তথ্যচিত্র প্রদর্শনের পরের দিন বুদ্ধদেবকে ফোন করে একটি বিশেষ দৃশ্য বাদ দিতে বলেন গণেশ। এই মতামত তাঁর নিজস্ব ছিল না কিন্তু এই মতামতের মানরক্ষা তাঁকে করতে হয়েছিল। বুদ্ধদেব ওঁকে বোঝান যে, তা সম্ভব নয়, গণেশ তবু জোর করেন। এক সময়ে বুদ্ধদেব বলেন, তিনি গণেশ যা বলছেন, তাই করবেন কিন্তু তার বদলে গণেশকেও তাঁর কোনও একটি পেইন্টিংয়ের বিশেষ কোনও জায়গা বুদ্ধদেবের কথামতো কেটে বাদ দিয়ে দিতে হবে।
যে-কলকাতায় জন্মাইনি, অথচ যে-কলকাতার গল্প শুনে এখনও তার প্রেমে পড়ি– সেই ছয়ের দশকের কলকাতায় ছড়ানো-ছিটোনো ছিল কিছু ‘ঠেক’। এইসব ঠেকে আড্ডা জমাত বেশ কিছু ছেলেপিলে, যাদের মাথায় অনেকটা স্বপ্ন আর বুকে অনেকটা আগুন। এরা পরে কেউ কেউ কেউকেটা হয়ে উঠেছেন, কেউ কেউ হননি এবং তাতে কিছু যায়-আসে না। এমনই এক ঠেক ছিল এসপ্ল্যানেড-এর মোড়ে কে.সি দাশের দোতলা দোকানটি। চা, ডালপুরি, ছোলার ডাল বা আলুর দম-এর এই ঠেক বিখ্যাত ছিল, বিশেষ করে বিমল করের জন্য।
বিমল কর সে সময়ের ডাকসাইটে লেখক তো বটেই, উপরন্তু ‘দেশ’ পত্রিকার হত্তা-কত্তা। অত্যন্ত বন্ধুবৎসল মানুষ, কে. সি দাশে তাঁর টেবিলে গিয়ে যিনিই বসুন না কেন, বিল মেটাতেন বিমল কর। তো কে. সি দাশে কোনও এক হারিয়ে যাওয়া দুপুরে হন্তদন্ত হয়ে হাজির হয় এক তরুণ, সদ্য একটি বিজ্ঞাপনের কাজ বাগিয়েছে সে। স্বপ্ন দ্যাখে কোনও একদিন সিনেমা বানানোর, নিজের মতো করে নিজের সিনেমা, কিন্তু সে স্বপ্ন তখনও নাগালের অনেক বাইরে। বন্ধুদের টেবিলে গিয়ে বসে সে বলে, এই বিজ্ঞাপনের কাজটি তার খুবই দরকার, মাথায় একটি চমৎকার আইডিয়া এসেছে কিন্তু সে একেবারেই ছবি আঁকতে পারে না আর এই সামান্য টাকায় কোনও আর্টিস্টও স্টোরি বোর্ড করে দেবে না। কী করা যায় বা যায় না– সেই নিয়ে আলোচনা যখন তুঙ্গে, তখন আরেক তরুণ, যে এতক্ষণ চুপচাপ আপনমনে বসেছিল সামনে জল কেটে যাওয়া ঠান্ডা চা নিয়ে– সে ঝোলা থেকে বের করে আনল, ছবি আঁকার খাতা, চারকোল পেনসিল, কালো কালির পেন। বলল, ‘বলো দেখি তোমার আইডিয়া, আঁকতে পারি কি না।’ অতঃপর, সাদা পাতায় ফুটে উঠল দেশলাইয়ের বিজ্ঞাপন-এর স্টোরি বোর্ড, সেই স্টোরি বোর্ড থেকে তৈরি হল জনৈক বিজ্ঞাপনের ছবি। সেই দুপুর, আর সেই শহরের মতোই হারিয়ে গিয়েছে গণেশ পাইনের আঁকা কোনও এক হারিয়ে যাওয়া দেশলাই কোম্পানির বিজ্ঞাপনের স্টোরি-বোর্ড, হারিয়ে গিয়েছে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর বানানো বিজ্ঞাপন ছবিটিও। তবু এ শহরেরই আকাশে বাতাসে থেকে গিয়েছে সেই দুই অর্বাচীন, স্বপ্ন দেখে ফেরা ছেলের গল্প যাঁরা আরও অনেক পরে স্বপ্ন দেখানোর কারিগর হয়ে উঠবেন। তাঁদের ক্যানভাস আর পর্দা পৃথিবীবিখ্যাত হবে।
সেই দেশলাই-এর বিজ্ঞাপনের বহু বহু বছর পর, গণেশ পাইন আর বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর বন্ধুত্ব একটি বড়সড় কোলাবরেশনের জায়গায় পৌঁছয় ১৯৯৭ সালে, ফিল্মস ডিভিশনের হয়ে যখন বুদ্ধদেব একটি তথ্যচিত্র বানান গণেশ পাইনের ওপর। বুদ্ধদেব ছিলেন ছবি এবং সংগীতের আপাদমস্তক ভক্ত, শুনেছি তেমনটাই সিনেমার প্রেমে পাগল ছিলেন গণেশও– অতএব এই কোলাবরেশনে খুশি হয়েছিলেন দু’জনেই, গণেশ চেয়েছিলেন তাঁকে নিয়ে এই কাজটি করুক বুদ্ধদেব আর বুদ্ধদেবও চেয়েছিলেন তাঁর ছবিতে ফুটিয়ে তুলতে গণেশের ছবির পৃথিবী, কিন্তু আমার প্রশ্ন ছিল– এই কাজটা সম্ভব হল কী করে! গণেশ পাইন এবং বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত– দু’জনেই ছিলেন অত্যন্ত স্বল্পবাক মানুষ, অন্তত আমি তাদের যেভাবে দেখছি। নিশ্চয়ই নিজেদের নিজেদের আড্ডায় তাঁরা অন্যরকম ছিলেন, কিন্তু এত কম কথা বলে, বা প্রায় শোনা যায় না এমন কথোপকথনে কীভাবে একটি অসামান্য তথ্যচিত্র তৈরি হয়ে উঠতে পারে, তা আমার জানা নেই।
প্রায়শই প্রশ্ন করতাম বুদ্ধদাকে, গণেশ পাইনের গলার স্বর কেমন? বুদ্ধদেব মুচকি হাসতেন। আমার ওঁদের দেখে মনে হত দু’জনের মধ্যেই এক অপার মহাসাগরের স্তব্ধতা আর রহস্যময়তা আছে, আছে সেই রং আর সেই সুর। তথ্যচিত্রটিও ঠিক তেমনই তৈরি হয়েছিল। গভীর, স্তব্ধ অথচ অদ্ভুত বাঙ্ময়, যে স্তব্ধতা ছবির শেষেও উচ্চারিত হতে থাকে ভেতরের ঘাত-প্রতিঘাতে।
অনেক পরে, অন্য একটি কাজের শুটিংয়ের সময় গণেশ পাইনের উত্তর কলকাতার বাড়ির সামনের সেই আড়াই হাত চওড়া বিনুনির মতো গলিতে দাঁড়িয়ে বুদ্ধদেব বলেছিলেন যে এই পাড়া, এই গলি, এই স্যাঁতসেতে পুরনো বাড়ির পুরনো ঘুরপাক খাওয়া সিঁড়ি, দালান, খিলান– এই সব গণেশ পাইনের খুব প্রাণের ছিল। এই বাড়ি, তার গল্প, নোনা ধরা দেওয়ালে দেওয়ালে সেইসব গল্পের ছবি, এই বাড়ির মানুষগুলো, এই ভিজে ভিজে আঁধার, লোহার শিকের জানলা দিয়ে তেরচাভাবে এসে পড়া, ম্যাড়ম্যাড়ে গোধুলির আলো– এইসব ছিল গণেশ পাইন-এর ছবির আঁতুড়ঘর, তাঁর ছবির কারখানা। বাড়ি বদলের পর নাকি গণেশ আরও চুপচাপ, বিষণ্ণ হয়ে উঠেছিলেন। ওঁরা দু’জনেই থাকতেন ঢাকুরিয়া লেকের খুব কাছে, দু’জনেই হাঁটতে যেতেন লেকে, দেখা হত, মাঝে মাঝে দু’টি কথা হত, গণেশ বলতেন দক্ষিণ কলকাতা, তার ভূগোল আর স্থাপত্য, এ প্রান্তের মানুষকে গণেশ নিজের করে উঠতে পারেননি। সে সময়কার ঢাকুরিয়া লেক এত সুন্দর, সাজানো-গোছানো ছিল না, পিছনের দিকটা, মানে ঢাকুরিয়া, মুদিয়ালির দিকটা ছিল একেবারে ফাঁকা ফাঁকা, বিশাল বিশাল গাছের জঙ্গল। যাঁরা রোজ হাঁটতে যেতেন লেকে, তাঁরাও ওই দিকটায় কমই যেতেন। গণেশ ও বুদ্ধদেব– দু’জনেরই আবার লেক-এর ওই নির্জন, দুর্গম জঙ্গলটি বড় প্রিয় ছিল। এরকম নাকি হয়েই থাকত, যে বুদ্ধদেব সেই বিশাল গাছগুলির কাছে গিয়ে দেখেন জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঢলা পাজামা, খাদির পাঞ্জাবি পরা মগ্ন শিল্পী। তথ্যচিত্রটি শেষ হয় এই জঙ্গলের মধ্যে, গাছগুলির ওপর। সেই গাছেরা এখনও আছে, হারিয়ে যাওয়া অনেক কিছুর মধ্যে।
ছবিটি শেষ হওয়ার পর একটি মনোমালিন্যকে ঘিরে দুই বন্ধুর বন্ধুত্বে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল বেশ কিছু বছরের জন্য। নন্দন ৩-এ ছবিটির প্রথম প্রদর্শনে ছিলেন অনেক গুণীজন। ছবিটি অসম্ভব সমাদৃত হয়। খুব খুশি হন গণেশ পাইন নিজে। শুনেছি, ছবি দেখানো শেষ হওয়ার পর করমর্দন করেছিলেন দুই শিল্পী। গণেশ দু’হাতে বুদ্ধদেবের হাতখানি ধরে রেখেছিলেন বেশ কিছুক্ষণ, একে-অপরের চোখে চোখ রেখে। কিন্তু কোনও এক অদ্ভুত কারণে, পরের দিন বুদ্ধদেবকে ফোন করে একটি বিশেষ দৃশ্য বাদ দিতে বলেন গণেশ। বলতে বাধা নেই, এই মতামত তাঁর নিজস্ব ছিল না কিন্তু এই মতামতের মানরক্ষা তাঁকে করতে হয়েছিল। বুদ্ধদেব ওঁকে বোঝান যে, তা সম্ভব নয়, গণেশ তবু জোর করেন। এক সময়ে বুদ্ধদেব বলেন, তিনি গণেশ যা বলছেন, তাই করবেন কিন্তু তার বদলে গণেশকেও তাঁর কোনও একটি পেইন্টিংয়ের বিশেষ কোনও জায়গা বুদ্ধদেবের কথামতো কেটে বাদ দিয়ে দিতে হবে। বলা বাহুল্য, এরপর আর এই বিষয়ে কথা এগোয়নি ওঁদের। যাঁদের প্রকাশ এত নীরব, তাঁদের অভিমান যে কত নিস্তব্ধ হতে পারে, তা বোধহয় শুধু গাছেরাই জানে।
…………………………………………………….
আরও পড়ুন গৌরবকেতন লাহিড়ীর লেখা: কবিতাই লিখতে চেয়েছিলেন গণেশ পাইন
…………………………………………………….
এর বহু বছর পর কোনও একটি ছবির এগজিবিশনে দু’জনের দেখা। দু’জনেই ভারি সুন্দর হাসলেন, কাছে এসে ধরে থাকলেন পরস্পরের হাত, এত দিন বাদে নিভৃতে বেশ খানিক্ষণ গল্প করলেন। পরে, আমি বুদ্ধদাকে জিজ্ঞেস করলাম, কী গল্প করলেন? বুদ্ধদেব মুচকি হেসে বললেন, ‘সে অনেক কথা।’ আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওঁর কথা তুমি শুনতে পেয়ছ? গণেশ পাইনের গলার স্বর কেমন?’ চা-এ চুমুক দিতে দিতে হো-হো করে খুব খানিক হাসলেন বুদ্ধদেব।
এর কিছু সময়ের মধ্যেই চলে যান গণেশ, আচমকা, অসময়ে। চলে গিয়েছেন বুদ্ধদেবও। আরও অনেক আশ্চর্য সব বন্ধুত্বের গল্পের মতো তাঁদের সেই সখ্য-র গল্পও হারিয়ে গিয়েছে তারায় তারায়। রয়ে গিয়েছে, রয়ে যাবে তাঁদের নিজেদের ছবিগুলি– অটুট সদম্ভে।
…………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার.ইন
…………………………………………….