Robbar

আমার বাবা জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী

Published by: Robbar Digital
  • Posted:August 19, 2025 7:11 pm
  • Updated:August 19, 2025 8:33 pm  
My father Jyotirindranath Nandi by Tirthankar Nandi। Robbar

আমি কখনও পিতৃদেবকে কোনও সভা-সমিতিতে দেখিনি। পাড়ায় ‘লেখক’ বলে পরিচয়ও দেয়নি। বরং মানুষ চিনত একজন অত‌্যন্ত সাধারণ মানুষ হিসাবে। যে-মানুষটি লেখক হতে পারে না। নায়ক হতে পারে না। যে মানুষটির গাড়ি হতে পারে না। যে মানুষটি রাতের পর রাত পানশালায় আড্ডা মারতে পারে না। শুধু পারে সৎভাবে জীবনযাপন করতে। নিজের লেখার উপর স্থির থাকতে। দু’বেলা নিয়ম করে লেখার টেবিলে বসতে।

তীর্থঙ্কর নন্দী

কিছু কিছু বাড়ি থাকে, ভোলা যায় না। যায় না স্মৃতির জন‌্য। আমার ক্ষেত্রে এই বাড়িটির কথা কখনও ভুলব না। যদিও আমি এই বাড়িতে জন্মাইনি, তবুও জন্মের পর যখন থেকে শিশুবোধ তৈরি হয় তখন থেকেই এই বাড়ি আমার কাছে এক মায়া। স্বপ্ন। শিয়ালদহ থেকে যে রেললাইন উল্টোডাঙার (বর্তমান নাম ‘বিধাননগর’) দিকে চলে গিয়েছে, সেই রেললাইনের ধারে ১৪৩ নং বাড়িটি। পাঁচের দশকে এই বাড়ির আশপাশে সবই কেমন ছোট নিচু বাড়ি। বড় উঁচু বাড়ি ছিলই না। রাস্তাঘাট ছিল ভাঙা। অপরিকল্পিত।

জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী। শিল্পী: হিরণ মিত্র

এইরকমই এক বাড়ির সন্ধান পিতৃদেব পায় কোনও দূর সম্পর্কের আত্মীয়র কাছ থেকে। বাড়িটিতে ছয় ঘর ভাড়াটে। একটিই বাথরুম, তাও খোলামেলা। মহিলাদের স্নান করতে একটু অসুবিধাই হত। অর্থাৎ, ‘বস্তি’ বলতে যা বোঝায়। বড় হয়ে বুঝেছি, কেন পিতৃদেব বস্তিতেই থাকত! এই বাড়িতে আসার আগে বেলেঘাটার রাসমণি বাগানের বাড়িটিও বস্তি ছিল। ‘বারো ঘর এক উঠোন’ সেই বাড়িতেই লেখা। আমি সেই বাড়িতে জন্মেছিলাম। কিন্তু পিতৃদেবের সঙ্গে বড় হয়েছি ১৪৩ নং-এ। আমার জ্ঞান-বোধ ফুটে ওঠেছিল ওই বাড়িতেই। বড় হয়ে মনে মনে প্রশ্ন করেছি, কেন পিতৃদেব বস্তিতেই অধিকাংশ সময় কাটায়? প্রশ্নের উত্তরে যা পাই, তা একমাত্র দারিদ্রের জন‌্য। অন‌্য কোনও কারণ এই মানুষের থাকতে পারে না। নেই। শৈশব থেকেই দেখি, একটি মানুষ কত ‘ডিসিপ্লিনড’ হতে পারে! ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে মানুষটির জীবন যেন বাঁধা।

এই বাড়িতেই আমার বড় হয়ে ওঠা, পিতৃদেবের সঙ্গে বড় হওয়া। মা এবং দাদা-দিদির সঙ্গে বড় হয়ে ওঠা। তবে পিতৃদেবের সঙ্গে বড় হয়ে ওঠার রোমাঞ্চটি একটু ভিন্ন। পৃথক। শৈশব থেকেই পিতৃদেবের শরীরের গন্ধ ঘরোয়া জামাকাপড়ে, গামছায়। আমি প্রতিটি জিনিসেই পিতৃদেবের উপস্থিতি টের পেতাম। এমনকী, বিড়ি বা পানের গন্ধে‌ও তার উপস্থিতি টের পেতাম। আসলে পিতৃদেবের প্রতিটি পদক্ষেপ আমি খুব নিবিড়ভাবে খেয়াল করতাম। বা খেয়াল করতে বাধ‌্য হতাম। এই বাড়ি থেকেই খুব ভোরে পিতৃদেবের সঙ্গে শিখেছি কেমনভাবে কুয়াশা ঢাকা রেললাইনে ফগ ক্লিয়ারেন্সের মাধ‌্যমে মানুষকে সচেতন করা যায়। বাগমারীর বড় কবরস্থানের সারিবদ্ধ হাজারো ফুলগাছের বাহার– কী অপূর্ব দৃশ‌্য! সেই দৃশ‌্য দেখতে দেখতে দু’জনে বড় হই। বড় হই কবরস্থানের পুকুরে জাল দেখতে দেখতে। মাছেরা জালের সময় কেমন ছটফট করে ইত‌্যাদি।

দেখতে দেখতে আরও বড় হই। পিতৃদেবও বড় হয়। স্কুলের শেষদিক। হয়তো এইট বা নাইন। দেখতাম কত সাদাসিধে মানুষটির জীবন। ঘরে লুঙ্গি আর হাতাঅলা গেঞ্জি। ভোরে আর সন্ধ‌্যায় সেই লুঙ্গির ওপর একটি হাফ শার্ট। পায়ে চটি। এই পোশাকেই দু’বেলার ভ্রমণ। নিয়ম করে দু’বেলা হেঁটে এসে একটু বিশ্রাম। তারপর লিখতে বসে যাওয়া। সকালে ন’টা থেকে ১২টা। রাতে আটটা থেকে দশটা সাড়ে দশটা। দুপুরে ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে মিলিয়ে একটায় খেতে বসা। রাতে সাড়ে দশটার পরই। এই নিয়মের কোনও বিপরীত নিয়ম আমার মনে পড়ে না। শৈশব থেকে যৌবন অবধি পিতৃদেবকে রাতে দেখিনি বাইরে রাত কাটাতে। রাতে নিয়ম করে লিখতে বসা। সময়ে খেয়ে নেওয়া এবং বিছানায় চলে যাওয়া। এটাই ছিল রুটিন। সবই ঘড়ির কাঁটার মতো।

লেখার কাজ না-থাকলে বই পড়া। শুয়ে শুয়ে। অধিকাংশই ইংরেজি। আমি পিতৃদেবের বইয়ের আলমারি থেকে প্রথম পাই ‘ওল্ড ম‌্যান অ্যান্ড দ‌্য সি’, ‘ইউলিসিস’, ‘ফল’ ইত‌্যাদি। আর অসংখ‌্য ছোটগল্পের বই। ‘আরগোসি’ সিরিজের। যে-বইগুলি তখন নাবিকরা অর্ধেক দামে বিক্রি করে চলে যেত। আর সেইসব বই তখন চৌরঙ্গি, ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে প্রচুর পাওয়া যেত।

আরও বড় হলাম। কলেজের ফার্স্ট ইয়ার। পড়লাম ‘প্রেমের চেয়ে বড়’ ধারাবাহিক উপন‌্যাসটি। ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশ হতে লাগল। অপূর্ব লাগত মানুষের জটিলতার সম্পর্ক। মনস্তাত্ত্বিক ব‌্যাখ‌্যা। হয়তো তখনও ভালো বুঝতাম না। মাথা পাকা না হলে পিতৃদেবের মনস্তাত্ত্বিক লেখা বোঝা বেশ কঠিন। মনে হয়, এই কঠিনের জন‌্যই প্রচারের আলো থেকে অনেক দূরে। যে-প্রচার আশাপূর্ণা দেবী বা বিমল মিত্ররা পেয়েছেন।

একবার এক সন্ধ‌্যায় বাড়ি ফিরে এসে একটি গল্প মাকে বলি। ‘প্রেমের চেয়ে বড়’ তখন বই হয়ে বেরিয়েছে। খুব সম্ভব ‘দেশ’ পত্রিকায় বিমল মিত্রর সঙ্গে দেখা। বিমল মিত্র পিতৃদেবকে দেখেই কাছে এসে বলেন, “জ্যোতিরিন্দ্রবাবু ‘প্রেমের চেয়ে বড়’ তো ভালোই লিখেছেন। কিন্তু গল্প কই?” আমি তখন কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। কথাটা শুনেই পিতৃদেব নাকি মুচকি এক টুকরো হাসি উপহার দেয়। অর্থাৎ, বিমল মিত্ররা যে সময় সাহিত্যে গোল রোমান্টিক গল্প, ঐতিহাসিক গল্প লিখে চলেছেন, পিতৃদেব তখন ছিল সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে থাকা মানুষ। গোলাকার গল্পের তুলনায় মনস্তাত্ত্বিক লেখাতেই বেশি মন। আমার কাছে ‘এই তার পুরস্কার’ অসাধারণ লাগে। এইসব লেখা সিনেমা হয় না। কেননা দর্শক আজও গোলগাল গল্প চায়। আমার মনে হয় ‘মীরার দুপুর’-এর মতো ফিক্‌শন আজও বাংলায় লেখা হয়নি।

আমি ১৪৩ বাগমারী রোডে আরও বড় হই। পিতৃদেবেরও বয়স হয়। বড় হই। কোনও উপন‌্যাসই হু হু করে বিক্রি হয় না। বাড়িতে অর্থ আসে না। আমরা বস্তিতেই মানুষ হতে থাকলাম। আমার মা বেশ কিছু বছর খবর কাগজের ঠোঙা বানায়। আমি তখন থ্রি-ফোরে। ঠোঙা বানিয়ে মা নিচ্ছে কিছু উপার্জন করত। সংসারেও খরচ করত। আমি মুদির দোকানে ঠোঙা দিয়ে আসতাম। আমার মার কথা না বললে পিতৃদেবের কথা অসম্পূর্ণ থাকে।

মা ছিল মুক্তমনা। স্বাধীনচেতা। ঠোঙা বিক্রির টাকায় তখনকার দিনে ভালো নাটক দেখতে যেত। সেতার কিনত। বেহালা কিনত। আরও কত যন্ত্র। সংগীতের ওপর ছিল অগাধ ভালোবাসা। দেখত, আমার পিতৃদেবের তেমন আয় নেই। তাই নিজের শখ নিজেই মেটাত। টিউশনও করত। অনেক আর্থিক বোঝা মা কমিয়ে দেয়। পিতৃদেবকে বুঝতেও দেয়নি।

বাঙালী সাহিত্যিক জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর ৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি - nurubrl's bangla blog

১৪৩ বাগমারী রোডের বাড়ি দু’কামরার। পাখা নেই। মাথার ওপর টিনের চাল। মানে, বস্তি যেমন হয়। তবুও বাড়িঅলা বোঝে, পিতৃদেব অন‌্য দশজনের থেকে আলাদা। আমি যখন খুবই ছোট তখন পিতৃদেব প্লুরিসিতে আক্রান্ত হয়। আমি সেই বয়সে ‘প্লুরিসি’ জানতাম না। বড় হয়ে বুঝি, তা হল লাংসে জল জমা। সেই আর্থিক কষ্টের ভিতরেই মা-র সামান‌্য রোজগারে সংসার চলে। ‘বারো ঘর এক উঠোন’ লেখা হয় রানি রাসমণি বাগানের বাড়িতে। মানে বেলেঘাটায়। আমি হয়তো সদ‌্য হয়েছি। কিন্তু কিছু মনে নেই। আমার যা কিছু মনে থাকার পিতৃদেবকে নিয়ে, সবই এই ১৪৩ বাগমারি রোডের বাড়িতে।

 

ঘরোয়া ব‌্যাপারে পিতৃদেবের চালচলন সংসারে তার ভূমিকা কর্তব‌্যবোধ অর্ধাঙ্গিনীর সঙ্গে আচার-আচরণ আমার দৃষ্টি থেকে এড়িয়ে যেত না। ‘লোক দেখানো’ ব‌্যাপারটি পিতৃদেবের কখনই ছিল না। অত‌্যন্ত সরল-সাধাসিধে জীবনেই নিজেকে ধরে রাখত, ভালোবাসত। আমি কখনও পিতৃদেবকে কোনও সভা-সমিতিতে দেখিনি। পাড়ায় ‘লেখক’ বলে পরিচয়ও দেয়নি। বরং মানুষ চিনত একজন অত‌্যন্ত সাধারণ মানুষ হিসাবে। যে-মানুষটি লেখক হতে পারে না। নায়ক হতে পারে না। যে-মানুষটির গাড়ি হতে পারে না। যে-মানুষটি রাতের পর রাত পানশালায় আড্ডা মারতে পারে না।

শুধু পারে সৎভাবে জীবনযাপন করতে। নিজের লেখার ওপর স্থির থাকতে। দু’বেলা নিয়ম করে লেখার টেবিলে বসতে। সংসারকে আগলে রাখতে। স্নেহ করতে। সহধর্মিণী পারুল নন্দীর চেষ্টায় এগিয়ে যেতে।

ছোট গল্পের রাজাকে নিয়ে বিশদে কখনও লিখব না-হয়। আজ এটুকুই।

……………………..

ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার.ইন

……………………..