শান্তিনিকেতনে বাংলা শেখা শুরু করলাম। এ-কথা আমরা সকলেই জানি যে, যে কোনও ভাষা শেখার জন্য সে ভাষায় কথা বলা ভীষণ জরুরি। তাই আমিও শান্তিনিকেতনে লোকজনের সঙ্গে আলাপ করা, কথা বলা শুরু করলাম বাংলা ভাষাটাকে আয়ত্ত করার জন্য। শান্তিনিকেতনের একদম ভেতরে, প্রত্যন্ত গ্রামেও চলে গেছিলাম। সাইকেল চালিয়ে পাড়ি দিতাম দূরে, বাংলায় কথা বলব বলে। বাংলায় কথা বলব বলে। প্রতিদিন দু’ থেকে তিন ঘণ্টা প্রতিদিন বাংলা পড়তাম। সঙ্গে চলছিল গবেষণার কাজও।
১৯৭৩ সালে প্রথম কলকাতা এসেছিলাম। ডাক এসেছিল গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশনে জার্মান শেখানোর জন্য। জার্মান ভাষা পড়াব– এই প্রস্তাব পছন্দ হয়ে যাওয়ায় চলে এসেছিলাম। তখন কোনও বিশাল পরিকল্পনা ছিল না আমার জীবন নিয়ে। জানতাম না সামনে কী অপেক্ষা করছে আমার জন্য। ভাবিনি এই কলকাতা ছেড়ে আর কোনও দিনই যাওয়া হবে না আমার। প্রাথমিকভাবে যেহেতু একবছরের কাজ ছিল, তাই বাংলা ভাষা শেখার প্রয়োজন পড়েনি। ভেবেছিলাম ফিরেই তো যাব, নতুন ভাষা শেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
একবছরের বদলে তিনবছর থেকে গেলাম।
ফিরে গেলাম বটে জার্মানি, কিন্তু সেটা মোটে তিন মাসের জন্য। আবারও কলকাতা চলে আসতে হল। এবার যখন ফিরলাম, তখন ঠিক করলাম ভারতীয় দর্শন নিয়ে পড়াশোনা করব। ভারতকে ভেতর থেকে জানা খুব জরুরি। কারণ তখন মনে মনে বুঝতে পারছিলাম এ দেশ থেকে সহজে মুক্তি নেই আমার। সে জন্যই হয়তো এই দেশটাকে জানার উৎসাহ তৈরি হল। সেবার টানা সাড়ে তিনবছর থাকলাম। পড়লাম রামকৃষ্ণের কথা, বিবেকানন্দের কথা।
তারপর চলে গেলাম মাদ্রাসে, তখনও চেন্নাই হয়নি। মাদ্রাসে গিয়ে আমি মাস্টার্স ডিগ্রি করলাম ভারতীয় দর্শন নিয়ে। আরও নিবিড়ভাবে ভারতকে বোঝা সেই শুরু আমার। দক্ষিণ ভারতে থাকতে ঠিক করেছিলাম তালিম বা মালায়ালাম শিখব। কিন্তু এই দুটো ভাষার উচ্চারণে আমার সমস্যা হচ্ছিল। কিন্তু কলকাতায় এতবছর থাকার ফলে দেখেছি বাংলা ভাষার উচ্চারণ ততটাও কঠিন নয়। আর তাছাড়া আমার বাংলায় কথাবার্তা শুনতে খুব ভালো লাগত। অতগুলো বছর বাংলা শোনার ফলে বাংলার সঙ্গে একটা সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল, বাংলা ভাষার প্রকাশভঙ্গির সঙ্গে পরিচিত হয়ে গিয়েছিলাম।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: বর্ণপরিচয়-ই আমার পড়া প্রথম বাংলা বই
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আমার ইচ্ছে ছিল সাংস্কৃতিক সাংবাদিক হব। এবং আমাকে নিজের কেরিয়ার তৈরি করতে হবে জার্মানিতে। তখনও আমি জানি জার্মানিতেই আমার বাসভূমি হবে। কর্মভূমি হবে। কিন্তু মাদ্রাস থেকে দেশে ফেরা হল না আমার। কোনও এক অমোঘ টান কাজ করছিল হয়তো। ঠিক করলাম শান্তিনিকেতনে যাব। গবেষণা করতে। মাদ্রাস থেকে সোজা শান্তিনিকেতন। গবেষণার বিষয় হিসেবে বেছে নিলাম রামকৃষ্ণের দর্শন। ইতিমধ্যে রামকৃষ্ণ মিশনে থাকাকালীন আমি এই দর্শনের সঙ্গে কিছুটা পরিচিত হয়েছি। আরও জানার ইচ্ছে নিয়ে দ্বিতীয় পিএইচডি করতে এলাম শান্তিনিকেতনে। এবার আর বাংলা না শিখলে হবে না। বাংলা ভাষা না শিখে রামকৃষ্ণকে বোঝা সম্ভব নয়। শান্তিনিকেতনে বাংলা শেখা শুরু করলাম। এ-কথা আমরা সকলেই জানি যে, যে কোনও ভাষা শেখার জন্য সে ভাষায় কথা বলা ভীষণ জরুরি। তাই আমিও শান্তিনিকেতনে লোকজনের সঙ্গে আলাপ করা, কথা বলা শুরু করলাম বাংলা ভাষাটাকে আয়ত্ত করার জন্য। শান্তিনিকেতনের একদম ভেতরে, প্রত্যন্ত গ্রামেও চলে গেছিলাম। সাইকেল চালিয়ে চলে যেতাম। বাংলায় কথা বলব বলে। প্রতিদিন দু’ থেকে তিন ঘণ্টা প্রতিদিন বাংলা পড়তাম। সঙ্গে চলছিল গবেষণার কাজও। আমাকে বাংলা শেখাতেন সুবর্ণা চ্যাটার্জি, তাঁর সঙ্গে আমার এখনও যোগাযোগ রয়েছে। আর গবেষণার কাজে আমার মাস্টারমশাই ছিলেন কালীদাস ভট্টাচার্য, প্রশান্তকুমার পাল। পরে তো আমি আর প্রশান্তকুমার পাল একসঙ্গে বইও করেছি।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এখন জার্মানিতে আছি। অসুস্থ হওয়ায় ফিরে এসেছি, একটা অপারেশনও হয়েছে। যদিও এবছরের শেষের দিকে ফেরার ইচ্ছে আছে। আসলে জলবায়ু সংকটের ফলে কলকাতার আবহাওয়া আমি আর সহ্য করতে পারছি না। অসুস্থ হয়ে পড়ছি, বয়সও হয়েছে অনেক, এখন তো আর আগের মতো সহ্যশক্তি নেই। তবে মনের শক্তি এখনও আছে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
দু’বছর পর অনুবাদের কাজ করব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। ‘রামকৃষ্ণ কথামৃত’। বাংলা শিখে প্রথম আমি এই বইটিই পড়েছিলাম। এর আগে কথামৃত-র অনুবাদ হয়েছে জার্মান ভাষায়। কিন্তু সেটা ইংরেজি থেকে। সেই অনুবাদটা খুব ভালো নয়, এবং সঠিকও নয়। তাই লাইন ধরে ধরে জার্মান ভাষায় কথামৃত অনুবাদ করার ইচ্ছে তৈরি হল। সেই অনুবাদ শেষ করতে আমার ১০ বছর সময় লেগেছে। এতটাই খুঁটিয়ে কাজ করতে হয়েছে। গবেষণা শেষ হওয়ার পরও তাই থেকে গেলাম। ইতিমধ্যে পড়তে শুরু করেছিলাম ‘গীতাঞ্জলি’। বাংলায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ার অনুভূতিই আলাদা। সেটা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। কত যে কবিতা পড়েছি, কত কবির। বাংলায় কবিতা পড়তে আমার সবচেয়ে ভালো লাগে। ‘গীতাঞ্জলি’-ও অনুবাদের কথা ভাবলাম। ২০০টি কবিতা অনুবাদ করেছি। জার্মানিতে আজ বহু মানুষ রবীন্দ্রনাথ ও রামকৃষ্ণ পড়ে। দেখে খুব ভালো লাগে।
‘নিয়োগী বুকস’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে আমার ৩টে ছোটদের বই। ‘আনন্দ পাবলিশার্স’ তার মধ্যে দুটো বই বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেছে। সত্যি বলতে, ছোটদের বই লিখে আমি সবথেকে গর্বিত। এই দুটো কাজ করে আমার ভীষণ আনন্দ হয়েছে।
তবে, বাংলা থেকে সেরকম স্বীকৃতি পাইনি। যদিও এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে সিস্টার নিবেদিতা ইউনিভার্সিটি থেকে আমাকে অনারারি ডি.লিট দেওয়া হল।
এখন জার্মানিতে আছি। অসুস্থ হওয়ায় ফিরে এসেছি, একটা অপারেশনও হয়েছে। যদিও এবছরের শেষের দিকে ফেরার ইচ্ছে আছে। আসলে জলবায়ু সংকটের ফলে কলকাতার আবহাওয়া আমি আর সহ্য করতে পারছি না। অসুস্থ হয়ে পড়ছি, বয়সও হয়েছে অনেক, এখন তো আর আগের মতো সহ্যশক্তি নেই। তবে মনের শক্তি এখনও আছে। আমি শান্তিনিকেতনে থাকতে খুবই অর্থকষ্টে থেকেছি, এসি-র প্রয়োজন হয়নি তখন। কিন্তু এখন বেশ কষ্ট হয়। তবে ডাক্তারের অনুমতি পেলে আবার আমি শান্তিনিকেতনে ফিরব। ৫০ বছর যেখানে থেকেছি, সেখান থেকে কি এত সহজে নিস্তার পাওয়া যায়?
এখন আমি ভারত নিয়ে একটা বই লিখছি জার্মান ভাষায়। আমার ভারত ভ্রমণ। এখন যে পর্বটা লিখছি, সেটা শাড়ি নিয়ে।এই পোশাকটার আমি খুবই ভক্ত। এই কাজটা আপাতত শেষ করতে চাই।
সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাই। নতুন বছর সবার ভালো কাটুক।
অনুলিখন তিতাস রায় বর্মন