আমার অদ্বিতীয় দ্বিতীয় উপন্যাসের দ্বিতীয় সংস্করণ বেরল। নাম– উত্তরণ। এবং এই সাবলিমেশন ঘটল উইথ স্লাইট ওভারডোজ অফ সেক্স। প্রকাশক ঠিকই বলেছিল। চেষ্টা করতেই ফ্লো এসে গেল। ‘উত্তরণ’ নামের সঙ্গে এই ফ্লো বাজারে খেলো। আমি রাতারাতি হয়ে উঠলাম ফিচার রাইটার থেকে রাইটার। যে রাইটার দুধেল গাই। আমার দরজায় প্রকাশকের বেল মাঝে মধ্যেই বাজতে লাগল। এবং কলেজ স্ট্রিটের মন ও মুখোশ খুলতে লাগল।
তখন আমার বয়স ৪০-এর চারপাশে। তখন আমি সন্তানের বাবা। তখন আমি টইটম্বুর বিবাহিত। তখন আমি দুর্বার ভাবে পরজায়ার শরীরে-মনে। সেই বহ্নিত বন্যার মধ্যে, সেই মগ্ন মিথ্যাচারের মধ্যে, সেই অর্বাচীন আনন্দের মধ্যে, আক্ষরিক অর্থে বুলেটের মুখে একই সঙ্গে রোমান্টিক কম্পমানতায় ও মুহ্যমানতায় নিজেকে প্রেমের জন্য বলিপ্রদত্ত ভাবতে ভাবতে, ভিতরের দুর্বার তাড়না থেকে লিখে ফেললাম ‘ইয়েন’– আমার অদ্বিতীয় দ্বিতীয় উপন্যাস।
এই বইয়ের প্রচ্ছদে তখন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, এখন প্রয়াত, প্রসিদ্ধ শিল্পী ওয়াসিম কাপুর এঁকে দিলেন সাদা পশ্চাৎপটে উন্মুখ, আগ্রহী, তৃষ্ণার্ত দু’টি লাল ঠোঁট। এবং সেই বই তোলপাড় তুলল। সেই সঙ্গে এই প্রশ্ন: এক ছাপোষা গেরস্ত বাঙালি সাংবাদিকের জীবনে তীব্র অবৈধ সম্পর্ক নিয়ে লেখা উপন্যাসের নাম কেন জাপানি মুদ্রার নামে?
ইয়েন-এর প্রথম সংস্করণ হু হু করে বিক্রি হয়ে গেল। নতুন প্রকাশক কলিংবেল টিপল বইটা বেশি দাম দিয়ে কেনার জন্য। সেই প্রথম বুঝলাম, অবৈধ সম্পর্ক লক্ষ্মী আনে। নতুন প্রকাশক বলল, ‘ইয়েন নামটার কোনও মানে হয় না। ওটা পাল্টান তো!’ আমি বললাম, মানে হয় না মানে? ইয়েন শুধু জাপানি মুদ্রা নয়! ‘Yen’ শব্দটার আর এক অর্থ ‘ইয়ার্নিং’। প্রকাশক চেক লিখতে লিখতে বলল, ‘এটাই বা কী জিনিস?’, বললাম, ‘ইয়ার্নিং’ হল সেক্সের জন্যে তেষ্টা। কলেজ স্ট্রিটের পবিত্র প্রকাশক, তিন ছেলের বাপ, ‘কুমারী’-লজ্জায় বেগুনি হয়ে বলল, ‘কী যে বলেন স্যর!’ তারপর বলল, ‘সেক্সের কথাই যখন উঠল, ওটা একটু বাড়াতে হবে।’ আমি বললাম, মানে আরও যৌনতা?
প্রকাশক লজ্জায় জিভ কাটল। আমি বুঝলাম, প্রকাশক সেই বাঙালি, যারা স্ত্রী-কে সব সময় ‘ওয়াইফ’, মদকে সবসময় ওয়াইন, এমনকী হুইস্কি, বিয়ার বলে রাম, ভদকা, জিন, ব্র্যান্ডি বা হিজিবিজি ককটেলে চুমুক দিতে দিতেই। প্রকাশক যৌনতা সম্পর্কে মৌনতা রক্ষা করেই বলল, ‘সেক্সটা আর একটু বাড়াতে হবে স্যর। কিছু মনে করবেন না, অনেক জায়গায় একটু চেপে গেছেন। যা হয়েছে সব খোলাখুলি বলুন। এত টাকা ইনভেস্ট করছি। রিস্ক নিতে পারব না।’ আমি বললাম, আপনার বায়না রাখতে তো যা করিনি তাও বলতে হবে। প্রকাশকের উত্তর, ‘করেছেন, করেছেন, একটু মনে করার চেষ্টা করুন, দেখবেন একবার ফ্লো এসে গেলে ধরে রাখতে পারবেন না। আর স্যর বোয়ের নামে একটা ধর্ম ধর্ম ভাব আনবেন। মলাটে একটু পবিত্র ভাব। আর ভেতরে সেক্সের ব্যাপার-ট্যাপার। আপনাকে আর কী বলব স্যর। আপনি কি নিজের এক্সপেরিয়েন্স থেকে লিখছেন?’
কিছুদিনের মধ্যেই আমার অদ্বিতীয় দ্বিতীয় উপন্যাসের দ্বিতীয় সংস্করণ বেরল। নাম– উত্তরণ। এবং এই সাবলিমেশন ঘটল উইথ স্লাইট ওভারডোজ অফ সেক্স। প্রকাশক ঠিকই বলেছিল। চেষ্টা করতেই ফ্লো এসে গেল। ‘উত্তরণ’ নামের সঙ্গে এই ফ্লো বাজারে খেলো। আমি রাতারাতি হয়ে উঠলাম ফিচার রাইটার থেকে রাইটার। যে রাইটার দুধেল গাই। আমার দরজায় প্রকাশকের বেল মাঝেমধ্যেই বাজতে লাগল। এবং কলেজ স্ট্রিটের মন ও মুখোশ খুলতে লাগল। সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি।
বিষয় যেহেতু আমার দ্বিতীয় উপন্যাস, এই বইয়ের লেখক হিসেবে আরও দুয়েক কথা বলার আছে।
প্রথমেই বলি, এই বইয়ে এবং আমার আরও অনেক পরবর্তী লেখায় খোলাখুলি যৌনতা থাকলেও, আমি আমার ভাষা থেকে রুচি, শিক্ষা, সভ্যতা এবং ড্রইংরুম পালিশ কখনও বর্জন করেছি বলে মনে হয় না। একটা উদাহরণ দিচ্ছি আমার দ্বিতীয় উপন্যাস থেকেই।
আমার দ্বিতীয় উপন্যাসে মূল চরিত্র সাংবাদিক। সে একদিন তার পরস্ত্রী প্রেমিকার আঙুল ছুঁয়ে বলছে: কখনও কখনও মনের কথা আঙুলের ডগায় এসে জড়ো হয় মোমো। আমি ওদের পড়তে চেষ্টা করছিলাম। এরপর নায়িকা মোমো বলছে– শরীরের আর কোন কোন জায়গা স্পর্শ করে তুমি মনের কথা পড়তে পারো? প্রশ্নটা মোমো করতে চায়নি। হঠাৎ করে ফেলল। উত্তরে আমি কী বলেছিলাম, বলছি না। অশ্লীল তো বটেই। কিন্তু টেনিসনের ভাষায়। মোমো বলেছিল, ইংরেজ কবি তোমাকে বাঁচিয়ে দিলেন। আমি বলেছিলাম, তোমাকেও। ‘অন অল দি ব্রাঞ্চেস অফ দাই ব্লাড’, কিন্তু মারাত্মক কথা। আশা করি, উত্তর পেয়েছ।
মনে পড়ছে বিয়ে নিয়ে মোমোর সঙ্গে আমার আলোচনা এইভাবে এসেছে আমার সেই কবে লেখা দ্বিতীয় উপন্যাসে। আমি প্রেমের প্রসঙ্গে মোমোকে বলেছিলাম, প্রেম হল দু’টি হৃদয়ের সংলাপ। এই সংলাপ যখন শেষ হয়ে যায় প্রেম শেষ হয়ে যায়। কিন্তু সংলাপ শেষ হবার পরেও বিয়ে টিকে থাকে। হাজার হাজার বিয়ে ঘরে ঘরে সেভাবে মরে বেঁচে আছে। সংলাপ নেই তবু স্বামী-স্ত্রী পাশাপাশি শুয়ে থাকে।
……………………………………
আমার এই দ্বিতীয় উপন্যাস লেখার পর আমি উপলব্ধি করলাম, লেখক হিসেবে আমি যতটুকু হই, যাই হই, বাংলা ভাষাই আমার অভয় অরণ্য। এখানেই কাটাব আমার বাকি জীবন। লেখা ছাড়া আর কোনও কাজ নেই আমার। আমার একমাত্র পরিচয় আমি লিখি। বাংলা না লিখলে আমি বাঁচব না। বাংলার সঙ্গে আমার দীর্ঘ সহবাসের উর্বরতা আজও অক্ষুণ্ণ। বাংলা ভাষা আজও আমাকে বলেনি, তুমি বড্ড বুড়ো হয়ে গেছ। আর তোমাকে দরকার নেই।
……………………………………
আমার দ্বিতীয় উপন্যাসের একটি অংশ আমি সম্ভবত লিখেছিলাম ভাইকেরিয়াস প্লেজারে। আমি তো সেখানে উপস্থিত ছিলাম না। মোমো আমাকে বলেছিল, এক ইংরেজ স্কলারের সঙ্গে ওর রাত্রিযাপনের অভিজ্ঞতার কথা। আমার ‘উত্তরণ’ উপন্যাসে সেই রাত্রি উড়ে এসে জুড়ে বসল এইভাবে। আমার লেখায় যে কত কিছু এইভাবে যখন তখন চলে আসে, আটকাবে কে? এই দ্বিতীয় উপন্যাস লিখতে লিখতে শিখেছি, লেখা নিজে নিজে নিজের ভাবনা, শরীর, বাক্য, শব্দ সব তৈরি করে। আমার বিশেষ কিছু করার থাকে কি? এই যেমন এখানে। মোমোর প্রথম যৌন অভিজ্ঞতা:
নাভির নিচ থেকে শাড়িটা আলতোভাবে খসে গেল। মোমো বুঝতে পেরেও বিন্দুমাত্র বাধা দিল না তার মধ্য বয়সের মুগ্ধ ইংরেজকে। তীব্র ভালো লাগার উজানে বাধা দেবার ইচ্ছে খড়ের টুকরোর মতো ভেসে গেল। পল একটানে খুলে ফেলল কালো পেটিকোটের দড়ি। মনে হল, শাড়ি-সায়া পরা মেয়ের সঙ্গে পল এই প্রথম শুতে চলেছে। একথা ভেবে মোমো পলকে নতুন কিছু দিতে পারার তৃপ্তি অনুভব করে। সে নিজেকে মেলে দেয় বিছানায়। পল ব্লাউসের হুক খুলতে থাকে। তারপর কালো ব্রা-টাকে উত্তেজনায় উপড়ে নেয়। ব্রায়ের স্ট্র্যাপ দুটোকে মোমোর হাতের ওপর দিয়ে এরোপ্লেনের মতো উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে ব্রা-টা ছুঁড়ে দেয় খাটের এক কোণে। তারপর মোমোর ওপর প্রায় উপুড় হয়ে বোধহয় ভাবতে থাকে বাঙালি মেয়ের শরীরে এত লাবণ্য! পলের গলার সোনার চেন ঝুলে পড়ে ছোঁয় মোমোর বোঁটা। মোমো এই প্রথম অনুভব করে, তার তলপেটের তলায় এমন আগুন আগে জ্বলেনি। আর তার মনে হয় দুটো ঊরুর মাঝখানে গলছে মোম। পল চুমু খায়। ঘন দীর্ঘ চুমু দু’টি বোঁটায়। বোঁটা দুটো চুমুর লালায় ভিজে নদীর ধারে ভিজে শক্ত নুড়ির মতো। এরপর এমনই তীব্র এক বিস্ফোরণ মোমো অনুভব করে তার রহস্যঘন সিক্ত গভীর গুহায়, তার মনে হয় এত যন্ত্রণার সঙ্গে এমন আনন্দ আগে কখনও মেশেনি।
এতদিন পরে এই জায়গাটা পড়তে গিয়ে আমার সেই অনেক দিনের পুরনো আমাকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে, এটা কি তোমার ভাইকেরিয়াস প্লেজার না কি তোমার খাঁটি দর্শকাম, voyeurism?
ভয়েরিস্টিক প্রবণতা কি আমার মধ্যে সত্যিই নেই? কার না থাকে? পুরুষ-নারী এই একটি জায়গায় সমান! কিন্তু আমি আমার সমস্ত ভয়েরিজম নিয়েই দ্বিতীয় উপন্যাসে আমার লেখা এই প্রেমপত্রটি রেখেছি! অন্তত আমার কাছে এর মূল্য আমৃত্যু থাকবে। এটা তো আমার ভেতর থেকে উঠে এসেছে:
আজকের দিনটা এত সুন্দর যে এই মুহূর্তে অন্তত লন্ডন ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। কখনও ঝিরঝিরে বৃষ্টি। কখনও ঝিলমিল রোদ্দুর। এলোমেলো ঠান্ডা হওয়া। রাস্তার ধারে রঙিন ছাতার তলায় বসে এহেন পরিবেশে বিয়ার সেবন আর সমস্ত চেতনার মধ্যে ছড়িয়ে পড়া মনকেমন, তোমার জন্যে। তবে এই রোমান্টিক মনকেমন শেষ কথা নয়। তোমাকে যদি এই মুহূর্তে পেতাম, তাহলে এই পেলব আবেগ কাটিয়ে তীব্র গহন ক্ষুধা যে সমস্ত শরীরে জ্বলে উঠত না, এমন কথা হলপ করে বলতে পারি না। ইস! আমি যদি লরেন্স সাহেবের মতো লিখতে পারতাম:
But then came another hunger very deep and ravening ; the very body’s body crying out, the hunger for the Woman!
এত দূর থেকে আমার ৮৪ বছর বয়সে আমার এই দ্বিতীয় উপন্যাস আবার পড়তে পড়তে একটি প্রশ্ন আমার মনে জাগছেই। এই আমি কি সম্পূর্ণ মরে গেছি? চিতার শেষে শুধু গরম ছাইটুকু পড়ে আছে? সে যাই হোক, আমার এই দ্বিতীয় উপন্যাস লেখার পর আমি উপলব্ধি করলাম, লেখক হিসেবে আমি যতটুকু হই, যাই হই, বাংলা ভাষাই আমার অভয় অরণ্য। এখানেই কাটাব আমার বাকি জীবন। লেখা ছাড়া আর কোনও কাজ নেই আমার। আমার একমাত্র পরিচয় আমি লিখি। বাংলা না লিখলে আমি বাঁচব না। বাংলার সঙ্গে আমার দীর্ঘ সহবাসের উর্বরতা আজও অক্ষুণ্ণ। বাংলা ভাষা আজও আমাকে বলেনি, তুমি বড্ড বুড়ো হয়ে গেছ। আর তোমাকে দরকার নেই। বরং বলছে, এই যে তুমি বদলে যাচ্ছ, আর আমাকেও বদলে নিচ্ছ তোমার পছন্দ মতো, বেশ লাগছে তোমার এই নতুন প্রত্যয় ও প্রাণ! তোমার শরীর মনের বদলের সঙ্গে তোমার সঙ্গে ঘরকরার ভঙ্গিটা আমিও তো পাল্টেছি। বুঝতে পারনি?
………………………………………… দ্বিতীয় বই-এর অন্যান্য লেখা ……………………………………….
মন্দাক্রান্তা সেন-এর লেখা: অবাধ্য হৃদয়ের কথা অন্যভাবে বলতে চেয়েছিলাম আমার দ্বিতীয় বইয়ে
অনিতা অগ্নিহোত্রী-র লেখা: পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ শুধু নয়, বহু অনাগত উপন্যাসের সম্ভাবনাও ছিল ‘বৃষ্টি আসবে’ বইটিতে