গত কয়েক দশক ধরে বাংলা গান যেন পারিপার্শ্বিকতা বিমুখ এক আত্মরতিতে পরিণত হয়েছে। হয়তো বিশ্বজুড়ে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের সংখ্যা কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে ‘গণ’ শব্দটির সংজ্ঞাও আমাদের কাছে বদলে গিয়েছে। তার সঙ্গে গানে, কবিতায় নয়া উদারনীতির নন্দনতত্ত্বের নিরন্তর বিজ্ঞাপন তো আছেই।
পালানোর সব পথ বন্ধ। পিছনে মারমুখী জনতার ভিড়। পুলিশও এসে পড়েছে, লালবাতি লাগানো গাড়ি হাঁকিয়ে। খানিকক্ষণের মধ্যেই হয়তো গ্রেপ্তার হবেন তিনি। আমাদের কুশীলবের কোনও নাম নেই। তিনি গ্রাম থেকে শহরে এসেছিলেন কাজের খোঁজে। তারপর ঘটনাচক্রে শহরের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত জীবনের নানা শঠতা চাক্ষুষ করে ফেলেন। এখন তিনি শহুরে বাবুদের ঘোর শত্তুর! গ্রেফতার তাঁকে হতেই হবে। কিন্তু ঠিক এমন সময় ‘জাগতে রহো’ ছবির গতিপথ পাল্টে যায়। শুরু হয় গান, ভৈরব রাগে। ‘জাগো মোহন প্যারে জাগো।’ ইমেজ এবং সংগীতের সংঘাতে ভৈরবও যেন হয়ে ওঠে ঘোরতরভাবে রাজনৈতিক।
ভৈরব রাগেরই এক প্রচলিত বন্দিশের অংশবিশেষ থেকে ধার করা হয়েছিল এ গানের কথা। কিন্তু সুরকারের কল্যাণে সে বন্দিশ যেন নিজের আপাত ‘অরাজনৈতিক’ পরিচয়কে অস্বীকার করেছে। পৌঁছে গিয়েছে এক তুরীয় মার্গে। ‘অরুণোদয়ের পথে’ নামে একটি নাটক লিখেছিলেন সলিল চৌধুরী। এ গান যেন সেই অরুণোদয়ের কথাই বলে। মনে করিয়ে দেয় ‘চিহ্ন’ উপন্যাসের উপসংহারের অংশকে, যেখানে স্বজনহারা যাদব অনায়াসে মিশে যায় বিদ্রোহী শোভাযাত্রায়। কিন্তু কোন বোধশক্তি একজন শিল্পীর প্রত্যেক উচ্চারণকে করে তোলে রাজনৈতিক? ইতিহাসের কোন সন্ধিক্ষণ সযত্নে লালন করে শিল্পীর চেতনাকে? সলিল চৌধুরীকে নিয়ে যে কোনও আলোচনায়– এ প্রশ্নই বোধহয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
চারের দশকের মধ্যভাগকে বলা চলে ‘ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ’ বা ‘আইপিটিএ’-এর ভরা জোয়ারের কাল। সে ছিল ‘খেলা ভাঙার খেলা’-র দশক। ভারতের মানুষ এ যাবৎকাল শিল্পচর্চাকে যেভাবে দেখে এসেছেন, আইপিটি-এর দৌলতে তাতে এক জোর ধাক্কা এসে পড়ল! মঞ্চ, ক্যানভাস এবং সংগীত– সবেতেই নতুনের আবির্ভাব ঘটল। গণনাট্য সঙ্ঘের কার্যকলাপ শুধুমাত্র শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল না। নিম্ন-মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষও তাতে সমানভাবে এসে শামিল হলেন। এলেন তর্জা গায়ক, গুরুদাস। কলকাতার ট্রাম কোম্পানির শ্রমিক, দশরথ লাল। অসমের ভূমিপুত্র মঘাই ওঝা, মহারাষ্ট্রের তামাশা এবং লাবণী শিল্পী, আন্না ভাউ সাথে। যদিও পরবর্তীতে পার্টির তরফে এঁদের প্রতি কতটা সুবিচার করা হয়েছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। যাই হোক, সে অন্য প্রেক্ষিত।
এ সময়ে সংগীতের ক্ষেত্রে দু’জনের নাম উজ্জ্বল হয়ে উঠল– হেমাঙ্গ বিশ্বাস এবং সলিল চৌধুরী। যদিও আইপিটিএ-তে যোগ দেওয়ার আগে গণসংগঠন করার দৌলতে সলিলের রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়ে গিয়েছিল। অসমের চা বাগানের কুলী-কামিনদের গান থেকে আরম্ভ করে কলকাতার ছায়া সিনেমার অর্কেস্ট্রার অভিজ্ঞতা তাঁর সামনে সংগীতের নানা অলিগলির রাস্তা খুলে দিয়েছে। বাবার রেকর্ডের সংগ্রহ থেকে তিনি শুনে ফেলেছেন বাখ, বেঠোফেন, মোৎজার্তের বিবিধ কীর্তিকলাপ। সোনারপুরের কাছে মামাবাড়িতে থাকাকালীন নিভৃতে বাঁশির চর্চা করেছেন।
এ অবস্থায় তিনি রচনা করলেন তাঁর প্রথম জনপ্রিয় গণসংগীত, ‘বিচারপতি, তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে।’ সলিল এখন সম্পূর্ণ রাজনীতি সচেতন একজন শিল্পী। তাঁর শৈল্পিক চেতনা নিয়ন্ত্রণ করছে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি। ‘উত্তাল চল্লিশ’-এর থেকে শিক্ষা নিয়ে তিনি নিছক সংগীতচর্চা করছেন না, রাজনৈতিকভাবে সমকালীন সংগীতকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টাও করছেন।
১৯৫১ সালে সমকালীন বাংলা গান সম্বন্ধে তাঁর একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। সুধী প্রধান সম্পাদিত ‘Marxist Cultural Movement in India’ গ্রন্থে তার ইংরেজি শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘Modern Bengali Music in Crisis’. সে প্রবন্ধে তিনি যা লিখছেন, তার অংশবিশেষের অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, “বাংলা সংগীতের শ্রোতাদের এখন একটাই দাবি, ‘চাঁদ, ফুলের গান তো অনেক হল। এবার নতুন কিছু চাই’।” তিনি আরও লিখছেন, ‘আজকের দিনে এমন গান তৈরি হওয়া দরকার যা মানুষের জীবনের কথা বলে।’ বলাই বাহুল্য, এই বোধ থেকেই তিনি সংগীত রচনা করেছেন। তাঁর একের পর এক গণসংগীত আমজনতার মুখে মুখে ফিরেছে।
পিসি যোশীর পর অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হলেন বিটি রনদিভে। প্রধানত এ সময় থেকেই পার্টির সাংস্কৃতিক মহলে কিছু সংকট দেখা দিল। প্রশ্নের মুখে পড়লেন বিষ্ণু দে, সমর সেনের মতো কবিরা। সময়ে সময়ে তাঁদের নামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হল ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ তকমা। যথারীতি পার্টির সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ল। গণনাট্য সঙ্ঘের গতিপথও যেন খানিক থমকে গেল।
পরবর্তীকালে কল্পনা বিশ্বাসকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে সলিল বলছেন, ‘আমার মনে হয় আইপিটিএ কখনওই শেষ হয়ে যায়নি। বরং আরও বহু নাট্য এবং সংগীত গোষ্ঠীর জন্ম দিয়েছে যারা আজীবন আইপিটিএ-এর মতাদর্শের কথা মাথায় রেখেই শিল্পচর্চা করে গেছে।’ সলিল চৌধুরীর শিল্পী জীবনকে যদি আমরা দু’ভাগে ভাগ করি, তাহলে এ বক্তব্যের যাথার্থতার প্রমাণ পাওয়া যাবে। আসলে মানসিকভাবে আইপিটিএ-এর থেকে তাঁর আদৌ কোনও দূরত্ব তৈরি হয়নি। খ্যাতির শীর্ষে থাকাকালীন যখন তিনি তথাকথিত মূলধারার গান রচনা করছেন, তাতেও অবলীলাক্রমে এসে পড়ছে রাজনীতির প্রসঙ্গ। তাঁর ‘আজ নয় গুনগুন গুঞ্জন প্রেমে’ গানে সুস্পষ্টভাবে পাওয়া যায় তেভাগা আন্দোলনের কালে রচিত ‘শপথ’ কবিতার ছায়া।
একুশ শতকে গণসংগীত আর সেভাবে লেখা হল না। কেউ কেউ হয়তো নিজের মতো করে লেখার চেষ্টা করেছেন, তবে সেগুলি তেমন জনপ্রিয় হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, গত কয়েক দশক ধরে বাংলা গান যেন পারিপার্শ্বিকতা বিমুখ এক আত্মরতিতে পরিণত হয়েছে। হয়তো বিশ্বজুড়ে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের সংখ্যা কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে ‘গণ’ শব্দটির সংজ্ঞাও আমাদের কাছে বদলে গিয়েছে। তার সঙ্গে গানে, কবিতায় নয়া উদারনীতির নন্দনতত্ত্বের নিরন্তর বিজ্ঞাপন তো আছেই। ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও, আমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি।’ পিট সিগার যে ‘Little boxes’-এর কথা লিখেছিলেন, তাকেই যেন কোথাও সিলমোহর দেওয়া হয় এ ধরনের গানের মধ্য দিয়ে। রেনেসাঁসের ‘আলোকপ্রাপ্ত’ বাঙালির ধারাবাহিকভাবেই অনেক বেশি রাজনীতি সচেতন হওয়ার কথা ছিল। তার শিল্পচর্চার রাজনৈতিক অনুশীলনে পুষ্ট হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হল না। একে আর ট্র্যাজেডি ছাড়া কী-ই বা বলা যেতে পারে?