সাদায়-কালোয় অবিশ্বাস্য সব পোর্ট্রেট, তলায় জ্বলজ্বল করছে তাঁর স্বাক্ষর। তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি, দেখলেই বোঝা যেত। কম গল্প শুনেছি নাকি তাঁর সম্পর্কে! মুক্তিযুদ্ধের সময়ের গল্প, ‘আনন্দবাজার’-এর বিখ্যাত সব অ্যাসাইমেন্টের গল্প। সেরা ছবিটা তারাদারই, সবসময়। সেই মানুষটার সঙ্গে যে কাজ করবার সুযোগ মিলবে, সেটাই জানা ছিল না। সামনাসামনি দেখে অবশ্য মানুষটাকে মেলাতে পারিনি। শক্তপোক্ত ফুটবলার টাইপ চেহারা, কাঁধের ব্যাগে অল্প একটু রগচটা অভিমান নিয়ে বসে থাকেন সবসময়। ‘রোববার’-এর প্রারম্ভিক ভিস্যুয়াল-এর একজন পিলার যদি হন বিপুল গুহ, অন্যজন অবশ্যই তারাদা। বুধবার সকালে প্রয়াত হয়েছেন তিনি।
প্রচ্ছদের ছবি: সন্দীপ কুমার
‘রোববার’ বেরবে বেরবে করছে, ঋতুদা বম্বে থেকে অমিতাভ বচ্চনের সাক্ষাৎকার নিয়ে সবে ফিরেছে, উত্তেজিত হয়ে ঘরে ঢুকে দেখি– ঋতুদা মুখ চুন করে বসে আছে।
‘কী হয়েছে? কোনও গুরুতর কিছু?’
ঋতুদা বলল, ‘তুই জানিস তারাদা কী করেছে?’
‘কী!’
‘অমিতদাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে।’
‘সে কী?’
‘হ্যাঁ। ফ্রেম করতে গিয়ে নানান কায়দা করছিল, একসময় অমিতদা বসতে গিয়েছে, তারাদা চেয়ারটা সরিয়ে দিয়েছে, অমিতদা মাটিতে!’
শুনে হাসব কি কাঁদব, ভেবে পেলাম না। এ কাজ শুধুমাত্র তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষেই সম্ভব! এমনই এক ফ্রেম-মতলবি মানুষ, ছবি তোলার সময় যিনি উন্মাদ হয়ে যান। তখন তাঁর কাছে সবই ‘সাবজেক্ট’। পাখি আর বচ্চনের মধ্যে তফাত বোঝেন না। তারাদাকে বললাম, ‘এ কী করেছ তুমি!’
তারাদা একগাল হেসে বলল, ‘আমার দোষ নেই কোনও, লম্বু যদি না দেখতে পায় কী করব!’
এমনই মানুষ তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়। একটা বয়স ছিল, যখন বাইলাইন দেখে পরিচয় হয়েছিল মানুষটার সঙ্গে। চাক্ষুষ দেখিনি, শুধুই বাঁশি শুনেছি। সাদায়-কালোয় অবিশ্বাস্য সব পোর্ট্রেট, তলায় জ্বলজ্বল করছে তাঁর স্বাক্ষর। তারাদার ছবি, দেখলেই বোঝা যেত। কম গল্প শুনেছি নাকি তাঁর সম্পর্কে! মুক্তিযুদ্ধের সময়ের গল্প, ‘আনন্দবাজার’-এর বিখ্যাত সব অ্যাসাইনমেন্টের গল্প। সেরা ছবিটা তারাদারই, সবসময়। সেই মানুষটার সঙ্গে যে কাজ করবার সুযোগ মিলবে, সেটাই জানা ছিল না। সামনাসামনি দেখে অবশ্য মানুষটাকে মেলাতে পারিনি। শক্তপোক্ত ফুটবলার টাইপ চেহারা, কাঁধের ব্যাগে অল্প একটু রগচটা অভিমান নিয়ে বসে থাকেন সবসময়। ‘রোববার’-এর প্রারম্ভিক ভিস্যুয়াল-এর একজন পিলার যদি হন বিপুল গুহ, অন্যজন অবশ্যই তারাদা। তারাপদ রায় নতুন করে লিখতে শুরু করলেন ‘ডোডো তাতাই’। আমাদের তাতাই তখন তাতাইবাবুর রোলে, ডেডোবাবু অন্য একজন। সব ফ্রেম তারাপদময়।
তারাপদ স্কোয়ারের সবুজ অভিযান তখন হইহই করে পিছনের পাতায়, ফুল ফোটাচ্ছে। ‘ভালো-বাসার বারান্দা’য় লেখিকার ছবি যাবে প্রতি সংখ্যায়। তারাদা সাতসকালে পৌঁছে গিয়েছেন ভালো-বাসায়। নবনীতাকে এমন তাড়া লাগিয়েছেন, বিরক্ত হয়ে তিনি ফোন করেছেন।
‘আমি কি নায়িকা বলো তো? একবার গাছের পাশে, একবার বারান্দার রোদ্দুরে, এ লোকের মাথা ঠিক নেই কিন্তু!’
আমি আশ্বস্ত করি, ‘দেখছি।’
ছবি দেখে তো পুরো থ! নবনীতাদির এমন ফোটো যেমন কখনও দেখিনি আগে। যতই বিরক্ত হন, নবনীতাদি নিজেও সেটা বুঝেছিলেন বিলক্ষণ। তারাদার হাতে একটা কিছু ছিল। সাধে কি সত্যজিৎ রায় নিজে ডেকে ছবি তোলাতেন। বিদেশ থেকে সত্যজিৎ নিয়ে প্রকাশ পাওয়া বিখ্যাত বইটির প্রচ্ছদ কিন্তু তারাদারই।
‘কত টাকা পেয়েছিলে?’
লাজুক লাজুক হাসত। ‘পয়সার জন্য দিইনি তো, ঢ্যাঙা বলেছিল, তাই দিয়েছিলাম।’ সত্যজিৎ রায়কে এই নামেই সম্বোধন করতেন আড্ডায়।
প্রথম প্রথম তারাদাকে মনে হত খিটকেল, ছবি তোলা নিয়ে নানা অশান্তি লেগেই থাকত। কী সব বিল অফিস পাস করছে না, এই নিয়ে ঘ্যান ঘ্যান করতেন খুব।
আমি বোঝাতাম, ‘তুমি হলে তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়, যখন তখন ঝগড়া করবে না একদম।’
আবার মাঝে মাঝে কী খেয়াল হত, বাড়ি থেকে চিকেন কাটলেট ভেজে এনে অফিসসুদ্ধ সকলকে খাওয়াচ্ছেন। কাটলেট কিন্তু তারাদার ফ্রেমের মতোই উমদা ছিল। সমরেশ মজুমদারের কলিকাতায় নবকুমার উপন্যাসের ফোটো তুলতে নিয়মিত সোনাগাছি যেতেন। এসেই গজগজ করতেন, ‘ঋতুর যত বিদঘুটে আইডিয়া, ওসব জায়গায় গিয়ে ছবি তোলা খুব ডেঞ্জারাস, মারধর খেতে খেতে বেঁচে গেছি আজ।’ আমরা হাসতাম, আর তারাদা আরও রেগে যেতেন।
একবার কবিদের নিয়ে একটা স্পেশাল সংখ্যা করে ‘রোববার’। সবার পোর্ট্রেট-এর ভার ছিল তারাদার ওপর। খুব খেটেছিল সেই সংখ্যায়। মৃদুল দাশগুপ্তকে টেনে পাশের পুকুরে মাছ ধরতে বসিয়েছিলেন। উৎপলকুমার বসুকে গড়িয়াহাট বাজারে বহুক্ষণ হাঁটিয়েছিলেন। সেরা কাণ্ডটা অবশ্য শঙ্খবাবুর সঙ্গে। স্যরকে মাটিতে শুইয়ে দিয়েছিলেন অবলীলায়। শঙ্খবাবু চিরশুভ্র উপস্থিতি নিয়ে ভূমিতে ভূপতিত– এ আইডিয়া তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া আর কারও মাথা থেকে বেরতই না।
তখন জুজু হয়েছে সবে। সকাল সাতটায় ঘন ঘন কলিং বেল। দরজা খুলে দেখি হন্তদন্ত মুখে তারাদা।
‘কী ব্যাপার গো?’
‘শিগগির ছেলেকে নিয়ে এসো, ছবি তুলব।’
‘ঘুমোচ্ছে তো এখন।’
‘ঘুম থেকে এক্ষুনি তোলো’, ক্যামেরা সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, পাত্তাই দিচ্ছেন না বাবা-মা’কে! আমাদের ‘রোববার’-এর শান্তিনিকেতন ট্যুর-এরও সব স্মরণীয় ছবি তারাদার হাতেই। বড় বড় জায়গায় কাজ করেছেন সারাজীবন, কিন্তু একবারও সেসব নিয়ে বারফট্টাই করতে শুনিনি কখনও। মন-মতলবি সাক্ষাৎ ফ্রেমিকপ্রবর। নিজের তালে থাকতেন। কেউ তাল না মেলালেই মেজাজ খাপ্পা! দপ্তরের সকলকে ভালবাসতেন খুব। আবার সামান্য জিনিস নিয়ে রাগ করতেন যখনতখন। সবসময় ভীষণ তাড়াহুড়ো ছিল কাজে। চলে যাওয়ার ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হল না একটু। বচ্চন, শঙ্খবাবু, জীবন– সপাট ধাক্কা মেরে চলে যাওয়াই নিয়তি। সারাটা জীবন এমন সব পোর্টেট তুলেছেন, যাতে মানুষটাকে আরও বেশি করে চেনা যায়।
তারাদা নিজের পোর্ট্রেট নিজে তোলেননি কখনও। তাই হয়তো মানুষটাকে চিনেও চিনতে পারলাম না কোনও দিন।
বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর খুব সঠিকভাবেই ভারতের বিদেশনীতির ব্যাখ্যা করে আগাম বলে রেখেছিলেন, ‘হোয়াইট হাউস ডেমোক্র্যাট প্রার্থী না রিপাবলিকান প্রার্থীর দখলে গেল তা নিয়ে নয়াদিল্লি মোটেও চিন্তিত নয়। কারণ, ভারত ও আমেরিকার সম্পর্কের এতে কোনও পরিবর্তন ঘটবে না। গত পাঁচটি প্রেসিডেন্টের আমলেই ভারত ও আমেরিকার সম্পর্কের উন্নতি ঘটেছে।’