‘কবিদের কবিতা অনুবাদ করায় কিন্তু একটা অসুবিধা আছে। কোনও কবি যদি, বিশেষ করে কোনও প্রতিষ্ঠিত কবি যদি অনুবাদ করেন, তাহলে অনুবাদে তাঁর নিজের প্রভাবটা চলে আসে। তাঁরা ঠিক নির্লিপ্ত থাকতে পারেন না। কিন্তু অনুবাদককে নির্লিপ্ত থাকা জানতে হয়।’ অরুণ সোম কীভাবে পেরেছিলেন নির্লিপ্তি আত্মস্থ করতে? অরুণ সোমের সাক্ষাৎকারের শেষ পর্ব। কথোপকথনে তিতাস রায় বর্মন।
দেবেশ রায় আপনার বইয়ের ভূমিকায় লিখেছিলেন যে, ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ দুটো শব্দই মূল রুশি শব্দ থেকে সরে তৈরি হয়েছে। এমনকী, ‘অপরাধ’ আর ‘শাস্তি’-ও সঠিক শব্দ নয়। তাহলে আসল শব্দগুলো কী? কীভাবে এই দুটো শব্দের কাছাকাছি যাওয়া যেতে পারে?
হ্যাঁ। ওভাবে তো অনুবাদ করা যায় না। মূল রাশিয়ান শব্দটার তাৎপর্য হচ্ছে– বড় বড় মহাপুরুষেরা যে সীমানাটা লঙ্ঘন করছেন, সেটা তাঁদের মানায়। কিন্তু তুমি-আমি করলে সেটা কি উচিত হবে? নেপোলিয়ান যা করেছেন, সেটা দেখে আমি যদি ভাবি আমি নেপোলিয়ান, তাহলে তো হয়ে গেল। কিন্তু সেটা তো আবার অপরাধও নয়। অনেকে আবার ‘পাপ’ কথাটাও ব্যাবহার করেছেন। পাপ তো অপরাধের মধ্যে পড়ে না। ওটা ‘সিন’ হয়ে গেল। এই দুটোর মধ্যে তো অনেক ফারাক। পাপের মধ্যে একটা ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক ব্যাঞ্জনা আছে, অপরাধ তা নয়। অপরাধ তো দেখা যাচ্ছে। সমাজে বসবাস করতে গেলে যে আইন, সেটাকে আঘাত করলে সেটা অপরাধ হতে পারে। যে কোনও শব্দ বা এক্সপ্রেশন আসলে সেই ভাষাটার বীজমন্ত্র। একটা কোড। সেই শব্দটাকে ভাঙলে ইতিহাস, ভূগোল, সংস্কৃতি সবকিছু পাওয়া যাবে। কোনও অনুবাদককে যদি অনুবাদ করতে হয়, তাহলে সেই কোডটাকে ভাঙতে হবে। না ভাঙলে সেই অনুবাদ গ্রাহ্যই হবে না।
সেসময় সোভিয়েতের এই বইগুলোতে, বিশেষত শিশু-কিশোর সাহিত্যে চমৎকার সব অলংকরণ থাকত। এই অলংকরণ কি মূল ভাষার বই থেকে নেওয়া নাকি নতুন ছবি।
কিছু কিছু হয়তো রুশ ভাষার মূল বই থেকে নেওয়া, তবে অধিকাংশই নতুন ছবি হত। যাঁরা অলংকরণ করতেন, আমরা তাঁদের চিনতাম না। যেভাবে কারা সিলেকশন করে, আমরা জানতাম না। তবে দেখতে পেতাম অনেক সময় তাঁরা মূল বইয়ের ছবিগুলোই খানিক অদল-বদল করে দিতেন, সেগুলো যেন আরও সুন্দর হয়ে যেত। তবে আমি খেয়াল করে দেখেছি মূল বইয়ের অলংকরণের থেকে আমাদের জন্য করা অলংকরণগুলো যেন বেশি ভাল ছিল। যেমন ‘আনাড়ির কাণ্ডকারখানা’-র মূল বইতে ওরকম অলংকরণ নেই। অন্যান্য ভাষার ক্ষেত্রেও আলাদা আলাদা অলংকরণ শিল্পী ছিলেন। ‘রুশ ইতিহাসের কথা ও কাহিনী’ বইটির অরিজিনালে কিন্তু অত রঙিন ছবি নেই।
পড়ুন সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব: অনুবাদককে হাল ছেড়ে দিলে চলবে না
আপনি অনুবাদ করতে চেয়েছিলেন রুশ সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে। ওদিকে একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও ছিল অনুবাদের। এখানে রাজনীতি এবং ব্যক্তিগত জুড়ে যাচ্ছে। আপনার কি মনে হয়, আজকে ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক জায়গায় অনুবাদ কোনও ভূমিকা নিতে পারে?
খুব পারে। খুবই। যেমন ধরো ‘প্রতিক্ষণ’ থেকে মায়াকোভস্কির কবিতার অনুবাদ বেরিয়েছে আমার। সেখানে যে দীর্ঘ লেনিনের কবিতাটা, সেটা তো রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগতও বটে। তাছাড়া ভাবো না, প্রগতি বা রাদুগার যা উদ্দেশ্য ছিল, তা কি পুরোপুরি বৃথা নাকি? তা তো দার্শনিক প্রগতি বা সামাজিক প্রগতিতে আমাদের সমৃদ্ধ করেছিল। আজ পুঁজিবাদের সময়, আজ কোনও দর্শন নেই, আদর্শ নেই। দিকভ্রান্ত সবাই। ক্যাপিটালিজমের কি আর প্রচার হয়? সে তো মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। সোভিয়েতের তা ছিল, তাই সে প্রচার করেছে, বিশ্ব চেতনা ছড়িয়ে দিতে পেরেছে। এখন আর সেরকম লেখা হচ্ছে কই? কোথাওই হচ্ছে না, যা এই রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। আগে একটা বই কত কিছু করে দিতে পারত। এখন নানা মাধ্যম এসে গেছে। ডিজিটাল যুগ। এখন কথার খেলা, জাগলারি। এসব দিয়ে কি কিছু হয়? আরও কয়েক বছর যাক।
আপনার কবিতা অনুবাদের ইচ্ছে হয়নি কখনও?
আমি কিন্তু কবিতা অনুবাদ করতে পছন্দ করি। কিন্তু কেউ দেয়নি করতে (হাসি)। কিন্তু আমি তো আর কবি নই। এদিকে, কবিদের কবিতা অনুবাদ করায় কিন্তু একটা অসুবিধা আছে। কোনও কবি যদি, বিশেষ করে কোনও প্রতিষ্ঠিত কবি যদি অনুবাদ করেন, তাহলে অনুবাদে তাঁর নিজের প্রভাবটা চলে আসে। সেটা কিন্তু গ্রহণযোগ্য নয়। আমার খুবই প্রিয় এবং শ্রদ্ধাভাজন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। সুভাষদা নেরুদা অনুবাদ করেছেন, নাজিম হিকমত অনুবাদ করেছেন, একটা রুশি কবিতাও করেছিলেন। কিন্তু আমি ওই রুশ কবিতাটা মিলিয়ে দেখেছি, ওটা সুভাষদার নিজের কবিতা হয়ে গেছে। অনুবাদে ওই ব্যঞ্জনাগুলো পাল্টে পাল্টে গেছে। এটা নিয়ে আমি লিখেওছি বাংলা আকাদেমি সুভাষদাকে নিয়ে যে সংকলন বের করেছিল, সেখানে। সোলঝেনিৎসিনের ভক্ত হয়ে গিয়েছিলেন সুভাষদা শেষের দিকে। ওঁর দুটো কবিতা, যেগুলো কবিতাই নয় আসলে, সেটা সুভাষদা অনুবাদ করেছিলেন, সেটা অনুবাদে হয়েছিল অপূর্ব এক কবিতা। কিন্তু তাতে সোলঝেনিৎসিন নেই। কবিরা কবিতা অনুবাদ করতে গেলে এরকম হয়। তাঁরা ঠিক নির্লিপ্ত থাকতে পারেন না। কিন্তু অনুবাদককে নির্লিপ্ত থাকা জানতে হয়।
মূল ভাষার কাছাকাছি যেমন থাকতে হবে, আবার অনূদিত ভাষার সংস্কৃতিতে মিশে যেতেও হবে। এ তো একটা দ্বন্দ্বও বটে। অনুবাদকের টানাপোড়েন।
সে তো নিশ্চয়ই। তবে, মূল ভাষার ব্যঞ্জনা রেখে দেওয়ার পক্ষপাতী আমি। এখন যদি ধরো রুশ থেকে অনুবাদ করছি, হঠাৎ একটা বাংলা প্রবাদ ঢুকিয়ে দিলাম– ঘরের শত্রু বিভীষণ। এটা তো ঠিক না। সুভাষদার অনুবাদেও ওগুলো আছে। আমার পাঠকের বোধগম্য হওয়ার জন্য আমি মূল ভাষায় মধ্যে আমার ভাষাকে চাপিয়ে দিতে পারি না। সংস্কৃতির তো অনুবাদ হয় না, তাই না? সুভাষদা একবার লিখেছিলেন ‘কালীর কসম’। কসম শব্দটার অপব্যবহার করা হল এখানে।
এখন যারা অনুবাদ করছেন, তাদের কী বার্তা দেবেন?
ক্লাসিক অনুবাদ করে কিন্তু বদল আনা যায় না।
বাংলা ক্লাসিক সম্পর্কেও এই কথাই বলবেন?
বাংলায় কি ক্লাসিক আছে আদৌ? নিঃসন্দেহে বড় বড় সাহিত্যিক আছেন, যাঁরা ভাল স্টোরি টেলার। কিন্তু ক্লাসিক হতে গেলে তো ভাল ভাষা, ভাল গল্প, ভাল ভঙ্গি হলেই চলবে না। ক্লাসিকের হয়তো ভাষা ভাল না, কষ্ট করে পড়তে হবে। দস্তয়েভস্কির ভাষা যেমন খুব খারাপ। ক্লাসিককে অবস্থান করতে হবে স্থান-কাল-পাত্রের ওপরে। এই মাটি থেকে তৈরি হয়েই মাটি ছাড়িয়ে যেতে হবে। হয়তো রাজা-রাজড়ারই গল্প বলছে, কিন্তু আসলে যেটা বলতে চাইছে, সেটা চিরকালীন। শেক্সপিয়র আজও কেন লোকে পড়ে এবং যুগ যুগ ধরে তার নতুন নতুন দিক আবিষ্কৃত হয়। স্টোরি টেলাররা আসবে, পাসিং ফেজ হয়ে।
কখনও মনে হয়েছে কোনও বাংলা বইকে রুশে অনুবাদ করার কথা?
না। আমি সেরকম রুশি লিখতে পারি নাকি? আমি তো রুশি নই। এ কাজ আমার দ্বারা হবে না। এটা স্বীকার করতেই হবে। আজও আমি রুশি শিখছি। আমাকে অনেক সময়ই আমার স্ত্রীর সাহায্য নিতে হয়। যদিও ওর বিষয় একেবারেই আলাদা। ও বটানির ছাত্রী। ও পতঙ্গবিশারদ।
আপনি বললেন কবি নির্লিপ্ত হতে পারে না। আপনি এতদিন ধরে অনুবাদ করছেন, আপনি কীভাবে নির্লিপ্ত থাকতে পারলেন?
আমি তো কবি নই, লেখকও নই। তাই পারি। আমি অনেক চেষ্টা করেছি নিজের লেখা লিখতে, যা আমার অরিজিনাল। কিন্তু লিখতে বসে বুঝি এ তো আমি নই। যে লেখাটা বেরচ্ছে আমার কলম থেকে, তা আসলে অন্যের থেকে ধার করা। কখনও দস্তয়েভস্কি বেরিয়ে আসছে। কখনও তলস্তয়। এত এত লেখা পড়েছি অনুবাদের জন্য। সেগুলোর প্রভাব আমার লেখাতে এসে পড়ছে। আমি লেখক নই। প্রবন্ধ লিখতে পারি, কিন্তু গল্প উপন্যাস নয়। অনুবাদক হচ্ছে একজন অভিনেতার মতো। তাকে যে পাত্রে রাখবে, সেই পাত্রই সে ধারণ করবে। একজন পেশাদার অনুবাদককে কিন্তু সবকিছু অনুবাদ করতে হবে। যাকে বলে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ। আমাকে একবার দিল ‘সোভিয়েত নারী’-র একটা কলাম অনুবাদ করতে। কলামটা ছিল উল বোনা নিয়ে। আমি কিন্তু প্রথমে অবাক হয়েছিলাম। আমি কীভাবে করব এটা। এদিকে ওখানে কোনও বাংলা মহিলা অনুবাদক নেই। কিন্তু করছি আমি অনুবাদ। সেখান থেকেও রুশ ভাষা আয়ত্ত করেছি। সংস্কৃতিটা যেহেতু জানতে পারছি, তাই ভাষাটারও কাছাকাছি পৌঁছতে পারছি।
সেসময় মস্কোতে বাংলা ভাষার কোনও মহিলা অনুবাদক ছিলেন না?
ভারতীয় ভাষা বিভাগে কোনও মহিলা অনুবাদক ছিলেন না, তবে বিদেশি ভাষার বিভাগগুলোতে ছিলেন। ইংরেজি বিভাগে একজন ছিলেন, মনে পড়ছে। আরও বেশ কিছু ভাষায় ছিলেন। তবে প্রগতিতে সম্পাদকরা বেশিরভাগই মহিলা। আমার বিভাগীয় প্রধানই তো মহিলা। ধরো, শতকরা ৬০ জনই মহিলা সম্পাদক। সম্পাদনা, শিক্ষকতা বা ডাক্তারি, এই কর্মক্ষেত্রগুলোতে মহিলাদের প্রভাব ছিল বেশি। ওদেশে মহিলারা কর্মক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে ছিল।
আমরা যারা সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার সময় জন্মেছি, তাদের কাছে সোভিয়েত ছিল কল্পনার জায়গা। কিন্তু আপনার কাছে ঘোর বাস্তব। সেটা ভেঙে যাওয়ার প্রভাব আপনার ওপর কীভাবে এসে পড়ল?
বড় স্বপ্নভঙ্গ। আদর্শটাই তো টিকতে পারল না। সেটা তো আদর্শের অক্ষমতা নয়, বরং যারা এই সমাজব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে পারল না জনসংযোগহীনতার কারণে, তাদের অক্ষমতা। প্রথমদিকে যেভাবে কাজ হয়েছিল, সেটা ধরে রাখতে পারল না। শেষদিকে ব্যুরোক্রেসির জায়গায় চলে গেল। এখানেও সেইভাবেই শেষ হয়েছিল। মানুষের জন্য ভাবনাটা বন্ধ হয়ে গেল। যারা ওপরের দিকে ছিল, তারা ধীরে ধীরে নীচের দিকটা আর দেখতে পেল না। কিন্তু আদর্শটা তো ঠিকই ছিল।
সোভিয়েতের কোন জায়গাটা এখনও স্বপ্নের মতো আপনার কাছে?
একটা জিনিস বলি তোমায়, ওই দেশের যে সাংস্কৃতিক বোধ, যা মানুষের মনে গেঁথে দেওয়া হয়েছিল, তা ছিল আশ্চর্যের। সেই বোধটা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যই কিন্তু আমাদের অনুবাদ করা। যেমন ধরো, প্রতিটি শহরেই নিয়মিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হত। যেমন ব্যালে। সেখানে এত বেশি সংখ্যাক লোক যেত যে মাসের পর মাস তা হাউসফুল থাকত। টিকিট পাওয়া মুশকিল হয়ে যেত। এই সাংস্কৃতিক চেতনা কিন্তু স্কুল থেকেই তৈরি করা হত। কত কিছু জানত ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। একজন ক্লাস টেন পাস ছাত্রের কিন্তু পুশকিন মুখস্থ। তুর্গেনিভ পড়ে ফেলেছে। আমার মেয়েদের পড়াশোনা দেখে আমিই মুগ্ধ হয়ে গেছি। তাদের বন্ধুবান্ধবদেরও দেখেছি। শুধু শুধু নিজের দেশের না, অন্য দেশের সাহিত্য, গান সবকিছু জানত। যেমন কোনও ক্লাসিক্যাল গান হচ্ছে, ওরা বলে দেবে সেটা কোন সিম্ফনি, কোন দেশের সুরকার তিনি। আমরা বলতে পারব এটা? আসলে চারিদিকেই এই আবহটা বিরাজ করত, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে ছাওয়া ছিল।
এটা কি সর্বস্তরেই দেখা যেত, কালচারালি এলিট অংশের বাইরেও?
সর্বস্তরে। সবাইকে জানতে হত। মেট্রোতে দেখতাম সবাই বই পড়ছে। বাসে-ট্রামেও একই দৃশ্য। সবাই কিছু না কিছু পড়ছে। এইটা আর কোথাও দেখতে পাইনি।
সমাজব্যবস্থায় এর প্রভাব কীভাবে পড়েছিল?
আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা সরকার করে দিচ্ছে। আমাকে কোনও খরচ করতে হচ্ছে না। আমার বাসস্থান ওদের দায়িত্ব। কেউ রাস্তায় থাকবে না। আমার চাকরি সরকার দিতে বাধ্য। কেউ চাকরি না করে থাকতে পারবে না। নয়তো পুলিশ ধরবে। মহিলাদের ক্ষেত্রে একমাত্র ছাড় ছিল সন্তান প্রসব ও লালনপালনের সময় পর্যন্ত। কিন্তু চাকরিতে তোমাকে ফিরতেই হবে। শিক্ষাব্যবস্থা বিনামূল্যে। এই যে এতগুলো জিনিস তোমাকে রাষ্ট্রই দিচ্ছে, তাতে যেটা হয়েছিল তোমার বেঁচে থাকার চিন্তা লাঘব হয়ে গেল। সংস্কৃতিচর্চার জন্য তুমি নিজেকে ঢেলে দিতে পারছ। অনেকে বলত, সেখানে তো একজন শ্রমিক অনেক টাকা পায়, তাহলে তার আর উচ্চশিক্ষার কী দরকার? কিন্তু ওখানে উচ্চশিক্ষা সবাই লাভ করত। হয়তো স্কুল পাস করে কোনও একটা কারখানায় সে ঢুকে গেল। কিন্তু তারাও ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার জন্য লাইন দিচ্ছে। সে শিক্ষা লাভ করবেই। আমি আমার মেয়েদের দেখেছি, যেসমস্ত অঙ্ক ওরা করতে পারে, তা অবিশ্বাস্য। পরবর্তীকালে যখন ভেঙে গেল সোভিয়েত, আমি বুঝতে পারছিলাম আমাকে এ দেশে ফিরে আসতে হবে, তখন ভাবছিলাম মেয়েরা তো আর সেই শিক্ষাটা পাবে না। খুব আফসোস হয়েছিল ওদের শিক্ষার কথা ভেবে। যাই হোক, আমাকে রফা করতেই হল।
আপনাকে সোভিয়েত থেকে চলে আসতে হল। বাংলাদেশ থেকেও চলে এসেছিলেন। দু’বার দেশ ছাড়া…
আমি চিরকালই উৎখাত হওয়া লোক। কিন্তু আমার কোনও নস্টালজিয়া নেই। কৌতূহল আছে নিশ্চয়ই। জানতে ইচ্ছে করে এখন কেমন আছে মস্কো। এইটুকুই। বাংলাদেশ থেকে যখন চলে এসেছিলাম, তখন আমার বয়স ১০। অনেক কিছুই স্পষ্ট মনে আছে। কিন্তু আজ সেখানে গেলে তো সেই জায়গাগুলোই খুঁজে পাব না। সব বদলে গেছে। এখন যদি আমি রাশিয়া যাই, বিশাল বিশাল বিল্ডিং দেখতে পাব খালি। আমার মস্কো তো পাব না।
ফিরে যেতেও ইচ্ছে করে না কখনও?
না। বাংলাদেশ থেকে কতবার বলেছে ওখানে যেতে। বলেছে চলে আসুন, কোনও খরচ লাগবে না, যেখানে যেতে চান নিয়ে যাব। কিন্তু আমি যাব না।
এখন তো কোনও দেশেই বামপন্থা নেই, ভারত বলুন কি রাশিয়া। এটা নিয়ে কোনও দুঃখ আছে?
(কিছুক্ষণ ভেবে) কোথাও কোথাও তো ফিরে আসছে। এখনও আশা রাখি কোথাও না কোথাও হবেই।
(সমাপ্ত)