ইতালীয় সাহিত্যিক ইটালো ক্যালভিনো-র জন্মশতবর্ষে কী আর দিতে পারি আমরা তাঁকে? থাকল তাঁরই একটা ছোটগল্প ‘টেরেসা’-র অনুবাদ। এই গল্পটি থেকেই, অনুবাদটি থেকেই তাঁর জগতে প্রবেশ করা যাক। দেখি, কেমন আলো এসে পড়েছিল তাঁর লেখার টেবিলে, তাঁর অন্তরে। যদি সেই আঁচে নিজেকে একটু রাখা যায়। অনুবাদটি করেছেন প্রসিত দাস।
ফুটপাথ থেকে নেমে দাঁড়িয়ে কয়েক পা পিছিয়ে এলাম, চোখ উপরের দিকে। তারপর রাস্তার ঠিক মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে, হাত দুটো মুখের সামনে এনে চোঙার মতো করে নিলাম। আর তারপর ফ্ল্যাটবাড়িটার একেবারের উপরের তলাগুলোকে লক্ষ্য করে চিৎকার করে উঠলাম: ‘টেরেসা!’
আমার ছায়াটা চাঁদ দেখে আচমকা ভয় পেয়ে গিয়ে আমার পায়ের কাছে জড়োসড়ো হয়ে এল।
কে যেন পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। আমি আবার হাঁক পাড়লাম: ‘টেরেসা!’
লোকটা আমার কাছে এসে বলল: ‘‘আরও জোরে না চেঁচালে তো ও তোমার গলা শুনতে পাবে না। চলো, দু’জনে মিলে চেষ্টা করে দেখি। তাহলে, আমি তিন অবধি গুনব, তিন এলেই আমরা দু’জনে একসঙ্গে চেঁচাব।” তারপর লোকটা বলল: ‘এক, দুই, তিন।’ আর আমরা দু’জনে প্রবল চিৎকার ছাড়লাম: ‘টেএ-রেএএএএ-সাআআআ!’
এই সময়ে কয়েকজন বন্ধুবান্ধব এ রাস্তা দিয়েই থিয়েটার কিংবা কাফে থেকে ফিরছিল। তারা আমাদের ডাকাডাকি করতে দেখে বলে উঠল: ‘চলো, আমরাও তোমাদের সঙ্গে একহাত চেঁচাই।’
তারপর ওরা রাস্তার মাঝখানে এসে আমাদের সঙ্গে ভিড়ে গেল। সেই প্রথম লোকটা এক থেকে তিন গুনল। তারপর সব্বাই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, ‘টেএ-রেএএএ-সাআআআ!’
আরও একজন এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিল; মিনিট পনেরো পরে দেখা গেল, রীতিমতো একটা দল খাড়া হয়ে গেছে, সব মিলিয়ে প্রায় জনা কুড়ি লোক। তাছাড়া মাঝেমধ্যেই নতুন কেউ এসে হাজির হচ্ছে।
আমাদের সবাইকে ভালো করে গুছিয়ে নিয়ে সকলে মিলে ঠিক একইসঙ্গে দারুণ একটা চিৎকার দেওয়ার কাজটা অবশ্য খুব একটা সহজ হল না। প্রতিবারই কেউ একটা তিনের আগেই শুরু করে দিচ্ছে, কিংবা বড্ড বেশিক্ষণ ধরে চেঁচিয়ে চলেছে। কিন্তু শেষমেশ দেখা গেল, গোটা জিনিসটাকে আমরা বেশ দক্ষ হাতেই সামাল দিচ্ছি। সবাই মিলে ঠিক করেছি যে, ‘টে’-তে চিৎকারটা হবে খাদের দিকে এবং টানা, ‘রে’ হবে চড়ার দিকে আর টানা, আর ‘সা’ বলতে হবে খাদের দিকে ও চট করে। দিব্যি ভালোই শোনাচ্ছে জিনিসটা। শুধু মাঝে মাঝে কেউ চলে গেলেই সামান্য বখেড়া বেধে যাচ্ছে।
গোটা ব্যাপারটা যখন ঠিকঠাক রপ্ত করে আনা যাচ্ছে, ঠিক সেই সময় একটা লোক, গলা শুনে মনে হয় নির্ঘাত তার মুখভর্তি ছুলির দাগ, জিজ্ঞেস করল: ‘কিন্তু তুমি ঠিক জানো তো যে ও বাড়িতে নেই?’
–না, আমি বললাম।
–তাহলে তো খুব মুশকিল, আরেকজন বলে উঠল। ‘তা চাবি ফেলে এসেছ নাকি?’
–আসলে, আমি বললাম, ‘আমার চাবিটা আমার কাছেই আছে।’
–তাহলে, ওরা জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি সোজা ওপরে উঠে যাচ্ছ না কেন?’
–আমি তো এখানে থাকি না, আমি জবাব দিলাম। ‘আমি থাকি শহরের ওদিকটায়।’
–ও আচ্ছা, তাহলে, যদি কিছু মনে না করো, সেই ছুলিওলা গলার লোকটা জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু এখানে তাহলে থাকেটা কে?’
–সেটা আমি সত্যিই জানি না, আমি বললাম।
একথা শুনে সবাই একটু মুষড়ে পড়ল।
আরেকজন লোক, যার গলা শুনে মনে হয় কথা বললেই দাঁত দেখা যাবে, সে জিজ্ঞেস করল, ‘তাহলে তুমি কি একটু বুঝিয়ে বলবে যে এখানে টেরেসার নাম ধরে ডেকে চলেছ কেন?’
–আমার কথা যদি বলো, আমি বললাম, ‘তাহলে আমরা অন্য কোনও নাম ধরেও ডাকতে পারি, কিংবা ইচ্ছে হলে অন্য কোথাও-ও চেষ্টা করতে পারি।’
এবার বাকিরা সবাই খানিকটা চটে গেল।
‘তুমি আমাদের সঙ্গে কোনও চালাকি করছ না তো?’ ছুলিওলা বেশ সন্দেহের গলায় জিজ্ঞেস করল।
–কী, আমি বেশ তেতো গলায় বললাম, তারপর আমার সততার ব্যাপারটা নিশ্চিত করার জন্য অন্যদের দিকে তাকালাম। কেউ কিচ্ছু বলল না।
মুহূর্তের জন্য একটা অপ্রস্তুত অবস্থা।
–দেখো, কেউ একজন দরাজভাবে বলল, ‘আরও একবার আমরা টেরেসা বলে ডাকি না, তারপর সবাই বাড়ি চলে যাব।’
কাজেই আরও একবার আমরা জিনিসটা করলাম। ‘এক দুই তিন টেরেসা!’ কিন্তু এবার ব্যাপারটা তেমন জমল না। তারপর সবাই যে যার বাড়ির দিকে পা বাড়াল, কিছু লোক একদিকে গেল, আর কিছু লোক গেল অন্যদিকে।
বড় রাস্তার চত্বরটায় যখন ঢুকে পড়েছি, তখন মনে হল যেন একটা গলা শুনতে পেলাম, এখনও চেঁচিয়ে চলেছে: ‘টেএএ-রেএএ-সাআআ!’
নির্ঘাত কেউ একজন চেঁচানোর জন্য থেকে গেছে। নাছোড়বান্দা কেউ একজন।
শিল্পী শান্তনু দে