সব দাগই কি তোমার? স্বামীর মারে চোখের তলা ফেটে যাওয়া দাগ কি তোমার? বাবার হাতে মার খেয়ে কানের পর্দা ফেটে যাওয়া কি তোমার? ভালোবাসার নামে বিছানায় ফেলে কালশিটে ফেলে দেওয়ার চিহ্ন কি ভালোবাসার? পুলিশ স্টেশনে অকথ্য অত্যাচারে পিঠের লাল লাল দাগগুলো তোমার? সমাজের অত্যাচারে, সময়ের অত্যাচারে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টার যে দাগ তোমার শিরা ছুঁয়ে আছে, সেই দাগ তোমার নয়। মেয়েদের শরীরের কোন দাগ মেয়েটির নিজের, কোন দাগ অন্যের– সেটা জানা জরুরি। কোন দাগ তোমার জয়নিশানা, কোন দাগ তোমার অসম্মানের, তোমাকে সম্পত্তি ভাবার– এই পার্থক্য জানা আশু প্রয়োজন। এই দাগও মুছে ফেলার নয়, এই দাগ জানান দেয় তুমি একটি পুরুষশাসিত সময়ে কীভাবে বেঁচে আছ! তোমার প্রতিটি লড়াইয়ের চিহ্ন থাক। অত্যাচারের চিহ্ন একদিন ঠিক মুছে যাবে, তুমিও সেরে উঠবে, তুমিও অন্য লড়াইয়ের জন্য আবার প্রস্তুতি নেবে, অন্য একটি মেয়ের কানে মন্ত্রণা দেবে লড়াইয়ের, সেই ডাক তুমিও অস্বীকার করতে পারোনি, সেও পারবে না।
এত তো মসৃণ হওয়ার কথা ছিল না! কথা ছিল না আলোর ঠিকরে যাওয়ার। বরং ওই খাঁজে আলোর এসে বসার কথা। সেই আধা আলোয়, বাঁকা আলোয় মিশে যেত বহুকালের জমানো অন্ধকার, প্রাচীন রাতের যাবতীয় না-জানা। ঘনঘোর কালোয় এই মৃত্যুর মতো আলোর সংকেতই জীবন, বাস্তব, ঘোর সংসার, সংসারত্যাগের স্বপ্ন। এসো জীবন, অনন্তের মতো জেগে থাকো ভেঙেচুরে যাওয়া জীবনের সন্ধানে।
এই ভেঙে যাওয়ার দাগ বহন করা কেন হঠাৎ অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠল? কেন তুমি ভাবলে এই দাগ তোমাকে কুৎসিত করেছে? কেন নিজের দাগ থেকেই নিজেকে আলাদা করছ? কেন ভাবলে দাগ মুছে ফেললেই তুমি সার্থক, তুমি আনন্দ জেনে ফেলেছ? ওই খাঁজকাটা, অমসৃণ, অকৃত্রিমতাই যে আমরা, আমাদের বেঁচে থাকার অহংকারী নিশানা।
কিন্তু সর্বগ্রাসী পুঁজিবাদ আমাদের শিখিয়েছে দাগ ভালো নয়। দাগ কলঙ্ক, দাগ আসলে হেরে যাওয়ার চিহ্ন, দাগ অসুন্দর, দাগ বহন করার নয়। আর বোকাসোকা আমরা, এ কথা শুনেই দাগ মুছে ফেলার সন্ধানী দৃষ্টিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ভুলে গেলাম আমার এত যত্নে কুড়িয়ে পাওয়া জীবনের ওঠা-পড়া, বারবার পড়ে গিয়ে, আঘাত পেয়ে আবার উঠে দাঁড়ানোর জয়চিহ্নকে ওরা স্বীকৃতি দিচ্ছে না। ওরা বলছে ভুলে যাও অতীত, ভুলে যাও হাড়ভাঙা খাটুনি, ভুলে যাও জীবনের মানুষী সব চিহ্ন। যেসব সাধারণ স্বপ্নে-আহ্লাদে জীবন তৈরি হয়, সেই স্বপ্ন আমরা আর দেখি না, তাকে ভাবি সামান্য, অবহেলা করি। আমরা দেখি সেই স্বপ্ন, যেখানে মসৃণতা, চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া আলো, দাগ মুছে ফেলার হাজারো কায়দা– যা আসলে আমাদের কৃত্রিমতা, আমাদের পচে যাওয়া বোধ, গিলে খেতে চাওয়া পুঁজিবাদের লালসাকেই প্রকট করে। এই মসৃণতা লোভ, পচে-গলে যাওয়া সময়ের ফাঁপা কারুকার্য। এই দাগহীনতা আরাম দেয় না, বরং আরও আরও অস্থির করে তোলে। ছুটে চলে যাই শপিং মলে, সেখানে তাকে তাকে সাজানো নিজেকে মসৃণ করে তোলার, দাগ মুছে ফেলার হাজারো সামগ্রী সাজানো। আমি ওই তাকের দিকে তাকিয়ে আবিষ্কার করি– চোখের তলার কালিও আসলে তুলে ফেলতে হয়। আমরা আবিষ্কার করি আমাদের যা কিছু ছিল, সব ঘষে ঘষে তুলে ফেলতে হবে। যদি ঘষে ঘষে তোলা না যায়, তাহলে অপারেশন করাতে হবে, কেটে বাদ দিতে হবে, ওই কাটার দাগও তুলে ফেলতে প্লাস্টিক সার্জারি করাতে হবে। মুখে, গালে, ঠোঁটে ইঞ্জেকশন ফোটাতে হবে। তারপর কিছুদিন পর টুডুম, তুমি চকচকে আলো ঠিকরে যাওয়া চামড়া নিয়ে, লেজার ট্রিটমেন্ট করা শরীর নিয়ে উপস্থিত হলে প্রকাশ্যে, শুনতে পেলে হাততালি, বিস্মিত সব মুখ তোমার দিকে তাকিয়ে! না, এখানেই শো খতম হয় না। ওই হাততালিতে চাপা পড়ে গেল কটাক্ষগুলো– ওই তো কানে কানে চলছে গুঞ্জন– অপারেশন আনসাকসেসফুল! ততটাও ভালো হয়নি, আরও ভালো হতে পারত।
আমরা উদারনৈতিক সময়ের মানুষ। এত সহজে আমরা হারিয়ে দেব নাকি সময়টাকে? তাই তো আমাদের জন্য হাজির করা হল নয়া-উদারবাদের নতুন খেলা। আমাকে শেখানো হল সেলফ কেয়ারই এই সময়ের শুশ্রুষা। সত্যিই তো সময়টা খারাপ, নয়া-উদারবাদও আমাদের এই কথায় সায় দেয় প্রবলভাবে। আমরা পথ খুঁজে পাচ্ছি না, হাতড়ে মরছি, তাই পরোপকারী নয়া-উদারবাদ শেখাল সেলফ কেয়ারের অপর নাম শপিং মলের মহিলা সেকশন। ওখানেই রয়েছে জাদুকাঠি। ওখানেই রয়েছে ব্রনর দাগ তোলার টোটকা। মনে আছে, সাইকেল চালানো শেখার সময় স্টোনচিপসে পড়ে গিয়ে তোমার হাঁটু কেটে গিয়ে রক্ত পড়েছিল। সেই রক্তে কিন্তু তুমি ভয় পাওনি, ব্যথা পেয়েছিলে নিশ্চয়ই, কিন্তু সাইকেল চালানোর আনন্দ, শেষমেশ সাইকেল শিখতে পারার উল্লাসের কাছে ওই পড়ে যাওয়া, ওই কেটে যাওয়া কিছুই নয় মাত্র। পরে যখন সেই দাগের দিকে তাকাতে, মনে পড়ে যেত সাইকেল চালানোর আনন্দ, গলি দিয়ে তীরবেগে ক্রিং ক্রিং করতে করতে গোটা পাড়াকে জানান দেওয়া আজ থেকে তুমি সাইকেল চালাতে পারো। কয়েকটা হাসিমুখ সেদিন জানলায় দাঁড়িয়ে, বারান্দার এসে তোমাকে জিতে যেতে দেখেছিল। কিন্তু হাঁটুর ওই দাগটা মুছে ফেলার নিদান দিয়েছে নয়া-উদারবাদ। ওই দাগের সঙ্গে মুছে যাবে নাকি এই স্মৃতিটাও?
মনে আছে, সেদিনের কথা, যেদিন রোদটানা সারা দুপুর মাঠে খেটে গোপালদা যখন গোলঘরে ফিরেছিল, ক্লান্ত শরীর উঠোনেই বসে পড়েছিল। বসে বসে গল্প জুড়েছিল রঘুর মায়ের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার সাধের কথা। সেই গল্প বলতে বলতে ক্লান্ত গলায় গেয়ে উঠেছিল, ‘প্রেমের মাটি প্রেমের খুঁটি, তাই দিয়ে একখান ঘর বানাব’। ওই ভাঙা গলায়, ক্লান্ত গলায় ওই গান শুনে তুমিও তো ভেবেছিলে গানের তো সব সুরে বসার দরকার নেই। সারাদিন খাটাখাটনির পর ক্লান্ত চোখের গোপালদার গলা থেকে যে সুর বেরচ্ছে, সেখানেই তো ইউরেকা! ওই ভাঙা গানে, ওই ভাঙা শরীরে, তিরতির করে বয়ে চলেছে জীবন। মাঝি হতে তবুও কেন তুমি পারলে না?
যদি দাগই মুছে ফেলো, স্মৃতিও মুছে ফেলা দস্তুর। পারবে পুরাতন প্রেম ছাড়া বেঁচে থাকতে? পারবে সেই আদিম ডাককে অস্বীকার করতে? বারবার জিতে যাওয়াগুলো ভুলে যেতে? সেইসব অপ্রেমের ভেতর নিজেকে খুঁজে পাওয়ার ওই আনন্দ ভুলে যেতে? কাটাগাছে হাত কেটে রক্তাক্ত, তবুও রাতের শেষে সেদিন বাঁকা চাঁদ উঠলে তুমিই তো আলোয় ভরে উঠেছিলে, আরও কিছুদূর এগিয়ে গিয়েছিলে। ফেরার রাস্তা ভুলতে চেয়েছিলে। আধেক আলো আর গোটা জীবন নিয়ে ফিরে এসেছিল সকাল হতে।
আয়নায় তাকাও, দেখো জীবনে পরিপূর্ণ ভেসে যাওয়া একটা মুখ দেখতে পাবে, ছোট-বড় কাটা দাগ, এবড়োখেবড়ো ত্বক, রোদে পোড়া চামড়া, বহুপথ হেঁটে এসে ফেটে পাওয়া পা। আয়নায় তাকাও, দেখো–
‘এবারে সজল হও, ফিরে পাও শুভকাল, চুটিয়ে কাজল পরো, আরাত্রি সকাল।’
কিন্তু সব দাগই কি তোমার? স্বামীর মারে চোখের তলা ফেটে যাওয়া দাগ কি তোমার? বাবার হাতে মার খেয়ে কানের পর্দা ফেটে যাওয়া কি তোমার? ভালোবাসার নামে বিছানায় ফেলে কালশিটে ফেলে দেওয়ার চিহ্ন কি ভালোবাসার? পুলিশ স্টেশনে অকথ্য অত্যাচারে পিঠের লাল লাল দাগগুলো তোমার? সমাজের অত্যাচারে, সময়ের অত্যাচারে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টার যে দাগ তোমার শিরা ছুঁয়ে আছে, সেই দাগ তোমার নয়। মেয়েদের শরীরের কোন দাগ মেয়েটির নিজের, কোন দাগ অন্যের– সেটা জানা জরুরি। কোন দাগ তোমার জয়নিশানা, কোন দাগ তোমার অসম্মানের, তোমাকে সম্পত্তি ভাবার– এই পার্থক্য জানা আশু প্রয়োজন। এই দাগও মুছে ফেলার নয়, এই দাগ জানান দেয় তুমি একটি পুরুষশাসিত সময়ে কীভাবে বেঁচে আছ! তোমার প্রতিটি লড়াইয়ের চিহ্ন থাক। অত্যাচারের চিহ্ন একদিন ঠিক মুছে যাবে, তুমিও সেরে উঠবে, তুমিও অন্য লড়াইয়ের জন্য আবার প্রস্তুতি নেবে, অন্য একটি মেয়ের কানে মন্ত্রণা দেবে লড়াইয়ের, সেই ডাক তুমিও অস্বীকার করতে পারোনি, সেও পারবে না।
চলো, লড়াইয়ে ফিরি আমরা, সারা শরীরে লড়াইয়ের জয়নিশানা থাক। বেঁচে থাক জেতার নেশা, বেঁচে থাক পুরুষতন্ত্রকে সমূলে নিকেষ করার আপ্রাণ চেষ্টা।
দাগ থাকুক। তোমার এই দাগ, অন্য কোনও মেয়ে বহন করে নেবে।