ট্রেন দেখে ভাইবোনের ফেরার পথে পিসির মৃত্যুদৃশ্য। সঙ্গে একটি বাছুর। পিসি বাঁশবনে বসে, সাউন্ড-ট্র্যাকে শিশুদের হাসির শব্দ। দুর্গা গুঁড়ি মেরে অপুর দিকে যায়, তাকে ঝাঁকায়, অপু দাঁত বের করে হাসে। পিসি হঠাৎ উপুড় হয়ে পড়ে, জলের ভেতরে গড়িয়ে পড়ে ঘটি। আমরা দেখি, উঠে দাঁড়ানো দুর্গা-রূপী উমা দাশগুপ্তের মুখ। এ কী অভিনয়, না চলন্ত ভাস্কর্য? ১৮ নভেম্বর প্রয়াত হয়েছেন উমা দাশগুপ্ত, রইল তাঁর স্মরণলেখ।
সেই রাত। দুর্গা অসুস্থ। বাইরে ভয়ংকর এক ঝড়। সর্বজয়া দুর্গার কপালে জলপটি দেয়। ঝড়ের প্রচণ্ডতায় ছেঁড়া পর্দাটি ফুলে ওঠে, প্রদীপ কাঁপে, হুড়কো ভেঙে দরজাটি খুলে আসতে চায়। সর্বজয়া দুর্গাকে প্রকৃতির হাঁ-মুখ থেকে আগলে রাখতে চায়। তাকের ওপরে দোলে গণেশ-মূর্তি। বিদ্যুৎ চমকায়। রক্ষাকর্তা কখন হল এত ভয়াল, সত্যজিতের শিল্পচেতনায়?
‘পথের পাঁচালি’-তে ছবিতে দুর্গার মৃত্যু চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় মৃত্যুদৃশ্য হয়ে আছে। সর্বজয়া-রূপী করুণা বন্দ্যোপাধায় ও দুর্গারূপী উমা দাশগুপ্ত যেন অভিনয় করছেন না, আমাদের চমকে দিয়ে হয়ে উঠছেন রক্তমাংসের সর্বজয়া ও দুর্গা। কী করে হল? কী করে? ভারতীয় চলচ্চিত্রের শৈশবাবস্থা থেকে প্রথমতম উত্তরণের মুহূর্তে?
উমা দাশগুপ্ত আর অপু ত্রয়ীতে ফিরে আসবেন না। ইন্দির-রূপী চুনীবালা দেবী আর অপু-রূপী সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো একটিমাত্র ছবিতে উমা দাশগুপ্ত ইতিহাস রচনা করবেন। গতকাল তাঁর প্রয়াণের দিন এই আশ্চর্য বিদ্যুৎময়ী বালিকাকে প্রণাম জানাই। কেন সে এত অসাধারণ? তার অভিনয়ের সত্যমূল্যের জন্য। ‘সত্যমূল্য’ কথাটা বিরল এক সোনার মোড়কে রাখা আছে বিরলতম শিল্পসাহিত্যের গ্যালারিতে।
দুর্গার মৃত্যুদৃশ্য ছবির প্রায় শেষ প্রান্তে। ছবির স্থাপত্যময় দৃশ্যসংস্থাপন, ফ্রেম নির্মাণ, ও ক্যামেরা মুভমেন্ট এবং অভিনয় মিশে গিয়ে যে অনবদ্য প্রকাশব্যঞ্জনা তা যেন শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছয় ওই মৃত্যুদৃশ্যে। সাহিত্যবোধ, মৌলিক চিন্তা, কল্পনার প্রসার ও প্রকরণ নৈপুণ্যের পারস্পরিক ক্রিয়া থেকে চলচ্চিত্রের পর্দায় যে গতিময় দ্যুতির সঞ্চার হয়, ‘পথের পাঁচালী’ তার ক্লাসিক নমুনা হয়ে আছে।
উমা দাশগুপ্তের সঙ্গে করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লাবণ্যময় মুখের মিল দর্শকের কল্পনায় আগুন ধরায়। দুরন্ত বালিকার বুদ্ধি, ভালবাসা, মমতা, লোভ যেন এক অনন্ত চিত্রপটে এঁকে দিল উমা। পিসি ইন্দির ঠাকরুণের সঙ্গে গভীর, গভীর এক বন্ধন চলচ্চিত্রের পর্দা থেকে বেরিয়ে লবণাক্ত ঢেউয়ের আস্বাদ দেয় আমাদের। তার মধ্যে লুকিয়ে থাকে অশ্রুর অণুমঞ্জরী, যা আমরা মনের ঝিনুকে লুকিয়ে রেখেছি।
কী করে পারল সেই বালিকা, যে হঠাৎ এক তরুণীর মতো চোখে লুকনো অশ্রু নিয়ে তাকিয়ে থাকে বিয়ের কনে বান্ধবীর দিকে? সে বলে, ‘আমি জানি আমার কখনও বিয়ে হবে না।’ চকিতে হৃদয় খুঁড়ে বেদনার আভাসমাত্র জাগানো সত্যজিতের এই অবিশ্বাস্য শিল্পিত নির্মাণ যেন উমার মুখের নিগূঢ় নিস্তব্ধতায় তুলি দিয়ে আঁকা হয়ে যায়।
দারিদ্রে লালিত, আজন্ম বস্তুসুখে বঞ্চিত মেয়েটি যেন এক আশ্চর্যময়ী। সে দুয়ারের ভিখারিকে ভিক্ষা দেয় পিছনপানে সংকটের দিকে তাকাতে তাকাতে, মৃদু ভীত, অপারগ, যে সমস্যাগুলি সে এখনও পুরোপুরি বোঝে না, তাকে বুঝছে কিন্তু বুঝছে না… পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে ভাইয়ের গুরুত্ব বেশি সে জানে। অপুকে আদর করে পাঠশালায় পাঠানো হয়, সর্বজয়ার স্পষ্ট পক্ষপাতিত্ব তার দিকে। চিত্র-সমালোচক রবিন উড তাঁর বিশ্ববিখ্যাত ‘অপু ট্রিলজি’ গ্রন্থে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, ঝগড়াঝাঁটির সময় সর্বজয়া প্রতিবারই নির্দ্বিধায় ছেলের পক্ষ নেয় (চুরির অভিযোগের সময় ছাড়া); ভাইবোনের যখন পয়সার দরকার হয়, যেমন বাক্স-বায়োস্কোপের খেলা দেখার জন্য, দুর্গা অপুকেই পাঠায় হরিহরের কাছে। তার ছোট্ট সম্পত্তিটিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে একটি স্থায়ী ক্রমবর্ধমান সমস্যাকে তীব্রতর করে তোলা হয়। দুর্গাকে চুল ধরে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে নিয়ে গিয়ে বাইরে বের করে দেওয়ার দৃশ্যে সমান্তরাল রেখায় পড়ে থাকে চুরি করা ফলগুলি।
দুর্গাদের ভবিতব্য যেন কালক্রমে ইন্দিরে পরিণত হওয়া। তাদের গভীর নৈকট্য কী করে পর্দায় এঁকে দিল ছোট দুর্গার রেশ ধরে ‘উমা’ নামের বালিকা? সর্বজয়ার দুর্গাকে মারার দৃশ্যের পরই দেখা যায় ইন্দির দুর্গার ছড়িয়ে ফেলা সম্পত্তি কৌটোয় তুলে রাখছে!
সেই আশ্চর্য ভাঙা দেওয়াল। এমন গ্রাফিক কম্পোজিশন যেন স্বপ্নের নির্মাণ। মার খেয়ে দেয়ালের বাইরে দুর্গা কাঁদতে কাঁদতে আর খোঁড়াতে খোড়াতে চলে যায়। দরজার পিছনে, অর্থাৎ পর্দার ডানদিকে, সর্বজয়াও কান্নায় ভেঙে পড়ে। রবিন উড দেখিয়েছেন যে ঠিক যেভাবে দৃশ্যটি দ্বিধাবিভক্ত, দর্শকের সমবেদনাও সেই ভাবে বিভাজিত হয়ে যায়।
মৃত্যুদৃশ্যের পাশাপাশি আরও কয়েকটি অবিস্মরণীয় দৃশ্যে উমা দাশগুপ্তের অভিনয় স্মরণ করা যাক। হরিহরের কাছে লেখাপড়া করার দৃশ্যে দূরে অন্ধকারে ট্রেনের শব্দ শোনা যায়, যা এক অকল্পনীয় প্রগতির চিহ্ন বয়ে আনে। পিসি ছুঁচে সুতো পরাতে গিয়ে ব্যর্থ হচ্ছে (একটি প্রজন্মের ব্যর্থতার ইঙ্গিত), মা দুর্গার চুল বেঁধে দিচ্ছে। অপু দুর্গাকে জিগ্যেস করে, ‘একদিন (রেলের লাইন দেখতে) যাবি?’ ফলে ওই ব্যর্থতা আর ট্রেনের দূরাভাস অপুর শিক্ষার সঙ্গে জড়িয়ে গেল। যাত্রা দেখা, দুর্গার কৌটো থেকে অপুর রাংতা চুরি করে মুকুট বানানো, ভাইবোনে ঝগড়া, দুর্গার আড়ি করা, গাছগাছালি পেরিয়ে ফাঁকা মাঠের দিকে দৌড়ে যাওয়া, টেলিগ্রাফের তারের ঝনঝনানির সামনে দুর্গার অনিশ্চয়তা। বর্তমান উত্তেজনাকে শিথিল করে দিয়ে পর্দা ঢেকে দেওয়া ট্রেন, একদিন যার নীচে আত্মহত্যা করতে যাবে অপু।
ট্রেন দেখে ভাইবোনের ফেরার পথে পিসির মৃত্যুদৃশ্য। সঙ্গে একটি বাছুর। পিসি বাঁশবনে বসে, সাউন্ড-ট্র্যাকে শিশুদের হাসির শব্দ। দুর্গা গুঁড়ি মেরে অপুর দিকে যায়, তাকে ঝাঁকায়, অপু দাঁত বের করে হাসে। পিসি হঠাৎ উপুড় হয়ে পড়ে, জলের ভেতরে গড়িয়ে পড়ে ঘটি। আমরা দেখি, উঠে দাঁড়ানো দুর্গা-রূপী উমা দাশগুপ্তের মুখ। এ কী অভিনয়, না চলন্ত ভাস্কর্য?
বৃষ্টিতে ভেজার দৃশ্যে চুল খুলে জলকে ধারণ করে নেওয়া উমা দাশগুপ্ত যেন আবহমান উন্মীলিয়মান এক প্রতিমা। গাছের নীচে বসে সে অপুকে আঁচলে জড়িয়ে নেয়। এ তো জীবনের এমবস করা ছবি, যা আমৃত্যু মনে রাখব আমরা।
নীচু হয়ে সেই শিল্পরস মনের আঁজলায় এই সমস্ত আশ্চর্য প্রতিমাকে তুলে নিতে গিয়ে দেখি, ভাইকে নিয়ে লোভাতুর দুর্গা মিষ্টিওলার পিছনে পিছনে ছুটেছে। সঙ্গে কুকুরটি। ছবি এমন শিল্পগাথায় উত্তীর্ণ হয়েছে কখনও চলচ্চিত্রের ইতিহাসে? হয়তো কয়েক বার, তার বেশি নয়।
এখনও শুনতে পাচ্ছি, দুর্গার গলায়,
‘পুণ্যিপুকুর পুষ্পমালা।
কে পুজে রে দুপুর বেলা?
আমি সতী লীলাবতী,
ভাইয়ের বোন– পুত্রবতী।’…
দেখতে পাচ্ছি, রাণুর বিয়ের আসরে দুর্গার উদাসী দৃষ্টিতে বিষণ্ণতার দীপাঞ্জনরেখা।