রাকভর্তি কৃষক সিনেমাহলে এসেছিল। নিজেদের ছবি দেখতে। বক্স-অফিসে মন্থন দারুণ সফল।
ভূমিকা ছবিটি অন্যধারার। সে ছবির অনুসন্ধান– ব্যক্তি-অস্তিত্ব এবং আত্মতৃপ্তি। ১৯৪০। মহারাষ্ট্রের সেলুলয়েড এবং নাট্যজগতের পরিচিত মুখ হাসনা ওয়াড়কার। এ ছবি তাঁরই জীবন-কেন্দ্রিক। যে জীবন রঙিন এবং অ-সাধারণ।
–‘বেনেগাল এই চমৎকার ভিজ্যুয়ালের পুনর্নিমাণ করলেন কীভাবে? কীভাবে আঁকলেন হাসনা ওয়াড়কারের সেইসব আশ্চর্য দিন, যা একজন ট্যালেন্টেড অভিনেত্রীর যন্ত্রণা এবং দুর্দশার প্রতি সংবেদনশীল? যে নারীর নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তা শুধুমাত্র স্বাধীনতার জেদের সঙ্গেই সমগোত্রীয়?’
–“আমি যে বিশ্বাসে ভূমিকার চিত্রনাট্য লিখেছিলাম, বিদ্যা বালান অভিনীত ‘দ্য ডার্টি পিকচার’, সেই বিশ্বাসেই অনুসৃত!”
বেশিরভাগ নতুন সিনেমা-নির্মাতাদের মতো নয়, বেনেগাল নিজের বেশ কয়েকটি ছবির জন্য কিছু ফিল্ম-তারকার ব্যক্তিগত সমর্থন পেয়েছিলেন। শশী কাপুরের সাহায্যার্থে তৈরি করেছিলেন ‘জুনুন’ (১৯৭৯) এবং ‘কলিযুগ’ (১৯৮১)। জুনুন ছবিটির ব্যাকড্রপে ছিল ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ। উথালপাথাল সময়। আমার মতে, জুনুন শ্যাম বেনেগালের অন্যতম স্টাইলিশ ছবি। মনে হয়েছিল, সে ছবির নিখুঁত ডিটেলিং আর দৃশ্যকল্পে বেনেগাল যথেষ্টই তৃপ্ত! কিন্তু কলিযুগ, মহাভারতের ভিত্তিতে সৃষ্ট এক জটিল আখ্যান। মহাভারতের উপাখ্যানের কয়েকটি দুর্দান্ত মুহূর্ত ছিল কলিযুগে। তবু অসফল। ১৯৮০। নিউ সিনেমার পতনের পরেই, বেনেগালের সিনেমাগুলো যথার্থভাবে মুক্তি পেল না। সেই সময়েই টেলিভিশনের দিকে ঝুঁকে পড়লেন তিনি। ভারতীয় রেলব্যবস্থার জন্য তৈরি সিরিয়াল যাত্রা (১৯৮৬), পরিচালনা করলেন। এবং অবশ্যই, ভারতীয় টেলিভিশনের অসামান্য প্রজেক্ট, ভারত এক খোঁজ (১৯৮৬)– সেখানেও তিনি পরিচালকের ভূমিকাটি পালন করলেন দুরন্তভাবে।
‘মিডল সিনেমা’— শ্যাম বেনেগাল এবং তাঁর সমসাময়িক পরিচালকদের সিনেমা যে নামে পরিচিত। তবে কেন তাঁর নিজের অন্তরেই এ-প্রবণতার জন্ম হয়েছিল, সিনেমার কোনও ভেদ নেই? সমান্তরাল সিনেমা অথবা বাণিজ্যিক সিনেমা— এই মুহূর্তে সেই ভেদাভেদের কোনও অস্তিত্ব নেই? অথচ শ্যাম বেনেগাল বলেছিলেন, “১৯৭০ এবং ’৮০’র দশকে, বাণিজ্যিক ছবি হয়ে উঠেছিল বড় বেশি ফরমুলা নির্ভর। অথচ আমাদের সিনেমা-নির্মাণের মতাদর্শ এবং নির্মাণশৈলী সম্পূর্ণ আলাদা। তথাকথিত বাণিজ্যিক ছবিগুলির বিপরীতে একটি ভিন্ন ধরনের দৃষ্টি স্থাপন করতে পেরেছিল সেই সমস্ত ছবি।”
বেনেগালের পরবর্তী ছবি, মান্ডি (১৯৮৩)। একটি ব্যঙ্গাত্মক কমেডি। রাজনীতি এবং বেশ্যাবৃত্তি সম্পর্কিত। অভিনয়কেন্দ্রে শাবানা আজমি এবং স্মিতা পাটিল। এরপরে, যখন একেবারে নিজস্ব একটি গল্পের ওপরে কাজ করছেন শ্যাম বেনেগাল, পর্তুগিজদের শেষ দিনগুলো কেমন কেটেছিল গোয়ায়– এই ছিল গল্পের ভিত্তি, সেই সময়ে তৈরি করেছিলেন ত্রিকাল (১৯৮৫)। মানবিক-সম্পর্কের অন্বেষণ এই ছবির সারবস্তু। শীঘ্রই, শ্যাম বেনেগাল চিরাচরিত আখ্যানমূলক চলচ্চিত্রের বাইরে পা রাখেন এবং আরও আরও স্বাধীনপথে সিনেমার এক্সপেশনের জন্য বেছে নিয়েছিলেন জীবনীমূলক উপাদান। প্রথম এক্সপেরিয়েন্ট, সত্যজিৎ রায়ের জীবনকেন্দ্রিক তথ্যচিত্র। নাম, ‘সত্যজিৎ রায়’ (১৯৮৫)। এই ধারা অনুসরণ করেই বেনেগাল তৈরি করেছিলেন ‘সর্দারী বেগম’-এর মতো ছবি। এবং ২০০১ সালে জুবেইদা। ছবিটির লেখক, চলচ্চিত্র-নির্মাতা ও সমালোচক খালিদ মোহাম্মদ।
’৯০-র দশকে ভারতীয় মুসলিম নারীদের কেন্দ্র করে একটি ট্রিলজি তৈরি করেছিলেন শ্যাম বেনেগাল। শুরু হয়েছিল মাম্মো (১৯৯৫), সর্দারী বেগম (১৯৯৬) এবং জুবেইদা (২০০১)। জুবেইদা সেই ছবি, যার জন্যে প্রথমবারের মতো বলিউডের মূলধারার ছবির জগতে প্রবেশ করলেন তিনি। যেহেতু এ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন বলিউডের স্টার করিশ্মা কাপুর এবং সংগীত পরিচালনায় এ.আর. রহমান।
১৯৯২ সাল। তৈরি করলেন ‘সুরজ কা সাতওয়া ঘোড়া’। সূর্যের সপ্তম ঘোড়া। লেখক-কবি ধর্মবীর ভারতীর একটি উপন্যাস ভিত্তি করে। ১৯৯৬ সাল। দক্ষিণ আফ্রিকান লেখক ফাতিমা মীরের ‘অ্যাপ্রেন্টিস অফ মহাত্মা’ বইটিকে আধার করে, তৈরি হয় আরও একটি চলচ্চিত্র– দ্য মেকিং অফ মহাত্মা। জীবনীমূলক উপাদানের ধারায় ভেসে যেতে যেতে, বেনেগাল ইংরেজি ভাষায় নির্মাণ করেন, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস: দ্য ফরগটেন হিরো (২০০৫)। ভারতের জাতিপ্রথা তাঁর চলচ্চিত্রে সমালোচিত হয়। তীব্র কণ্ঠে ধিক্কার জানায় ‘সমর’ (১৯৯৯) ছবিটি।
২০০৮। শ্রেয়াস তালপাড়ে এবং অমৃতা রাও অভিনীত ছবি, ওয়েলকাম টু সজ্জনপুর, মুক্তির পরে বেশ ভালো প্রতিক্রিয়াই পেয়েছিল। ২০১০ সালের মার্চে, বেনেগাল একটি রাজনৈতিক স্যাটায়ার তৈরি করেন। ওয়েল ডান আব্বা। মুম্বই শহরের একজন ড্রাইভার, আরমান আলির গল্প বলতে শুরু করেন শ্যাম বেনেগাল। এক মাসের ছুটি নিয়ে আরমান পৌঁছেছে হায়দ্রাবাদের কাছেই, একটি ছোট গ্রামে। আরমানের কন্যা কিশোরি, তাই স্বামী খুঁজতে হবে এখনই। তিন মাস পরে যখন মুম্বাই ফিরছেন আরমান আলি, ড্রাইভারের চাকরিটা প্রায় যেতে বসেছে। অথচ আরমানের বস, রাজি হয়েছিলেন আরমানের গল্প শোনার জন্য। দীর্ঘ তিনমাস সে কোথায় ছিল।
বেনেগালের ভবিষ্যতে প্রকল্পের মধ্যে একটি, নূর ইনায়েত খান। সে আবার কে? ইনায়েত খানের মেয়ে এবং টিপু সুলতানের বংশধর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, একজন ব্রিটিশ-ভারতীয় গুপ্তচর রূপে কাজ করেছিলেন। শ্যাম বেনেগাল বলেছিলেন, একটি মহাকাব্যিক মিউজিক্যাল ছবি নির্মাণ করবেন। চামকি চামেলি। জর্জ বিজেটের ক্লাসিক স্প্যানিশ অপেরা, কারমেন-এর অনুপ্রেরণায়। চামকি নামের এক সুন্দরী জিপসি মেয়ে। মেজাজ সর্বক্ষণ একেবারে তিরিক্ষে! সেই মেয়েরই গল্প। লিখেছিলেন শামা জাইদি লিখেছেন। গানের সুর এ আর রহমান। কথায়, জাভেদ আখতার।
নিজস্ব ফিল্মোগ্রাফির উপর তিনটি বই লিখেছিলেন শ্যাম বেনেগাল: মন্থন ছবিভিত্তিক ‘দ্য চার্নিং উইথ বিজয় টেন্ডুলকার’ (১৯৮৪), ‘সত্যজিৎ রায়’ (১৯৮৮), এবং মান্ডি ছবিভিত্তিক ‘দ্য মার্কেটপ্লেস’ (১৯৮৯)। মুখবন্ধ লিখেছেন একটি বইয়ের। নাম, ডিপ ফোকাস। সত্যজিৎ রায় সিনেমা-সর্বস্ব যে ক’টি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, তারই একটি সংগ্রহ। রায় সোসাইটি এবং হার্পার কলিন্সের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত।
১৯৭৬ সালে পদ্মশ্রী। ১৯৯১ সালে পদ্মভূষণ। বেনেগালের সোনায় বাঁধানো মুকুটে যুক্ত হয়েছে আরও একটি পালক। ৮ আগস্ট, ২০০৭। দাদা সাহেব ফালকে পুরষ্কার পেলেন শ্যাম বেনেগাল। জাতীয় পুরস্কার সাতটি। এবং সম্প্রতি, আমাদের পরম আদরের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বেনেগালকে পুরস্কৃত করেছে। ‘ডক্টর অফ লিটারেচার’। শ্যাম বেনেগালের জন্ম একটি কোঙ্কনি-ভাষী ব্রাহ্মণ পরিবারে। তারিখ? ১৪ ডিসেম্বর ১৯৩৪। সেকেন্দ্রাবাদ। সেই সময় সেকেন্দ্রাবাদ একটি ব্রিটিশ ক্যান্টনমেন্ট। বর্তমানে তেলেঙ্গানা রাজ্যের রাজধানী হায়দ্রাবাদ শহরের টুইন সিটি। এখানেই, বারো বছর বয়সে প্রথম সিনেমা তৈরি করেছিলেন শ্যাম বেনেগাল। বাবা, শ্রীধর বেনেগাল একজন ফোটোগ্রাফার। বাবার উপহার দেওয়া ক্যামেরাতেই প্রথম ছবির স্বাদ লেগেছিল চোখে। ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজাম কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর। সেখানেই গঠন করেছিলেন হায়দ্রাবাদ ফিল্ম সোসাইটি। বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ও অভিনেতা গুরু দত্ত’র আত্মীয় বেনেগাল। তাঁর পিতামহী এবং গুরু দত্ত’র মাতামহী– একই ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। সম্পর্কে দিদি-বোন।
১৯৫৯। বোম্বাইয়ের (এখন মুম্বাই) একটি বিজ্ঞাপনী-সংস্থায় কপিরাইটার পদে নিযুক্ত হলেন শ্যাম বেনেগাল। কোম্পানির নাম। লিন্টাস অ্যাডভারটাইজিং। পদোন্নতি হয়। কোম্পানির ক্রিয়েটিভ হেড হয়েছিলেন পরবর্তীতে। ১৯৬৩ সাল। এএসপি (অ্যাডভার্টাইজিং, সেলস অ্যান্ড প্রমোশান) নামের আরও একটি বিজ্ঞাপনী-সংস্থার কাজ করতে শুরু করেন। বেনেগাল শিক্ষকতাও করেছেন বেশ কিছু বছর। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৩। পুনে ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে। এবং ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব সামলেছেন দু’বার: ১৯৮০-৮৩ এবং ১৯৮৯-৯২। ইতিমধ্যে তথ্যচিত্র নির্মাণকাজ শুরু করে ফেলেছেন। প্রথম দিকের তথ্যচিত্র, ‘এ চাইল্ড অফ দ্য স্ট্রিটস’ (১৯৬৭)। ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছিল দর্শক এবং সমালোচক মহলে। বেনেগালের তৈরি শর্ট ফিল্ম এবং তথ্যচিত্রের সংখ্যা সব মিলিয়ে প্রায় ৭০।
বেনেগালের অসংখ্য শুভাকাঙ্ক্ষীর অনুরোধে, যে তালিকায় আমার নামটিও রয়েছে, সম্প্রতি ভেদান্তা কোম্পানির একটি ফিল্ম কমিটি থেকে পদত্যাগ করেছেন তিনি। কোম্পানিটি বিতর্কিত। এ হেন সাহসিকতা, আরও একবার প্রমাণ করেছে পরিবেশের প্রতি বেনেগালের দায়িত্ব। সংবেদনশীলতা। আমরা ঋণী।
কাট: ২০১২। ২৭টি গ্রীষ্ম অতিবাহিত। শ্যাম বেনেগালের সঙ্গে আমার মুখোমুখি সাক্ষাৎ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণজ্ঞাপন বিভাগ আয়োজিত একটি আলোচনা পর্বে। বলছেন সিনেমার ফর্মের কথা। ব্যাখ্যা করছেন, কেন সিনেমা মাধ্যমটি অন্য যে কোনও মাধ্যমের চেয়ে পৃথক। স্বতন্ত্র। সিনেমার সঙ্গে তুলনায় টেনে এনেছিলেন রন্ধনপ্রণালী। দু’টি ক্ষেত্রেই প্রয়োজন বহু বিভিন্ন উপাদানের।
আমি বলেছিলাম, এহেন ব্যাখ্যার জন্যেই আপনি শ্রেষ্ঠ শেফ। সঙ্গে জুড়েছিলাম একটি প্রশ্ন। আপনার দীর্ঘ কর্মজীবনে, কখনও বিজ্ঞাপনী ছবি, কখনও রাজনৈতিক ছবি, কখনও আবার শিশু-কিশোরদের জন্য ছবি তৈরি করেছেন! বায়োগ্রাফিক্যাল ছবিও সে তালিকায় কম নেই। এই যে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের রান্না, সেই রন্ধনপ্রণালী কেমন?
উদাহরণ হিসেবে বেছেছিলেন, সুরজ কা সাতওয়া ঘোড়া (সূর্যের সপ্তম ঘোড়া)। ছবিটি দেবদাস সিন্ড্রোমের বিপরীত কথা বলেছিল। বিধ্বংসী স্বরে। ছবিতে আমরা দেখছি, কথক মানিক মুল্লা (রজিত কাপুর) আসলে তিন নারীর তিন গল্প বলছেন। নীনা গুপ্তা (দরিদ্র), পল্লবী জোশী (বুদ্ধিজীবী) এবং রাজেশ্বরী সচদেব (মধ্যবিত্ত)। তিনজন নারীর সঙ্গেই মানিকের দেখা হয়েছিল। জীবনে বিভিন্ন সময়ে। তিনটি গল্প আদতে একটি গল্প। দৃষ্টিকোণ তিনটে। সর্বনিম্ন, ধীরগতিসম্পন্ন অথবা সমাজের দুর্বলতম শ্রেণিই যে সমগ্রের অগ্রগতি নির্ধারণ করে– তা-ই এ-ছবির মূল।
প্রশ্নোত্তর পর্ব যখন শেষ, আমি উঠে গিয়ে একটি ছোট লাল বাক্স উপহার দিলাম। সকলের একটিই জিজ্ঞাসা। কী আছে এই বাক্সে? উত্তর দিলাম না। লাল বাক্সের ভেতরে অনাদিকালের একটি লাইট মিটার। গায়ে খোদাই করা তারিখ। ১৯০১। জার্মানির কার্ল জেইস তৈরি করেছিলেন। আমার বাবা, নির্মলচন্দ্র কুমারের সংগ্রহে ছিল বহুদিন। এ লাইটার আসলে ফরাসি চলচ্চিত্র-পরিচালক জঁ রেনোয়ারের। রেনোয়ার যখন কলকাতায়, শ্যুটিং করছেন ‘দ্য রিভার’ ছবিটি! তখনই আমার বাবাকে উপহার দিয়েছিলেন। সিনেমা যে উপহার দিয়েছিল, সে উপহার সিনেমার কোলেই অর্পণ করে এসেছিলাম। পেয়েছিলাম অদ্ভুত এক শান্তি।
……………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………