আমি বাংলা ভাষা পড়তে জানতাম না। শুনে শুনে শিখেছি বাংলা ভাষাটা। বাংলা ভাষাটা খুব মিষ্টি। আমার স্বামী উজ্জ্বল, ও আমায় কিনে দিয়েছিল ‘বর্ণপরিচয়’। ওর কাছেই বাংলা ভাষা পড়া এবং লেখা শিখেছি। অল্পস্বল্প লিখতেও পারি এখন। আসলে ভারতের সব জায়গার আলাদা আলাদা কালচার রয়েছে, বাংলারও। ফরাসিদের সঙ্গে আমি অনেক মিল খুঁজে পাই বাংলার মানুষের। কালচারের দিক থেকে অনেক মিল রয়েছে।
আমি মনেপ্রাণে বাঙালি। তাও এক্কেবারে খাঁটি। আমি বিদেশি বটে, বাইরে থেকে এসেছি। তাতে কী? এসবে আমি ভাবিত নই। এই সংস্কৃতিটাই আমার হয়ে গিয়েছে। এখানে থাকতে থাকতে মানুষের সঙ্গে মিশতে মিশতে আমিও আপনাদের মতো ‘বাঙালি’ হয়ে গিয়েছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানে আছে না, ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল…’। এই গানই তো রাজ্যদিবসের গান। সেই বাংলার মাটি, জল আমি আমার অন্তরে গ্রহণ করেছি। আর পাঁচটা বাঙালির মতো আমিও এখন বাংলা নববর্ষ পালন করি। এখন দেখি অনেকেই বলেন, পয়লা বৈশাখের সেই আগের মতো নেই। আমার তা মনে হয় না। এটা তো আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ। এটাকে তো আমাদেরই বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
পয়লা বৈশাখের আনন্দটাই আলাদা। বাড়ির সবাই মিলে এই দিনটা পালন করি। বাড়িতে কেউ এলে মিষ্টিমুখ না করে যেতে দেওয়া হয় না। কত সুন্দর ব্যাপার। আমি এরকম আর কোথাও দেখিনি। বিয়ের সূত্রে বাংলার সঙ্গে আমার যোগাযোগ। ১৯৮৮-এ আমি প্রথম ভারতে আসি। ইউনেস্কোর এইডসের সচেতনতামূলক শিবিরের হয়ে প্রচারে এসেছিলাম এখানে। আসার সময় বাড়ি থেকে বলেছিল, ‘যাচ্ছিস যখন একবার চন্দননগর ঘুরে আসিস।’ বাংলার সঙ্গে অবশ্য তার আগেই পরিচয় হয়েছিল। আমার স্বামী উজ্জ্বল মণ্ডলের মারফত। ওর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল ফ্রান্সে। বেলজিয়ামের লুইভেনে জন্ম হলেও আমার বেড়ে ওঠা ব্রুসেলসে। পড়াশোনা সূত্রে ছিলাম প্যারিসে। সেখানেই উজ্জ্বলের সঙ্গে আমার পরিচয়। কলকাতাতে এসেও চন্দননগরে গিয়েছিলাম উজ্জ্বলের সঙ্গে দেখা করতে। স্থায়ীভাবে এখানে থাকব, এমন কোনও পরিকল্পনা আমার ছিল না। কয়েক বছর নিজের কাজ নিয়ে ভারতে থাকব, তারপর ফিরে যাব প্যারিসে, এমনটাই পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু ওই যে বলে না ভাগ্য! আমার জন্য এটা লেখা ছিল। উজ্জ্বলের সঙ্গে সম্পর্কটা শেষ পর্যন্ত বিয়েতে গড়াল। আমাদের মধ্যে একটা অবিচ্ছেদ্য বন্ধন তৈরি হল, কোনও পরিকল্পনা ছাড়াই। ১৯৮৯-তে আমাদের বিয়ে। বাংলার তারিখটা শুনবেন? ৬ বৈশাখ। সামনেই বিবাহবার্ষিকী।
যাই হোক, সেই থেকে আমি বাংলার মেয়ে। বিয়ের আগে অবশ্য বাংলার সম্পর্কে তেমন কোনও ধারণা ছিল না। আমি শুধু জানতাম, বেঙ্গল হল ইংরেজ আমলের ভারতের রাজধানী। একটা হেরিটেজ সিটি। যার সর্বত্র জড়িয়ে আছে ইতিহাস। সেটাই আমাকে বেশি করে টানত। বাংলা বলতে আমি চিনতাম একজনকেই– মাদার টেরেজা। আর ফ্রান্সে থাকতে পড়েছিলাম– ডমিনিক ল্যাপিয়েরের ‘সিটি অফ জয়’। তবে বইটায় যে সব তথ্য ঠিক, তা নয়। নারীশিক্ষায় বাংলার পাশাপাশি ঢাকা, মুম্বই এবং সেই সময়ের লাহোর যে অনেক প্রগতিশীল ছিল, সেটাও জানতাম। সংস্কৃতির পীঠস্থান ছিল তখন এই চার শহর।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সামনের বছর অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির দুশো বছর পূর্তি। আমি অনেক তথ্যপ্রমাণ ঘেঁটেই কথাটা বলছি। অনেকে আলাদা মত থাকতে পারে। আমি বলেছি, ‘প্রমাণ দেখাও?’ কেউ দেখাতে পারেনি। আমাদের বাড়িতে দুর্গাপুজো হয় দীর্ঘদিন ধরে। আমার স্বামীর পূর্বপুরুষদের পারিবারিক ব্যবসা ছিল। অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি ছিলেন আমাদের নুনের গোডাউনের ম্যানেজার। এই বাংলার সংস্কৃতিকে আপন করে নিয়েছিলেন তিনিও। আমাদের বাড়িতে পুরনো একটা বলরুম আছে। আগে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হত, পার্টি হত। সেই হলঘরে অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি গান গাইতেন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
তবে আমি বাংলা ভাষা পড়তে জানতাম না। শুনে শুনে শিখেছি বাংলা ভাষাটা। বাংলা ভাষাটা খুব মিষ্টি। আমার স্বামী উজ্জ্বল, ও আমায় কিনে দিয়েছিল ‘বর্ণপরিচয়’। ওর কাছেই বাংলা ভাষা পড়া এবং লেখা শিখেছি। অল্পস্বল্প লিখতেও পারি এখন। আসলে ভারতের সব জায়গার আলাদা আলাদা কালচার রয়েছে, বাংলারও। ফরাসিদের সঙ্গে আমি অনেক মিল খুঁজে পাই বাংলার মানুষের। কালচারের দিক থেকে অনেক মিল রয়েছে। মিল রয়েছে সাহিত্য চর্চা, রান্নাতেও। রবীন্দ্রনাথের লেখা আমি পড়েছি, এছাড়াও আমায় টানত ঋষি অরবিন্দের লেখা।
চন্দননগরে আসার আগে স্বামীর কাছে শুনেছিলাম এখানকার জগদ্ধাত্রী পুজোর কথা, এখানে পুজোর সময় গোটা শহরটা আলোয় সেজে ওঠে– সেসব নানা গল্প। কিন্তু আমি যখন এসেছিলাম, সেভাবে চন্দননগর সম্পর্কে বিদেশে স্পষ্ট ধারণা ছিল না। আমি চেষ্টা করেছি, এখানকার কালচারকে, হেরিটেজকে তাদের সমানে তুলে ধরার। বিদেশ থেকে প্রথম প্রথম অনেকে জগদ্ধাত্রী পুজো দেখতে এসে বলেছে, ‘তোমাদের এই বড় লেডি-পুতুলটা কি? এটাকে পুজো করো কেন?’ তাদেরকে বোঝাতে হয়েছে, জগদ্ধাত্রী গডেস, বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে পুজোপার্বণ, আরও অনেক কিছু। এই হেরিটেজকে ধরে রাখতে আমাকে অনেক লড়াই করতে হয়েছে। এখনও চেষ্টা করছি সবাইকে সচেতন করতে। তবে এখনও দেখি, অনেক হেরিটেজ বিল্ডিং ভেঙে ফেলা হচ্ছে। যখন জানতে পারছি, তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। আমার আর কিছু করার থাকে না। আসলে আমি সায়েন্টিস্ট হলেও আমার রক্তে মিশে আছে আর্ট কালচার। চন্দননগর এই কারণে এত আমার প্রিয়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: বাঙালির মরে যাওয়া আড্ডার অবিচুয়ারি
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
অনেকেই জানেন না, রাধানাথ শিকদারের মতো গুণীমানুষ জীবনের শেষ দশ বছর ছিলেন এই চন্দননগরে, মণ্ডলপাড়ায় থাকতেন তিনি। কিন্তু তেমন কোনও স্বীকৃতি তিনি পাননি। রাস্তার নামটা তাঁর নামে, ‘রাধানাথ শিকদার লেন’। ব্যস, এইটুকু। অথচ সেই মানুষটার কোনও মূর্তি নেই চন্দননগরে। নাথিং। আমি দু’বছর অনেক লড়াই করে সেইটুকু করতে পেরেছি। প্রথমদিকে অনুমতি পাচ্ছিলাম না ওঁর মূর্তি স্থাপনের। শেষে শ্রীরামপুর চার্চের ফাদারের কাছে যাই। রাধানাথ শিকদার খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। ফাদারকে গিয়ে বলি, এমন গুণী মানুষটার জন্য কিছু করা যায় না? আমরা পারি না, চার্চের একফালি জায়গায় রাধানাথ শিকদারের একটা মূর্তি স্থাপন করতে। ফাদার এককথায় রাজি হয়ে যান। এখন চন্দননগর এলে কর্পোরেশনের ঠিক সামনে, চার্চের পিছনে দেখতে পাবেন রাধানাথ শিকদারের মূর্তি বসানো আছে।
সামনের বছর অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির দুশো বছর পূর্তি। আমি অনেক তথ্যপ্রমাণ ঘেঁটেই কথাটা বলছি। অনেকে আলাদা মত থাকতে পারে। আমি বলেছি, ‘প্রমাণ দেখাও?’ কেউ দেখাতে পারেনি। আমাদের বাড়িতে দুর্গাপুজো হয় দীর্ঘদিন ধরে। আমার স্বামীর পূর্বপুরুষদের পারিবারিক ব্যবসা ছিল। অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি ছিলেন আমাদের নুনের গোডাউনের ম্যানেজার। এই বাংলার সংস্কৃতিকে আপন করে নিয়েছিলেন তিনিও। আমাদের বাড়িতে পুরনো একটা বলরুম আছে। আগে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হত, পার্টি হত। সেই হলঘরে অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি গান গাইতেন। অন্যান্য জায়গার তুলনায় চন্দননগর তখন অনেক বেশি লিবেরাল ছিল। এখানেই গান গেয়েই তিনি বিখ্যাত হয়েছেন। এখন আর সেই গোডাউন নেই, সেখানে এখন হসপিটাল তৈরি হয়েছে।
বৈশাখ এসে গেল আবার। আরও একবার আমি বাঙালি হলাম। সুদূর বেলজিয়াম থেকে আসা এক আদ্যন্ত বাঙালি। বিশ্বাস করুন, আমি আপনাদেরই লোক।