রাধারানি জানান, “আমার ছবি (লাইফ স্টাডি) করবার জন্য ডেকে নিয়ে গেলেন বাসাতে। দু-একদিন ছবি করতে করতে রাত হয়ে যেত। আসতে পারতাম না মীরা দেবীর বাসায়। নিয়ে ঐখানেই থেকে যেতাম। ভোরবেলায় বাবুদের সঙ্গে দেখা। বললে, ‘কে আসে, কে যায় আমরা দেখতে চাই।’ ” রাধারানির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ককে ঘিরে প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়ালেন রামকিঙ্কর। এই প্রশ্নেই শান্তিনিকেতনের মাটি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে একসময়। রাধারানি জানান, ‘আপিসে একবার ঝগড়া হয় আমার সম্বন্ধ নিয়ে। আমার বিষয় নিয়ে আপিসে একদিন মারামারি লাঠালাঠির মতো হইছিল। সেই হওয়াতেই একেবারে সেই যে বন্ধ হয়ে গেল তারপরে আর কেউ কিছু বলত না।’
কিংবদন্তি চিত্রকর, ভারতের প্রথম সৃষ্টিশীল আধুনিক ভাস্কর রামকিঙ্করের জীবনের মধ্য ও অন্তিম পর্বের মাঝামাঝি সময়ে দেখা দিয়েছিলেন রাধারানি। রাধারানিকে পাশে সরিয়ে রেখে রামকিঙ্করের জীবন ও শিল্পকর্মের সামগ্রিক মূল্যায়ন করা যাবে না কখনওই। বরং বলা যায়, রাধারানির উপস্থিতিতে রামকিঙ্করের শিল্প সৃষ্টির স্রোতে একটি গতিবেগ সঞ্চারিত হয়। একটি পালাবদল ঘটে। রামকিঙ্করের সঙ্গে রাধারানির নামটি বহুবার, বহুভাবে উচ্চারিত হতে শোনা গিয়েছে। কল্পগাথা মিশিয়ে নানা ঘটনার ঘনঘটাও জুড়ে দিতে দেখা গিয়েছে। কিন্তু গোটা একটি মানুষের অনুসন্ধানে তৎপর হতে দেখা যায়নি তেমনভাবে। বরং অবজ্ঞা মিশ্রিত এক ধরনের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ছুড়ে দিতে দেখা গিয়েছে রাধারানির প্রতি।
কে ছিলেন এই রাধারানি?
এই বাংলার ভাগ্যবিড়ম্বিত, নিরক্ষর, নিম্ন-মধ্যবিত্ত একটি পরিবারের কন্যা ছিলেন তিনি। তাঁর পদবি ছিল গড়াই। পিতার নাম চন্দ্র গড়াই। মাতা দুর্গা দাসী। তাঁর জন্মভূমি বর্ধমান-বীরভূমের সীমান্তবর্তী অঞ্চল গুসকরার সাহেব বাগান। খুব একটা সুখের হয়নি বিবাহ-পরবর্তী জীবন, বিবাহের পর-পরই, তাঁর জীবনে, অকস্মাৎ নেমে আসে বিপর্যয়। প্রকৃত প্রস্তাবে, রাধারানি ছিলেন প্রতিবাদী সেই মহিলা, দুরাচারি স্বামীর নীতি-ভ্রষ্টতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে, দাম্পত্যের সমস্ত হলাহল বিসর্জন দিয়ে, ঘর ছেড়ে পথে নেমে এসেছিলেন একদিন। পিতার শত অনুরোধ-উপরোধও, কন্যাকে, পথ থেকে ঘরে ফেরাতে পারেনি। সামনে পড়ে থাকা অনন্ত, অনিশ্চিত পথে, এরপর, যাত্রা শুরু হয় তাঁর। জন্মভূমির অদূরেই শান্তিনিকেতন। শান্তিনিকেতনের এ-বাড়ি, সে-বাড়ির কাজ করতে করতে একসময় প্রবেশ করলেন শান্তিনিকেতনের চৌহদ্দির ভেতরে ঠাকুরবাড়ির আঙিনায়। রবীন্দ্রনাথের কন্যা মীরা দেবীর গৃহকাজে যোগদান করলেন। শান্তিনিকেতনের নিচু বাংলার বাসিন্দা অন্নদাকুমার মজুমদার মীরা দেবীর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁকে। মীরা দেবীর পাশেই রবীন্দ্রনাথের পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীর বাড়ি। মীরা ও প্রতিমার প্রিয়জন হয়ে উঠলেন রাধারানি। মীরা দেবী-প্রতিমা দেবীর বাড়ির খুব কাছেই, শ্রীপল্লীর একটি বাড়িতে থাকতেন রামকিঙ্কর। ঠাকুরবাড়ির আঙিনায় অবাধ যাতায়াত ছিল তাঁর। ঠাকুরবাড়ির এই অন্দর মহলেই রাধারানির সঙ্গে পরিচয় ঘটবে তাঁদের প্রিয় ভাস্কর ও চিত্রী রামকিঙ্করের। আর এখান থেকেই, রাধারানির, যাত্রাপথ বাঁক নেবে অন্য পথে। পরিচয় থেকে, এরপর, রাধারানি, গিয়ে পৌঁছবেন রামকিঙ্করের সৃষ্টির সাম্রাজ্যে।
শুধুমাত্র রামকিঙ্করেরই নয়, এরপর, তিনি হয়ে উঠবেন, শান্তিনিকেতনের শিল্পকলা সাম্রাজ্যের প্রথম নগ্নিকা মডেল। শান্তিনিকেতনের বিশুদ্ধবাদীদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বিপ্লবের একটি চারাগাছ রোপিত হবে তাঁর হাত দিয়েই। ভারতের স্বাধীনোত্তর আধুনিক শিল্পকলার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় মহিয়সী এই নারীর হাত ধরেই, ঠিক এখানে থেকেই, রামকিঙ্করের শিল্পসৃষ্টির যাত্রাপথটিও বাঁক নেবে একটি নতুন পথে। কী সেই যাত্রাপথ? ভাস্কর্যের চিরনতুন উৎকর্ষের লক্ষ্যে নগ্নিকার অনুশীলন তাঁর সৃষ্টির ভুবনে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করবে। রাধারানির নগ্ন দেহ অনুশীলনের মধ্য দিয়ে, দশ বছরেরও অধিককাল, নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর, রামকিঙ্কর তৈরি করবেন, নতুন দিল্লির রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রধান প্রবেশ দ্বারের সম্মুখে, স্থাপত্যের সঙ্গে সমতা রেখে, ‘যক্ষ’ ভাস্কর্যের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা– ১১ ফুট প্যাডেস্টাল বাদ দিয়ে ২১ ফুট উচ্চতার ‘যক্ষী’ শিলা ভাস্কর্যটি। রামকিঙ্করের কালজয়ী শিল্প সৃষ্টির ভিতর দিয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন রাধারানি। ভারতের শিল্পকলা প্রেমিকেরা অন্তত এই একটি কারণে স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, আধুনিক ভারতের রূপকার জওহরলাল নেহরুর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবেন, কারণ, অনেক বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে মূলত তাঁরই চেষ্টায় বা ইচ্ছায় এই ভাস্কর্য দু’টির কাজ সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন রামকিঙ্কর। এটিই হল রামকিঙ্করের তৈরি প্রথম শিলা ভাস্কর্য এবং পরিবেশীয় ভাস্কর্যের মধ্যে তাঁর শেষ বড় কাজ।
বরাবরের নিয়ম-ভাঙা রামকিঙ্করই হলেন শান্তিনিকেতনের সেই দুঃসাহসী শিল্পী প্রথা ভেঙে ন্যুড স্টাডির দিকে যিনি ঝোঁকেন প্রথম। শান্তিনিকেতনের বজ্র কঠিন প্রস্তর ভূমিতে যা দুঃসাধ্যই ছিল না শুধু, যা ছিল কল্পনারও অতীত! সুতরাং শিল্পকলার অনুশীলনের একটি অন্তর্গত তাগিদে রামকিঙ্করের শ্রীপল্লীর বাড়িতে রাধারানির যাওয়া-আসা নিরুপদ্রব ছিল না মোটেই। রামকিঙ্কর-রাধারানিকে ঘিরে সেদিনের আশ্রমিকদের কারও কারও মর্মে জেগে ওঠে অদম্য কৌতূহল। এই লেখকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এই বিষয়ে রাধারানি জানান, “আমার ছবি (লাইফ স্টাডি) করবার জন্য ডেকে নিয়ে গেলেন বাসাতে। দু’-একদিন ছবি করতে করতে রাত হয়ে যেত। আসতে পারতাম না মীরা দেবীর বাসায়। নিয়ে ঐখানেই থেকে যেতাম। ভোরবেলায় বাবুদের সঙ্গে দেখা। বললে, ‘কে আসে, কে যায় আমরা দেখতে চাই।’ ” রাধারানির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ককে ঘিরে প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়ালেন রামকিঙ্কর। এই প্রশ্নেই শান্তিনিকেতনের মাটি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে একসময়। রাধারানি জানান, ‘আপিসে একবার ঝগড়া হয় আমার সম্বন্ধ নিয়ে। আমার বিষয় নিয়ে আপিসে একদিন মারামারি লাঠালাঠির মতো হইছিল। সেই হওয়াতেই একেবারে সেই যে বন্ধ হয়ে গেল তারপরে আর কেউ কিছু বলত না।’
রাধারানি বলেছেন, কুড়ি বছর বয়সেই তিনি যান ওখানে, ‘বাবু’র কাছে। রামকিঙ্করকে ‘বাবু’ বলেই সম্বোধন করতেন তিনি। সম্পর্ক সূত্রে ‘রামকিঙ্করের সেবাদাসী’ হিসাবেই দিতেন নিজের পরিচয়। অপার মমতা আর শ্রদ্ধার সঙ্গে বলেছিলেন ‘বাবু’র সেবা করেই তাঁর কেটে গিয়েছে সারা জীবন।
……………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন সমীর মণ্ডলের লেখা: মারিও মিরান্ডার ছবির দেশে জনসংখ্যা খুব বেশি
……………………………………………………………………………………………………………….
রামকিঙ্করের ন্যুড স্টাডি সম্পর্কে– এই লেখকের সঙ্গে সাক্ষাৎকার ভিত্তিক একটি লেখায় কলাভবনের দ্বিতীয় পর্বের রামকিঙ্করের অন্যতম প্রিয় ছাত্র, প্রখ্যাত ভাস্কর শঙ্খ চৌধুরী লেখেন, ‘শান্তিনিকেতনে কেউ কোনও দিন ভাবতে পারেনি ন্যুড স্টাডি হতে পারে। এটা সম্পূর্ণ কল্পনার বাইরে। কিঙ্করদা অনেক পরে, বুড়ো বয়সে, তাঁর ন্যুড স্টাডির কথা বলেছিলেন। কিন্তু এখানে মনে রাখা জরুরি যে কিঙ্করদার নিজের করা মানে শান্তিনিকেতনে করা নয়। আমি করি মানে আমার ঘরে বসে করি। কিন্তু শান্তিনিকেতনে মদ্যপান গ্রাহ্য নয়। বোম্বেতে এসে তাই আমার প্রথম কাজ ছিল দাদর-এর কাছে লক্ষ্মী স্টুডিও নাকি বলে একটা স্টুডিও ছিল, সেখানে প্রতিদিন সকালে দশ টাকা দিয়ে ন্যুড স্টাডি করতে যেতাম। কিঙ্করদাকে যখন ওই কথাটা বলি, তখন কিঙ্করদা বলেছিলেন, ‘জানো হে?’ বললাম, ‘কী?’ বললেন, ‘আমিও তো ওটাই চেয়েছিলাম। তুমি অ্যাবস্ট্রাক্ট করছ কর, কিন্তু জীবনের সঙ্গে যোগ না হলে কাজগুলো বড় ‘ক্যাড’ হয়ে যায়।’ কিঙ্করদার ‘ক্যাড’ বলে একটা কথা ছিল তখন। শান্তিনিকেতনে যে জিনিসটার অভাব বোধ করেছি, বরোদায় এসে আমি তা পূরণ করেছি। কলাভবনকেও সেই কথাই বলেছিলাম, ‘পাঁচ বছরের যে কোর্স করছেন, ন্যুড স্টাডি রাখতে পারবেন আপনারা?’ বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তা কেন না, আ… আ…’ ইত্যাদি। আমাদের অন্যান্য কলাশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও তো ন্যুড স্টাডি হত না। কলকাতাতেও হত না। মাখন দত্তগুপ্ত গিয়ে প্রথম আরম্ভ করেছিলেন।’ শঙ্খ চৌধুরির দিল্লির বাসায় রাধারানি ভিত্তিক বেশ কিছু ন্যুড ড্রইং-এর প্রতিলিপি তাঁকে দেখান এই লেখক। সেগুলি দেখার প্রতিক্রিয়ায় শঙ্খ চৌধুরির, সাক্ষাৎকার ভিত্তিক ওই রচনায় জানান, ‘কিঙ্করদার এতগুলো ন্যুড ড্রইং আমি কখনও দেখিনি। আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি– লাইফ থেকে এত ড্রইং করেছিলেন কিঙ্করদা অথচ আমরা জানতেই পারিনি।… রঁদা কোনও মডেলকে বসিয়ে ন্যুড স্টাডি করতেন না। তাঁর নির্বাচিত কয়েকজন মেয়ে মডেল ছিল, তাঁরা নগ্ন হয়ে ঘুরে বেড়াত। রঁদা দেখতেন এবং ড্রইং করতেন। গুণের দিক দিয়ে কিঙ্করদার ন্যুড ড্রইংগুলো রঁদারই মতো। এগুলোতেও রয়েছে সেই গতি। অর্থাৎ ম্যুভমেন্ট।’
স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, আধুনিক ভারতের রূপকার পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু চেয়েছিলেন নতুন দিল্লির রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রধান প্রবেশ পথের দু’-পাশের ভবনের স্থাপত্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ভারতের প্রথম সারির ভাস্করের তৈরি ভাস্কর্য নির্মিত হোক। প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ভারতের ভাস্কর্য জগতের স্বনামধন্য ভাস্করদের কাছ থেকে, এই উদ্দেশে খসড়া ভাস্কর্য পেশ করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। এই আমন্ত্রণ পত্রের একটি, শান্তিনিকেতনে, রামকিঙ্করের উদ্দেশে প্রেরিত হয়। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের এই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ভারতের প্রধান ধনাগারের নতুন ভবনের জন্য ‘যক্ষ-যক্ষী’ নামে দু’টি খসড়া ভাস্কর্য বা ম্যাকেট পেশ করেন রামকিঙ্কর। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর উপস্থিতিতে উচ্চ পর্যায়ের এক নির্বাচক মণ্ডলী রামকিঙ্করের করা যক্ষ-যক্ষীর খসড়া ভাস্কর্য দু’টি নির্বাচন করেন।
……………………………………………………………………………………………………………….
দীর্ঘ ২০ বছরেরও অধিককাল তাঁরা কাটিয়ে গিয়েছেন স্বামী-স্ত্রীর মতোই। অনেক উপেক্ষার দান মাথায় নিয়ে বহুকালের বাসভূমি শান্তিনিকেতন ছেড়ে একদা চলে যান সতীর্থ-অন্তরঙ্গ বন্ধু, অভিমানাহত শিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়। আর চারিদিকের উপেক্ষা আর উদাসীনতায় নীরব থেকে তাঁর সারা জীবনের তীর্থভূমি শান্তিনিকেতনের মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছেন রামকিঙ্কর। আর সভ্য সমাজের বিদ্রুপ ও বিরূপ সমালোচনার কাছে হার না মেনে রাধারানিকে নিয়েই পার করে এসেছিলেন তাঁর জীবনের অনেকটাই বন্ধুর পথ।
……………………………………………………………………………………………………………….
১৯৫৫ সালে খসড়া ভাস্কর্য পেশ করার পর, ভারতের বিভিন্ন সংগ্রহশালা ঘুরে যক্ষ-যক্ষীর রূপ অন্বেষণে অজস্র খসড়া চিত্র-ভাস্কর্য নির্মাণ, ভাস্কর্যের জন্য উপযুক্ত পাথর নির্বাচন থেকে শুরু করে পাদপীঠে ভাস্কর্য স্থাপন– ওই সময়সীমাটুকু ধরলে প্রায় দশ বছর ওই ভাস্কর্যের পিছনে ব্যয় করেন রামকিঙ্কর। ওই দশ বছর, বলা যায়, যক্ষ-যক্ষীর রূপধ্যানে ডুবে ছিলেন রামকিঙ্কর। বিশিষ্ট ভাস্কর, কলাভবনের দ্বিতীয় পর্যায়ের রামকিঙ্করের প্রিয় ছাত্র প্রভাস সেন জানাচ্ছেন, ‘মূল ভাস্কর্য গঠনের আগে প্রায় দু-বছর ধরে রামকিঙ্কর যক্ষ-যক্ষীর অজস্র খসড়া ভাস্কর্য করেন।’ তাঁর মতে এই খসড়া ভাস্কর্যগুলির মধ্যে অন্তত দশ জোড়া যক্ষ-যক্ষীর মূর্তিকে রামকিঙ্করের শ্রেষ্ঠ ভাস্কর্যের মধ্যে ধরা যায়। এই ভাস্কর্যগুলির কোনও সন্ধান পাওয়া যায় না এখন। এই একটি ভাস্কর্য নির্মাণের জন্য এমন গভীর অনুশীলন করতে দেখা যায়নি তাঁকে। ধ্রুপদী যুগের মথুরার যক্ষ-যক্ষী থেকে শুরু করে যক্ষীর জন্য জীবন্ত মডেলের অনুশীলনের গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে মূল ভাস্কর্য দু’টির রূপ গঠনে উপনীত হন রামকিঙ্কর।
……………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন গৌরবকেতন লাহিড়ীর লেখা: ‘পটুয়া’ যামিনী রায় বোধহয় ততটা শৈল্পিক নয়, যতটা ব্যবসায়িক
……………………………………………………………………………………………………………….
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রধান প্রবেশ পথের দু’-পাশে, ১৯৬৬ সালে, ভাস্কর্য দু’টি বসানোর কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও যক্ষীর রূপ অন্বেষণের কাজ শেষ হয়ে যায়নি রামকিঙ্করের। এই ষাটের দশকেই, অবশেষে, গর্ভবতী একটি যক্ষীর জন্ম হল তাঁর হাতে। দীর্ঘ সময় কালের যক্ষী-র রূপ অন্বেষণের সফলতার গোটা পর্বের বার্তাটি উঠে এল ওই ভাস্কর্যটির মধ্য দিয়ে। ফার্টিলিটি বা এই বিশ্বপ্রকৃতির উৎপাদিকা শক্তির প্রতীক রূপে সমগ্র নারী জাতির প্রতিনিধি হিসাবে হাজির করা হল যক্ষীকে। যার মধ্যে আদিম ভাস্কর্যের আদর্শ থাকলেও জৈবিক প্রাণশক্তির বিবর্তন গুণে যা সজীব, পরিণত আর নতুনত্বের পরিচায়ক।
………………………………………………………………………………………………………………
রোগভোগে ক্লান্ত, বাতের আক্রমণে পঙ্গুপ্রায় গৃহবন্দি রামকিঙ্করের শেষ জীবনের বাসস্থান শান্তিনিকেতনের এন্ড্রুজ পল্লীর ২০ নম্বরের বাসায় যখন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভের সুযোগ হয় তখন রাধারানি বলেছিলেন, ‘সংসারের প্রয়োজনে বাইরে গেলে, জানালা দিয়ে দূর পথের দিকে তাকিয়ে গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন রামকিঙ্কর– কখন তিনি ফিরে আসবেন বাসায়। এই সময়ে, জীবনের প্রান্ত বেলায়, রামকিঙ্কর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন অভিভাবকসম রাধারানির ওপর। এদেশের-একালের একতম মরদ শিল্পী রামকিঙ্করের সেই ভালোবাসার মূল্য আমরা কী দিয়েছি কিছুই? এক ধরনের ঔদাসীন্য মিশ্রিত নিদারুণ অবহেলা-অবজ্ঞা ছাড়া রাধারানিও কী পেয়েছিলেন তাঁর প্রাপ্য সম্মান?
………………………………………………………………………………………………………………
১১ ফুট কংক্রিটের পাদপীঠ বাদ দিয়ে, ভারতের প্রধান ধনাগারের প্রবেশ পথের দু’-ধারে ২১ ফুট উচ্চতর দাঁড়িয়ে থাকা, দু’টি শিলা ভাস্কর্যের একটি হল ‘যক্ষ’। যক্ষের বাঁ-হাতে ধরা আছে টাকার থলি, ডান হাতে ধরা আছে পেনিয়ান, যা হল ইন্ডাস্ট্রি বা শিল্পের প্রতীক। যক্ষীর ডান হাতে ধরা আছে, কৃষির প্রতীক, শস্যগুচ্ছ। বাম হাতে ধ্যানমগ্ন, একাগ্রতার প্রতীক, জমাট বাঁধা পদ্মের কুঁড়ি। ধনাগারের স্থাপত্যের পটভূমির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দাঁড়িয়ে থাকা যক্ষ-যক্ষী শিলা ভাস্কর্য দু’টির মধ্য দিয়ে স্বাধীন ভারতের একটি রূপকল্প তুলে এনে একটি বার্তাই পৌঁছে দিতে চেয়েছেন রামকিঙ্কর। বার্তাটি হল শিল্প ও কৃষির হাত ধরে এগিয়ে যাবে আগামীর ভারত। ধনভাণ্ডারের রক্ষক যক্ষের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিশ্বপ্রকৃতির উৎপাদিকা শক্তির প্রতীক যক্ষী ভাস্কর্যের রূপকল্পটি রাধারানির নগ্ন দেহাবয়বটির বহু দিন-রাতের ধ্যানমগ্ন অনুশীলনের মধ্য দিয়ে তুলে এনেছিলেন রামকিঙ্কর। ২৫ ফুট উচ্চতার পাথর কুঁদে বের করে আনা যক্ষী ভাস্কর্যের মুখমণ্ডল, নিতম্ব বা নিম্নাংশের সঙ্গে রাধারানির দেহ সৌষ্ঠবের সাক্ষী হয়ে, খোলা আকাশের নিচে, আলো-বাতাস-মেঘ-বিদ্যুতের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে এখনও। এই শিল্প ভাস্কর্যটির স্রষ্টা রামকিঙ্করের দশ বছরেরও অধিক কালের নিবিড় অনুধ্যান, শ্রম আর মেধার ভিতর দিয়েই উঠে এসেছিলেন যে নারী। এই মহাপৃথিবীর চরাচরে শিল্পের জন্য ক্রন্দন থেকে যাবে যতদিন, ততদিন থেকে যাবেন রামকিঙ্কর। থেকে যাবেন মহীয়সী ওই নারী, যে নারীর নাম রাধারানি।
……………………………………………………………………………………………………………….
সন্দীপ রায়ের সাক্ষাৎকার: সন্দেশে লেখকদের পারিশ্রমিক ছিল লেখার সঙ্গে বাবার অলংকরণ
……………………………………………………………………………………………………………….
সংসার যাত্রায় বরাবরের উদাসীন রামকিঙ্কর প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে সংসার জীবনের মধ্যে যেন অনেকটাই ঢুকে পড়েছিলেন। শান্তিনিকেতনের সভ্য সমাজ থেকে দূরে, চারিদিকে গাছগাছালি ও নির্জনতায় ঘেরা খড়ের ছাউনি আর মাটির ঘরে, শঙ্খ চৌধুরীর দেওয়া রতনপল্লীর বাড়ির এক টুকরো জমিতে পাততে চেয়েছিলেন ভরাট সংসার। আত্মীয়স্বজন যাঁরা দূরে ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে আত্মীয়তা করলেন এ সময়ে। এই সময়েই গাইগোরু ও ছাগল পুষতেও দেখা গেল তাঁকে। আশপাশের বাচ্চা-বাচ্চারা এসে, এই সময়ে, জুটে গেল তাঁর চারিদিকে। তিনি তাদের সঙ্গে খেলতেন, আদর করতেন, তাদের নিয়েই সময় কাটাতেন। হাওয়ায় দোল খাওয়া ধান গাছের নৃত্য দেখার ইচ্ছায় রতনপল্লির বাড়ির সামনের জমিতে ওই সময়েই একবার লাঙল দিয়ে ধান গাছের চারা রোপণ করিয়েছিলেন রামকিঙ্কর। রাঢ় বাংলার মাটির মানুষ রামকিঙ্কর ওই সময়ে যেন মাটির আরও কাছাকাছি নেমে এলেন। গৃহী রামকিঙ্করও যেন এসে দাঁড়ালেন আমাদের সম্মুখে। এ যেন কল্পনা থেকে বাস্তবের কাছে ফিরে আসা। ষাট বছরের কাছাকাছি যখন পৌঁছে গিয়েছে তাঁর বয়স। আর এই সময়েই শান্তিনিকেতনের সভ্য সমাজের ভ্রূকুটিকে উপেক্ষা করেই রাধারানিকে নিয়ে প্রকাশ্যে বসবাস করতে শুরু করেন রামকিঙ্কর। রাধারানির সঙ্গে অনুষ্ঠানবদ্ধ ছিলেন না তিনি। কিন্তু দীর্ঘ ২০ বছরেরও অধিককাল তাঁরা কাটিয়ে গিয়েছেন স্বামী-স্ত্রীর মতোই। অনেক উপেক্ষার দান মাথায় নিয়ে বহুকালের বাসভূমি শান্তিনিকেতন ছেড়ে একদা চলে যান সতীর্থ-অন্তরঙ্গ বন্ধু, অভিমানাহত শিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়। আর চারিদিকের উপেক্ষা আর উদাসীনতায় নীরব থেকে তাঁর সারা জীবনের তীর্থভূমি শান্তিনিকেতনের মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছেন রামকিঙ্কর। আর সভ্য সমাজের বিদ্রুপ ও বিরূপ সমালোচনার কাছে হার না মেনে রাধারানিকে নিয়েই পার করে এসেছিলেন তাঁর জীবনের অনেকটাই বন্ধুর পথ।
১৯৬০ সালের কাছাকাছি সময়ে রামকিঙ্করের রতনপল্লীর বাড়িতে রাধারানিকে প্রথম দেখে কিছুটা অবাক হওয়া প্রভাস সেনকে ‘একমুখ হেসে’ রামকিঙ্কর বলেন, ‘তুমি ওকে এই প্রথম দেখছ নাকি? অনেক দিন তো আছে। বড় সুন্দর ফিগার ছিল। অনেক ড্রইং করেছি, দেখাব একদিন। তারপর রয়ে গেল। আমারও তো বয়স হচ্ছে, একজন মেয়েছেলে দরকার কাছে।’ রাধারানি সম্পর্কে রামকিঙ্করের যে কোনও সংকোচ বা হীনম্মন্যতা বোধ ছিল না ১৯৭৩-’৭৪ সালে রামকিঙ্করের জন্মদিনে কলাভবনে অনুষ্ঠিত তাঁর এক সংবর্ধনা সভার কথা উল্লেখ করে প্রভাস সেন জানাচ্ছেন, ‘কিঙ্করদা সেদিন বেশ সেজেগুজে রাধারানিকেও সাজিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। সঙ্গে বসিয়ে কলাভবনেও অবশ্য রাধারানিকে সম্মানের আসন দেওয়া হয়েছিল। দিল্লিতেও ছাত্রের বাড়িতে উঠেছিলেন রাধারানিকে সঙ্গে নিয়ে স্বামী-স্ত্রী-র মতো।’ প্রভাস সেনকে রামকিঙ্কর একবার বলেছিলেন, ‘যখন ভদ্রলোকের মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম, সবাই নাপিতের বেটা বলে দূর দূর করছে।’ বলেছিলেন, ‘তিনি তো কারোর ক্ষতি করেননি, রাধারানিরও করেননি। যাঁদের ইচ্ছা তাঁর সঙ্গে সম্বন্ধ না রাখলেই তো হল।’ ছাত্র শঙ্খ চৌধুরীর দেওয়া রতনপল্লীর নির্জন, নিরিবিলি বাড়িটি দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘দেখো দেখি ভদ্রলোক সমাজের মধ্যেও আমি থাকি না।’ রাধারানির সঙ্গে তাঁর বিয়ের প্রসঙ্গ উত্থাপন করলে, রামকিঙ্কর জানান, ‘ওতে আর আমার বিশ্বাস নেই।’ বিশ্বাস নই, কারণ, সভ্য সমাজের কুঠারাঘাত বিবাহ নামক সামাজিকতার ঠুকনো সম্পর্কের থেকে তখন অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে তাঁকে। সরিয়ে নিয়েছে, কিন্তু, চারপাশের নিষ্ঠুর বিদ্রুপ আর সমালোচনায় রাধারানির প্রতি তাঁর প্রেম পরিহার করেননি এতটুকুও। রামকিঙ্কর-রাধারানির মধুর মিলনের সাক্ষী প্রভাস সেন তাঁর সেই অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতার কথা জানাচ্ছেন এইভাবে, ‘রাধারানিকে রামকিঙ্কর ভালবেসে ছিলেন, এবং, ভালবেসে ছিলেন নিঃস্বার্থভাবেই প্রতিদানের কোনও প্রত্যাশা না রেখেই। আমার মধ্যবিত্ত মন নিয়ে এটা বিশ্বাস করতে মাঝে মাঝে দ্বিধা হয়েছে, কিন্তু সব সন্দেহের নিরসন হয়েছে যখন মৃত্যু শয্যায় অজ্ঞান অবস্থায় শুধু তার নামই ওঁর মুখে শুনেছি।’ এইরকমই এক অনাবিল অভিজ্ঞতার কথায় প্রখ্যাত ভাস্কর-চিত্রী সোমনাথ হোর জানাচ্ছেন, ‘হিতৈষীদের কেউ কেউ সঙ্গিনী নির্বাচনে দুঃখিত ছিলেন। কিন্তু আমার মনে হয়েছে কিঙ্করদার ভালোবাসা অপার ছিল। সঙ্গিনীর জন্য তিনি অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। অপরের সমালোচনায় মৌনি থেকেছেন, কিন্তু প্রেম পরিহার করেননি। হাসপাতালের শেষ দিনগুলিতে রাধারানি-কিঙ্কর মধুর মিলনের যাঁরা সাক্ষী তাঁরা অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন।’ রামকিঙ্করের শিল্পী জীবনের একেবারে শেষ পর্যায়ে আঁকা ‘পৌষ মেলা’ চিত্রমালার কোনও কোনও ছবিতে রাধারানির মুখাবয়বের সঙ্গে সাদৃশ্য থাকা একজন প্রৌঢ় মহিলার উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। রোগভোগে ক্লান্ত, বাতের আক্রমণে পঙ্গুপ্রায় গৃহবন্দি রামকিঙ্করের শেষ জীবনের বাসস্থান শান্তিনিকেতনের এন্ড্রুজ পল্লীর ২০ নম্বরের বাসায় যখন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভের সুযোগ হয় তখন রাধারানি বলেছিলেন, ‘সংসারের প্রয়োজনে বাইরে গেলে, জানালা দিয়ে দূর পথের দিকে তাকিয়ে গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন রামকিঙ্কর– কখন তিনি ফিরে আসবেন বাসায়। এই সময়ে, জীবনের প্রান্ত বেলায়, রামকিঙ্কর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন অভিভাবকসম রাধারানির ওপর। এদেশের-একালের একতম মরদ শিল্পী রামকিঙ্করের সেই ভালোবাসার মূল্য আমরা কী দিয়েছি কিছুই? এক ধরনের ঔদাসীন্য মিশ্রিত নিদারুণ অবহেলা-অবজ্ঞা ছাড়া রাধারানিও কী পেয়েছিলেন তাঁর প্রাপ্য সম্মান? রামকিঙ্করের মৃত্যুর পরও রাধারানি বেঁচেছিলেন সাত-আট বছর। আস্তে-আস্তে সকলের দৃষ্টির অন্তরালে চলে গিয়ে রাধারানি হয়ে গিয়েছিলেন বিস্মৃতপ্রায়।’
তিন দশকেরও অধিক সময় রামকিঙ্করের জীবন ও সৃষ্টির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে ছিলেন রাধারানি। একজন মহাশিল্পীর জীবনব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের বহু ঘটনা-মুহূর্তের সাক্ষী রাধারানির সঙ্গে আমার মুখোমুখি সাক্ষাৎ ঘটে পাঁচবার। মৃত্যুর কিছুকাল আগে, রামকিঙ্করের বসবাসের শেষ ঠিকানা, শান্তিনিকেতনের এন্ড্রুজ পল্লীর ২০ নম্বর কোয়ার্টাসে প্রথম সাক্ষাৎ। দ্বিতীয় সাক্ষাৎ রামকিঙ্করের মৃত্যুর কিছুকাল পর, শান্তিনিকেতনে রাধারানির ঘনিষ্ঠজনদের দৃষ্টির অন্তরালে চলে গিয়ে এক আশ্রয়দাতার বদান্যতায় বিস্মৃতপ্রায় রাধারানির আশ্রয়স্থল যখন হয়ে উঠেছে শান্তিনিকেতনের অদূরে ভেদিয়ায়। তৃতীয় সাক্ষাৎ বোলপুরের পুরনো বাসস্ট্যান্ডে বাড়ি ফেরার বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে চরম আর্থিক দুরবস্থায় উদ্ভ্রান্ত প্রায় রাধারানির সঙ্গে অকস্মাৎ দেখা হয়ে যায় ঘোর গ্রীষ্মের এক মধ্যাহ্নবেলায়। চতুর্থ সাক্ষাৎ আমার আমন্ত্রণে, আমার বাড়িতে এসে যখন থাকেন একটা গোটা দিন আর একটা গোটা রাত। মৃত্যুর অল্প কিছুকাল আগে, শান্তিনিকেতনের ভুবনডাঙায়, তাঁর নিজের দোতলা পাকা বাড়ির নিচুতলার বারান্দায়, বিনা চিকিৎসায়, অযত্নে অবহেলায়, চরম অর্থকষ্টে, একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া, প্রায় সংজ্ঞাহীন রাধারানির সঙ্গে ছিল আমার পঞ্চম তথা শেষ করুণ সাক্ষাৎ। এই শেষ সাক্ষাতের অল্প কিছুদিন পর, রাধারানির প্রয়াণের সংবাদ কানে এসে পৌঁছয়। সময়টা ছিল ১৯৮৭ সালের নভেম্বর মাস। লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যাওয়া রাধারানির খোঁজে একদিন বেরিয়ে পড়েছিলাম। তাঁকে খুঁজে, তাঁর মুখোমুখি হয়ে, দীর্ঘ একটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগও ঘটে গিয়েছিল একিদন। এটিই ছিল রামকিঙ্কর-সঙ্গিনী রাধারানির একমাত্র খোলামেলা ও দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। জীবনের প্রান্তবেলায় পৌঁছে, স্মৃতি ভারাক্রান্ত, অশ্রুসজল রাধারানি দুর্লভ এই সাক্ষাৎকারের শেষ প্রান্তে এসে তাঁর ‘বাবু’র প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন এইভাবে: ‘তুমি আমাকে আর জন্মে পেয়ো আর আমি তোমার পাশে পাশে আছি। আমি তোমাকেই কামনা করছি। সবসময়ই কামনা করি, তুমি স্বর্গ থেকে আমাকে আশীর্বাদ করো। আমি তোমার আশাতেই বসে আছি।’