২০০৮-এ থলয় সাগর জয় করা অবশ্য আমার কাছে এ জীবনের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ছিল। এমনকী, এভারেস্ট জয়ের থেকেও বেশি। ১৯৯৯ সালে থলয় সাগরের পাশেই ভৃগুপন্থ যখন আরোহণের চেষ্টা করি, তখন কিছুতেই থলয় সাগরের শৃঙ্গের দিকে তাকাব না সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। বারবার মনে করতাম যে ওটা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়, শুধু বিদেশিরাই ওটা পারবে। বহু বিদেশি মানুষের সঙ্গে পর্বতারোহণ করেছি। প্রায় বিশ্বজোড়া ক্লাইম্বারদের সঙ্গে সহযাত্রী হয়েছি, কিন্তু ভারতীয় পর্বতারোহীদের পারদর্শিতা ও আবেগ আলাদা। আমরা মানসিকতায় অনেক অনেক এগিয়ে।
আমি কোনও দিন ভাবিইনি যে, পর্বত আরোহণ করব। আমি না, পাহাড়ই আমাকে বেছে নিয়েছিল। নইলে কেউ ২৮ বছর বয়সে প্রথম পাহাড়ে অভিযান করে? ওই যে একবার অভিযাত্রীর চোখে পাহাড় দেখলাম, তারপর ওই চোখ আর ছাড়তে পারলাম না।
সেই সময় আমি ছবি তুলতাম। সেই সুবাদেই কৃষ্ণনগরের মাউটেনিয়ারিং ক্লাবের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। ওদের সঙ্গে সেই যে জুড়ে গেলাম, আজও সেখানেই পড়ে রয়েছি। ওদের সঙ্গে রক ক্লাইম্বিং, ট্রেকিং করে, তারপর মাউন্টেনিয়ারিংয়ের কোর্স শুরু করলাম। ততদিনে বুঝে গেছি পাহাড় থেকে আমার নিস্তার নেই। এর আগে তো আমি জানতামই রক ক্লাইম্বিং কী, ট্রেকিং-ই বা কী! সে সময়ে পাহাড় এতটাও চর্চিত বিষয় ছিল না। আমি মফসসলের মানুষ, পাহাড় ও অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস সম্পর্কে ধারণা আরওই ছিল না আমার কাছে। শুশুনিয়াতে প্রথম রক ক্লাইম্বিং কোর্স করলাম। পাঁচ দিনের ট্রেনিং। ওই পাঁচ দিনের ক্যাম্প লাইফ, ওই নিয়মানুবর্তিতা, ওই সহ-পথিকের সঙ্গে সম্পর্ক– এগুলো দেখে অভিভূত হয়ে গেছিলাম। মনে হল এমন একটা জীবন হলে মন্দ হয় না! ওখান থেকে আমার পাহাড়ি জীবন শুরু। তারপর এক বছর পরে হিমালয়ে ট্রেকিং। দু’বছর ট্রেকিং করলাম হিমালয়ের বিভিন্ন পথে। তারপর এসে পড়ল মাউন্টেনিয়ারিং-এর ট্রেনিংয়ের সময়।
উত্তরকাশীর ‘নেহেরু ইন্সটিটিউট অফ মাউন্টেনিয়ারিং’-এ প্রাথমিক কোর্স করি। ১৯৮৯ সালে। সেই কোর্সে ভালো ফল করলে অ্যাডভান্স কোর্স করা যায়। সেটাও করলাম। ট্রেনিং হল গোমুখে। আইস ট্রেনিং, ক্লাইম্বিং ট্রেনিং– সব ওখানেই হল। ’৯০ সালে প্রথম অভিযানের ডাক আসে, হিমাচল প্রদেশে, নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সৌরীন ব্যানার্জি, যাঁর কাছে আমি মাউন্টেনিয়ারিং শিখেছিলাম। ’৯১ সাল থেকে কৃষ্ণনগর মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাবে নেতৃত্ব দিচ্ছি, এই ২০২৪ সাল পর্যন্ত। আমার বয়স এখন ৬৪, এই বছরও আমি দুটো শৃঙ্গ আহরণ করেছি– একটা হিমাচল প্রদেশে জাস্কর ভ্যালির কাছে, রামজাক শৃঙ্গ, ৬,৩১৮ মিটার। আমার সঙ্গে আরও পাঁচজন পর্বতারোহী ছিলেন। অন্যটা হল অরুণাচল প্রদেশে মাউন্ট গোরি চেন, ৬৪৮৮ মিটার। এটাতেও আমার ক্লাবের আরও চারজন ছিলেন। এই অক্টোবরের ২১ তারিখ গেছিলাম।
তবে প্রথম অভিযানের যে অভিজ্ঞতা ও রোমাঞ্চ, সেটা ভোলার নয়। কীভাবে অভিযানে যেতে হয়– সেই প্রথম গোটা পদ্ধতিটা জানলাম। সবচেয়ে উত্তেজনার সময়টা ছিল ম্যাপ দেখে রুট প্ল্যানিং করা। ম্যাপ দেখতে শেখাটাও খুব রোমাঞ্চের ছিল। তারপর রুট প্ল্যান হয়ে গেলে কতদিনের অভিযান দেখে রেশন ঠিক করা। এগুলো হাতে-কলমে সৌরীন ব্যানার্জির কাছে শিখেছিলাম। সেই অভিযানে শেষ পর্যন্ত আমি একাই গিয়েছিলাম। কিন্তু টেকনিক্যালি খুব কঠিন ছিল না অভিযানটা। তার পর থেকে আজ অবধি ৩৭টা অভিযান করেছি, তার মধ্যে ২৫টা ক্লাইম্ব করেছি। এর মধ্য়ে ছ’টা শৃঙ্গ দু’বার করে গিয়েছি। কারণ প্রথমবার পারিনি, ফিরে এসেছি। পরের বছর আবার চেষ্টা করেছি, পেরেছি। প্রথমদিকে যেসব অভিযান করেছি, সেগুলো স্বাভাবিকভাবেই ততটা জটিল নয়।
’৯৬ সালে কামেট আরোহণ করি। কামেট ভারতের উচ্চতম আরোহণযোগ্য শৃঙ্গ। কাঞ্চনজঙ্ঘা ভারতের উচ্চতম, কিন্তু ভারত দিয়ে তো ওঠা যায় না, নেপাল দিয়ে যেতে হয়। নন্দাদেবীও পবিত্র শৃঙ্গ, সেখানেও আরোহণ করা যায় না। যাই হোক, কামেটের গল্পে ফিরি। কামেট ৭৭৫৬ মিটার। বড় অভিযান এটা। মূল শিবিরের পরেও ছ’টা ক্যাম্প লাগাতে হয়। প্রায় ৪৫ দিনের অভিযান। কিন্তু পাঁচ নম্বর ক্যাম্প অবধি গিয়ে আমরা ফিরে আসি। এত বরফপাত হচ্ছিল যে আমাদের অধিকাংশ জিনিস ফেলে দিয়ে আসতে হয়। কারণ বরফের তলায় চাপা পড়ে গেছিল, অপেক্ষা করতে পারিনি, ফিরে এসেছিলাম। পরে আট মাসের মাথায় আবার বেরিয়ে পড়েছিলাম, সেটা ছিল এপ্রিল মাস। এবার পেরে গেলাম। এই যে পরেরবার পারলাম আরোহণ করতে, এটা আমার মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছিল। পর্বতারোহণ তো কখনও শারীরিক শক্তির ওপর নির্ভরশীল নয়, মূলত মনোবলই জরুরি হয়ে ওঠে। ফলে কামেট আমার প্রথম ভালো লাগা, প্রথম সাফল্য।
তারপর তো সেইসব শৃঙ্গগুলোকেই বাছতাম, যে শৃঙ্গগুলো দুর্গম, বা লোকে কম যায়, বা কখনও কেউ যায়নি। যেমন চৌখাম্বা ১, ভৃগুপন্থ, গঙ্গোত্রীর শিবলিঙ্গ। আমি যেসময়ে গঙ্গোত্রীতে ট্রেনিং নিচ্ছি, তখন একদল বিদেশি এসেছিল শিবলিঙ্গ আরোহণ করতে। সেই তখন আমার ইচ্ছে হয়েছিল শিবলিঙ্গ জয় করার। পরে যখন সত্যিই করতে পারলাম, তখন খুব গর্ব বোধ করেছিলাম। মনে হয়েছিল, জীবনের একটা বড় সাধ আমার মিটল।
২০০৮-এ থলয় সাগর জয় করা অবশ্য আমার কাছে এ জীবনের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ছিল। এমনকী, এভারেস্ট জয়ের থেকেও বেশি। ১৯৯৯ সালে থলয় সাগরের পাশেই ভৃগুপন্থ যখন আরোহণের চেষ্টা করি, তখন কিছুতেই থলয় সাগরের শৃঙ্গের দিকে তাকাব না সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। বারবার মনে করতাম যে ওটা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়, শুধু বিদেশিরাই ওটা পারবে। বিদেশিরা পর্বতারোহণের অনুমতি পেয়েছিল ১৯৭৯ সালে। তারপর থেকে ২০০৭ পর্যন্ত প্রায় ৭৫টা অভিযান হয় থলয় সাগরে। শুধু একটা দিক থেকে নয়, বিভিন্ন দিক থেকে চেষ্টা করা হয়েছিল। তার মধ্যে ১৫টা সফল হয়েছিল। কিন্তু আমি তো স্বপ্নটা দেখেছিলাম যে থলয় সাগরে আমি যাব, অনেকের মতো আমিও ভয় পেয়েছিলাম এই শৃঙ্গ আরোহণ করতে। কোন পথে যাব, সেটা নিয়েও নানা চিন্তা ছিল। তবে শেষমেশ পারলাম। ভারতীয়দের মধ্যে প্রথম প্রতিষ্ঠিত পর্বতারোহী হিসাবে।
তবে এভারেস্টের সৌন্দর্য আলাদাই। কত শুনেছি এভারেস্টের কথা, তারপর যখন সত্যিই দেখতে পেলাম নিজের চোখে, সে অনুভূতি প্রকাশ করা মুশকিল। কাঞ্চনজঙ্ঘা তো আমরা দূর থেকে দেখতেই অভ্যস্ত, দূর থেকে যে রূপ দেখা যায়, তাই অতুলনীয়। আমি আসলে কখনও ভাবিনি কাঞ্চনজঙ্ঘায় যেতে পারব বলে। অন্যদিকে অন্নপূর্ণা সবচেয়ে বিপজ্জনক শৃঙ্গ। একশোজন গেলে ৩৩ জনের মৃত্যু হয়– এতই দুর্ঘটনাপ্রবণ।
তবে পর্বতারোহণের ক্ষেত্রে শৃঙ্গে পৌঁছনোতেই কিন্তু শেষ হয়ে যায় না যাত্রাটা। বা আরোহণের আনন্দেই শেষ হয় না। বরং সবচেয়ে জরুরি হয়ে ওঠে ফিরে আসাটা। সবটা, সব আনন্দ, সব চেতনা, সব দৃশ্য ফিকে হয়ে যায় যদি ফিরেই আসতে না পারি। ফেরাটা জরুরি। ফিরে সকলকে জানানোটা জরুরি। ভারতের প্রথম সূর্যদয় দেখার আনন্দের কথা সবাইকে জানানোয় সেই আনন্দ আরও দৃঢ় হয়েছিল। গোরি চেনে ভারতের প্রথম সূর্যদয় হয়, আমরা শৃঙ্গের ওপর থেকে সেই সূর্যদয় দেখেছিলাম। ক’জনই আর এই দৃশ্য দেখতে পারে! ইচ্ছে থাকলেও তো তা সম্ভব হয় না।
…………………………………………….
আমরা রাতের বেলা বেরিয়েছিলাম, তবে আবহাওয়া খুব একটা সুবিধের ছিল না। আমরা যখন পৌঁছেছিলাম, তখন অনেকটাই দেরি হয়ে গেছিল। আমার সঙ্গে একজন স্প্যানিশ দল যাচ্ছিল, তাদের একজন আরোহীর দুর্ঘটনা ঘটে। আর ১০০ মিটার বাকি। এদিকে বিকেল হয়ে গেছে। ওই অ্যাক্সিডেন্টটা দেখে আমরা সিদ্ধান্ত নিই ফিরে যাওয়ার। এদিকে ওই স্প্যানিশ অরোহীর রেসকিউ-এর ব্যবস্থা করে ফেরার পথ ধরি। ইতিমধ্যে যে আমার অক্সিজেন ফুরিয়ে এসেছে, আমি বুঝতে পারিনি। আমি পড়ে যাই। আমার বাঁচার সম্ভাবনা ছিল না, আমাকে রেখেই আমার দলের অন্যরা সেফ জায়গায় ফিরে যায়। আমি পড়ে থাকি ৭৮০০ মিটারে। আমি অপেক্ষা করতে থাকি মরার জন্য।
…………………………………………….
আগে অমরনাথে যে পৌঁছতে পারতেন, তাঁকেই লোকে দেখতে আসত। অমরনাথে যাওয়া এমনই দুর্গম একটা ব্যাপার ছিল। এখন লাখ লাখ মানুষ যাচ্ছে। এখন চলার পথ সুগম, গোটা পথটা হাঁটতেও হবে না। মানুষের হাতে পয়সা এসেছে, যেতে পারছে। এভারেস্টের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। এখন এভারেস্ট জয় করার অর্থ অনেক মানুষই জোটাতে পারেন। কারও কোনও দুর্ঘটনা ঘটে গেলেই হেলিকপ্টার এসে যাচ্ছে। আবহাওয়া পূর্বাভাসও যথাযথ পাওয়া যায়। অভিযানের সময়ক্ষণ ও শৃঙ্গ জয়ের দিন আগে থেকেই ঠিক করে নেওয়া যাচ্ছে। হিলারি স্টেপে যে ভিড়টা দেখা যায়, সেটার একটা কারণ রয়েছে। সকাল ৫টা থেকে ১০টার মধ্যে পৌঁছে আবার ফিরেও আসতে হবে। খুব কম সময়ের মধ্যে সম্পূর্ণ করতে হয়। তাই ওখানে ভিড় জমে যায়।
ধওলাগিরি যাচ্ছিলাম সেবার ২০১৩ সালে, পৃথিবীর সপ্তম উচ্চতম শৃঙ্গ। আমাদের সঙ্গে লোকবলও কম ছিল, আয়োজনও পরিমিত ছিল। সাধারণত বেস ক্যাম্পের পরে চারটে ক্যাম্প করতে হয়। এদিকে সেবার ধওলাগিরির চার নম্বর ক্যাম্পে জায়গা নেই। তিন নম্বর ক্যাম্প থেকেই সামিট করতে হবে। ফলে রাস্তাও অনেকটা। আমরা রাতের বেলা বেরিয়েছিলাম, তবে আবহাওয়া খুব একটা সুবিধের ছিল না। আমরা যখন পৌঁছেছিলাম, তখন অনেকটাই দেরি হয়ে গেছিল। আমার সঙ্গে একজন স্প্যানিশ দল যাচ্ছিল, তাদের একজন আরোহীর দুর্ঘটনা ঘটে। আর ১০০ মিটার বাকি। এদিকে বিকেল হয়ে গেছে। ওই অ্যাক্সিডেন্টটা দেখে আমরা সিদ্ধান্ত নিই ফিরে যাওয়ার। এদিকে ওই স্প্যানিশ অরোহীর রেসকিউ-এর ব্যবস্থা করে ফেরার পথ ধরি। ইতিমধ্যে যে আমার অক্সিজেন ফুরিয়ে এসেছে, আমি বুঝতে পারিনি। আমি পড়ে যাই। আমার বাঁচার সম্ভাবনা ছিল না, আমাকে রেখেই আমার দলের অন্যরা সেফ জায়গায় ফিরে যায়। আমি পড়ে থাকি ৭৮০০ মিটারে। আমি অপেক্ষা করতে থাকি মরার জন্য। আমি জেনে গেছিলাম যে আমি বাঁচব না। তবে এতদিনের পর্বতারোহণের অভিজ্ঞতা থেকে হঠাৎ বুঝতে পারি যে বেঁচে যেতেও পারি। পোশাকটা যথাযথ ছিল, আর বরফপাতও হচ্ছিল না, হাওয়াও ছিল না। ফলে আমি ক্ষীণ আশা করছিলাম যে বেঁচে যাব। সারা রাত ওখানে পড়ে ছিলাম। পরদিন একজন শেরপা অক্সিজেন নিয়ে আসে, অনেক কষ্টে আমাকে ২০০০ ফিট নামায়। আমার সঙ্গে ওই স্প্যানিশ ক্লাইম্বারকেও নামানো হয়। আমাদের দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে দিয়েছিল। হেলিকপ্টার এসে ওই দড়ি দিয়ে আমাদের নামিয়ে আনে বেসক্যাম্পে। সেখান থেকে কাঠমাণ্ডু নিয়ে যাওয়া হয়। তিনদিন আইসিইউ-তে থাকি। পায়ের তিনটে আঙুল ফ্রস্টবাইটের জন্য বাদ দিতে হয়। তবে নেশা তো নেশাই। পরের বছর আবার ক্লাইম্ব করি। আমার এই বেঁচে থাকাটা সত্যিই মিরাকেল ছিল। অবিশ্বাস্য।
শেষে একটাই কথা বলব, বহু বিদেশি মানুষের সঙ্গে পর্বতারোহণ করেছি। প্রায় বিশ্বজোড়া ক্লাইম্বারদের সঙ্গে সহযাত্রী হয়েছি, কিন্তু ভারতীয় পর্বতারোহীদের পারদর্শিতা ও আবেগ আলাদা। আমরা মানসিকতায় অনেক অনেক এগিয়ে। সহযাত্রীর প্রতি আমাদের যে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা, পাহাড়ের প্রতি শ্রদ্ধা– এটা কিন্তু বিরল।