এমন টান টান শিকার কাহিনির মণিমুক্তো তাঁর বইয়ের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে। কিন্তু জন্মের ১৫০ বছর পর শুধু তাঁর শিকার অভিজ্ঞতার জন্য তাঁকে আমরা মনে রাখিনি। জীবৎকালে তিনি কতগুলি মানুষখেকো বাঘ মেরেছিলেন সে পরিসংখ্যানের চেয়েও অনেকবেশি গুরুত্বপূর্ণ বাঘ এবং জীববৈচিত্র সংরক্ষণে তাঁর ব্যতিক্রমী ভূমিকার কথা। ‘প্রাণীজগৎ থেকে বাঘ যেদিন লোপ পেয়ে যাবে সেদিন ভারতবর্ষের যে অপরিপূরণীয় ক্ষতি হবে তা বলার নয়। আর বাঘকে যদি আমরা বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা না করি তাহলে সে যে কালক্রমে লোপ পাবেই একথা নিশ্চিন্ত।’
আজ সেই বালকের ১৫০তম জন্মদিন। যে বালক জরাজীর্ণ গাদা বন্দুক হাতে তরাই এবং ভাবরের জঙ্গলে ঘুরে-ঘুরে বেড়াত একা। রাত্রিবেলা শুয়ে পড়ত জঙ্গলের যেখানে-সেখানে। ছোট্ট একটু আগুন জ্বালিয়ে নিত পাশে। জঙ্গলের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভেসে আসা বাঘের ডাকে তার ঘুম ভেঙে যেত মাঝে মাঝেই। আর দু’-একটা শুকনো কাঠ আগুনে গুঁজে দিয়ে নিশ্চিন্তে পাশ ফিরে শুত সে।
সেই বালক জানত, বিরক্ত না করলে বাঘ কখনও কিছু করে না। আর দিনের বেলা বাঘকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে যেত, একান্ত সামনে পড়লে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ত। একবার বালক বয়সেই খানিকটা খোলা জায়গায় গোটা ছয়েক মুরগি চরছিল– তাদের কাছে চুপিসারে যেতে গিয়ে একটা কুলগাছের ঝোপের মধ্যে উঁকি মারতেই মুখোমুখি এক বিশাল বাঘ! বাঘটা বালকের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তাকে স্থিরভাবে দাঁড়াতে দেখে ধীরেসুস্থে সরে গেল, একটি বারও পিছন ফিরে না তাকিয়ে।
হ্যাঁ, এই বালকই পৃথিবী বিখ্যাত শিকারি এডওয়ার্ড জেমস করবেট (১৮৭৫-১৯৫৫)। সকলের প্রিয় জিম করবেট (Jim Corbett)।
তাঁর বিখ্যাত বই ‘কুমায়ুনের মানুষখেকো বাঘ’-এর ভূমিকায় নিজের ছেলেবেলার কথা শোনাতে গিয়ে এই অভিজ্ঞতা জানিয়েছিলেন করবেট। তাঁর রোমহর্ষক শিকারের গল্প আজও ছোট-বড় প্রত্যেকের কাছে সমান জনপ্রিয়।
‘…আমি ঠিক করলাম মৃতদেহের কাছাকাছি গা ঢাকা দিয়ে থাকব অপেক্ষায়। কাছাকাছির মধ্যে একটিই গাছ ছিল, লোকেরা যখন তার ওপর উঠে মাচান বাঁধছে তখন নিচে পাহাড়তলিতে বাঘের গর্জন শোনা গেল। খুব তাড়াতাড়ি করে দুটো ডালের মধ্যে কয়েক টুকরো দড়ি বাঁধা হল। ইবটসেন নিচে রাইফেল হাতে পাহারা দিতে লাগলেন, আর আমি গাছে উঠে মাচানটায় বসলাম। আমি মাচানে বসেছি বহুবার, কিন্তু এবারকার মতো কষ্ট বোধ হয় আর কখনো পাইনি। গাছটা পাহাড় থেকে ঝুঁকে পড়েছিল, এই গাছের এমন জায়গায় আমি বসেছিলাম যে একচুল এদিক-ওদিক হলেই একেবারে একশো ফুট নিচে পাথর ভরতি নালায় গিয়ে পড়তাম।…’
এমন টান টান শিকার কাহিনির মণিমুক্তো তাঁর বইয়ের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে। কিন্তু জন্মের ১৫০ বছর পর শুধু তাঁর শিকার অভিজ্ঞতার জন্য তাঁকে আমরা মনে রাখিনি। জীবৎকালে তিনি কতগুলি মানুষখেকো বাঘ মেরেছিলেন সে পরিসংখ্যানের চেয়েও অনেকবেশি গুরুত্বপূর্ণ বাঘ এবং জীববৈচিত্র সংরক্ষণে তাঁর ব্যতিক্রমী ভূমিকার কথা। ‘প্রাণীজগৎ থেকে বাঘ যেদিন লোপ পেয়ে যাবে সেদিন ভারতবর্ষের যে অপরিপূরণীয় ক্ষতি হবে তা বলার নয়। আর বাঘকে যদি আমরা বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা না করি তাহলে সে যে কালক্রমে লোপ পাবেই একথা নিশ্চিন্ত।’
…………………………….
জিম করবেট মানুষখেকো বাঘকে বাধ্য হয়ে মেরেছেন, কিন্তু প্রতিটি বাঘের মৃত্যুই যে তাঁকে ব্যথিত করেছে, তা ফুটে উঠেছে তাঁর লেখায়। মানুষ যে বাঘের স্বাভাবিক খাদ্য-তালিকার অন্তর্গত নয়, একথা বারবার বলেছেন। কেন, কোন পরিস্থিতিতে বাঘ ‘মানুষখেকো’ হয়ে ওঠে, একথা নিখুঁতভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। এবং আজকের দিনে দাঁড়িয়েও সেসব যুক্তি যথার্থ ও প্রাসঙ্গিক। প্রকৃতপক্ষে জিম করবেট যেভাবে জঙ্গলকে, জঙ্গলের প্রাণীদের দেখেছেন, তেমনিভাবে দেখেছেন খুব কম মানুষই।
…………………………….
না, এটা ২০২৫ সালের বাঘ দিবসে কেন্দ্রীয় পরিবেশমন্ত্রীর বক্তব্য নয়, একথা জিম করবেট লিখেছিলেন ১৯৪৪ সালে। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন ১৯৪৪ সালে। মনে রাখতে হবে, তার আগের প্রায় ১৫০ বছরে গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে অবাধে বন্যপ্রাণী নিধন হয়েছে, প্রতিটি পশু, বিশেষত বাঘকে হত্যা করা গৌরবের প্রতীক, বীরত্বের আস্ফালন হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এই উপলব্ধি সহজ কথা নয়।
জিম করবেট মানুষখেকো বাঘকে বাধ্য হয়ে মেরেছেন, কিন্তু প্রতিটি বাঘের মৃত্যুই যে তাঁকে ব্যথিত করেছে, তা ফুটে উঠেছে তাঁর লেখায়। মানুষ যে বাঘের স্বাভাবিক খাদ্য-তালিকার অন্তর্গত নয়, একথা বারবার বলেছেন। কেন, কোন পরিস্থিতিতে বাঘ ‘মানুষখেকো’ হয়ে ওঠে, একথা নিখুঁতভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। এবং আজকের দিনে দাঁড়িয়েও সেসব যুক্তি যথার্থ ও প্রাসঙ্গিক। প্রকৃতপক্ষে জিম করবেট যেভাবে জঙ্গলকে, জঙ্গলের প্রাণীদের দেখেছেন, তেমনিভাবে দেখেছেন খুব কম মানুষই। বিশেষত বাঘের গতিবিধি, বাঘের স্বভাব, বাঘের আচার-আচরণ কী নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন ভাবলে সত্যিই অবাক হতে হয়! এখনও প্রাণীবিজ্ঞানীরা তাঁর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার বিবরণ পড়ে বিস্মিত হন। জঙ্গলের মধ্যে বাঘের প্রতিটি পদক্ষেপ অনুসরণ করেছেন জীবন সংশয় নিয়ে। প্রতিটি বাঘ শিকারের আগে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করেছেন যে, বাঘটি সত্যিই ‘মানুষখেকো’ কি না, ১০০ শতাংশ নিশ্চিত না হলে ট্রিগারে চাপ দেননি।
ইস্পাতের মতো স্নায়ু, অসীম সাহস, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিশক্তি, অব্যর্থ নিশানার সঙ্গে সঙ্গে জিম করবেট ছিলেন একজন মমতাময় মানুষ। জঙ্গলের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল গভীর এবং নিখাদ। ‘আর সব প্রাণীর মতো বাঘও অবস্থার দাস, সুতরাং যদিও বা কখনও দায়ে পড়ে সে একটা-আধটা মানুষ মারে, কিংবা স্বাভাবিক খাদ্যে ঘাটতি পড়লে গরু-বাছুরের ওপর নজর দেয় তাহলে তাকে বিশেষ দোষ দেওয়া চলে না। আর সত্য বলতে কী, যতগুলো দুষ্কর্মের জন্য বাঘকে দায়ী করা হয়, তার শতকরা দু’-ভাগও বোধহয় তার প্রাপ্য নয়।’ জিমের এ-কথা আজও সমান প্রাসঙ্গিক।
‘বাঘের মতো নিষ্ঠুর’ বা ‘বাঘের মতো রক্তপিপাসু’ এসব কথা কখনও মন থেকে মেনে নিতে পারতেন না। বারবার বিভিন্ন লেখায় বাঘকে ‘সাহসী প্রাণী’ বলেছেন। আর বলেছেন, ভারতের জীববৈচিত্র রক্ষায় বাঘের মতো প্রাণীর অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার গুরুত্বের কথা।
অবস্থানগত দিক থেকে তাঁর নামাঙ্কিত ‘জিম করবেট জাতীয় উদ্যান’ আজ যেমন ভারতের মানচিত্রের বক্ষস্থলে অবস্থিত, ঠিক তেমনই ভারতের প্রকৃতি-পরিবেশ সচেতন প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের অন্তঃস্থলে চিরকালীন ভালোবাসার স্থায়ী আসন দখল করে নিয়েছেন আজ থেকে ঠিক ১৫০ বছর আগে জন্মানো ছয় ফুট দুই ইঞ্চির নীল চোখের বিনয়ী, লাজুক, ইংরেজ শিকারি এবং পরিবেশ সংরক্ষণবিদ জিম করবেট।
……………………………
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
……………………………
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved