ইংরেজি বছরের শেষের দিনে কলকাতার বাবু যথারীতি রেসের মাঠে টাকা খুইয়ে সেই দুঃখ আহ্লাদে ঢাকতে এসেছে বউবাজারের বাইজি-রোশানাইতে বিলিতি মদে রাত পোয়াতে। কিন্তু গায়ের শালটি সর্বক্ষণ পাকড়ে আছে বাবু। বাড়িতে বউ পই-পই করে বলে দিয়েছে, রোজ শাল হারাতে-হারাতে এটাই শেষ শাল। এটাও হারিয়ে এসো না। বাবু তাই এক চুমুক গালে নেয়, আর শালটাকে নতুন করে পাকড়ায়। ছিমকিবাই, রোশনি বাই, চাঁদনি বাই– কতভাবে না গা ভাঙছে বাবুর সামনে। কারও গায়ে বাবু পরিয়ে দেয় হাজার-হাজার টাকার শাল। বাবু কিন্তু এড়িয়ে-যাওয়া উচ্চারণে চিয়ার্সেই আটকে। গিন্নির বাক্য কানে বাজছে, ‘এই শেষ শাল। এটিও হারিয়ে এসো না।’
সে অন্য কলকাতা, ভিন্ন সময়। সাহেবদের তখন রমরমা। একদিকে কলকাতা লালমুখোদের এটিকেট-দীপিত মদ্যপান। অন্যদিকে প্রবল নাট্যকার, মত্তভৈরব গিরিশচন্দ্র ঘোষের মাতলামি। সেই সময়ে মদ ধরেছে এক বনেদি বাঙালি। তার বিকেল কাটে রেসের মাঠে। সন্ধে থেকে রাত কাটে বাইজি-আঁচে মদের ঠেকে। এবং বাবু রোজই নেশায়, বেহুঁশে হারিয়ে আসে গায়ের শাল। বড়দিনে কলকাতার রেসকোর্সে ঘোড়ার পিঠে পরোয়াহীন বনেদিবাবু যে কত টাকা খোয়াল, হিসেব নেই! তারপর মদের ঠেকে কলকাতার সেরা বাইজির গায়ে নিজের শাল পরিয়ে বাড়ি ফিরতে বউ বলে, আজও শাল হারিয়েছ? এহেনবাবু ইংরেজি বছরের শেষের দিনে যথারীতি রেসের মাঠে টাকা খুইয়ে সেই দুঃখ আহ্লাদে ঢাকতে এসেছে বউবাজারের বাইজি-রোশানাইতে বিলিতি মদে রাত পোয়াতে। কিন্তু গায়ের শালটি সর্বক্ষণ পাকড়ে আছে বাবু। বাড়িতে বউ পই-পই করে বলে দিয়েছে, রোজ শাল হারাতে-হারাতে এটাই শেষ শাল। এটাও হারিয়ে এসো না। বাবু তাই এক চুমুক গালে নেয়, আর শালটাকে নতুন করে পাকড়ায়। ছিমকিবাই, রোশনি বাই, চাঁদনি বাই– কতভাবে না গা ভাঙছে বাবুর সামনে। কার গায়ে বাবু পরিয়ে দেয় হাজার-হাজার টাকার শাল। বাবু কিন্তু এড়িয়ে-যাওয়া উচ্চারণে চিয়ার্সেই আটকে। গিন্নির বাক্য কানে বাজছে, ‘এই শেষ শাল। এটিও হারিয়ে এসো না।’
ভোররাতে বাড়ি ফিরেছে বাবু। আজ আর কড়ানাড়া নয়। বাবু বিজয়গর্বে মারল দরজায় লাথি। তারপর বউকে ডাকল ‘তুই’ বলে। ‘কোথায় তুই, দেখে যা, শাল গায়ে বাড়ি ফিরেছি কি না!’ গিন্নি চোখ কচলে বলে, ‘যাক, আজকে শালটা মনে করে এনেছ! কিন্তু তোমার কাপড়টা কোথায় ছেড়ে এলে?’
এমনই একসময়ে ছিল কলকাতার বনেদিবাবুদের ইংরেজি বছরের শেষ রাতে নতুন বছরকে ‘চিয়ার্স’ বলার বেহুদা মাতলামি! প্রশ্ন হল গাঁজা, আফিং, তামাক, চরস– এসব ছেড়ে বাবুরা বিলিতি মদ ধরল কেন? কৃষ্ণনগরের প্রাচীন কবি কৃষ্ণকান্ত জব্বর উত্তর দিয়ে ছিলেন রাজসভায়; ‘গাঁজাটা বড়ই পাজি, ক্ষীণ করে দেহ/ পচাগন্ধে নাড়ী ওঠে টানে যদি কেহ।/ আফিঙেতে কত সুখ কী বলিব আর!/ বুম হয়ে বসে থাকা, নড়াচাড়া ভার।/ মজা যদি থাকে কিছু মদেতেই রয়,/ লইয়া ইয়ার বকসী প্রাণ খুশি হয়।’
মদ খাওয়ার শুরুতে, ‘চিয়ার্স’ বলার রীতি পুরোপুরি ইংরেজের। ‘চিয়ার্স’-এর বদলে ‘উল্লাস’ বলতে প্রথম শুনি সুনীলদাকে (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)। বাংলা ভাষায় তাঁর অবদান তো অন্তহীন। সম্ভবত, এটাই শ্রেষ্ঠ অবদান। কিন্তু একবার ক্যালকাটা ক্লাবে বুদ্ধদেব গুহ-র স্কচে প্রথম চুমুকটি দিয়ে ইংরেজি নববর্ষের উদ্দেশ্যে মহাহ্লাদে ‘উল্লাস’ বলে যে কী বিড়ম্বনায় পড়েছিলাম বলার নয়। নিউ ইয়ার্স ইভ্-এ ‘চিয়ার্স’-এর বদলে ‘উল্লাস’, এ তো ডাউনরাইটস্যাক্রিলেজ! স্কচ্-কে কলুষিত করলে তুমি। ওই শব্দটা সুনীলের সামনে বোলো। আমার সামনে কক্ষনও নয়!’ লালাদার (বুদ্ধদেব গুহ) সুনীল-বিদ্বেষ কোন বিন্দুতে পৌঁছেছিল ‘উল্লাস’-এর প্রতি, তাঁর বিতৃষ্ণা মুহূর্তে বুঝিয়ে দিয়েছিল সেই সন্ধের ছোট্ট সমাবেশ। এবং ‘চিয়ার্স’-এর ঘনঘন ব্যবহারও আবহাওয়াকে হালকা করতে পারেনি। তবে আমার কিন্তু বেশ লাগে চিয়ার্স-এর বিকল্পে সুনীলদার রঙিন ছক্কা ‘উল্লাস’! তবে বন্ধুনিদের ভেজা ঠোঁট থেকে যখন ঝরে পড়ে ‘উল্লাস’, বিশেষ করে নিউ ইয়ার্স ইভ্-এর মধ্যরাতে, তখন সুনীলদাকে ঈর্ষা হয়। মনে হয় সুন্দরীদের সমস্ত আর্দ্র ঠোঁট সুনীলদার গালেই এঁকে দিল লিপস্টিক চিহ্ন!
তবে ‘চিয়ার্স’-ই বলি বা ‘উল্লাস’– কেন বলি, সেই প্রাচীন গল্পটা একটু ঝালিয়ে নেওয়া যাক! রূপকথাটি হল এইরূপ: মদ্যপানের এক উৎসবে আবির্ভাব হল পাঁচ ইন্দ্রিয়র। তারা প্রত্যেকে মদের স্বাদ যে-যার নিজের মতো করে গ্রহণ করে জানাবে কেমন লাগল। জিভ বলল, এমন স্বাদ কোনও পানীয় তাকে দেয়নি। চোখ বলল, মদ দেখতে কী সুন্দর, গায়ের রং কখনও সোনার মতো, কখনও টুকটুকে গোলাপ, কখনও বরফসাদা, আর কখনও বা মদ গ্লাসের কানায় চোখ মারছে, ‘বিডেড বাবলস্ উইংকিং অ্যাট দ্য ব্রিম’ (জন কিটস্)! এবার ঠোঁট বলল, মদ আমাকে ছুঁলেই মনে হয়, হোয়াট আ ম্যাজিক টাচ্! এই ছোঁয়াটুকুর জন্যই সারাক্ষণ তৃষ্ণার্ত থাকি! এবার এল ‘নাক’ বা ‘ঘ্রাণ’-এর পালা। সে তো এক এক মদের এক একরকম গন্ধ শুঁকে পাগল। শেষ নাহি যে শেষ কথাকে বলবে? কিন্তু ‘কান’? ‘কান’-কে যে মদের কিছু দেওয়ার নেই। কানের দুঃখ দেখে কে? দেখল এক ইংরেজ মাতাল। সে বলল, মদ ভর্তি কাচের পানপাত্র সবাই একসঙ্গে ওপরে তোলো, তারপর সব পাত্র কাচের ঝংকার তুলে পরস্পরের সঙ্গে মহোল্লাসে ঠেকিয়ে বলো ‘চিয়ার্স!’ এতগুলি মানুষের সেই আনন্দধ্বনির স্বাদ পেয়ে কান বলল, মদের মতো এত স্বাদু পানীয় আর নেই! সেই থেকে মদ্যপানের শুরুতেই এই শব্দব্রক্ষ: ‘চিয়ার্স!’
এই মাতাল চিয়ার্স বা উল্লাসের একটা গল্প বলা যাক। সম্ভবত নিউ ইয়ার্স-এর পার্টি এক মহার্ঘ হোটেলে। পার্টি দিচ্ছেন রিচার্ড বার্টন আর এলিজাবেথ টেলর! বিপুল উল্লাসে এমন জোরে এলিজাবেথের সুরাপাত্রে ঠুকল হলিউডের এক মুগ্ধ তারকা তার পানপাত্র যে ভাঙা পড়ল এলিজাবেথ টেলরের শ্যাম্পেন গ্লাস। এলিজাবেথ ছুড়ে ফেললেন সেই ভাঙা শ্যাম্পেনের গ্লাস ফায়ার প্লেসে। দারুণ সুন্দর একটি শব্দ করে ফায়ার প্লেসে তার মৃ্ত্যু সংবাদ জানিয়ে গেল সেই মহার্ঘ কাটগ্লাসের শ্যাম্পেনপাত্র। বাহ! চমৎকার শব্দ তো! রিচার্ড বার্টন তার শ্যাম্পেন ভর্তি পানপাত্র ছুড়ে দিলেন জ্বলন্ত ফায়ার প্লেসে। আবার সেই স্বর্গীয় শব্দ। আর যায় কোথা? সবাই ছুড়তে লাগল ফায়ার প্লেসে বেলজিয়ান শ্যাম্পেন গ্লাস। আর সবারই পাগলের মতো ভালো লাগতে লাগল ফায়ার প্লেসে শ্যাম্পেন গ্লাস ভাঙার কসমিক মিউজিক। ‘আরও শ্যাম্পেন গ্লাস নিয়ে এসো– যেখানে যত শ্যাম্পেন গ্লাস আছে, ভোর পর্যন্ত ফায়ার প্লেসে আমরা ছুড়ব শ্যাম্পেন গ্লাস! আর বলব চিয়ার্স!’ বললেন রিচার্ড বার্টন। আর অপূর্ব প্রেমিককে অনন্ত চুমুতে ভরে দিলেন লিজ টেলর! পার্টি শেষ হল ভোরবেলা। কত শ্যাম্পেন গ্লাস ভাঙা হয়েছে? কে রাখে শ্যাম্পেন গ্লাসের মৃত্যুর হিসেব! কিন্তু ক্ষতিপূরণ? ব্ল্যাঙ্ক চেকে পড়ল এক হিরণ্ময় স্বাক্ষর: রিচার্ড বার্টন! বহু বছর পরে বছরের শেষ দিনটি কাটাচ্ছেন রিচার্ড বার্টন সুইজারল্যান্ডে। বছরের শেষ সূর্য ডুবছে বিকেল হতে না হতেই তুষার ঢাকা আল্পস্-এর গায়ে। রিচার্ড তাঁর সানডাউনারের গ্লাসটি পশ্চিম আকাশের দিকে তুলে মৃদু স্বরে বললেন, চিয়ার্স! পাশে বসে তাঁর শেষ প্রেমিকা। এক তরুণী। হঠাৎ প্রশ্ন করল, রিচার্ড, কেন তুমি এমন বিপজ্জনক বেহিসেবি জীবন যাপন করলে?
বার্টন মৃদু হেসে বললেন, অ্যাই হ্যাভ নেভার ওয়েস্টেড টাইম কাউন্টিং মানি অ্যান্ড ড্রিংকস্!
কোনও এক বছরের শেষ সন্ধ্যা। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে প্যারিসে। মদ খেতে-খেতে তাঁর লিভারটা জোঁকের মতো বড় হয়ে উঠে শার্টের ভিতর থেকে দেখা যায়! তবু মদ না খেয়ে তিনি থাকতে পারেন না। ঢুকেছেন প্যারিসের বার-এ। সঙ্গে স্ত্রী মেরি। ডাক্তারের কড়া নির্দেশ, হেমিংওয়ে তবু স্ত্রী মেরিকে নিয়ে ঢুকেছেন প্রিয় পানশালাতেই। আহা, বছরের শেষ দিন, নতুন বছরকে একটিবার চিয়ার্স বলব না। রিটজ্ হোটেলেই হেমিংওয়ের প্রিয় বার এবং বারটেন্ডার। বারটেন্ডারকে হেমিংওয়ে বলে রেখেছেন, এমন ককটেল একটা তৈরি করবে তুমি স্পেশালি আমার জন্য যা আমার বউ মদ বলে চিনতে না পারে। তাই করল বারটেন্ডার: ভদকার সঙ্গে টোম্যাটো জুস মিশিয়ে তৈরি করল এমন ককটেল, যা দারুণ মনে ধরল হেমিংওয়ের স্ত্রী মেরির। বাঃ, বেশ তো। বছরের শেষ সূর্যের দিকে সেই বিপুল ভদকা মেশানো টোম্যাটো জুস তুলে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বললেন, চিয়ার্স। তারপর বারটেন্ডারকে বললেন স্ত্রী মেরির দিকে তাকিয়ে, নেম দ্য ড্রিঙ্ক আফটার মাই ব্লাডি ওয়াইফ। জন্মাল নতুন ককটেল, ব্লাডি মেরি! উল্লাস!