চলচ্চিত্রকার হিসেবে ঋত্বিক ঘটক ও মৃণাল সেনকে উৎপলেন্দু শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু তাঁর প্রাণের প্রিয় ছিল সত্যজিৎ রায়। যদি আমরা ‘চোখ’ ছবিটি দেখি, তাহলেই বুঝব– ইতিমধ্যেই ১৯৮০ সালে সত্যজিৎ রায় সমাপ্ত করেছেন ‘সদগতি’। সদগতি ছবির যে গ্রোথ, তাকেই রাজনৈতিক উচ্চাশা দিয়ে চোখ-এ পরিণত করেন উৎপলেন্দু। ‘সদগতি’-তে ওম পুরী ও স্মিতা পাতিলের যা অভিনয়, তা প্রায় হুবহু শ্রীলা মজুমদার এবং ওম পুরী অনুকরণ করেন চোখ-এ। উৎপলেন্দু সত্যজিৎ রায়ের সংগীত নিয়ে ১৯৮৪ সালে যে তথ্যচিত্রটি করেন, তাও সত্যজিৎ রায়ের প্রতি একরকম অর্ঘ্য।
উৎপলেন্দু চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় মতিলাল নেহেরু রোডে মৃণাল সেনের বাড়ির দোতলায়। এই তরুণ, সেদিন ‘ময়নাতদন্ত’ নামে একটি গল্প, মৃণাল সেনকে পড়াতে এসেছিলেন। মৃণাল সেনের ইচ্ছে সেই ছবিটি করার। কিন্তু উৎপলেন্দুর আরও একটু উচ্চাশা ছিল। তিনি আরও একটি গল্প এনেছিলেন– ‘প্রসবনাগ’– যেখানে এক মহিলা একটি অবরুদ্ধ গ্রামে শেষ পর্যন্ত একটি রাইফেল ও রেডবুক প্রসব করেন। বলা বাহুল্য, মৃণাল সেন সেই উগ্র রাজনৈতিক মন্তব্য সিনেমায় শুনতে রাজি ছিলেন না। তিনি এই গল্পের নিষ্পত্তিকে ‘অবাস্তব’ মনে করেন। এবং সেটি উৎপলেন্দুকে জানান। কিন্তু ‘ময়নাতদন্ত’ করার ব্যাপারে তাঁর উৎসাহ ছিল। তিনি ভেবেছিলেন, কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদান পাবেন। তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী ইন্দ্রকুমার গুজরাল জানান যে, ক্ষুধার মৃত্যু ভারতীয় সংবিধান অনুবিদিত নয়, তাই এই সাংস্কৃতিক অনুদান দেওয়া সম্ভব হবে না। মৃণাল সেন সেই প্রস্তাব বাতিল করে দেন। ফলে উৎপলেন্দুকেই ’৮০ সালে ‘ময়নাতদন্ত’ বানাতে হয়। এবং সে ছবি আমাদের রাজনৈতিক ছবির জগতে একধরনের প্রত্যক্ষ, রৌদ্রমুখর মন্তব্য হিসেবে বিবেচিত হয়।
এখন উৎপলেন্দু সম্বন্ধে আমরা যখন কথা বলতে যাই, তখন দেখি, ভারতীয় চলচ্চিত্রে গৌতম ঘোষ, উৎপলেন্দু চক্রবর্তী, খানিকটা বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, বিপ্লব রায়চৌধুরী– এঁরা প্রত্যেকেই বামফ্রন্টে রাজনীতি শুরু হলে এমন এক ধরনের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাযুক্ত রাজনৈতিক ছবি শুরু করেছিলেন, যা মৃণাল ও ঋত্বিক-উত্তর যুগের বৈশিষ্ট। যেমন, ‘ময়নাতদন্ত’-এর ক্ষেত্রে উৎপলেন্দু নিজেই লিখেছেন, ‘সিনে ক্লাব অব আসানসোল’-এর প্রথম সংখ্যা ‘সেলুলয়েড’ পত্রিকায়, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের ত্রাণ না পেলে এই ছবি শেষ করা অসম্ভব ছিল। পরবর্তীকালে ‘চোখ’ পশ্চিমবঙ্গ সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত। উৎপলেন্দুর অন্য ছবি ‘দেবশিশু’ তাও ‘এনএফডিসি’র অনুদানে। কিন্তু যেটা প্রাক-উদারীকরণ পর্বে সরকারি প্রচেষ্টার বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, যে তখনও পর্যন্ত চলচ্চিত্র জগতে একধরনের সাংস্কৃতিক ঔদার্য ছিল। যার ফলে বিপ্লব রায়চৌধুরির ‘শোধ’, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ‘নিম অন্নপূর্ণা’ এবং উৎপলেন্দুর এইসব ছবি তৈরি হতে পারে। ‘চোখ’ ছবিটি থেকে আমরা যদি ‘ময়নাতদন্ত’ ছবিটির দিকে তাকাই, তাহলে দেখব আশ্চর্য বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে আজকে এই শব্দটি। কলকাতার রাজপথ এখন এই শব্দটিকে নিয়ে উদ্বেলিত! উৎপলেন্দু নিজে শ্রমজীবী সমাজের সঙ্গে মিশতেন বলে, এই যে ময়নাতদন্তের বিষয়টা এবং ময়নাতদন্ত সত্য ও মিথ্যার মধ্যে কোন অবস্থান দিতে পারে, এবং কেন ন্যায়– এই বিষয়টিতে মন্তব্য করেছিলেন তা হয়তো যথেষ্ট শিল্পসংগত নয়, কিন্তু আমি বলবই এইরকম অকুতোভয় অবস্থান ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের জানা ছিল না। ‘চোখ’ ছবিতে তিনি পাটকলের যে দুর্দশা এবং যদুনাথের যে ভূমিকা রচনা করেছিলেন, তাতে আমরা একই রকম জিনিসের অনুবর্তন দেখি। ‘দেবশিশু’ সামাজিকভাবে সরাসরি আঘাতের পক্ষপাতী। অর্থাৎ, ঋত্বিক ঘটকের ছবিতে যা দার্শনিকতায় ঘেরা, মৃণাল সেনের ছবিতে যা অপ্রত্যক্ষ– তা কিন্তু গৌতম ঘোষ তার ‘হাংরি অটাম’ বা ‘দখল’-এ, উৎপলেন্দু চক্রবর্তী তাঁর ‘চোখ’ ও ‘দেবশিশু’তে, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘নিম অন্নপূর্ণা’ ছবিতে ও বিপ্লব রায়চৌধুরির ‘শোধ’ ছবিতে অকপটে বিবৃত করেছিলেন।
চলচ্চিত্রকার হিসেবে ঋত্বিক ঘটক ও মৃণাল সেনকে উৎপলেন্দু শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু তাঁর প্রাণের প্রিয় ছিল সত্যজিৎ রায়। যদি আমরা ‘চোখ’ ছবিটি দেখি, তাহলেই বুঝব– ইতিমধ্যেই ১৯৮০ সালে সত্যজিৎ রায় সমাপ্ত করেছেন ‘সদগতি’। সদগতি ছবির যে গ্রোথ, তাকেই রাজনৈতিক উচ্চাশা দিয়ে চোখ-এ পরিণত করেন উৎপলেন্দু। ‘সদগতি’-তে ওম পুরী ও স্মিতা পাতিলের যা অভিনয়, তা প্রায় হুবহু শ্রীলা মজুমদার এবং ওম পুরী অনুকরণ করেন চোখ-এ। উৎপলেন্দু সত্যজিৎ রায়ের সংগীত নিয়ে ১৯৮৪ সালে যে তথ্যচিত্রটি করেন, তাও সত্যজিৎ রায়ের প্রতি একরকম অর্ঘ্য। আমাদের মনে করতেই হবে, তিনি তাঁর আগের বছর ১৯৮৩ সালে দেবব্রত বিশ্বাসের সংগীত নিয়েও তথ্যচিত্র রচনা করেন। সবথেকে বড় কথা জনপরিসরে কিন্তু তিনি এই ছবিগুলোর জন্য পরিচিত নন।
আমার সঙ্গে তাঁর দ্বিতীয়বার দেখা হল, তখন সবে বামফ্রন্ট সরকার এসেছে। একদিন টিফিনের সময় উৎপলেন্দু আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন ওঁর ‘মুক্তি চাই’ তথ্যচিত্রটি দেখানোর জন্য। এই যে তথ্যচিত্রটি, অনেক সময় তারেক মাসুদের ‘গানের কথা’ স্মরণ করিয়ে দেয়। বস্তুত এই ছবিটাই তৎকালীন সরকারকে বন্দিমুক্তির একটা খসড়া তৈরি করতে সাহায্য করেছিল। ‘মুক্তি চাই’ যে কত জায়গায় দেখানো হয়েছে– বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনে, ছাত্রদের মাঝখানে, শ্রমিক মহল্লায় এবং অনেক সময় অফিসেও। এই ‘মুক্তি চাই’-এর সূত্রেই উৎপলেন্দুর নাম ছড়িয়ে পড়ে। উৎপলেন্দু সে-অর্থে আমার মতো অজ্ঞাতকুলশীল নন। উৎপলেন্দুর মামা ছিলেন স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য—– যিনি ‘ছিন্নমূল’ চিত্রনাট্যের রচয়িতা এবং আইপিটিএ-র বিখ্যাত সাহিত্যিক। উৎপলেন্দুর দাদা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের স্বনামখ্যাত অধ্যাপক দীপেন্দু চক্রবর্তী। ফলে আমাদের বন্ধুত্ব একধরনের আক্রমণ-প্রতিআক্রমণের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। উৎপলেন্দু মনে করতেন না যে সমসময় আমি তাঁর রাজনীতিকে সমর্থন করছি, আমিও মনে করতাম না যে উৎপলেন্দু আমার প্রতি সুবিচার করছে।
…………………………………………………..
আরও পড়ুন উৎপলেন্দু চক্রবর্তী-কে নিয়ে লেখা: জেলের মধ্যে ওম পুরীকে সত্যিই আসামি বানিয়ে তুলেছিল উৎপলেন্দু
…………………………………………………..
শেষ করছি একটা ব্যক্তিগত স্মৃতি দিয়ে। একদিন উৎপলেন্দুর সঙ্গে দেখা। হঠাৎই। তিনি আমার দিকে তর্জনী-নির্দেশ করে বললেন যে, ‘আপনি এত বলেন, লেখেন, আমার ওপর তো কোনও দিন লেখেননি কিছু?’ আমি লজ্জিত হয়ে বলেছিলাম, ‘সবসময় তো সুযোগ পাওয়া যায় না।’ কিন্তু সুযোগ এল। কয়েক দিন বাদেই একেবারে আকস্মিক! যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা একটা চলচ্চিত্র উৎসবের বক্তব্য রাখার জন্য আমাকে নেমন্তন্ন করেছিল। আমি তাতে বললাম, আমার বদলে উৎপলেন্দু চক্রবর্তী– অনেক উপযুক্ত নাম হবে, তাঁকে তোমরা বলো। ছাত্ররা আমার কাছ থেকেই ফোন নাম্বার নেয়, এবং ওঁকে বলে। উৎপলেন্দু খুবই খুশি হন। সেই অনুষ্ঠানে আসে এবং ছাত্ররা আমাকে জানায়, ‘স্যর, আমরা ওঁকে শুধু উদ্বোধনী বক্তৃতা দিতে বলেছিলাম, কিন্তু উনি আমাদের সঙ্গে থেকে গেলেন সারা বিকেল পর্যন্ত। এমনকী, ভাড়া করা ট্যাক্সিতে ওঠার আগে আমাদের বললেন, ‘ভারি ভালো লাগল। এই বিকেলটা, এই দিনটা অন্যরকম।’
অন্যরকম ছিল সত্তর দশক। স্বপ্ন দেখেছিলাম আমরা। সেই স্বপ্নগুলো ক্রমশই শুকিয়ে যাচ্ছে। উৎপলেন্দুর চলে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে আগুন আরও স্তিমিত হয়ে গেল।
……………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার.ইন
……………………………………..