গীতা আর নীতার তফাত আদর্শচ্যুত মানুষ আর আদর্শে বেঁচে থাকা মানুষের তফাত
Published by: Robbar Digital
Posted on: November 5, 2024 7:23 pm
Updated: November 6, 2024 4:35 pm
এই দুই বোনের মধ্যে কোনও সম্পর্ক আমরা দেখি না, যেমন হয়ে থাকে দুই বোনের মধ্যে– ভালোবাসা, খুনসুটি, আড্ডা, একটু হিংসে আর অনেকটা আগলে রাখা– তেমন কিছুই আমরা দেখি না। তবু সিসটারহুড নিয়ে এই লেখার কারণ চরিত্র দু’টির কারিগর– ঋত্বিক কুমার ঘটক। ‘মেঘে ঢাকা তারা’ একটি বিশেষ আর্থ-সামজিক প্রেক্ষাপটে একটি রিফিউজি পরিবারের মেয়ের মাথা উঁচু করে লড়াইয়ের গল্প, তার মানুষকে ভালোবাসা, জীবনকে ভালোবাসার গল্প, তার বাঁচতে চাওয়ার গল্প আর সেই গল্প ঘিরে যে সিনেমাটি চিত্রপরিচালক বানিয়েছেন, তার মূল ঘটনা, বা সেন্ট্রাল প্লট নীতা-গীতা-সনৎ-এর প্রেম-বিয়ে-সম্পর্ক।
সোহিনী দাশগুপ্ত
২০০৮ সাল। পুনা ফিল্ম ইনস্টিটিউট গিয়েছি ওখানকার জনপ্রিয় ‘ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন’ কোর্সটি করতে। খুব উত্তেজিত, ফুর্তির শেষ নেই, বুকের মধ্যে প্রজাপতির ফড়ফড়ানি! ক্যাম্পাস ঘুরে ঘুরে দেখছি, দেখি বিভিন্ন জায়গায় বোর্ড ঝুলছে– ‘স্মোকিং অ্যান্ড ড্রিংকিং প্রহিবিটেড হিয়ার’। এবং সবক’টি বোর্ডের তলায় বা আশপাশে গ্রাফিত্তি করা– ‘ঋত্বিক ওয়াজ হিয়ার’।
এহেন আশ্চর্য কথোপকথনে কৌতূহলী হয়ে এক রেগুলার ছাত্রকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেসটা কী?’ সে হাসতে হাসতে যা বলল, তা খানিকটা এইরকম– কিছুদিন আগেই জেনারেল বডির মিটিংয়ে ঠিক হয় ক্যাম্পাসের মধ্যে সিগারেট খাওয়া এবং মদ্যপান বন্ধ করার কথা। সেই অনুযায়ী ক্যাম্পাসে বোর্ড ঝোলানো হয়, আধিকারিকের অফিস থেকে আর রাতারাতি সেসব বোর্ডের নিচে ছাত্রদের দুষ্টু প্রত্যুত্তর– ঋত্বিক এখানেই ছিলেন। তিনি মাতাল ছিলেন, সিগারেটখোর ছিলেন, কিন্তু তিনি একজন মাস্টার ফিল্মমেকার ছিলেন, যার এফ.টি.আই.আই-এ পড়ানোর বছরগুলোর কথা এখনও ইতিহাস হয়ে আছে। ঋত্বিক ঘটক একশোয় পা দিলেন ২০২৪-এ, অথচ ঋত্বিক আজও একটি তীব্র, নক্ষত্রসম মিথ– যার মৃত্যু নেই, যার কীর্তিকলাপের গল্পের শেষ নেই, যার সিনেমার ‘পুরনো’ হয়ে যাওয়া নেই।
‘মেঘে ঢাকা তারা’ প্রথম দেখেছি বোধহয় বছর দশেক বয়সে– দূরদর্শনের সাদা-কালো পর্দায়, তারপর কতবার, কত কত পর্দায়। এর মধ্যে জল গড়িয়েছে, বহু পাল্টেছে দেখা, বোঝা, আরও অনেক কিছুই। হালে মেঘে ঢাকা তারা নিয়ে ভাবতে গেলে কখনও-সখনও মনে হয়েছে এই যে নীতা (সুপ্রিয়া দেবী), এই যে সর্বংসহা, বলিদানের প্রতিমূর্তি জগদ্ধাত্রী-দেবী-সমা নারী, যার ভালোত্ব নিজেকে শেষ করে দেওয়াতেই, তেমন মেয়েদেরই তো আদর্শ বানিয়ে রেখেছে সিস্টেম। আর ওই যে সাজুনি, ফ্লার্ট করা বোনটা– গীতা (গীতা ঘটক), যে দিদির প্রেমিককে বিয়ে করে বসল– এমন মেয়ে তো সমাজের দাগিয়ে দেওয়া ‘নারীত্ব’র সংজ্ঞায় অচল। দৃষ্টিকোণ পাল্টালে দেখা যাবে এই দু’টি ‘ছাপ্পা’ই গতানুগতিক পুরুষতন্ত্রের ছাপ্পা– নারীর ভালো থাকা, নারীর কোনও কিছু চাওয়া যেখানে নিম্নমানের। অতএব, নীতা ও গীতা কি নারীবাদের চোখে দু’টি মধ্যযুগীয় স্টিরিওটাইপ, নয়?
কোমর বেঁধে লিখতে বসার আগে মনে হল কিছু জায়গা আরেকবার দেখেনি। ল্যাপটপের পর্দায়, দু’দিন আগে ক্রাইটেরিয়ন কালেকশনের ঝকঝকে এইচ.ডি প্রিন্টে আরও একবার দেখে ফেললাম ঋত্বিক কুমার ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’। ভেবেছিলাম স্কিপ করে করে কিছু বিশেষ অংশ দেখব, তা হল না, ‘মেঘে ঢাকা তারা’ শুরু করলে তা শেষ না করে ওঠা যায় না, ট্রেন বা প্লেন যাই মিস হয়ে যাক না কেন! দেখতে দেখতে বুঝলাম, ভাগ্যিস না-দেখে লিখতে বসিনি। সেটা হলে সে অপরাধের সীমা-পরিসীমা থাকত না। ঋত্বিক আমাকে আরেকবার মাথা নুইয়ে বসিয়ে দিলেন তাঁর পায়ের কাছটিতে, চোখের জলে ভাসিয়ে দিলেন আবার। মনে মনে ঋত্বিক ও নীতার সামনে মাথা ঠুকে ক্ষমা চেয়ে নিলাম আমি– কী করে ভুলে গেলাম যাঁর ছবি নিয়ে কথা বলছি তিনি ঋত্বিক! তিনি ‘স্টিরিওটাইপ’-এর ওপর দিয়ে বুলডোজার চালিয়েছেন তাঁর সবক’টি কাজে। যে হাতে-গোনা কয়েকজন কালজয়ী স্রষ্টা এসেছেন এ জগতে, তাঁরা কোনও তন্ত্র, কোনও বাদ-এর ধার ধারেননি কোনও দিন, তাঁদের দর্শন, তাঁদের বুনন, তাঁদের কাজ তাঁদেরই এবং তা নিখাদ।
নীতা সেই গ্রিক ট্র্যাজেডির এপিক হিরো, সত্যিই সেই সিন্ধবাদ নাবিক যে তার সংসারের যাবতীয় ভার, দায়িত্ব বহন করে চলেছে যুগ যুগ ধরে। কিন্তু সে ‘দেবী’ না, সে দায়িত্ববান, সে সংবেদী, সে ভালোবাসে, পাগলের মতো ভালোবাসে। দেবীর মহত্ব, বৈরাগ্য তার নেই, নীতার আছে তীব্র, পবিত্র প্যাশন, যা শুধুমাত্র এক মানুষীরই থাকা সম্ভব। এই প্যাশন, মাথা উঁচু করে লড়ে যাওয়ার প্যাশন। অসম্ভব চেনা, ভীষণ কাছের, অথচ আশ্চর্য একটি মেয়ে এই নীতা।
এই বয়সে দাঁড়িয়ে নিজের কাছাকাছি বয়সি এই মেয়েটিকে দেখে বুঝতে পারি, সে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বড়দিদি নয় যে সব মেনে নেয়, সব হজম করে মুখটি বুজে কলুর বলদের মতো কলের ঘানি টেনে চলে। যে জন্মেছে ভালো হওয়ার জন্য, ভালো হয়ে নিষ্পেষিত হওয়ার জন্য আর নিষ্পেষিত হয়ে মরে যাওয়ার জন্য। নীতা, যথার্থই ‘হিরো’। এবং তার প্রতিবাদ নিজের আদর্শ, মূল্যবোধ আর বিশ্বাসের মতোই সপাট, সজোর। মায়ের কথায় রাগে-অপমানে গুঁড়িয়ে যাওয়া বড়দাদা শঙ্কর-কে সে অনায়াসে বলে, ‘একদিনের কথায় সারা জীবনটা নষ্ট করবি? বাজে কথায় এত কান দিস কেন?’ বিয়ের কথায় সনৎকে সে পরিষ্কার বলে, ‘অপেক্ষা করতে হবে’। কী নমনীয়তা সেই বলায়, অথচ কী সুঠাম। দাদাকেও বলে, ‘যদি কেউ ভালোবাসে, যদি সত্যিই বাসে তাহলে সে অপেক্ষা করবেই।’ তার দু’টি চলে যাওয়া, নীরবে মাথা উঁচু করে জাস্ট চলে যাওয়ার মতো সোচ্চার প্রতিবাদ সিনেমার বা জীবনের পর্দায় মেলে না বিশেষ– একটি যখন ছোটভাইয়ের অ্যাক্সিডেন্টের পর টাকার জন্য হন্যে হয়ে সে সদ্য বিবাহিতা বোনটির কাছে যায়, যে বোন তারই প্রেমিককে বিয়ে করেছে। বোন অদ্ভুত অবজ্ঞায় এবং ইঙ্গিতময় ভাবে দিদিকে অসম্মান করে।
এই সময়ে, কিছু অমূল্য নীরব মুহূর্ত তৈরি করেন ঋত্বিক এবং তারপর নীতা স্রেফ উঠে বেরিয়ে যায়। তার দ্বিতীয় ‘যা ফোট’ ধরনের চলে যাওয়া, যখন পুরনো প্রেমিক, বিশ্বাসের দহরম-মহরম করা প্রেমিক সনৎ নীতার কাছে, গীতাকে বিয়ের পরে তার কী হাল হয়েছে সেই কাঁদুনি গাইতে বসে। সে বলে আবার সে স্ট্রাগলের জীবনে ফিরে যেতে চায়, রিসার্চ করতে চায়– যেই রিসার্চের স্বপ্ন সে দেখেছিল আর নীতা যে স্বপ্নের কান্ডারি ছিল। এই বিলাসী জীবন, এই সুখী জীবন সে ছেড়ে দেবে… সে ভুল করেছে গীতাকে বিয়ে করে… তা এইসব ভালো ভালো কথা যখন সে বলছে, হয়তো ভাবছে নীতা আবার তাকে আঁকড়ে ধরবে, তাদের প্রেমের মূল্য দেবে। তখন একসময় ফিরে দেখে নীতা কখন উঠে চলে গেছে, সেই আকাশের মতো গাছটার তলা দিয়ে সে চলে যাচ্ছে– একবারও না তাকিয়ে। ‘মেঘে ঢাকা তারা’ নীতার প্রতিবাদের গল্প, তার বলিদানের না। আর নীতার বোন গীতা হল সেই রোজকার দেখা মেয়েটি যে অভাবের সংসারে নিজের নতুন শাড়িটি পেলেই আহ্লাদে আটখানা। যে গাধার খাটনি খাটা দিদি, বাবা, মাকে দেখেও ‘আমি কিন্তু কোনও কাজ করতে পারব না’ বলে পালায়। শঙ্করের ভাষায়, ‘অনেকটা গরু জাতীয়’। নিজের আনন্দ খুঁজে নেওয়ার মধ্যে কোনও নিকৃষ্টতা নেই, নিজের ভালো থাকা, নিজের নিশ্চয়তা বুঝে নেওয়ার জন্য সাহস কিছু কম লাগে না কিন্তু গীতা আর নীতার তফাতটা একটি আদর্শচ্যুত মানুষ আর একটি আদর্শে বেঁচে থাকা মানুষের তফাত– এমন দু’টি মানুষের তফাত যাদের একজন বলে যত কষ্টই হোক, তুমি রিসার্চটা ছেড়ো না। এটা তোমার স্ট্রাগলের সময়, এই সময় আমি তোমার পাশে দাঁড়াব না? আর অন্যজন বলে, বোকামো করবেন না, এবার একটা চাকরি নিন, একটা বাড়ি নিন, ভালো জামাকাপড় পরুন আর একটা বিয়ে করুন।
এই দুই বোনের মধ্যে কোনও সম্পর্ক আমরা দেখি না, যেমন হয়ে থাকে দুই বোনের মধ্যে– ভালোবাসা, খুনসুটি, আড্ডা, একটু হিংসে আর অনেকটা আগলে রাখা– তেমন কিছুই আমরা দেখি না এদের মধ্যে। এদের সমীকরণের ভিতর অবশ্য যার কথা না বললেই না, সে হল এদের দু’জনের মা। ‘মেঘে ঢাকা তারা’র সবচেয়ে কমপ্লেক্স চরিত্র। যে-মা সংসার টানা মেয়ে যদি বিয়ে করে চলে যায় সেই ভয়ে, নীরবে চুলবুলে ছোট মেয়েকে দিয়ে সনৎ-এর কাছে চা পাঠায়। এরা দুই মেরুর দু’টি মানুষ, দু’জনেই চেনা, দু’জনেই ভয়ানক রিয়েল অথচ এদের পারস্পরিক সম্পর্কের কোনও বুনোটই তৈরি করেননি ঋত্বিক! তবু সিসটারহুড নিয়ে এই লেখার কারণ নীতা বা গীতা না, চরিত্র দু’টির কারিগর– ঋত্বিক কুমার ঘটক। ‘মেঘে ঢাকা তারা’ একটি বিশেষ আর্থ-সামজিক প্রেক্ষাপটে একটি রিফিউজি পরিবারের মেয়ের মাথা উঁচু করে লড়াইয়ের গল্প, তার মানুষকে ভালোবাসা, জীবনকে ভালোবাসার গল্প, তার বাঁচতে চাওয়ার গল্প আর সেই গল্প ঘিরে যে সিনেমাটি চিত্রপরিচালক বানিয়েছেন, তার মূল ঘটনা, বা সেন্ট্রাল প্লট নীতা-গীতা-সনৎ-এর প্রেম-বিয়ে-সম্পর্ক। এই সেন্ট্রাল প্লটটির ওপর গড়ে উঠেছে এই সিনেমার স্ট্রাকচার বা পরিকাঠামো। এই ব্যাপারটা একটা মাস্টারস্ট্রোক। নীতা ও গীতা, আর তাদের সাধারণ জীবনটি বিস্ময়কর সৃষ্টি হয়ে থেকে যাবে আরও কত একশো বছর! মানুষের গল্প তো ফুরনোর না।
শেষে একটা কথা না লিখে পারছি না, ‘মেঘে ঢাকা তারা’ যে বছর জাতীয় পুরস্কারের জন্য লড়েছিল, সে বছর জুরিতে ছিলেন কারা? তাদের কি সিনেমার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ ছিল না! সুপ্রিয়া দেবীর জাতীয় পুরস্কার না পাওয়াটা নীতার জীবনের মতোই বিশ্বাসঘাতকতার!
জাল ছবি তৈরির ডেরাগুলো খুঁজতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ের সংবাদমাধ্যম থেকে যা জানা গেল, তাতে ভারতের নকল শিল্পের রাজধানী নাকি কলকাতা এবং পরবর্তীকালে সরে গিয়ে দিল্লি আর মুম্বই!