তখন শুরু হয়ে গিয়েছে অগ্নিযুগ। অনুশীলন, যুগান্তর, বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের নাম ঘুরছে মুখে মুখে। আখড়ায় শরীরচর্চায় মেতে ব্রিটিশ তাড়ানোর স্বপ্নে বিভোর বাঙালি যুবক। তাঁদের অনেকেরই বিকেলের অনিবার্য গন্তব্য মোহনবাগান মাঠ। ফুটবল যে দেশপ্রেমের আয়ুধ, কয়েক বছর আগেই তা দেখিয়ে দিয়েছেন শিবদাস ভাদুড়ী, বিজয়দাস ভাদুড়ীরা। দেশের কাজ করতে দেশবন্ধুর সঙ্গী হয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে আসা শিবরামও যে তাই মোহনবাগান গ্যালারিতে বসবেন নিয়মিত, তাতে আর আশ্চর্যের কী আছে!
তাঁর রাবড়ি প্রেমের কথা তো সকলেই জানেন। খাওয়া এবং ঘুম বাদে শিবরাম চক্রবর্তীর আরও একটি প্রিয় কাজ ছিল সিনেমা দেখা। কিন্তু তিনি যে গড়ের মাঠের ফুটবল গ্যালারির নিয়মিত দর্শক ছিলেন, তা কিন্তু তেমন চর্চিত নয়। মস্কো নিয়ে পণ্ডিতি এবং পণ্ডিচেরি নিয়ে মশকরার ফাঁকে, হর্ষবর্ধন-গোবর্ধনদের সঙ্গে চাঁদে জমি কেনার পরিকল্পনার অবসরে মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটের মেসবাড়ির বাসিন্দা তাঁর তক্তারাম ছেড়ে প্রায়শই পৌঁছে যেতেন মোহনবাগান মাঠে। সবুজ-মেরুন ছিল শিবরামের রক্তে।
তখন মাঠ মাতাচ্ছেন উমাপতি কুমার, গোষ্ঠ পালের মতো বরেণ্য ফুটবলার। আর সময়টাও তো আশ্চর্য! মোহনবাগান তো কেবল একটা ‘ক্লাব’ নয় তখন, বাঙালির জাতীয়তাবাদী আবেগের মশাল। বুটপরা ইংরেজদের হারিয়ে খালি পায়ের বঙ্গসন্তানদের শিল্ড জয়ের অমর কৃতিত্ব তখনও রীতিমতো জলজ্যান্ত! দেশের পরিস্থিতিও রীতিমতো উত্তাল। দেশপ্রেমের জোয়ারে পাল ফুলিয়ে ছুটছে বিপ্লববাদের নৌকা। শুরু হয়ে গিয়েছে অগ্নিযুগ। অনুশীলন, যুগান্তর, বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের নাম ঘুরছে মুখে মুখে। পাড়ায় পাড়ায় স্বদেশি আখড়া। শরীরচর্চায় মেতে ব্রিটিশ তাড়ানোর স্বপ্নে বিভোর বাঙালি যুবক। তাঁদের অনেকেরই বিকেলের অনিবার্য গন্তব্য মোহনবাগান মাঠ। ফুটবল যে দেশপ্রেমের আয়ুধ, কয়েক বছর আগেই তা দেখিয়ে দিয়েছেন শিবদাস ভাদুড়ী, বিজয়দাস ভাদুড়ীরা। দেশের কাজ করতে দেশবন্ধুর সঙ্গী হয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে আসা শিবরামও যে তাই মোহনবাগান গ্যালারিতে বসবেন নিয়মিত, তাতে আর আশ্চর্যের কী আছে!
কলকাতায় জন্ম হলেও শিবরাম তো আসলে মালদহের চাঁচলের রাজপরিবারের সন্তান। জীবনে কখনও তেমন মালকড়ি কামাতে না পারলেও জন্মসূত্রেই তিনি মালদার। ঘটি-বাঙালের সমীকরণে এ দেশীয়। ঘোর মোহনবাগানি। অবশ্য সেই সময় অধিকাংশ হিন্দু বাঙালিই মোহনবাগানের সমর্থক। ইস্টবেঙ্গল তখনও শিশু। মহামেডান সবে ডালপালা মেলছে। প্রায় প্রত্যেক বিকেলেই মোহনবাগান মাঠ ছিল শিবরামের খেলা দেখা এবং আড্ডার জায়গা।
ময়দানের কথা শিবরাম নিজে অবশ্য খুব বেশি লেখেননি। ‘কাষ্ঠকাশির চিকিৎসা’ গল্পে রয়েছে, ‘…সারাদিন আর বাড়ি ফিরলাম না। ওয়াই, এম. সি. এ-তে সকালের লাঞ্চ সারলাম, তারপর সোজা কলেজে গেলাম, সেখান থেকে এক বন্ধুর বাড়ি বিকেলের জলযোগ পর্ব সেরে চলে গেলাম খেলার মাঠে। মোহনবাগান ম্যাচ জেতায় যে ফুর্তিটা হল, ক্লাবে গিয়ে ঘণ্টা দুই ব্রিজ খেলায় হেরে গিয়ে সেটা নষ্ট করলাম। সেখান থেকে গেলাম সিনেমার সাড়ে নটার শোয়ে।’ এমনই ছিল তাঁর রোজনামচা। ফুলের পাপড়ির মতো নির্ভার, চঞ্চল, ফুরফুরে।
আরেকটি গল্প ‘নিখরচায় জলযোগ’-এ ময়দান নিয়ে শিবরাম আরেকটু বিশদ: ‘…সাড়ে-এগারোটা থেকে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে, ভিড় ঠেলে, ঘোড়ার ধাক্কা সয়ে কতো তপস্যার পর তো ঢুকলাম খেলার গ্রাউন্ডে! ভিড়ের ঠেলায় পকেট ছিঁড়ে যা ছিল সব গড়িয়ে গেছে গড়ের মাঠে। মানে, মামার পকেটের যা কিছু ছিল। আমার পকেট তো এমনিতেই গড়ের মাঠ!.. ছিন্ন হয়ে ক্যালকাটা গ্রাউন্ডে ঢুকেছিলাম, ভিন্ন হয়ে বেরুলাম খেলার শেষে। ঐ ভিড়ের ঠেলাতেই।…
ভাগ্যিস মামা ছিলেন হুশিয়ার! খাড়া ছিলেন গেটের গোড়ায়, তাই একটু না আগাতেই দেখা মিলল, নইলে এই গোলের মধ্যে (মোহনবাগানের এত গোলের পর) আবার যদি মামাকে ফের খুঁজতে হতো তা হলেই আমার হয়েছিল! আমার হাঁকডাকে কতো জনার সাড়া মিলতো, কতো জনার কতো মামাই যে অযাচিত এসে দেখা দিতেন কে জানে! এই জন-সমুদ্রে আমি নিজেই হারিয়ে যেতাম কিনা তাই কে বলবে!…’
কল্লোল যুগের সাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের লেখায় শিবরামের ময়দানি উপস্থিতির বেশ খানিকটা বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি লিখছেন, শিবরাম বসতেন সেন্টার সার্কেলের কাছাকাছি। গ্যালারির প্রথম ধাপে। তখন তাঁর গোলগাল, নধরকান্তি চেহারা। লম্বা চুল। পিছনের দিকে আঁচড়ানো। অচিন্ত্যকুমারের বলছেন, শিবরামের সমস্ত উপস্থিতিটাই রসে-হাস্যে সমুজ্জ্বল। তার মধ্যে শ্লেষ আছে, কিন্তু দ্বেষ নেই। শিবরামের সরসতা তো সরলতারই অপর নাম। ততদিনে ‘ভারতী’ পত্রিকায় ছোটগল্প লিখে বেশ নাম করেছেন। সেই সঙ্গে বেশ কিছু কবিতাও পাঠকের ভালবাসা পেয়েছে। হাসির প্রাণবন্ত প্রস্রবণ শিবরাম যেমন সকলকে হাসান, নিজেও হাসেন প্রাণভরে। অচিন্ত্যকুমার লিখছেন, ‘পরকে নিয়ে হয়তো হাসছে, তবু সর্বক্ষণ সেই পরের উপর তার পরম মমতা।’
ঠিক এমনই ঝলমলে, অথচ কোমল হাস্যমুখরতা নিয়ে শিবরাম হাজির হতেন মোহনবাগান গ্যালারিতে। মাঠে চলছে ফুটবল খেলা আর শিবরামের মুখে অনর্গল শব্দের খেলা। মোহনবাগানের খেলা দেখতে আসা দর্শকরাও মেতে উঠতেন এই হাসকুটে মানুষটিকে নিয়ে।
ক্রমে শিবরামের বয়স বাড়ল। চারদিকে দারিদ্রের কড়া ট্যাকলে হাঁসফাঁস করতে লাগলেন হাসিঠাট্টার বল প্লেয়ার। তার মধ্যেও রসিকতার ড্রিবল করে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। তবে জীবন নামের রেফারিটিও যে বড়ই পক্ষপাতদুষ্ট। পাওনা টাকা মারা যেতে দেখেছেন কতবার! হাত একদম খালি। সম্বল বলতে একটি পাঞ্জাবি। সেটিও ছিঁড়ে গেল একদিন। গেঞ্জি পরে মেসবাড়ির রাজসিংহাসনে বসে রয়েছেন কলকাতার আকাশ-আলো-হাসি ও ফুটপাথের সম্রাট। কেমন আছেন জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিচ্ছেন, ‘ফার্স্ট ক্লাস’। ঠিক যেন মারকুটে ডিফেন্ডারের ট্যাকেলে থেঁতলে যাওয়া শিল্পী ফুটবলার।
১৯৮০ সালের ২৮ আগস্ট। কয়েক দিন একটানা প্রবল জ্বর। দুর্বল শরীরে টলতে টলতে বাথরুমে ঢুকেই সংজ্ঞা হারালেন শিবরাম। সারারাত পড়ে রইলেন সেখানেই। পরদিন বেলায় ভর্তি করা হল হাসপাতালে। ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন লাগছে শরীর? জড়ানো গলায় এল ইনজুরি টাইমের উত্তর, ‘ফার্স্ট ক্লাস’।
শিবরামের মৃত্যুর ঠিক ১২ দিন আগে, ১৯৮০ সালের ১৬ আগস্ট বড় ম্যাচ দেখতে গিয়ে মারা গিয়েছিলেন ১৬ জন। অসুস্থ, মৃত্যুপথযাত্রী শিবরাম কি জানতেন তাঁর যৌবনের ভালবাসার কলকাতা ময়দানের গায়ে লেগে গিয়েছে রক্তের দাগ?