কবি তিলোত্তমা বসু– সুনীল বসুর কন্যার সৌজন্যে রোববার.ইন-এর হাতে এসেছে সুনীল বসুকে লেখা বুদ্ধদেব বসুর অপ্রকাশিত একটি চিঠি। চিঠিটি ২৮ অক্টোবর, ১৯৫৬ সালের। এক তরুণ কবির প্রতি কী মায়া ও যত্ন নিয়ে বুদ্ধদেব চিঠি লিখছেন, তা এত বছর পরেও কোনও তরুণ কবি-লেখককে উদ্দীপ্ত করতে পারে। বিশ্ব কবিতা দিবসে, বুদ্ধদেব বসুর লেখা অপ্রকাশিত এই চিঠিটি রইল রোববার.ইন-এর পাঠকদের জন্য। প্রচ্ছদের বাঁদিকে বুদ্ধদেব বসু, ডানদিকে সুনীল বসু।
প্রচ্ছদ: দীপঙ্কর ভৌমিক
কবি সুনীল বসু। পঞ্চাশের কবি। ১৯৩০ সালের, ৩১ বৈশাখে জন্মছিলেন যশোরে, তৎকালীন পূর্ব-বাংলায়। প্রিয় কবিতা কবে, কোথায় রচিত– এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানিয়েছিলেন: ‘নিজের তিনতলার চিল্কুঠুরিতে। বেলা ১২টার সময়। গ্রীষ্মকাল। তখন খিদেয় নাড়ি চোঁ চোঁ করছিল। স্নান করিনি, ভাত খাইনি। মনে মনে আমি সারা পৃথিবীতে ঘুরি। নিজেকে কখনো কখনো নিষ্ঠুর দস্যু ভাবতে খুব ভালো লাগে।’
‘হৃদপিণ্ডে দারুণ দামামা’ কাব্যগ্রন্থর বিজ্ঞাপনে লেখা হয়েছিল: ‘সুনীল বসু– এই নামের মানুষটি ও কবির মধ্যে একটি দ্বৈত চরিত্র আছে। এক দিকে অতি শান্ত ও লাজুক এবং নম্র সঞ্চারী, প্রকাশ্যে নিজেকে প্রকট করার চেয়ে ইনি ভিড়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকতে ভালোবাসেন। আবার যখন ইনি একা, যখন নিজের মুখোমুখি, তখন ইনি দুর্দান্ত ও প্রগল্ভ, একই সঙ্গে ইনি রূপের পূজারী ও লুণ্ঠনকারী, দুনিয়ার সমস্ত অন্যায়ের প্রতি ছুড়ে দেন উপহাস। এঁর হাতে রয়েছে শব্দের রাজদণ্ড, কবিতার মধ্যে ইনি কল্পনা-সাম্রাজ্যের অধীশ্বর। সুনীল বসুর কবিতার এমন স্বাদ আছে, যা আর কোনো কবি আমাদের আগে উপহার দিতে পারেননি। এই কবি যেন কখনো এক দুরন্ত বেদুইন, কখনো জলদস্যু। কখনো যেন রয়েছেন বিশ্বের সবচেয়ে দুঃসাহসী অভিযানের পুরোভাগে, যে-কোনো রকমের মায়াময় পরিবেশ রচনায় উনি সিদ্ধহস্ত।’
আজকে, এই ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে সুনীল বসুর কবিতা তেমন পঠিত হয় না। তাঁর কবিতা ফিরে পড়া প্রয়োজন, এ আমাদের বিশ্বাস। বুদ্ধদেব বসুর তাঁর কবিতা পত্রিকায় অনেকবারই সযত্নে প্রকাশ করেছেন সুনীল বসুর কবিতা। সম্পাদক বুদ্ধদেব বসু এবং কবি সুনীল বসুর সম্পর্ক কীরকম? বিমল কর তাঁর ‘আমার কালের তরুণ লেখক বন্ধুরা’য় জানিয়েছিলেন, ‘কত সময় সুনীলকে খ্যাপাবার জন্য নানান মজার কথা বলেছি বুদ্ধদেবের লেখা নিয়ে। সুনীল কিন্তু একলব্য।’
……………………………………………………………
কল্যাণীয়েষু,
২৮.১০.১৯৫৬
তোমার চিঠিখানা প’ড়ে আনন্দ পেয়েছি। জীবনের নানা অনিশ্চয়তার মধ্যে আমাকে তুমি মাঝে-মাঝে স্মরণ করো, এতে তোমারই স্নেহের পরিচয় পাই– কিন্তু এ-কথা ভাবতে খারাপ লাগে যে বিনিময়ে তোমার জন্য আমি কিছুই করতে পারি না। আমি, পঞ্চাশ হ’তে যার বেশি দেরি নেই, নানারকম কাজে, অকাজে ও নিজের অক্ষমতার চেতনায় যে নিরন্তর নিপীড়িত, যার বহু উজ্জ্বল পরিকল্পনা একে-একে ম্লান হ’য়ে ঝ’রে পড়ছে, অথচ যাকে– নেহাৎই সে বেঁচে আছে ব’লে– অনবরত কিছু-না-কিছু করে যেতেই হয়: সেই আমি তোমার যৌবনকে কী সান্ত্বনা দিতে পারি? যা-কিছু আমি বলতে পারি, সবই উপদেশের মতো শোনাবে: এবং উপদেশের চাইতে হাস্যকর প্রগল্ভতা আর-কিছু নেই– বিশেষত বয়স্ক মানুষের মুখে। শুধু এই কথাটি ভেবো যে তোমার এখনও যৌবন আছে, প্রকৃতির সমস্ত শক্তি এখনও তোমার সপক্ষে কাজ করছে, আর তারই জন্যে এত প্রবল তোমার সান্ত্বনার প্রয়োজন– যারা ঈশ্বরের দ্বারা লালিত হয় তুমি এখনও তাদেরই দলে, কোনো মানুষের কাছে সান্ত্বনা না পেলেও কামাখ্যা আদ্যাশক্তি তোমার সহায়। তোমাকে আমি যেমন বুঝি, তেমনি তাদেরও বুঝতে পারি, যারা জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তাদের সব আশার ধ্বংসস্তূপের সম্মুখীন হয়েছে, যাদের শ্বেতকেশ আর কুঞ্চিত চর্ম সকল সম্ভব সহানুভূতির শত্রুতা করে, যাদের মুখে দুঃখের কথা বিসদৃশতার পরাকাষ্ঠা, আর তাদের চাইতে স্বভাবত অনেক বেশি সবল মানুষেরা যাদের উপর নির্ভর ক’রে আছে! তাদের অবস্থাটা আমি তোমাকে ভাবতে বলবো না– তা আপাতত তোমার ধারণার বাইরে থেকে যাবে, সেটাই জীবনের বিধান। কিন্তু নিজের অবস্থাটাই আর একবার ভেবে দেখতে বলবো তোমাকে– সেখানে কোনো সম্পদ আছে কি না যাকে তুমি চিনতে পারছো না, কিংবা কোনো শক্তির উৎস, যাকে তুমি উপেক্ষা করছো। আর আমার অনেক শুভকামনা গ্রহণ করো।
রুমি, পাপ্পার তোমাকে মনে আছে; এখানে যাদের সঙ্গে তোমার আলাপ হয়েছিল সেই যুবকদের সকলেই এখানে ঘন-ঘন আসে না আজকাল, কিন্তু তুমি একদিন সময় ক’রে যদি আসতে পারো তো সকলেরই ভালো লাগবে। ‘কবিতা’-র একটি নতুন সংখ্যা তোমাকে পাঠালাম– কবিতায় তোমার স্বাদ চলে গেছে এ-কথাটা ঠিক বলোনি, মাঝে-মাঝে ও-রকম অবস্থা আমাদের সকলেরই হয়, কিন্তু সময়মতো সবই ফিরে আসে। তুমি সকালে সন্ধ্যায় কাজ করছো– এটা সুখবর। কাজটাকে বন্ধন মনে হয় এক-এক সময়, কিন্তু কাজ ছাড়া মুক্তিও নেই।
বুদ্ধদেব বসু
মনে আছে, গ্লেনারিজে একটা টেবিলে বসে, বই পড়ছিলাম। একটা মেয়ে এসে বলল, ‘তুমি কি একা? তাহলে একটু বসি তোমার সঙ্গে?’ জানতে পারলাম, মেয়েটি মুম্বইয়ে থাকে। সিনেমাটোগ্রাফার। এবং হাতে কোনও কাজ নেই– বেকার। আমিও বললাম, আমি অভিনেত্রী, হাতে কোনও কাজ নেই, আপাতত আমিও বেকার!