বিক্ষিপ্তভাবে হাংরি বুলেটিন বেরিয়েছে কখনও বাংলায়, কখনও ইংরাজিতে। ক্রমেই আন্দোলনের প্রধান মুখ হয়ে উঠেছেন মলয়। হাংরিদের সাহিত্যিক আদর্শে আকৃষ্ট হয়েছেন তরুণ সাহিত্যিকরা। হাংরি বুলেটিনে নতুনরা জায়গা পেয়েছেন। মলয়ই লিখে ফেলেছেন হাংরি আন্দোলনের ম্যানিফেস্টো। বাজার চলতি সাহিত্যের যাবতীয় গতানুগতিকতাকে নস্যাৎ করার কথা বলিষ্ঠভাবে ঘোষণা করে দিয়েছেন মলয় হাংরি আন্দোলনের ইশতাহারে। বাস্তবকে গ্রহণ করার কথা বলেছেন পরীক্ষামূলকভাবে। সাহিত্যে নির্দয়-নির্মম-নগ্নভাবে আত্মার বন্দিত্বকে মুক্ত করতে চেয়েছেন, সর্বাগ্রে জানান দিতে চেয়েছেন অস্তিত্বকে।
‘বেঁচে থাকার কোন কার্যকারণ নেই জানার পরেও মানুষ মৃত্যু পর্যন্ত বেঁচে থাকে, মৃত্যু পর্যন্ত মৃত্যুর জন্যে জীবনপাতি শ্রম করে যায়, বেঁচে থাকে, কারণ ব্যক্তি জীবনের সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে যে হাঁ-মুখ, যে ক্ষুধা, যে অজানা অপেক্ষা, যে যাত্রা, তা তাকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে বাধ্য করে, আর করে বলেই কবিতার প্রয়োজন হয়।’– মলয়ের আনখসত্তায় মিশে রইল এই সত্যোপলব্ধি। এ অনুভবী উচ্চারণ মলয়েরই। হাংরি জেনারেশন স্রষ্টা মলয় রায়চৌধুরী। ৬০ বছর পেরিয়ে এসে আজ হাংরি জেনারেশন আন্দোলন তো ইতিহাস। আর সেই ইতিহাসের ট্র্যাজিক হিরো মলয় রায়চৌধুরী।
বিশ শতকের ছয়ের দশকে হাংরি আন্দোলনকারীরা সাহিত্যে আপন অন্তরাত্মার সত্য স্বরূপ উন্মোচনের যে তাগিদ অনুভব করেছিলেন, আজীবন সেই সত্যের কাছেই নতজানু থেকেছেন মলয়। বহুত্বময় সত্য ছাড়া কবিতা তথা সাহিত্যের সঙ্গে আর কোনও কিছুরই কোনও সম্পর্ক নেই বলে বিশ্বাস করে এসেছেন বরাবর। ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত হাংরি আন্দোলনের একটি বুলেটিনে ‘মৃত্যুমেধী শাস্ত্র’ শিরোনামে মলয় লিখেছিলেন, ‘আমাদের কবিতা নিজের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে নিজের বিদ্রোহ, নিজেকে দেখা আর দেখানো, নিজেকে খুঁচিয়ে জখম করে নিজের আসল স্বরূপ উদঘাটন, নিজের সামনে নিজেকে দাঁড় করিয়ে গায়ের চামড়া হিঁচড়ে উপড়ে ফেলে দেহের ক্রদ্ধ কেউটের মতো শিরামহলকে ষড়যন্ত্ররত অবস্থায় মেলে ধরা। তা হল আত্মপ্রত্যাখ্যান, আত্মগ্রাস, আত্মউপলব্ধি, আত্মউন্মোচন, আত্মপীড়ন, আত্মস্বীকারোক্তি, আত্মপ্রার্থনা।’ মলয় রায়চৌধুরীর সমূহ সৃষ্টির প্রেরণা এহেন আত্মনিবেদন।
মাত্র ২২ বছর বয়সে মলয় রায়চৌধুরী জড়িয়ে পড়েছিলেন হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে। মলয় তখন সদ্য পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থশাস্ত্রে মাস্টার্স করেছেন। দিল্লি স্কুল অফ ইকনোমিকসে পড়ার জন্য বাবা যখন চাপ দিচ্ছেন, তখনই ইংরেজ কবি জিওফ্রে চসারের ‘In the sower hungry time’ বাক্যবন্ধটির বিশেষ করে ‘হাংরি’ শব্দটিতে আটকে পড়েছে মলয়ের মন। ঐতিহাসিক অসওয়াল স্পেংলারের সাংস্কৃতিক অবক্ষয়কালীন সর্বগ্রাস তত্ত্বে ‘হাংরি’ শব্দটির দার্শনিক ভিত্তি খুঁজে পেলেন মলয়। আপন হৃদয়সত্যকে উপলব্ধি এবং প্রকাশ করার অনন্ত ক্ষুধা অনুভব করলেন। গড়ে তুললেন হাংরি আন্দোলন।
প্রথম দিকে হাংরি আন্দোলন তেমন কোনও সংঘবদ্ধ প্রয়াস ছিল না। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, মলয়ের দাদা সমীর রায়চৌধুরী, দেবী রায় ওরফে হারাধন ধাড়া ( গত মাসে প্রয়াত হয়েছেন) এবং মলয় রায়চৌধুরী এই চারজনের প্রথাবিরোধী চিন্তা একসূত্রে বাঁধা পড়েছিল প্রথম হাংরি বুলেটিনে। প্রকাশিত হয়েছিল নভেম্বর ১৯৬১-তে। ছাপা হয়েছিল স্রষ্টা মলয় রায়চৌধুরী। নেতৃত্ব শক্তি চট্টোপাধ্যায়। সম্পাদনা দেবী রায়। হাংরিরা সাহিত্যকে করে তুলতে চেয়েছিলেন পক্ষপাতহীন আমিত্বের নির্মম নগ্ন প্রকাশ! অন্তরাত্মার অপরিসীম বিরক্তিতে জীবন-ধর্ম-রাজনীতি- ঈশ্বর সম্পর্কে যখন বদলে গেছে বহমান ধারণা, তখন বহিরাত্মা ক্ষুধা নিবৃত্ত করতে চেয়েছে বিদ্রোহের মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠান, এমনকী, প্রতিষ্ঠার তোয়াক্কা না করে বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে হাংরি জেনারেশন।
বিক্ষিপ্তভাবে হাংরি বুলেটিন বেরিয়েছে কখনও বাংলায়, কখনও ইংরাজিতে। ক্রমেই আন্দোলনের প্রধান মুখ হয়ে উঠেছেন মলয়। হাংরিদের সাহিত্যিক আদর্শে আকৃষ্ট হয়েছেন তরুণ সাহিত্যিকরা। হাংরি বুলেটিনে নতুনরা জায়গা পেয়েছেন। মলয়ই লিখে ফেলেছেন হাংরি আন্দোলনের ম্যানিফেস্টো। বাজার চলতি সাহিত্যের যাবতীয় গতানুগতিকতাকে নস্যাৎ করার কথা বলিষ্ঠভাবে ঘোষণা করে দিয়েছেন মলয় হাংরি আন্দোলনের ইশতাহারে। বাস্তবকে গ্রহণ করার কথা বলেছেন পরীক্ষামূলকভাবে। সাহিত্যে নির্দয়-নির্মম-নগ্নভাবে আত্মার বন্দিত্বকে মুক্ত করতে চেয়েছেন, সর্বাগ্রে জানান দিতে চেয়েছেন অস্তিত্বকে। হাংরিদের সাহিত্যচর্চা প্রভাবিত করেছিল তাদের জীবনযাত্রাকেও। জীবন, সমাজ ও সময়ের প্রতি তীব্র ঘৃণা এবং বিতৃষ্ণ থেকে হাংরিরা অদ্ভুত পোশাক পরিচ্ছদ পরতেন, বিচিত্র নেশাভাঙ করতেন এবং তার সঙ্গে ছিল নানা উদ্ভট আচরণ। এসবের ক্ষেত্রেও মলয়ই ছিলেন মধ্যমণি!
মোট ১০টি সংখ্যা বেরিয়েছিল ‘হাংরি জেনারেশন’ পত্রিকার। সপ্তম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল অশ্লীলতার অভিযোগে অভিযুক্ত শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতা ‘ঘোড়ার সঙ্গে ভৌতিক কথাবার্তা’। সমাজের বৃহত্তর অংশ হাংরিদের সাহিত্য গ্রহণ করতে চায়নি। অষ্টম সংখ্যাটির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল ‘Obscene unauthoorised publication’-এর। জোড়াবাগান থানায় এফ.আই.আর দায়ের হল। তারপরের ইতিহাস কমবেশি সকলেরই জানা। গ্রেপ্তার হলেন শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, দেবী রায়, সমীর রায়চৌধুরী এবং মলয় রায়চৌধুরী। ছ’জন গ্রেপ্তার হলেও মামলা দায়ের হল কেবল মলয় রায়চৌধুরীর নামে। অষ্টম সংখ্যায় প্রকাশিত মলয়ের ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটিকে অশ্লীলতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হল। স্বাভাবিক ভাবেই ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে হাংরি আন্দোলন। ১৯৬৪-র ৪ সেপ্টেম্বর পাটনা থেকে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মলয়। সাহিত্যের জন্য মলয়কে আইনি লড়াই চালাতে হল ১৯৬৭-র ২৬ জুলাই অবধি। তবু হাল ছাড়েননি তিনি। ১৯৬৫ এবং ১৯৬৭-তে মলয় বের করেছিলেন হাংরি জেনারেশনেরই চিন্তার প্রকাশক ‘জেব্রা’ পত্রিকা। আইনি লড়াই শেষ হতে ‘হাংরি জেনারেশন’-এর নবম ও দশম সংখ্যাও প্রকাশ করেন তিনি। ততদিনে অন্যান্য হাংরি আন্দোলনকারী নানা পত্রিকাকে কেন্দ্র করে তাঁদের সাহিত্যচর্চা শুরু করেছেন। মলয়ও থেমে থাকেননি। সহযোদ্ধাদের সঙ্গে মনোমালিন্য হয়েছে ঠিকই, হাংরি আদর্শের সঙ্গে মলয়ের সম্পর্ক আজীবন অটুট থেকেছে। তিনি নিরন্তর লিখে গেছেন হাংরি আন্দোলনের কথা, হাংরিদের সাহিত্যের কথা, হাংরি সাহিত্য। তাঁর সৃষ্টির প্রতিটি পাতায় টের পাওয়া যাবে হাংরি উত্তাপ!
জাতি হিসেবে বাঙালি নির্বাক ছিল না কখনও, তার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির দিকচিহ্নগুলিকে আবারও নতুন করে ফিরে দেখা সম্ভব হবে, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। পৃথিবীর তাবৎ সংস্কৃতি গবেষণার চিন্তন-ভূগোলে বাংলা ভাষা এবং বাঙালি সাংস্কৃতিক নতুনতর মাত্রা যোগ করবে– এ দাবি অহেতুক নয়।