বিদ্যাসাগর পরপর প্রকাশ করলেন ‘বর্ণপরিচয়’, ‘কথামালা’, ‘বোধোদয়’, ‘ঋজুপাঠ’। ‘বর্ণপরিচয়’-এর জন্ম ১৮৫৫-এর এপ্রিল মাসে। বলা যেতে পারে এই মাসে, ২০২৪ সালে, ‘বর্ণপরিচয়’ ১৭০-এ পড়ল। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বিদ্যাসাগরের পরম বন্ধু। বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ দেখে দেবেন্দ্রনাথের ভারি আহ্লাদ ও গর্ব হল। তিনি শিশু রবীন্দ্রনাথকে কিনে দিলেন ‘বর্ণপরিচয়’। রবীন্দ্রনাথ পড়তে লাগলেন: বড় গাছ। ভাল জল। লাল ফুল। ছোট পাতা। জল পড়ে। পাখি ডাকে। পাতা নড়ে।
১৮৪৯ সাল। প্রকাশিত হল মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ‘শিশুশিক্ষা’র প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ। তৃতীয় ভাগ বেরল পরের বছর। বন্ধু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাতে এল এইসব বই, পরপর। এ কী কাণ্ড ঘটিয়েছে মদন! ভাবলেন ঈশ্বর। খোঁজ নিলেন, মদনের বই কেমন বিক্রি হচ্ছে। জানলেন তিনি, মদনমোহনের ‘শিশুশিক্ষা’র তিনটি ভাগই বাজার মাতিয়েছে। আহা! বাজার মাতাবে না কেন? কী অসাধারণ সহজ সরল বাংলা ছড়া লেখেন মদন:
‘পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল
কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিল!’
আর মদন ‘শিশুশিক্ষা’য় ‘ক খ দ ধ’ বর্ণপরিচয় শিখিয়েছেন কীভাবে? ঈশ্বরচন্দ্র বিস্মিত মদনের বই পড়ে:
ক : কটু বাক্য নাহি কবে।
খ : কুকাজে অখ্যাতি হবে।
দ : বিদ্যাধন আছে যার।
ধ : সকলি সুসাধ্য তার।
বন্ধু মদনমোহনের বইগুলি হাতে ধরে বিস্মিত ঈশ্বরচন্দ্র ভাবতে বসলেন। এবং মদনমোহনের ‘শিশুশিক্ষা’র ছ’বছর পরে বাজারে এলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, তাঁর ‘বর্ণপরিচয়’ এবং ‘কথামালা’ নিয়ে। এবং অবশ্যই বাজার মাতালেন! কিন্তু আজকের বাঙালির ক’জন মনে রেখেছেন মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে, যিনি ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ব্রিলিয়ান্ট ক্লাসফ্রেন্ড কলকাতার সংস্কৃত কলেজে? এবং শিশুশিক্ষার জগতে নতুন ভাবনার প্রথম ঢেউটিও তোলেন মদনমোহন-ই! বঙ্গদেশে শিশুশিক্ষার প্রথম পুরুষ তিনিই।
এখানে মদনমোহনের সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্রের মূল পার্থক্যটাও ছোট করে বলে রাখি। মদনমোহন বঙ্গদেশে শিশুশিক্ষার পায়োনিয়ার হয়েও হেরে গেলেন। পারলেন না যুগনায়ক হতে। তিনি কবি ও রোম্যান্টিক। ঈশ্বরচন্দ্র মেশাতে পেরেছিলেন প্রজ্ঞার সঙ্গে বাস্তববোধ। শিক্ষার সঙ্গে বাণিজ্য। শিক্ষার সঙ্গে বাণিজ্য মেশানোর প্রথম ফল ঈশ্বরচন্দ্রের অসামান্য কীর্তি, ‘জটিল সংস্কৃত ব্যকরণ মুগ্ধবোধ’-এর পরিবর্তনে ‘উপক্রমনিকা’। তারপর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাজার জয় করলেন অসামান্য ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’ প্রকাশ করে, যার কোনও বিকল্প আজও লেখা হয়নি।
বিদ্যাসাগর পরপর প্রকাশ করলেন ‘বর্ণপরিচয়’, ‘কথামালা’, ‘বোধোদয়’, ‘ঋজুপাঠ’। ‘বর্ণপরিচয়’-এর জন্ম ১৮৫৫-এর এপ্রিল মাসে। বলা যেতে পারে এই মাসে, ২০২৪ সালে, ‘বর্ণপরিচয়’ ১৭০-এ পড়ল। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বিদ্যাসাগরের পরম বন্ধু। বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ দেখে দেবেন্দ্রনাথের ভারি আহ্লাদ ও গর্ব হল। তিনি শিশু রবীন্দ্রনাথকে কিনে দিলেন ‘বর্ণপরিচয়’। রবীন্দ্রনাথ পড়তে লাগলেন: বড় গাছ। ভাল জল। লাল ফুল। ছোট পাতা। জল পড়ে। পাখি ডাকে। পাতা নড়ে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
একথা ঠিক, আমরা কেউই রবীন্দ্রনাথ নই। ছেলেবেলায় বর্ণপরিচয় পড়তে-পড়তে আমাদের কারও চৈতন্যেই জল পড়েনি, পাতা নড়েনি। কেউই হয়তো বিদ্যাসাগরের ‘সীতার বনবাস’ পড়ে বালককালে বেদনায় অভিভূতও হইনি, যেমন হয়েছিলেন বালক রবীন্দ্রনাথ।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
ঈশ্বরচন্দ্রের বর্ণমালায় এসব আমরা খুব ছেলেবেলায় পড়েছি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বৃদ্ধবয়সে এই বর্ণমালা পড়ার অভিজ্ঞতার কথা দেখতে গিয়ে তাঁর আত্মজীবণীতে লিখলেন, ‘কেবল মনে পড়ে, জলে পড়ে, পাতা নড়ে।’ আমার জীবনে এইটেই আদি কবির প্রথম কবিতা, লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। আর লিখেছেন ‘বর্ণপরিচয়’ সম্বন্ধে তাঁর এই একান্ত আত্মকথা: ‘সেদিনের আনন্দ আজও যখন মনে পড়ে তখন বুঝিতে পারি, কবিতার মধ্যে মিল জিনিসটার এত প্রয়োজন কেন। মিল আছে বলিয়াই কথাটা শেষ হইয়াও শেষ হয় না। তাহার বক্তব্য যখন ফুরায় তখন তাহার ঝংকারটা ফুরায় না, মিলটাকে লইয়া কানের সঙ্গে জলের সঙ্গে খেলা চলিতে থাকে। এমনি করিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া সেদিন আমার সমস্ত চৈতন্যের মধ্যে জল পড়িতে ও পাতা নড়িতে লাগিল।’
ভাবলে দুঃখ হয়, এমন একখানি বই আমরা আজ বাঙালির শৈশব থেকে কেড়ে নিয়েছি। এবং আমরা ভেবে দেখি না, কোন অপরাধে ‘বর্ণপরিচয়’ পড়ার আনন্দ থেকে বাঙালি শিশুকে আমরা বঞ্চিত করলাম?
একথা ঠিক, আমরা কেউই রবীন্দ্রনাথ নই। ছেলেবেলায় বর্ণপরিচয় পড়তে-পড়তে আমাদের কারও চৈতন্যেই জল পড়েনি, পাতা নড়েনি। কেউই হয়তো বিদ্যাসাগরের ‘সীতার বনবাস’ পড়ে বালককালে বেদনায় অভিভূতও হইনি, যেমন হয়েছিলেন বালক রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু প্রশ্ন তবু থেকেও যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’, ‘কথামালা’, ‘সীতার বনবাস’, ‘শকুন্তলা’, ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ না-পড়ে যে বাঙালি বড় হয়েছে, সে কি বাঙালি? বহিরাগত নয়?